অমিত ত্রিবেদী
লেখক পরিচিতি
(সেপ্টেম্বর সংখ্যা থেকে শুরু হচ্ছে নতুন পর্যটনমূলক একটি ধারাবাহিক। লেখক পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সভাতে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলিতে। তারই পটভূমিকায় লেখা এই ভ্রমণ বৃত্যান্ত।)
প্রথম পর্ব
সেলসিয়াসের দেশে
উপ্পসালায় পৌঁছে প্রথমেই যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা সংগ্রহ করলাম, সেটা হলো মধ্য নিশীথের সূর্য না হোক, রাত এগারোটার গোধূলি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এই দক্ষিণ অংশ থেকে অবশ্যই দেখা যাবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে কিঞ্চিত ঘন-ঘটার উল্লেখ ছিল বটে, দেখলাম খোদার খোদকারির নিখুঁত পূর্বাভাস কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব নয়। বেশ রৌদ্রকরোজ্জ্বল উষ্ণ অভ্যর্থনাই এগিয়ে রেখেছে সেলসিয়াস আর লিনিয়াসের স্মৃতি-বিজড়িত এই প্রাচীন শহরটি। উপ্পসালা সেন্ট্রাল স্টেশনের বাইরে পাশাপাশি কিছু শতাব্দী-প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দন সহাবস্থান দেখে মন ভরে গেল।
হোটেল স্ক্যান্ডিক আপল্যান্ডিয়া । সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ঠিক পাঁচমিনিটের হাঁটাপথ। এখানে সব রাস্তার নামের শেষে ‘gatan’ (গাতান, এদের শব্দকোষে কড়া ট টা নেই) দেখে অনুমান করেছিলাম সেটার মানে রাস্তা, পরে গুগল দেখে নিশ্চিত হওয়া গেলো। রাস্তায় বেশ কিছু পাব, লাইব্রেরী আর গ্রন্থবিপণী চোখে পড়লো। উপ্পসালার পাবের খাবারের গল্প ও খ্যাতি সর্বজনবিদিত। পথনির্দেশের সংক্ষিপ্ত জিজ্ঞাসাবাদের সূত্রে বোঝা গেল এখানের মানুষ স্থানীয় ভাষার সাথে ইংরাজীটাও অনেকটাই ভালো বোঝে (সুইজারল্যন্ডের লুগানো শহরে এই নিয়ে গভীর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সে গল্প অন্য আর একদিন) আর বেশ সহৃদয়। হোটেলে ঢোকার মুখের রাস্তার উল্টোদিকে কিছুটা দূরত্বে চোখে পড়ে গেল বিখ্যাত উপ্পসালা গির্জার মনোরম চৈতন্যটি, শেষ-জুনের নর্ডিক সূর্যের ওম্ মেখে শুধু দাঁড়িয়েই নেই, কাছেও ডাকছে।
আণবিক কোয়ান্টাম মেকানিক্স শীর্ষক একটা গবেষক-সম্মেলনে যোগ দিতে এখানে আসা। উপ্পসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেকগুলো ক্যাম্পাসের একটায় এটা হচ্ছে, যার নাম সুইডিশ ইয়ুনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্স, (স্থানীয় ভাষায় নামের সংক্ষেপ এস-এল-ইয়ু)। ক্যাম্পাসটা মূল শহরের বাইরে, উল্টুনা বলে একটা জায়গায়। স্টেশন থেকে কয়েকটা বাস যায় ওদিকটায়, আর সময়মতো বেরতে পারলে আয়োজকদের গাড়িতে করে যাওয়া যাবে। আয়োজকদের দাক্ষিণ্যে কিছুটা সস্তায় এখানে ভালো হোটেলে থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে, নাহলে এখানের যাবতীয় ব্যবস্থাপত্র নাকি অগ্নিমূল্য! ইয়োরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় আর কি! যাই হোক। চমত্কার স্নানঘরে স্নানটান সেরে টেরি বাগিয়ে নীচে নামলাম সময়েই। ভারি প্রাতরাশ করে নিলাম। এখানের খাবারের মধ্যে স্বীয় মহিমায় বিশেষ খ্যাতিমান হলো মীটবল। মীটবল চিবোতে চিবতে বাসে গিয়ে উঠলাম। বাস ছাড়লো কাঁটায় কাঁটায় নির্ধারিত সময়ে।
