জার্মান সাহিত্যিক টমাস মান ১৯২৯ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সেই বিংশ শতাব্দীর এক উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি স্বীকৃতি পান। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে ডেথ ইন ভেনিস এবং দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন বিশেষভাবে বিখ্যাত। কেবল সাহিত্যিক হিসেবেই নয়, টমাস মানের খ্যাতি রয়েছে সমাজ বিশ্লেষক হিসেবেও। পুরো নাম পল টমাস মান। ১৮৭৫ সালের ৬ই জুন জার্মানির লিউবেক শহরে তাঁর জন্ম হয়েছিল এক সম্পদশালী জার্মান মধ্যবিত্ত পরিবারে। যৌবনের শুরুর দিকে ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেও তাঁর স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার। মাত্র ১৬ বছর বয়সের সময় তাঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন। বাধ্য হয়ে টমাসকে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরতে হয়। কিন্তু ব্যবসাবুদ্ধি তেমন না থাকার জন্য ব্যবসা অল্পদিনের মধ্যেই উঠে যায় এবং লেখক শেষ পর্যন্ত মিউনিখ শহরে চলে যান। ব্যবসা উঠে যাওয়ায় লেখক ও তাঁর পরিবারকে যথেষ্ট আর্থিক সংকটে পড়তে হয় এবং পারিবারিক ভাগ্য বিপর্যয়ের এই ঘটনাকে ভিত্তি করে এক দীর্ঘ ও বিস্তারিত উপন্যাস লেখার অনুপ্রেরণা পান তিনি। লিখেও ফেলেন শেষ পর্যন্ত বাডেন ব্রুকস নামে সেই পারিবারিক উপন্যাস। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সেই বই বেশ সাফল্য পায় এবং টমাস বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তাঁর তখন যা বয়স সেই তুলনায় উপন্যাসটি ছিল যথেষ্ট পরিণত সৃষ্টি। উপন্যাস ছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ রচনা করে গেছেন। একজন মানবতাবাদী হিসেবে টমাস মান সুপরিচিত। 

ত্রিশ বছর বয়সে তিনি কাটিয়া প্রিঙ্গশাইমকে বিয়ে করেন। কাটিয়া ছিলেন বিখ্যাত ইহুদি বুদ্ধিজীবি পরিবারের মেয়ে। তাঁদের ছটি সন্তান জন্ম নিয়েছিল। ছেলেমেয়েরা সবাই সাহিত্য ও শিল্পকে জীবনের কেরিয়ার হিসেবে নির্বাচন করেছিল। 

প্রাথমিকভাবে খ্যাতি অর্জনের পর পরবর্তী ২০ বছর মান ছোট নভেল বা নভেলা লেখার দিকে বেশি মন দেন। তাঁর ৪৯ বছর বয়সের সময় মান দ্বিতীয় বড় মাপের উপন্যাস রচনা করেন। বইটির নাম ছিল দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন। প্রথমদিকে মান একটি ছোটগল্প লিখতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছোটগল্প আয়তন পালটে হয়ে গেল এক বিশাল সিরিয়াস উপন্যাস। এখানে রয়েছে এক হাসপাতালের কাহিনী যেখানে যক্ষারোগে আক্রান্ত রোগীরা আরোগ্যলাভ করে। এই আশ্চর্য বই মানকে ১৯২৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। এবং তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা সাহিত্যিক হিসেবে মর্যাদা পান। 

১৯৩৩ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মান তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কাজে নিমগ্ন ছিলেন আর তা হল বাইবেলের এক আধুনিক সংস্করণ জোসেফ ও তাঁর ভাইদের নিয়ে। চারটি ভলিউমে প্রকাশিত বইটির নাম জোসেফ অ্যান্ড হিজ ব্রাদার্স, যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অত্যাচারের মধ্যে এক দ্বন্দ্ব মূর্ত হয়ে উঠেছে।

টমাস মান সবচেয়ে শক্তিশালী বইটি লিখেছেন তাঁর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে। ফ্যাসিজমের তিনি বিরোধী ছিলেন। তাঁর স্পষ্টবাদী স্বভাবের জন্য তাঁকে জার্মানি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। হিটলারের নাৎসিবাহিনী তাঁকে একদমই সহ্য করতে পারত না। তিনি বাধ্য হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখান থেকেই তাঁর শেষ মহৎ কর্ম ডক্টর ফাউস্টাস প্রকাশ করেন। এই বইতে জার্মানির এক সুপরিচিত উপকথা বলা হয়েছে যেখানে ফাউস্ট নামে এক ব্যক্তি সয়তানের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে। হয়তো জার্মানিতে নাৎসিবাহিনীর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকেই তিনি এই কাহিনী লেখার প্রেরণা পান। ১৯৪৪ সালে মান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন। ১৯৫২ থেকে বাকি জীবন তিনি জুরিখ শহরে থাকতেন এবং ৮০ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালে সেখানেই তিনি মারা যান। বুদাপেস্ট শহরে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান যার নাম টমাস মান জিমনাসিয়াম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *