মল্লিকা রায়
-মরে গেলাম গো আমার ছ্যলটারে উঠায়ে নিল ডায়েন গো এট্টু জল নিতে গেছিলাম কলে ফিরে দেখলাম ও নেই। বাবাগো মাগো আমার ছ্যলটারে বাঁচাও—-‘
ময়নার বৌয়ের বুক ফাটা আর্তনাদে একদল গ্রামবাসী ছুটে এল ডান হাতে টাঙ্গি,বল্লম,বর্শা,লাঠি বাম হাতে হ্যারিকেন নিয়ে।
-কি হয়েচে ও ময়নার বৌ চিল্লাও কেনে ডাকাত পরেচে না কি গো —‘ দলব্দ্ধ জিজ্ঞেসা। কেঁদেই চলে ময়নার বৌ
দু’চারজন ঘরে ঢুকে খোঁজার চেষ্টা করে বাচ্চাটির
-আশ পাশে কেউ নে যায় নি তো ?
-না না হরেন কাকা আমারে না বলি কেডা নেবে–‘
বল্লম শড়কির খোঁচা মেরে টর্চ হ্যারিকেন আলোতে ঘাসে জঙ্গলের আশ পাশে চলতে থাকে খোঁজ ও জিজ্ঞেসাবাদ।
নাহ্ কোনও ভাবেই উদ্ধার করা যায় না শিশুটিকে সেই রাতেই দল বেঁধে লোকাল থানায় জানানো হলে ঘুমে ঢুলে পরা দারোগা আশ্বাস দেন ভোর হলে তদন্তে যাবেন এখন রাতের বেলা কিছু করা সম্ভব নয় সেপাই নেই।
পরের দিন বেলা দশটায় এলেন তদন্ত করতে সঙ্গে হাফপ্যান্ট পরা সেপাই।
-রাত ঠিক কটা নাগাদ
-দশটা দারোগা বাবু
-কোন শেয়াল টেয়াল নিয়ে যায় নিয়ে যায় নি তো
চুপ করে থাকে সকলে। অদূরেই বাঁশঝাড় ঘন অন্ধকারে শেয়ালের ডাক শোনা যায় প্রায়ই। খাবার না পেয়ে গৃহস্থের বাড়ি ঢুকে পরে মাঝে মধ্যেই—- তেমন কিছু নয়তো
আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুকের ভেতর চিৎকার করে ওঠে কি মরতি যে জল আনতি গেলাম বাছারে আমার——‘
-যত্ত সব, নজর রাকতে পার না বাচ্চার জন্ম দেও কেন খেঁচিয়ে ওঠে দারোগা।
পরের দিন বৃন্দাবনদের হাঁস,মুরগী,ছাগল সব উধাও, পরে আছে হাড়গোড় রক্ত ছাল কিছুটা দূরে জঙ্গলের কাছে প্রায়।
পাগলের মত অবস্থা বৃন্দাবনের এই হাঁস,মুর্গির ডিম,মাংস বেঁচে সংসার চলে ওর। বাচ্চা দিলে তিনচার মাস বয়স হলে বিক্রি করে ঘরের চালটা, মেঝেটা পাঁকা করে নেয়। এভাবে সর্বস্বান্ত করে তাকে ভাতে মেরে গেল কে ! আবার রিপোর্ট থানায় জানানো হল নির্ঘাত শেয়ালের উৎপাত পাহাড়া দেও তোমরা।
এভাবে রাতের অন্ধকারে উধাও হয়ে চলেছে গৃহস্থের হাঁস মুরগী,ছাগলছানা,বাছুর পাহাড়া দিয়েও ধরা যাচ্ছে না কিছুই। প্রতি রাতে একেক দল করে পাহাড়া দেবার ব্যবস্থা হল কিন্তু রহস্যের কোনও উদ্ঘাটন করতে পারে না কেউ।
বসানো হল পঞ্চায়েত লাঠি ঠুকে বিধান দিলেন ‘তোমাদেরই দোষ ঘুমোয়ে কি আর পাহাড়া দেওয়া যায়,এসব শেয়ালেরই কারবার অন্য কারুর নয়’।
-কিন্তু কাকা অতবড় মোষটারে চিঁবয়ে খেল কি করে ?
-মোষ ?
