অমিত ত্রিবেদী
লেখক পরিচিতি
(পর্যটনমূলক ধারাবাহিকটির লেখক পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সভাতে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিতে। তারই পটভূমিকায় লেখা এই ভ্রমণ বৃত্যান্ত।)
দ্বিতীয় পর্ব
উপ্পসালা সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে আধ ঘন্টার ট্রেনে পৌঁছে গেলাম স্টকহোম সেনট্রাল স্টেশন। রাস্তায় পড়েছিল স্টকহোমের আরলান্ডা বিমানবন্দর, সোলনা। স্টকহোম সেনট্রাল স্টেশন থেকে শহর ঘোরানোর কয়েকটা আলাদা ভ্রমণ সংস্থার বাস ছাড়ে। সারাদিনের জন্য বাস ও ফেরির ‘যুগ্ম’ টিকিট কেটে নিয়ে তারই একটায় সওয়ার হওয়া গেলো। চমত্কার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। বাসের মধ্যেই রয়েছে শহর ও সংক্ষেপে দেশটাকে চেনানোর জন্য বিশেষ অডিও ভ্রমণসঙ্গী। স্টকহোম শহর সুইডেনের দক্ষিণপূর্বপ্রান্তের উপকূলে ১৪টা দ্বীপের মিলিত দ্বীপপুঞ্জের উপর গড়ে উঠেছে, যেখানে ম্যালারেন হ্রদ বাল্টিকসাগরে এসে পড়েছে। এই ভৌগোলিক বিস্তার সেই প্রস্তরযুগ থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে। নিয়মিত পরিশোধনের পর সুপেয় অমলিন জল শহরের মধ্যের হ্রদে প্রবাহিত করা হয়েছে। ভ্রমণপুস্তকের তালিকার প্রথম দুটি দর্শনীয় স্থান গ্যালেরিয়া আর ‘রয়্যাল অপেরা হাউস’ বাস থেকেই দেখে নিলাম। প্রথমে নামলাম ‘গামলা স্ট্যান’ অর্থাত্ ‘পুরনো শহরে’। ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক অতি-প্রাচীন শহর-এলাকা, মধ্যযুগীয় সরু সরু গলি-পথ, যার দু পাশে গগনচুম্বী প্রাচীরের জনপদ, মূলত সু -প্রাচীন উত্তর জার্মান স্থাপত্য-শৈলীতে বানানো অট্টালিকা, ‘কবলস্টোনের’ বানানো রাস্তাঘাট, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি। এখান থেকেই বিখ্যাত সুইডিশ রাজপ্রাসাদের একটা অংশ দেখা যাচ্ছিলো।
পুরনো শহর থেকে আবার বাস ধরে নিয়ে Fjäll-gatan (পাহাড় সরণী?)। এখান থেকে স্টকহোম শহরের মোহন স্কাই লাইন আর প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা যায়।
Fjäll-gatan থেকে বাস ধরতে গিয়ে কেমন সব গুলিয়ে গেলো। গোটাদুই বাস মিস করার পর অগত্যা ‘চরণবাবুর এক্কায়’ বাল্টিক সাগরবেলার ধার ধরে টুকটুক করে চলে এলাম ‘ভাইকিং লাইন এন্ড ক্রুজ বার্থ’। ফিনিশ জাহাজ কোম্পানীর জলযান এখান থেকে হেলসিঙ্কি-সহ বেশ কিছু জায়গায় নিয়ে যায়। ওখান থেকে আবার বাস চেপে নামলাম ‘রয়্যাল প্যালেস’। খাতায়কলমে যা কিনা সুইডিশ রাজপরিবারের বাসস্থান! জানা গেল যদিও বর্তমান রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাভ ও রানী সিলভিয়া তাঁদের সন্তান যুবরানী রাজকুমারী ভিক্টোরিয়ার সাথে ড্রটিংহোম প্রাসাদেই থাকতে পছন্দ করেন, কিন্তু রাজকার্যের খাতিরে এখানে নিয়মিত পদধূলি দিতেই হয়। রাজসমারোহে একদল বাদক চমত্কার বাজনা বাজিয়ে প্রাসাদের ভিতরে ঢুকছিল, তাদের অনুসরণ করে প্রাসাদের মধ্যে ঢুকলাম।
একটি মধ্যযুগীয় দুর্গের ধ্বংসাবশেষের উপর অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম বছরে যে প্রাসাদের নির্মানকাজ শুরু হয়, উত্তরের মহাযুদ্ধ পার করে সেই নির্মান শেষ হয় ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে। প্রাসাদে রয়েছে সাকুল্যে ১৪৩০ খানা ঘর, যার মধ্যে ৭৭০টায় কোনও জানালা নেই। রাজপরিবারের থাকার ঘরগুলোর সাথে রয়েছে সুসজ্জিত অতিথিসদন, উত্সবানুষ্ঠানের জন্য হল, রাজ্যাভিষেকের ঘর ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্যগুলি হলো, রানী ক্রিস্টিনার অভিষেকের রৌপ্যসিংহাসন-ধন্য হল অব স্টেট, সুইডেনের মহার্ঘ রাজপোষাকের সাথে ধনসম্পদের কক্ষ, রয়্যাল চ্যাপেল। কিছু চোখধাঁধানো মর্মরভাস্কর্য দেখে মন ভালো হয়ে গেলো।
রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়েই ফেরীতে উঠতে হলো, কারণ পরের গন্তব্য ভাসা মিউজিয়াম। ভাসা একটি ঐতিহাসিক সুইডিশ যুদ্ধজাহাজ, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটা সাংঘাতিকরকমের সমৃদ্ধ আর রোমাঞ্চকর সংগ্রহশালা। পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়ার যুদ্ধে নৌবহরের বলবৃদ্ধির জন্য রাজা গুস্তাভিয়াস অ্যাডলফাস তৈরী করিয়েছিলেন অস্ত্রসুসজ্জিত এই জাহাজ। কিন্তু ১৬২৮সালের ১০ই অগস্ট প্রথম জলে নামতেই এই জাহাজ ডুবে যায়। লিপিবদ্ধ ইতিহাস বলছে, যুযুধান রাজার তাড়ায় সম্পূর্ণ নির্মানোত্তর বিশ্লেষণ ছাড়াই ‘রাজনৈতিকভাবে ভীরু’ অথচ রাজার ‘আস্থাভাজন’ বিশেষজ্ঞের দল অসমাপ্ত ভাসাকে জলে নামান বলে অসহায় ভাসা কোনওরকম সাড়া না দিয়ে প্রাণহীন নিশ্চলভাবে ডুবে গিয়েছিল। সেটিকে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় রেখে দেওয়া আছে। রয়েছে তথ্যসমৃদ্ধ প্রদর্শনীও। নাবিকদের সাজসরঞ্জামও প্রদর্শনীতে রয়েছে। রয়েছে নাবিকদের আমোদপ্রমোদের জন্য আনানো অনেক জিনিসপত্রের মধ্যে সুদূর চীনদেশের তাসের গুচ্ছও।
ভাসার কাছের ফেরীঘাট থেকে আবার ফেরিতে চেপে পৌঁছানো গেলো আব্বাঃ দ্য মিউজিয়াম। লিভারপুলের Beatles Museum এর অনুপ্রেরণায় সুইডিশ পপগায়কের দল ‘Abba’ সুইডিশ মিউজিক হল অফ ফেমের জন্য বানিয়ে তুলেছে তাদের সৃষ্টির অদ্ভুত এক প্রদর্শনী। সেটার পাশ দিয়ে হেঁটে নর্ডিস্কা মিউজিয়াম পার করে একটা বাসস্টপ থেকে আবার বাসে উঠে পড়লাম। শেষ গন্তব্য স্টকহোম সিটি হল, সুইডিশ স্থাপত্যের জাতীয় রোম্যান্টিকতার অন্যতম স্তম্ভ। এরই ব্লু হলে নোবেলপুরস্কার-প্রদান-অনুষ্ঠানের পরের ব্যাঙ্কোয়েট অনুষ্ঠিত হয় আর ব্লুহলের উপরের গোল্ডেন হলে হয় ভোজনোত্তর বলনৃত্য। সিটিহলের দক্ষিণপূর্ব কোণে রয়েছে ১০৬ মিটারের গগনচুম্বী মিনার, যার শীর্ষে শোভা পাচ্ছে সুইডেনের পুরনো জাতীয় প্রতীক, তিনটি রাজমুকুট। ৩৬৫টা ধাপের সিঁড়ি ভেঙে ওই মিনারের মাথায় উঠে পড়ে যা দেখতে পেলাম, এককথায় চোখ জুড়িয়ে গেলো। জলের মধ্যে জেগে থাকা ত্রয়োদশশতাব্দীর পুরনো শহর-সহ ৩৬০ ডিগ্রিতে গোটা স্টকহোমের মনোমুগ্ধকর প্যানোরামা।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)