উল্টুনার দিকটা সবুজে সবুজ। সাইকেলের জন্য রাস্তার একটা অংশ আলাদা করে রাখা। আর সাইকেলের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। এই দেশের জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২১জন। আর এত রঙিন আর সমৃদ্ধ ইতিহাস আর কোনও দেশের আছে কিনা সন্দেহ। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে একদম আধুনিক সময় অবধি এতরকমের সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে এই ছোট্ট দেশটা! উল্টুনা যাওয়ার রাস্তায় উপ্পসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো ক্যাম্পাস চোখে পড়লো। মাথার মধ্যে পরিকল্পনার নীলনক্সা অনবরত পালটে পালটে যাচ্ছে কিভাবে এইটুকু সময়ে নর্ডিক দেশগুলোর অন্তত খানিকটা দেখে নেওয়া যায়, মর্মস্থ করে নেওয়া যায়। উল্টুনা ক্যাম্পাসের দুর্দান্ত অডিটরিয়ামে (স্থানীয় ভাষায় Aula) আণবিক কোয়ান্টামতত্বের মনোগ্রাহী আলোচনায় আর বাদানুবাদে দিনটা কেটে গেলো। রাত নটার পর ফেরার সময় চারিদিকে দিব্য মুচমুচে রোদ। ভাবলাম এবারের সফর বৃথা যাবেনা।
পরের দিন সেমিনারের মধ্যাহ্নবিরতিতে হোটেলে ফিরে যাওয়া হলো কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে। কয়েক পা হেঁটেই ফাইরিস নদী, কোলকাতার কেষ্টপুরের খাল বা আদিগঙ্গার মতো হ্রস্ব-প্রস্থ মৃত-স্রোতা, তাও কতো স্বচ্ছতোয়া। উপ্পসালা গির্জার গম্ভীর গথিক ছায়া পড়েছে নদীতে ভাসমান শালুকশাপলার মধ্যে। ধীরগতি বোট চলেছে মোহানায় ম্যালারেন হ্রদের দিকে। নদী পেরিয়ে ওপারে গেলেই নর্ডিকদেশগুলির উচ্চতম উপ্পসালা গির্জা। তার একদম কাছাকাছি রয়েছে মিউজিয়াম গুস্তাভিনিয়াম। সেখান থেকে একটু উপরে উঠে গেলে উপ্পসালা দুর্গ, রেনেসাঁ আমলের, গমগমে, সুবৃহত্! মিউজিয়ামের মধ্যে অজস্র গাত্রকন্টকিত করার মতো সংগ্রহ। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে শুরু করে ব্রোঞ্জযুগ, ভাইকিং যুগ, ত্রিশবছরের যুদ্ধ, সেলসিয়াস-লিনিয়াস-সহ অনেক প্রতিভাধর পথিকৃতের স্বতন্ত্র প্রদর্শনীতে সমৃদ্ধ এই মিউজিয়াম। প্রবাদ-প্রতিম থার্মোমিটারটি রাখা আছে, সঙ্গে তার উদ্ভাবিত ও ব্যবহৃত যন্ত্রাদির মধ্যে জীবন্ত তৈলচিত্রে হাসি-হাসি মুখে স্বয়ং অধ্যাপক অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস! রয়েছে আধুনিক জীব-শ্রেনী-বিন্যাস-বিদ্যার জনক কার্ল লিনিয়াসের স্মৃতি-সজ্জিত একটি সম্পূর্ণ প্রদর্শনীও।
মিউজিয়ামের মিশরীয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বেশ কিছু স্মারক। রয়েছে দুটি মমিও। সবচেয়ে রোমাঞ্চিত হলাম ভাইকিং যুগের সংগ্রহশালায় গিয়ে। রয়েছে ‘কুখ্যাত’ ভাইকিংদের অস্ত্র-শিরস্ত্রাণ-বর্ম-ঢাল। টুকরো টাকরা নথি। বাদ্য যন্ত্র-আদি ব্যবহৃত জিনিসপত্র। রয়েছে ঐতিহাসিক ভাইকিং নৌ-সমাধির স্মৃতিচিহ্ন। নর্স সমাধি-করণ প্রথানুযায়ী মৃতের দেহ একটি নৌকায় বা প্রস্তর-জাহাজে সমাহিত রাখা হতো, সঙ্গে দেওয়া হত তার জাগতিক যাপনের আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র, কোনও ক্ষেত্রে উত্সর্গিকৃত ভৃত্য বা শিকার-সঙ্গী জন্তু-জানোয়ার।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে ঢুকলাম উপ্পসালা গির্জায়। ভিতরের লম্বা মায়াবী প্রার্থনা-কক্ষে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মিত ফরাসী গথিক স্থাপত্য-শৈলীর এই ক্যাথেড্রাল লম্বায় প্রায় ১১৯ মিটার। কিছুক্ষণ জীবন্ত ইতি-বৃত্তের মধ্যে বসবাস করা গেলো।
পরদিন গেলাম উপ্পসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিল্ডিং হয়ে উপ্পসালা দুর্গ। ষোড়শ-শতাব্দীর এই রাজকীয় দুর্গ রাজ-তান্ত্রিক সুইডেনের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার অকুস্থল। সিংহহৃদয় রাজা গুস্তাভ অ্যাডলফ এই দুর্গ থেকেই ঘোষনা করেন সুইডেন ত্রিশবছরের যুদ্ধে প্রোটেস্ট্যান্টদের পক্ষাবলম্বন করে অংশগ্রহন করবে। যুদ্ধে রাজা মারা যান আর উত্তরাধিকারী রেখে যান ৬ বছরের নাবালিকা কন্যা ক্রিস্টিনাকে। ১৬৫৪ সাল অবধি উপযুক্তহাতে রাজ্যভার নির্বাহ করে এই দুর্গেই সুইডেনের স্বাধীনচেতা রানী ক্রিস্টিনা স্বেচ্ছায় রাজকীয় মর্যাদা ত্যাগ করে রাজদায়িত্ব তুলে দেন তুতো ভাই দশম কার্লের কাঁধে। উপ্পসালা দুর্গের স্টেট হলে পূর্ণরাজপোষাক(ভাষান্তরে রিগ্যালিয়া)-পরিহিতা রাণীর দেহ থেকে টুকরো টুকরো করে সেই রাজপোষাক সরিয়ে নেওয়া হয়, যতক্ষণ না শুধু রাজমুকুট টুকু অবশিষ্ট থাকে। শুভ্র ট্যাফেটা-গাউনে সদ্যরাজ্যহীনা রানী ধীরে ধীরে মুকুট খুলে রাখেন আর মুগ্ধ হতবাক সুইডেনবাসীদের সামনে এক ভিনগ্রহী প্রাণীর মতো তার বিদায়ী ভাষণ দেন। ২৮ বছরের রানী যখন রোমে আসেন, পোপ তাকে “রাজ্যহীনা রাণী, ঈশ্বরবিশ্বাসহীনা খ্রীষ্টান ও লজ্জাহীনা নারী” অভিধায় ভূষিত করেন। এতদসত্ত্বেও অ্যালকেমির ভক্ত উদার ও যুক্তি-বাদিনী ক্রিস্টিনা প্রচলিত অসম লিঙ্গ-প্রথার প্রতিস্পর্ধী একজন যথার্থ সংস্কার-পন্থী নেত্রী হিসেবে ইতিহাসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
উপ্পসালা দুর্গের বাইরের মাঠের প্রান্ত বরাবর সারি সারি অনেক কামান দেখা গেলো। আর এক কোণে রয়েছে রানি গুনিলার দেওয়া বিশাল ঘন্টা, তারই নামে নামাঙ্কিত। দুর্গের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলে গাড়ির রাস্তা পার করে পৌঁছানো যায় কার্ল লিনিয়াসের সমাধিতে ও তাকে বেষ্টন করে বিশাল লিনিয়াস গার্ডেনে। প্রবাদপ্রতিম উদ্ভিদবিজ্ঞানীর নিজে হাতে সাজানো উদ্ভিদের প্রদর্শনীতে সমৃদ্ধ। বাগানের মধ্যে তার আবক্ষ মূর্তি যেন আবহমান কাল ধরে তত্ত্বাবধান করে চলেছে তাঁর প্রিয় গাছগাছড়াগুলির।
উপ্পসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিল্ডিংয়ের মেরামতি চলছিলো। প্লাস্টিকের মোড়কে প্রায় পুরোটাই মোড়া। হেল্পডেস্কের চটপটে মেয়েটির পরামর্শে ওরই এঁকে দেওয়া ম্যাপ নিয়ে এর পর রওনা দিলাম গামলা উপ্পসালা। সুইডিশ ভাষায় গামলা হলো পুরনো। একটা বাস আমাদের কুড়ি মিনিটে নিয়ে গেলো শহরের বাইরে শহরের পুরনো গ্রাম্য শরীরে। উফ! এমন দিগন্তবিস্তৃত সবুজের দেশ আমি কোথাও দেখিনি। মধ্যে মধ্যে উলটানো গামলার মতো তিনটে প্রকান্ড রয়্যাল ঢিপি। নর্স রূপকথার মতে এঁরা হলেন শায়িত দেবতা থর, ওডিন আর ফ্রেয়র। যেদিকে চোখ যায়, একচ্ছত্র সবুজের কারবার। অদূরে রয়েছে এক প্রাচীন গির্জা, যেখানে অগণিত সমাধির ভিড়ে একটি সমাধিতে সমাহিত আছেন অ্যান্ডার্স সেলসিয়াস। আর আছে ভাইকিং মিউজিয়াম। এই প্রাচীন উপ্পসালার ইতিহাসও খুব আগ্রহোদ্দীপক আর বিতর্কিত। বেশিরভাগটাই নর্স রূপকথার রঙিন মোড়কে ঢাকা। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে নর্স দেবতাদের এই চিরহরিত্ বাসভূমি তাই সুইডিশদের কাছে পবিত্র ও আদরনীয়।
ফিরে এসে ইতিবৃত্ততাড়িত মোহাবিষ্ট আচ্ছন্ন অবস্থায় হোটেলের কাছাকাছি একটা পাবে তীব্র দিবালোকে নৈশভোজ সারলাম। পরদিন সকাল সকাল রওনা দেবো সুইডিশ রাজধানী, স্টকহোমের দিকে ।
দ্বিতীয় পর্ব
উপ্পসালা সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে আধ ঘন্টার ট্রেনে পৌঁছে গেলাম স্টকহোম সেনট্রাল স্টেশন। রাস্তায় পড়েছিল স্টকহোমের আরলান্ডা বিমানবন্দর, সোলনা। স্টকহোম সেনট্রাল স্টেশন থেকে শহর ঘোরানোর কয়েকটা আলাদা ভ্রমণ সংস্থার বাস ছাড়ে। সারাদিনের জন্য বাস ও ফেরির ‘যুগ্ম’ টিকিট কেটে নিয়ে তারই একটায় সওয়ার হওয়া গেলো। চমত্কার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। বাসের মধ্যেই রয়েছে শহর ও সংক্ষেপে দেশটাকে চেনানোর জন্য বিশেষ অডিও ভ্রমণসঙ্গী। স্টকহোম শহর সুইডেনের দক্ষিণপূর্বপ্রান্তের উপকূলে ১৪টা দ্বীপের মিলিত দ্বীপপুঞ্জের উপর গড়ে উঠেছে, যেখানে ম্যালারেন হ্রদ বাল্টিকসাগরে এসে পড়েছে। এই ভৌগোলিক বিস্তার সেই প্রস্তরযুগ থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে। নিয়মিত পরিশোধনের পর সুপেয় অমলিন জল শহরের মধ্যের হ্রদে প্রবাহিত করা হয়েছে। ভ্রমণপুস্তকের তালিকার প্রথম দুটি দর্শনীয় স্থান গ্যালেরিয়া আর ‘রয়্যাল অপেরা হাউস’ বাস থেকেই দেখে নিলাম। প্রথমে নামলাম ‘গামলা স্ট্যান’ অর্থাত্ ‘পুরনো শহরে’। ত্রয়োদশ শতাব্দীর এক অতি-প্রাচীন শহর-এলাকা, মধ্যযুগীয় সরু সরু গলি-পথ, যার দু পাশে গগনচুম্বী প্রাচীরের জনপদ, মূলত সু -প্রাচীন উত্তর জার্মান স্থাপত্য-শৈলীতে বানানো অট্টালিকা, ‘কবলস্টোনের’ বানানো রাস্তাঘাট, সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি। এখান থেকেই বিখ্যাত সুইডিশ রাজপ্রাসাদের একটা অংশ দেখা যাচ্ছিলো।
পুরনো শহর থেকে আবার বাস ধরে নিয়ে Fjäll-gatan (পাহাড় সরণী?)। এখান থেকে স্টকহোম শহরের মোহন স্কাই লাইন আর প্যানোরামিক দৃশ্য দেখা যায়।
Fjäll-gatan থেকে বাস ধরতে গিয়ে কেমন সব গুলিয়ে গেলো। গোটাদুই বাস মিস করার পর অগত্যা ‘চরণবাবুর এক্কায়’ বাল্টিক সাগরবেলার ধার ধরে টুকটুক করে চলে এলাম ‘ভাইকিং লাইন এন্ড ক্রুজ বার্থ’। ফিনিশ জাহাজ কোম্পানীর জলযান এখান থেকে হেলসিঙ্কি-সহ বেশ কিছু জায়গায় নিয়ে যায়। ওখান থেকে আবার বাস চেপে নামলাম ‘রয়্যাল প্যালেস’। খাতায়কলমে যা কিনা সুইডিশ রাজপরিবারের বাসস্থান! জানা গেল যদিও বর্তমান রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাভ ও রানী সিলভিয়া তাঁদের সন্তান যুবরানী রাজকুমারী ভিক্টোরিয়ার সাথে ড্রটিংহোম প্রাসাদেই থাকতে পছন্দ করেন, কিন্তু রাজকার্যের খাতিরে এখানে নিয়মিত পদধূলি দিতেই হয়। রাজসমারোহে একদল বাদক চমত্কার বাজনা বাজিয়ে প্রাসাদের ভিতরে ঢুকছিল, তাদের অনুসরণ করে প্রাসাদের মধ্যে ঢুকলাম।
একটি মধ্যযুগীয় দুর্গের ধ্বংসাবশেষের উপর অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম বছরে যে প্রাসাদের নির্মানকাজ শুরু হয়, উত্তরের মহাযুদ্ধ পার করে সেই নির্মান শেষ হয় ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে। প্রাসাদে রয়েছে সাকুল্যে ১৪৩০ খানা ঘর, যার মধ্যে ৭৭০টায় কোনও জানালা নেই। রাজপরিবারের থাকার ঘরগুলোর সাথে রয়েছে সুসজ্জিত অতিথিসদন, উত্সবানুষ্ঠানের জন্য হল, রাজ্যাভিষেকের ঘর ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্যগুলি হলো, রানী ক্রিস্টিনার অভিষেকের রৌপ্যসিংহাসন-ধন্য হল অব স্টেট, সুইডেনের মহার্ঘ রাজপোষাকের সাথে ধনসম্পদের কক্ষ, রয়্যাল চ্যাপেল। কিছু চোখধাঁধানো মর্মরভাস্কর্য দেখে মন ভালো হয়ে গেলো।
রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়েই ফেরীতে উঠতে হলো, কারণ পরের গন্তব্য ভাসা মিউজিয়াম। ভাসা একটি ঐতিহাসিক সুইডিশ যুদ্ধজাহাজ, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটা সাংঘাতিকরকমের সমৃদ্ধ আর রোমাঞ্চকর সংগ্রহশালা। পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়ার যুদ্ধে নৌবহরের বলবৃদ্ধির জন্য রাজা গুস্তাভিয়াস অ্যাডলফাস তৈরী করিয়েছিলেন অস্ত্রসুসজ্জিত এই জাহাজ। কিন্তু ১৬২৮সালের ১০ই অগস্ট প্রথম জলে নামতেই এই জাহাজ ডুবে যায়। লিপিবদ্ধ ইতিহাস বলছে, যুযুধান রাজার তাড়ায় সম্পূর্ণ নির্মানোত্তর বিশ্লেষণ ছাড়াই ‘রাজনৈতিকভাবে ভীরু’ অথচ রাজার ‘আস্থাভাজন’ বিশেষজ্ঞের দল অসমাপ্ত ভাসাকে জলে নামান বলে অসহায় ভাসা কোনওরকম সাড়া না দিয়ে প্রাণহীন নিশ্চলভাবে ডুবে গিয়েছিল। সেটিকে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় রেখে দেওয়া আছে। রয়েছে তথ্যসমৃদ্ধ প্রদর্শনীও। নাবিকদের সাজসরঞ্জামও প্রদর্শনীতে রয়েছে। রয়েছে নাবিকদের আমোদপ্রমোদের জন্য আনানো অনেক জিনিসপত্রের মধ্যে সুদূর চীনদেশের তাসের গুচ্ছও।
ভাসার কাছের ফেরীঘাট থেকে আবার ফেরিতে চেপে পৌঁছানো গেলো আব্বাঃ দ্য মিউজিয়াম। লিভারপুলের Beatles Museum এর অনুপ্রেরণায় সুইডিশ পপগায়কের দল ‘Abba’ সুইডিশ মিউজিক হল অফ ফেমের জন্য বানিয়ে তুলেছে তাদের সৃষ্টির অদ্ভুত এক প্রদর্শনী। সেটার পাশ দিয়ে হেঁটে নর্ডিস্কা মিউজিয়াম পার করে একটা বাসস্টপ থেকে আবার বাসে উঠে পড়লাম। শেষ গন্তব্য স্টকহোম সিটি হল, সুইডিশ স্থাপত্যের জাতীয় রোম্যান্টিকতার অন্যতম স্তম্ভ। এরই ব্লু হলে নোবেলপুরস্কার-প্রদান-অনুষ্ঠানের পরের ব্যাঙ্কোয়েট অনুষ্ঠিত হয় আর ব্লুহলের উপরের গোল্ডেন হলে হয় ভোজনোত্তর বলনৃত্য। সিটিহলের দক্ষিণপূর্ব কোণে রয়েছে ১০৬ মিটারের গগনচুম্বী মিনার, যার শীর্ষে শোভা পাচ্ছে সুইডেনের পুরনো জাতীয় প্রতীক, তিনটি রাজমুকুট। ৩৬৫টা ধাপের সিঁড়ি ভেঙে ওই মিনারের মাথায় উঠে পড়ে যা দেখতে পেলাম, এককথায় চোখ জুড়িয়ে গেলো। জলের মধ্যে জেগে থাকা ত্রয়োদশশতাব্দীর পুরনো শহর-সহ ৩৬০ ডিগ্রিতে গোটা স্টকহোমের মনোমুগ্ধকর প্যানোরামা।
তৃতীয় পর্ব
রাজকুমার হ্যামলেটের দেশে সারাদিন মেঘলায়…
স্টকহোম থেকে রাতের ট্রেনে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হ্যাসলহোম, সেখান থেকে একটি বাসে লুন্ড; আবার সেখান থেকে অন্য একটি ট্রেনে মালমো হয়ে বাল্টিক সাগর পার করে পৌঁছালাম ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে। রাতের ট্রেনে ওঠার সময় চেকার ভদ্রমহিলার সাথে কিঞ্চিত্ বাদানুবাদ হয়েছিল। একই কুপেতে আমাদের সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তিটি ছিলো একটি বিদেশী ছেলে, সে চাইলে কুপেতে আমার অর্ধাঙ্গিনীর উপস্থিতির ব্যাপারে নাকি বিধিসম্মত প্রতিবাদ জানাতেই পারতো, সেক্ষেত্রে আমাদের ঠাঁই কোথায় হতো তা বজ্রপ্রহরণ থরই জানেন। নিশ্ছিদ্র প্রযুক্তির দেশে টিকিট বানানোর সময় এই অদ্ভুত সমস্যার উল্লেখ দেখিনি কেন, সেটা ভেবে একটু বিরক্ত আর বিস্মিতই হয়েছিলাম। ধন্যবাদ মহাবলী থরকে, মধ্যরাত্রে মাথায় বাজ পড়েনি।
কোপেনহেগেনে যখন পৌঁছলাম, তখন সকাল। কিন্তু আবহাওয়া দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। সুইডেন যতটা উষ্ণ অভ্যর্থণা এগিয়ে দিয়েছিল, রাজকুমার হ্যামলেটের দেশ ঠিক ততটাই শীতল আর মেঘধূসর ম্লান হাসিতে স্বাগত জানালো যেন। স্টকহোমের মতো এখানেও সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে শহর ঘোরার জন্য একাধিক সংস্থার একাধিক রুটের রকমারি যানবাহনের ব্যবস্থা ছিলো। বাসের ব্যবস্থাটির একটা বদ-তরজমা করলাম “উঠে-পড়ুন-নেমে-পড়ুন পরিষেবা”। সুইডেনের মুদ্রা সুইডিশ ক্রোনা (বা ক্রাউন, যার সংক্ষেপ SEK) আর এদেশের মুদ্রা Danish krone (DKK) র মূল্য অভিন্ন। আমরা শুরু করলাম High Bridge Square (স্থানীয় ভাষায় Højbro Plads) থেকে। এখানের মূল দ্রষ্টব্য চৌমাথার মধ্যিখানে বিশপ অ্যাবসালনের অশ্বারোহী মূর্তিটি। হাতে উদ্যত কুঠার নিয়ে উদ্ধতভঙ্গিতে তাঁর সাধের ক্রিশ্চিয়ানবর্গ দুর্গপ্রাসাদের দিকে তাকিয়ে আছেন কোপেনহেগেনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্মানিত যোদ্ধা-বিশপ। ঝিরঝির বৃষ্টিতে রাস্তার দুপাশে নিওক্লাসিকাল স্থাপত্যের প্রাসাদোপম বাড়িগুলো ভিজছে। অদূরে একটি গলির শেষ প্রান্তে সন্ত নিকোলাসের গীর্জার চূড়া দেখা যাচ্ছে।
Højbro Plads |
পরের দ্রষ্টব্যস্থান হলো কোপেনহেগেনের ‘নতুন বন্দর’ বা নাইহ্যাভন। সপ্তদশ শতাব্দীতে সুইডিশ যুদ্ধবন্দীদের বানানো এই জলযানপোতটি খুব নয়নাভিরাম। জলের মধ্যে দুপাশের শতাব্দীপ্রাচীন রঙবেরঙের টাউনহাউস, রেস্তোরাঁ আর পানশালা ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ। অজস্র জলযান নোঙর করে থমকে আছে চিত্রার্পিতের মতো।
Nyhavn |
এরপর এসে নামলাম ড্যানিশ রাজপ্রাসাদ Amalienborg Palace-এ। একটি অষ্টভুজাকার কোর্টইয়ার্ডকে ঘিরে চারটি একইরকমের স্থাপত্যের রাজপ্রাসাদ, যার প্রতিটার অভ্যন্তর ‘রকোকো’ নামের একটি অপ্রতিসাম্যধর্মী ফরাসী স্থাপত্যশৈলীতে সাজানো। অষ্টভুজের কেন্দ্রে সুউচ্চ অশ্বারূঢ় মূর্তিতে অ্যামেলিয়েনবর্গের প্রতিষ্ঠাতা রাজা পঞ্চম ফ্রেডেরিক স্বয়ং! মূর্তিটার একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা নেহাৎ মন্দ না। Frederick V (1723-1766) ডেনমার্ক-নরওয়ের রাজা ছিলেন কুড়ি বছর (1746 – 1766)। তিনি যদিও মদ্যপ ছিলেন ও বিলাসবহুল জীবন পছন্দ করতেন, কিন্তু তার উদার মানসিকতার জন্য তাঁর রাজত্বে দেশের সার্বিক উন্নয়ন হয়েছিল। তাঁর আমলেই সাতবছরের যুদ্ধ (1756–63) চলেছিল। যুযুধান সুইডেন-রাশিয়ার প্রতিবেশী হয়েও তিনি দেশকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখেন। এরকম অনেক কীর্তির জন্য দেশবাসীর কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর মৃত্যুর পাঁচবছর পর তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে এই অশ্বারোহী মূর্তি (রোমান সম্রাটের বেশে) উদ্ঘাটিত করা হয়। পরে একটি মজার তথ্য জানলাম, Danish India র অংশ হিসেবে আমাদের শ্রীরামপুরের নামও ওনার নামে Frederiksnagore রাখা হয়েছিল (1755 থেকে 1845 পর্যন্ত এই নাম ছিল)।
Frederick V (1723-1766) |
ফ্রেডেরিক্–স্ চার্চ |
Amalienborg Palace |
বৃষ্টিস্নাত প্রাসাদচত্ত্বরে ও রাস্তার উল্টোদিকের ঝর্ণাশোভিত উদ্যানে কয়েকশতাব্দীর ইতিহাসযাপন করে বেড়ালাম অনেকক্ষণ। রাণী সোফি অ্যামেলি যে প্রাসাদ ও উদ্যান নির্মান করিয়েছিলেন, সেটিই পরবর্তী রাজাদের আমলে পরিবর্ধিত ও পুনর্নির্মিত হতে হতে আজকের এই মনোমুগ্ধকর বিশাল রূপ পেয়েছে। কিন্তু প্রথমে রাজপরিবার এখানে থাকতেন না। ১৭৯৪এ ক্রিশ্চিয়ানবর্গ রাজপ্রাসাদ এক বিশাল অগ্নিকান্ডে ধূলিসাত্ হয়ে গেলে তদানীন্তন রাজা সপরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ইতিহাসে এরকম প্রলয়ঙ্কর অগ্নিকান্ড অনেকবার হয়েছে। অ্যামেলিয়নবর্গের প্রাসাদগুলি তদানীন্তন মালিকদের কাছ থেকে রাজার কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার পর রাজপরিবার এখানে উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে এই প্রাসাদচারটি ড্যানিশ রাজপরিবারের স্থায়ী বাসস্থান হয়ে ওঠে। চারটি প্রাসাদের নামকরণও হয় যথাক্রমে রাজা সপ্তম ও অষ্টম ক্রিশ্চিয়ান, রাজা অষ্টম ফ্রেডেরিক ও রাজা নবম ক্রিশ্চিয়ানের নামে। প্রাসাদচত্ত্বরের পশ্চিমদিকে, যেখানে Frederiksstaden নামের এই জেলাটির নাভি অঞ্চল, সেখানে রয়েছে আগাগোড়া রকোকো স্থাপত্যশৈলীর অপরূপ ফ্রেডেরিক্-স্ চার্চ। যে দেশের সাতাত্তর শতাংশ নাগরিক লুথারীয় খ্রীষ্টধর্মের, এই শতাব্দীপ্রাচীন রাজকীয় লুথারীয় মর্মর গীর্জাটি সেই দেশের ধর্মপ্রাণতার, বলাই বাহুল্য, পীঠস্থানস্বরূপ। গীর্জার ভিতরে ঢুকে অপূর্ব স্থাপত্যে ও উপকরণে সুসজ্জিত প্রার্থনাগৃহ দেখে মন ভালো হয়ে গেলো।
এবার গন্তব্য জেফিঅন ঝর্ণা। বিশাল ঝর্ণার কেন্দ্রটিতে নর্স দেবী জেফিঅন তাঁর চার সন্তানকে চারটি প্রকান্ড ষাঁড়ে পরিবর্তিত করে তাদের দিয়ে তীব্র গতিতে হলাকর্ষণ চলে চলেছেন। ড্যানিশরা এটাকে উইশিং ওয়েল হিসেবে ব্যবহার করে।
জেফিঅন ঝর্ণা
কোপেনহেগেন সেন্ট্রাল স্টেশনে আমাদের বেছে নেওয়া ট্যুরিস্ট রুটটার নাম ‘দ্য লিটল মারমেড ট্যুর’ যে দ্রষ্টব্যটির নামে রাখা, অতঃপর সেটির দেখা পাওয়া গেলো। স্বনামধন্য ড্যানিশ লেখক হান্স অ্যান্ডারসনের ট্র্যাজিক রূপকথার নায়িকা ভাগ্যবিড়ম্বিতা মত্স্যকন্যা এরিয়েলের ব্রোঞ্জ প্রতিকৃতি কোপেনহেগেনের অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। বাস যেখানে নামিয়ে দিলো, সেখান থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে জলের ধারে গিয়ে দেখলাম, অদ্ভুত বিমূর্তভঙ্গিতে সাজিয়ে রাখা প্রস্তরখন্ডের উপর যেন ওফেলিয়ার প্রতীক্ষার আদলে বসে আছে সে। যে প্রেমিকের জন্য অসহন কন্টকবেদনাভরা নৃত্যে সে আবহমানকাল কাঁদিয়ে আসছে তামাম রূপকথার পাঠকপাঠিকাদের, তার জন্য প্রতীক্ষায় বসে আছে সে আজও! এই মূর্তির ইতিহাস রূপকথাটির চেয়ে ঢের বেশি রোমহর্ষক! ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে কোপেনহেগেনের রয়্যাল থিয়েটারে অ্যান্ডারসনের রূপকথার ব্যালে উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কার্লসবার্গ বিয়ারের উত্তরাধিকারী কার্ল জেকবসেন। তাঁর অনুরোধে সুন্দরী ব্যালেরিনা এলেনা প্রাইস রাজী হন রূপকথার মত্স্যকন্যার আদলে একটি অনুপম ভাস্কর্যনির্মানের মডেল হতে। তবে নগ্নতার ব্যাপারে তাঁর অস্বস্তি থাকায় শুধু মূর্তির মুখ বানানো হলো এলেনার মুখাবয়বের অনুকৃতি করে। অবশিষ্ট অংশের জন্য নগ্না হয়েছিলেন মূর্তির ভাস্কর এডভার্ড এরিকসেনের স্ত্রী এলিন।
উদবোধনের পর ১৯৬০ সাল থেকে অজস্র বার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে মূর্তিটি। কখনও রাজনৈতিক বাদানুবাদের দোহাই দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে অপাপবিদ্ধ তার মাথা, তার ডানহাত! কখনও ধর্মীয় কারণে তার নগ্নতায় আপত্তি জানিয়ে মূর্তিটি ঢেকে দেওয়া হয়েছে কালো আচ্ছাদনের অন্ধকার ব্রীড়ায়, কখনো তার হাতে একটি কৃত্রিম পুরুষাঙ্গ গুঁজে দিয়ে সবুজ রঙে লিখে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক নারীদিবসের তারিখ। প্রতিবার ধ্বংসের হাত থেকে পুনর্নির্মানের হাত ধরে ফিরে এসেছে মত্সকন্যা, যাবতীয় মৌলবাদের আর সংকীর্ণতার মুখের উপর তুমুল অট্টহাসির মতো!
দ্য লিটল মারমেড
‘দ্য লিটল মারমেড’ ট্যুরের রাস্তায় আমার সবচেয়ে চোখধাঁধানো লাগলো রোজেনবর্গ দূর্গ। রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের অনেক স্থাপত্যকীর্তির অন্যতম হলো ডাচ রেনেসাঁর স্থাপত্যশৈলীতে ১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে বানানো এই দুর্গটি। পরবর্তীতে ক্রমাগত পরিবর্ধনের পথ ধরে যেটি আজকের রূপটি পেয়েছে। ক্রিশ্চিয়ানবর্গ দুর্গের অগ্নিকান্ডের পর কিছুদিন রাজপরিবারের বসবাসের জন্যও দুর্গটি ব্যবহৃত হয়েছিল। দুর্গের বহিরঙ্গ দেখে তো মোহিত হতেই হলো, ভিতরে গিয়ে তো মোটামুটি চক্ষু ছানাবড়া হবার উপক্রম! রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানের আমল থেকে শুরু করে এখন অব্দি দীর্ঘ সময়ের রাজকীয় আড়ম্বরের আর ঐশ্বর্যের ঝলমলে রত্নখচিত তোষাখানা সাজানো রয়েছে প্রদর্শনী করে। যুদ্ধাস্ত্রের প্রদর্শনী, মণিমাণিক্যখচিত রাজমুকুট, রাজআভরণ, আসবাব, রকমারি দর্পন, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মর্মর ভাস্কর্যে ছয়লাপ অজস্র “Schatzkammer”, আবগারি সরঞ্জাম, আরও কত কী! চারতলায় রয়েছে Knight’s Hall, ১৬২৪এ বলরুম হিসেবে বানানো হলেও এটা মূলত অভ্যর্থনাকক্ষ হিসেবে বা কখনও রাজ্যাভিষেকের মতো বড় সমারোহের কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রতিটি সিলিং অতিসূক্ষ্ম ভাস্কর্যমন্ডিত, দেওয়ালে রয়েছে বারোটি ট্যাপেস্ট্রি, স্ক্যানীয় যুদ্ধে রাজার বীরগাথা আঁকা… যেগুলি শিল্পীরা রাজার সাথে সমরাঙ্গনে সশরীরে উপস্থিত থেকে ‘লাইভ’ এঁকেছিলেন! বিশাল ঘরের একপ্রান্তে রয়েছে রাজা ও রাণীর অভিষেকের সিংহাসন, চারটি প্রকান্ড রৌপ্য-সিংহ প্রবল পরাক্রমে নিশিদিন অতন্দ্র প্রহরায় যেগুলিকে নিষ্কন্টক রেখে চলেছে…
রোজেনবর্গ দুর্গ
রোসেনবর্গ দুর্গের রাজতোষাখানা
রাজা পঞ্চম ক্রিশ্চিয়ানের রাজমুকুট
Knight’s Hall
Christianshavn হলো কোপেনহেগেনের একটা প্রতিবেশী এলাকা। সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজা চতুর্থ ক্রিশিয়ান কোপেনহেগেনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য অনেক পদক্ষেপের সঙ্গে এই বিশেষ অঞ্চলটিরও পত্তন করেন। মূলশহরের থেকে আলাদা স্বাধীন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি উচ্চশ্রেণীর বাণিজ্যঅঞ্চলও গড়ে তোলা হয়। সঙ্গে তৈরী হয় একটি গীর্জাও, যার নাম ‘চার্চ অফ আওয়ার সেভিয়ার’। ওলন্দাজ ‘ব্যারক’স্থাপত্যের নিদর্শন এই গীর্জার বিশেষতা হলো এর বহির্ভাগ বেষ্টন করে একদম চূড়ায় উঠে যাওয়া সর্পিল সিঁড়ি। চূড়ায় উঠলে ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টিকোণে অপূর্ব হয়ে ধরা দেয় কোপেনহেগেন শহর। অনেক উত্থাণপতনের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই মূল প্রতিরক্ষাপরিকল্পনাটি প্রায় অবিকৃত রয়ে গেছে এই অঞ্চলে। আর রয়েছে ফ্রিটাউন ক্রিশ্চিয়ানিয়া। ৮৪ একর জায়গা জুড়ে ডেনমার্ক থেকে আইনগতভাবে বিচ্ছিন্ন একটি স্বাধীন এলাকা। ১৯৭১এ পত্তন হওয়া থেকে শুরু করে অসংখ্য বিতর্কিত ঘটনা ঘটে চলেছে এখানে। মূলত মাদকব্যবসাকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি, বিক্ষোভ হয়েছে বারবার। আমাদের বলে দেওয়া হলো, গাড়ি, ক্যামেরা, ‘কড়া’ মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র এই সব স্থানীয় আইনমতে একদম নিষিদ্ধ। ক্যামেরা ছাড়া কিছু নিষিদ্ধ জিনিস ছিলোনা, বলাই বাহুল্য। সেগুলিকেও চালান করে দিলাম ব্যাগের গহনতম কন্দরে। প্রবেশদ্বারের মুখে স্প্যানিশগীটারে তুফান তুলেছেন একজন তরুন। ভিতরে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘোরাঘুরি করলাম। অজস্র সাজসরঞ্জাম, দোকানপত্রে গমগম করছে। একটি এলাকা পুরো গঞ্জিকাসেবনে মত্ত অগুনতি যুবকযুবতী, বয়স্য, গঞ্জিকা ও একইরকমের মাদকের উন্মুক্ত বেচাকেনার দোকান আর অনর্গল ধোঁয়ায় ভর্তি আর ম ম করছে। বোঝা গেল গঞ্জিকাকে অন্তত কড়া মাদকের তালিকায় ধরেনি এদের আইন। জানতে পারলাম, দুটি মাদক মাফিয়ার দল Bullshit আর Hell’s Angels পারস্পরিক রেশারেশি করে মাঝে মাঝেই এই শহরের শান্তি বিঘ্নিত করে, কিছুদিন সব বন্ধ করে রাখার পর আবার সব খুলে দেওয়া হয়। এখানে পুরুষ সমকামীদের একটি শিল্পীগোষ্ঠীও রয়েছে, যার নাম ‘দ্য গে হাউস’। স্থানীয় বীয়ারপান করে আর চারপাশে ‘মনের খুশিতে বানানো’ দেওয়ালচিত্র, দেওয়ালকবিতা, ভাস্কর্য দেখতে দেখতে, আর রকমারি বাজনা শুনতে শুনতে অনেকটা সময় কেটে গেলো । যখন বেরিয়ে আসছি, গেটের মুখে এর তরুণটি তখনও নিজের মনে বাজিয়ে চলেছে তার গীটার।
ফ্রিটাউন ক্রিশ্চিয়ানিয়া
ক্রিশ্চিয়ানিয়ার স্বাধীন শহর থেকে ফিরে এলাম আবার High Bridge Square এ, ততক্ষণে সে জায়গা প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে রাস্তার ধারে দুরন্ত অপেরাগায়কদের গানে গানে, বাদকসঙ্গীদের যন্ত্রানুষঙ্গে মুখর হয়ে উঠেছে সমস্ত চৌরাহা! উষ্ণ গ্রীষ্মউদযাপন শুরু হয়েছে নিশীথসূর্যের স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়! সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার সেন্ট্রাল স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ কিছুদূর এসে চোখে পড়লো বিখ্যাত টিভলী উদ্যানের গগনচুম্বী রাইডগুলির মাথা। টিকিট কেটে ঢুকে গেলাম উদ্যানে। শতসহস্র শিশুর কলকাকলিতে মুখর টিভলী উদ্যান সকালের বিষন্ন আবহাওয়ার মেজাজে যেন জ্বেলে দিয়েছে উত্সবের সাতরঙা আলো! ঘুরে বেড়ালাম চারপাশে অজস্র রাইড আর এক্সহিবিটের মধ্যে। একদিকে জ্যাজবাদকের দল, অন্যদিকে অপেরাগায়কের দল! কোথাও রকমারি যন্ত্রের তুমুল রোশনচৌকি! মন্ত্রমুগ্ধকর বাজনা শুনতে শুনতে আত্মহারা হয়ে বসেছিলাম বেশ কিছুক্ষণ! সম্বিৎ ফিরে পেতে ঘড়ির দিকে চোখ গেলো! ফেরার সময় হয়ে এসেছে।
Tivoli Garden
High Bridge Square
যাওয়া হলোনা রাজকুমার হ্যামলেটের ‘এলসিনোর’ দুর্গে, যার অন্য নাম ক্রনবর্গ দুর্গ। কোপেনহেগেন থেকে বেশ খানিকটা দূরে Helsingør শহরে রয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতিহাস বিজড়িত এই রেনেসাঁ স্থাপত্যটি। হয়তো সেটার টানেই আর একবার আসতে হবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায়…
সমাপ্ত