-হ’ কাকা ওই জঙ্গলের কাচে হাড়গোড়,ছাল,চামড়া সব ছড়ানো ছেটানো পরি আচে দেখবে চল
-চল, ঝুঁকে পরে শিঙ দুখানা দেখেই চমকে ওঠেন প্রধান এদিক ওদিক ছড়ানো হাড় বাকল সব শুকনো রক্তে মাখামাখি চিবোয়ে খেয়েচে মাতাটাও। কপালে মুখে ভাঁজ ফুটে ওঠে চিন্তায়। তাহলে কি হতে পারে ,দেকতি হবে তো দিনের আলোতে এসব হচ্চে টা কি ——-‘
সেই থেকে পাথর হয়ে আছে ময়নার বৌ মধ্যিখানের কাপড় বেলাউজ ভেসে গড়িয়ে যাচ্ছে খাদ্যভান্ডার বাধ মানছে না কিছুতেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে পিড়ের উপর কোন সকালে সেই যে বসেছে মধ্যি পাতা জ্বেলে চাড্ডি ভাত ফুটয়ে ময়নার পাত সাজায়ে রাখিচে। কখন খেয়ে বেড়োয়েচে ময়না, গেরামে পুলিশ এয়েচে কিচু একটা বিহিত হবেই কৌতূহল গ্রামশুদ্ধ লোকের, ও আছে সঙ্গে।
দেখে শুনে অফিসার জানান দেন ‘ওই শেয়ালের কাজই হবেক বুঝলেন প্রধান বাবু এছাড়া কোনও বড় জন্তু এখানে থাকতে পারবে না থাকলে ঠিক ধরা পরত’
-ধুর ছাতা ক্ষেপে ওঠে ময়না , সার আপনি বোঝতেছেন না বড় কোন জানোয়ার আচে অতবড় মোষটারে হজম করি ফেলার মত ক্ষ্যামতা শেয়ালের হতি পারে , আপনে বলেন শহর থেকে অন্য পুলিশের ব্যবস্তা করতে সার আমার বৌটা কাইন্দে মরতিছে।
মাথা খাটাতে থাকেন পঞ্চায়েত প্রধান–তাইতো ? পরক্ষনেই ওনার টেলিফোন থেকে শহরের অফিসে আর্জেন্ট ফোন করা হয়। পরের দিন সকাল দশটায় দুটি বড় কালো পুলিশ বোঝাই ভ্যান এসে দাঁড়ায় গ্রামের পুলিশ ফারির কাছে, দু’জন দুঁদে সি আই ডি গোয়েন্দা পুলিশ আছেন।
গ্রামের শেষে একটি আধভাঙা কুড়ে ভাঙা চাল বেড়া নেই একটা ভাঙা চৌকির পাশে একটা কুঁজো, পাশে ওল্টানো একটি এলুমিনিয়ামের তোবড়ানো পুরোনো গ্লাস –‘
যেখানে কারুর নজর পরে না সেখানে গোয়েন্দার তীক্ষ্ণ নজর—
-চল ওই খানেই দেখে আসি
একটা পুরোনো ময়লা ছেড়া কাপড় পাতা রয়েছে চৌকির ওপর এলোমেলো করা কাপড়টি
-হুম এখানে কেউ থাকে বুঝলে সায়ন্ত
বা হাত দিয়ে গ্লাসটা তুলে কিছুটা জলের সন্ধাণ পায় কাকাবাবু অর্থাত সায়ন্তের কাকাবাবু প্রাইভেট গোয়েন্দা দশজনের গ্রুপের দু’জন।
-ঠিক ধরেছি, জল এল কোথা থেকে
এই ফাঁকা ধূ ধূ নির্জন মাঠে পাশে একটা পাঁকুর গাছ জনশূণ্য এখানে কে হতে পারে —–‘
-কোনও ভিখিরি হবে আর কে সায়ন্তর উত্তর
-দেখা যাক্
হঠাৎই একটা তির ছোঁ মেরে চলে গেল সায়ন্তের ডান পাশটা দিয়ে
-কেউ ওয়াচ করছে আমাদের বি কেয়ারফুল
লোহার জ্যাকেটটা পরে নাও মাথায় হার্ড কভার হারি আপ।
এলোপাতারি আরও চার পাঁচটা তীর ছুটে এল ওদের আশে পাশে, বহুদূরের ঝোঁপ ঝাড় থেকে। ক্ষতি হয় নি ওদের মুহূর্তেই পজেশন বর্ম পরে তৈরি হয়েই ছিল ওরা।
-কিছুক্ষণ গাঁ ঢাকা দিতে হবে বুঝলি ?
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই নিভে এল জাগতিক আলো হু হু অন্ধকারে দেখার উপায় নেই কারুকেই। পাতা নড়েনা নি:শব্দ চতুর্দিক অপেক্ষা আর অপেক্ষা ঘন্টা চারেক পর তিনজন প্রবেশ করে ঘরটাতে দু’জন পুরুষ একজন নারী অর্ধ উলঙ্গ পাতার আচ্ছাদন পিঠে তীর হাতে ধনুক উগ্র মূর্তি। মহিলাটি শীর্ণ, জটা ধরা চুল সরু হাত পা অন্ধকারে আর কিছু বোঝার উপায় নেই,লোক দুটোর কাঁধে মরা ছাল ছাড়ানো বাছুর, ছাগল। বাইরে মাটিতে গর্ত করে আগুণ জ্বেলে বাঁশের ওপর ঝুলিয়ে ঝলসানো হল প্রাণী দুটিকে তারপর ভক্ষণ। ধূলো চাপা দিয়ে আবার বেড়িয়ে পরে ওরা। পুরুষ দুজনের পিঠে পশুর চামড়ার থলি। কি আছে থলিতে ?
