মালয়েশিয়া বা সুমাত্রার রেনফরেস্টে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ শুনলেন গগনবিদারী চিৎকার।
চকিতে চোখ তুলে এক পলকে দেখলেন গাছের একডাল থেকে আরেক ডালে ঝুলে ঝুলে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য
হয়ে গেল এক দ্রুতগামী দ্বিপদ। কী ভাবছেন বলুন তো, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে টারজান? আজ্ঞে না, এরাই হল
সায়ামাং। দুর্লভ প্রজাতির এই বানর হল গিবনদের মধ্যে বৃহত্তম, গলার জোরও এদেরই সবথেকে বেশি। তবে
রংটা বেজায় কালো।
মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গলেই দেখা মেলে এই বৃক্ষবাসী সায়ামাংদের। শরীরের গঠনটা পাতলা
ছিপছিপে, ফলে লম্বা হাতে ভর দিয়ে ছোট্ট শরীরটাকে এরা দ্রুত এক ডাল থেকে আরেক ডালে সরিয়ে নিতে
পারে। তবে লাফিয়ে যেতেও এরা সমান স্বচ্ছন্দ। ৩০ ফুট (৯ মিটার) মত দূরত্ব এরা লাফিয়ে পেরিয়ে
যেতে পারে অবলীলাক্রমে।
কুচকুচে কালো ঘন লোম থাকলেও সায়ামাংদের লেজ নেই, তবে মুখটা কিন্তু রোমবিহীন, যেটুকু
আছে সেটাকে হালকা গোঁফ দাড়ি বলাই শ্রেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষদের চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই
এদেরও থাকে বোঁচা নাক আর কুতকুতে চোখ।
ছেলে সায়ামাংরা তাদের ঘরনীদের তুলনায় সামান্য বড় চেহারার, প্রায় এক ফুট (৯০
সেন্টিমিটার) লম্বা। ওজনে মোটামুটি ২৫ পাউন্ড (৭ কেজি)। সামাজিক এই গিবনকুল থাকে জোড়ায়
জোড়ায়। ৭ বছর না পেরনো পর্যন্ত বাচ্চা সায়ামাংকেও থাকতে হয় বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে, এদের
পারস্পরিক প্রীতি যে কতটা তা গা চুলকোনোর বহর দেখলেই বোঝা যায়।
বাকি গিবনদের মত মাচা বানিয়ে নয়, সায়ামাংরা ঘুমটা সেরে নেয় গাছের ডালের ফাঁকে খাড়া
হয়ে বসেই। তবে ‘গিবনকুলশ্রেষ্ঠ’ সায়ামাংদের আসল অহংকার হল এদের থ্রোট স্যাক বা গুলার স্যাক মা
সায়ামাংদের গলাবাজির ক্ষেত্রে বিপুলভাবে সাহায্য করে। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই রয়েছে এই ‘স্যাক’ যা
চিৎকার করার সময়ে ফুলে যায় এবং এর মধ্যে সায়ামাংদের ভোকাল কর্ড থেকে বেরনো আওয়াজের
অনুরণন ঘটে; এর ফলে আওয়াজ এতটাই তীব্র হয় যে এদের ডাক ঘন জঙ্গলের মধ্যেও প্রায় ২ মাইল দূর
থেকে শুনতে পাওয়া যায়।
জঙ্গল মানে রেনফরেস্টের ৩০ থেকে ৫০ একর জমিজায়গা জুড়ে তৈরি হয় সায়ামাংদের একেকটা
পাড়া। এদের রোজনামচাটাও ভারী অদ্ভুত। সকালবেলা উঠে গোটা পরিবার মিলে শুরু করে তারস্বরে
চিৎকার আর নানারকম অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি। এই হম্বিতম্বির কারণ হল যাতে বেপাড়ার সায়ামাং-বীর তাদের
এলাকায় ঢুকে না পড়ে। রোজ সকালে আধঘন্টা ধরে চলে এই ‘ছায়াযুদ্ধ’। তবে এপ্রসঙ্গে বলা দরকার, ভোর
ভোর উঠে আগে ডাকাডাকি শুরু করতে হয় গিন্নি সায়ামাংকেই।
সায়ামাংদের সুখী সংসার স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে খুব কম। সায়ামাং গিন্নী প্রায় ৮
মাস গর্ভবতী থাকার পর সন্তানের জন্ম দেয়। কচ্চিৎ-কদাচিৎ যমজ জন্মালেও সাধারণভাবে একবারে একটা
বাচ্চাই হয় এদের। সদ্যোজাতর শরীরে লোম থাকে অনেক কম এবং ওজন মাত্র ৬ আউন্স মত (এক কাপ
জলের ওজনের চেয়েও কম)। বাচ্চাকে প্রতিপালন করা হয় সযত্নে। ৫-৭ বছর বয়সে সায়ামা়ং যৌবনপ্রাপ্ত
হয়। তখন নিজের ইচ্ছেয় বা বাবা-মায়ের তাড়নায় সে ঘর ছাড়ে নিজের সংসার পাতবে বলে।
সায়ামাংরা ৩৫-৪০ বছর বাঁচে। তবে বন্দী অবস্থায় এরা ভালো থাকেনা।
সায়ামাংরা সর্বভুক। পোকামাকড়, আরশোলা, পাখির ডিম ও বাচ্চা এসব খেলেও এদের
প্রাথমিক ও প্রধান খাদ্য হল গাছপালা। মূলত ফল, এছাড়া এরা ফুল, বীজ, ছাল ইত্যাদি গাছের বিভিন্ন
অংশ খেয়ে থাকে। সামগ্রিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সায়ামাংরা গাছপালার ওপর ভীষণভাবেই নির্ভরশীল আর

আজ তাই এরা বিপন্ন। পৃথিবীজুড়ে মানুষের উপস্থিতি ও চাহিদার বহর সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী। নির্বিচারে
ধ্বংস হচ্ছে বনভূমি, নিজেদের চিরাচরিত বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে এই আদিম অধিবাসীদের।
জমিহারা সায়ামাংদের জীবন-জীবিকা বাঁচাতে এগিয়ে আসে না কেউ, ফলে আশঙ্কাজনকভাবে দিনের পর দিন
কমে চলেছে এদের সংখ্যা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *