দীপান্বিতা
ওলে সোয়িঙ্কা
আফ্রিকা মহাদেশের কোন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ওলে সোয়িঙ্কা। সালটা ছিল ১৯৮৬। নাইজেরিয়ার অধিবাসী সোয়িঙ্কার জন্ম হয়েছিল ১৯৩৪ সালে। বাবা ছিলেন শিক্ষক, নাম স্যামুয়েল আয়োডেন। মা গ্রেস ইনিওলা সোয়িঙ্কা ছিলেন এক দোকানদার। নাইজেরিয়ার পশ্চিম অঞ্চলে ছিল তাঁদের ঘর। এমনিতে আফ্রিকার মানচিত্রে নাইজেরিয়া দেশটিরও অবস্থান পশ্চিম প্রান্তে। নাইজেরিয়ার একটি প্রধান উপজাতির নাম ইয়োরুবা। সোয়িংকার বাবা-মা দু’জনেই সেই উপজাতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত।
ওলে সোয়িঙ্কার মূল নাম আকিনওয়ান্দে ওলুওলে সোয়িঙ্কা। সারা বিশ্বে যুগে যুগে বুদ্ধিজীবী লেখক-সাহিত্যিকরা স্বৈরাচারী শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরে তাদের অপ্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও পাশবিক রাষ্ট্রীয় শক্তির রোষানলে পড়ে জীবনভর দুর্দশা ভোগ করতে হলেও তাঁরা নিজেদের মাথা কখনোই অন্যায়ের কাছে নত করেননি। ওলে সোয়িঙ্কা এই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। তাঁর রাজনৈতিক রচনাগুলি নাইজেরিয়া সরকারের কেবলই অশান্তির কারণ হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধাবলীর সংকলন দ্য ওপেন সোর অফ আ কন্টিনেন্ট । নব্বইয়ের দশকে নাইজেরিয়ার ভয়াবহ অশান্ত পরিবেশের কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা রয়েছে এসব প্রবন্ধে। সোয়িঙ্কার চাচাছোলা সমালোচনা সরকারকে একেবারেই সন্তুষ্ট করেনি। তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতিকে অগ্রাহ্য করে নাইজেরিয়া সরকার সোয়িঙ্কাকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে অবশ্য মৃত্যুদণ্ড মুকুব করে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
সোয়িঙ্কা কোনদিনই তাঁর দেশের সরকারের প্রিয়পাত্র হতে পারেননি। ১৯৬৭ সালে তাঁকে আরও একবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজনের স্বাধীনতার জন্য লেখালেখি ও কাজকর্ম করার কারণে তাঁর ওই সময় দু’ বছরের কারাবাস জুটেছিল। ১৯৭২ সালে লেখা দ্য ম্যান ডায়েড: দ্য প্রিজন নোটস্ অফ ওলে সোয়িঙ্কা রচনায় তাঁর এসব অভিজ্ঞতা তিনি বলিষ্ঠ ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এই গ্রন্থের মুখবন্ধে সোয়িঙ্কা লিখেছিলেন, ‘বই ও লেখালেখির সমস্ত বিষয় যারা সত্যের কণ্ঠরোধ করতে চায় চিরকাল তাদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে এসেছে’। বন্দীদশায় থাকার সময় গোপনে তাঁর কাছে বইপত্রের যোগান দেওয়া হতো। সোয়িঙ্কা সেসব আদ্যোপান্ত পড়ে ওইসব বইপত্রের সাদা অংশে তাঁর লেখা লিখতেন। ওইসব বই আবার গোপনে জেল থেকে পাচার করে এনে তাঁর রচনা ছাপা হত। এভাবে তিনি তাঁর অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছেন। শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশে থেকে যেকোন বস্তুর ওপর সাহিত্য রচনা করার যে কাজ সোয়িঙ্কা দিনের পর দিন করে এসেছেন তা রীতিমতো দৃষ্টান্তমূলক।
ওলে সোয়িঙ্কা একাধারে নাট্যকার, কবি, সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার। তাঁর দেশবাসী অন্য এক বিখ্যাত লেখক চিনুয়া আচিবে-র সঙ্গে তাঁর অনেক বিষয়ে মিল পাওয়া যায়। ছোটবেলা থেকেই নানা বিষয়ে তিনি তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। বড় হয়ে তিনি ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পান ও সেখানে লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর সোয়িঙ্কা স্বদেশে ফিরে এসে নিজস্ব উপজাতি ইয়োরুবা ভিত্তিক থিয়েটার গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত নাট্য বিভাগের প্রধান ছিলেন তিনি এবং বহু তরুণকে নাট্যশিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৬৭ সালে বন্দীদশা প্রাপ্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই কাজ সাফল্যের সঙ্গে করে এসেছেন।
তিনি কিছু আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও রচনা করেছেন যেগুলি ১৯৪০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত নাইজেরিয়ার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছে। সোয়িঙ্কার কবিতাগুলি বেশির ভাগই রাজনীতিকে বিষয়বস্তু করে রচিত হলেও নাইজেরিয়ার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রারও পরিচয় দেয়। নাট্যকার হিসেবেই ওলে সোয়িঙ্কার বেশি নাম। উল্লেখ করা যায় ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত নাটক ডেথ অ্যান্ড দ্য কিংস্ হর্সম্যান-এর কথা। এখানে সোয়িঙ্কা ইয়োরুবা উপজাতীয় এক নেতার অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনিয়েছেন ।