আজ টার্গেট মানুষের বাচ্চা। দগ্ধ গরমে পাখার হাওয়া দিতে দিতে কখন ঘুমিয়ে পরেছিল মালিনী বারান্দায় দুধ টানছিল চার মাসের শিশুটি। ভোরবেলা উঠে দেখে উধাও। ক্লান্ত পরেশও থম মেরে আছে ভয়ে,আছাড় পাছাড় খেয়ে কাঁদছে শুধু, ওর বৌ শোকে নিথর পরেশ বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে।
দিনের আলো ফুটতেই থানার কাছে হন্যে দিয়ে পরে আছে স্বামী স্ত্রী সহ কয়েকজন গ্রামবাসী।
-হ্যাঁলো কিষানগঞ্জ থানা ?
-হ্যাঁ বলুন
-আমি সি আই ডি কাকাবাবু টিম থেকে বলছি
বড় বাবুকে জানানো হয়েছে উনি এখনই এসে পরবেন থানায় আমি যাস্ট এক ঘন্টার মধ্যে আসছি ফোর্স রেডি রাখবেন।
ডাইনি ডাইনি এতকাল পরে ধরা পরেছে গ্রামের ডাইনি রাতের অন্ধকারে গৃহস্থের হাঁস,মুরগি,ছাগল,বাছুর এমন কি গরুগুলোকে রক্ত চুষে মেরে ফেলে রাখছে,সেদিন হঠাৎই উধাও কর্মকারদের দু’মাসের শিশুটি—,তোলপাড় গ্রামকে গ্রাম ছড়িয়ে পরছে আতঙ্ক সন্ধ্যে হলেই শুনশান ফাঁকা হয়ে পরছে গ্রামটি সকলে দরজা জানালা বন্ধ করে এ ওকে ছুঁয়ে জড়াজড়ি করে বসে থাকে ভয়ে। কখন কার সর্বনাশ হয় আতঙ্কিত সকলে।
শতচ্ছিন্ন নোংরা শাড়ি পড়া মহিলাটি গুঁটিশুঁটি মেরে বসে আছে গোডাউনের এক কোনে, হাত পায়ের নখ বেড়ে উঠে বেঁকে গেছে,কালো শীর্ণ মুখের গহ্বরে আগুণ দুটি চোখ,নোংরা জটপরা এলোমেলো চুলে ঢাকা মুখের এক তৃতীয়াংশ, নারী কি পুরুষ বোঝার উপায় নেই শুকনো কালো শরীরে শীর্ণ দুটি হাত আর পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে কোনওমতে। উত্তর দিচ্ছে না কোন কথার মাথা চুলকে উকুন এনে বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে টিপে মারছে মেঝেতে পরক্ষণেই চিৎকার করে লাফিয়ে উঠছে । পাশেই দু’জন পালোয়ান সেপাই চেন দিয়ে বেঁধে রেখেছে ওকে তিন নম্বর জেলের গেটটার কাছে, ওদের ঘিরে গোয়েন্দা দলের সকল পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা, গ্রামশুদ্ধ মানুষ ছুটছে থানার দিকে ওকে একঝলক দেখবার জন্য।
-তোর নাম কি ?
নিরুত্তর
-সপাট করে লাঠির আঘাত পিঠের উপর
-বিরজু বালা দাসী
-বাড়ি কোথায় ছিল এখানে এলি কি করে
বাড়ি এখান থেকে তিনটে গ্রামের পর গোরক্ষপুরে বরেন বারুজ্জের ছেলে সমীর বারুজ্জের বৌ
-সে তো জমিদার —!
-ছেলেপুলে হল না বলে বিয়ের আট বচ্ছর পরে কেরোসিন দে জ্বালায়ে আধমরা পুঁতে দিল ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে মাটির নিচে। দু’জন শিকারী আমার চিৎকার শুনে মাটি খুড়ে উদ্ধার করে আমাকে। পরে জানতে পারি ওই দুইজন শিকারী দেশে বিদেশে পশুদের,মানুষের কিডনী,চোখ,রক্ত পাচার করে।
-আর তুই কি করতিস
-ভয় দেখাতাম, শিশুদের বিক্রি করে প্রচুর টাকা পেত ওরা আমাকে ভাগ দিত না,তাই ওদের সাথে মারামারি করে কেড়ে নিতে হত হকের টাকা।
-কিভাবে পাচার হত শিশুরা ?
-জঙ্গল ছাড়িয়ে কিছুটা দুরে হেলিকপ্টারে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা ছিল। পেটে খিদের জ্বালায় আমাকে রাতের অন্ধকারে গৃহস্থের খাবার চুরি করবার জন্য বেড়োতে হত। দেখে ফেলেছিল দু’একজন গ্রামের মানুষ। ওরাই আতঙ্ক ছড়িয়েছিল আমি হয়ে গেলাম ডাইনি, বাবু।
ছবি তুলতে এগিয়ে এসে বিস্ময়ে হতবাক হন প্রিন্স হাবার্ট অনাহার অর্ধাহারে রুগ্ন,শুষ্ক আধমরা বৃদ্ধার পা ধরে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পরেন ভদ্রলোক ,পরে জানা যায় উনিই বৃদ্ধার স্বামী যিনি এই কাহিনীর প্রধান চরিত্র।