পাঠক মিত্র

মানুষ বড়ো কাঁদছে

‘মানুষের অন্ধকার, মানুষের সব ঘরদোর

অধিকার করে নেয় আজ এই নষ্ট নক্ষত্রের

সন্ধ্যায়, আলোক তার ভবিতব্য নিয়ে মুখোমুখি

কর্তব্যের এবং কর্তব্য থেকে এ-মানুষ এমনি বিচ্যুত

যাতে ঝড় অবাধে দখল করে সব গ্রাম, গ্রামান্তরে শহর…।’ 

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন থেকে আজকের এই সময়কে দেখা যায় । সত্যি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে মানুষের ঘরদোর । চারিদিক এক নষ্ট নক্ষত্র আজ । কবি তাঁর সময়কে যেভাবেই বলুক না কেন, আজকের সময় পৃথিবী জুড়ে মানুষের জীবন এক শ্রেণীর লোভ আর ক্ষমতার ঝড়ে বিধ্বস্ত ।  ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের যুদ্ধ, রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ এক সমীকরণে নয় । কিন্তু এ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের সমীকরণে নেমে এসেছে যুদ্ধ নামক নষ্ট নক্ষত্রের ঝড় । আবার এ দেশে কাশ্মীর থেকে মণিপুর মানুষের জীবনে আলাদা এক অন্ধকার। তথাকথিত সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম সর্বত্র এক চিত্র । চার বছর আগে করোনা ভাইরাস দেখিয়ে দিয়েছে তার ভিন্ন নষ্ট নক্ষত্রের আর এক রূপ । মানুষগুলোর ঘরে যখন সত্যি অন্ধকার, তারা অনেক কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে । একদিন নয় । প্রতিদিন । তাই যে কোনো ঝড় দখল করে নেয় তাদের, তাদের গ্রাম, তাদের শহর । 

এই ঝড়ে তারা উঠে দাঁড়াতে পারে কি ? তারা এগিয়ে যেতে চায় আলোর দিকে, তবু পথ খুঁজে পায় না । কবি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন থেকে বলতে পারা যায় ।

 ‘মানুষের ভিতরের আলো তাকে পথ থেকে ঠেলে

 নামায়, যেখানে কাঁটা ঝোপঝাড় এইসব আছে

চোখে পড়া পথ নেই, আছে যাতে বুকে হেঁটে যাওয়া

হয়তো সম্ভব । আমি দেখেওছি কেউ কেউ পারে

সবাই পারে না ।

আবার সবার জন্যেও পথ নয় !’

আজকের এই সময়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া মানুষগুলোর সামনে যে পথ, সেই পথে সোজা হয়ে হাঁটা কি তাদের পক্ষে সম্ভব । এমনকি হামাগুড়ি দিয়ে চলতে পারবে কি ? এভাবেই চলতে হবে তাদের । সেই চলার পথে কিছু মানুষ আলো নিয়ে আসে তাদের কাছে । কেউ দেয় তাদের সাধ্যমতো আলো । আবার কেউ দেয় আইনের হাত ধরে, কিংবা বিজ্ঞাপনে । এভাবেই তারা আলোর মধ্যে ভালোবাসার উদ্দেশ্য হয়তো ভাগাভাগি করে থাকে । তাদের হয়ে কবি যেন বলেছেন–

 ‘এও জানি তোমরা দেবে, তোমাদের সাধ্যমতো, বিধানসম্মত

ভালোবাসা, কেউ খুঁটে খাবে, কেউ খাবে অপর্যাপ্ত পাঁক…।’  

মানুষগুলোর এই খাওয়াও একদল মানুষ নিজেদের মানবিক বলে মনে করে । এই মানবিক মুখ দেখানো মানুষগুলোর যেটুকু নষ্ট খাবার সেটুকু দিতে পেরে বুক ফুলে ওঠে । কেউবা চলে আইনের সাধ্যে আইন মতে । তবু মানুষগুলো যেন পাঁকের অন্ধকারে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে । বিজ্ঞাপিত মানুষ আর অন্ধকারে ডুবে যাওয়া মানুষের কথাই যেন ফুটে উঠেছে কবি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ।

 ‘দু’মুঠি ভাত তিজেলের ফাঁকে–হায় সেই তো সুন্দর !

মাছ কিংবা ভিকিরির কাজে লাগবে, সুখ্যাতি বাড়াবে

দেশের মানুষ বলবে: আমাদের উদ্বৃত্ত যা ছিলো

খয়রাত করেছি, দ্যাখো, পচিয়ে করিনি তাকে পানি..।’ 

যেমন করোনাকালে দেখা গেছে খয়রাত করেছে বহু মানুষ । সোস্যাল মিডিয়ার পাতায় তাঁরা ভাসিয়ে দিয়েছে নিজের সেই ছবি । আর সমাজে যাঁদের পিছনে মিডিয়া ঘুরে বেড়ায়, তাঁদেরও মানবিক মুখের ছবি ভেসে ওঠে প্রতিনিয়ত, যা দেখে বাহবা দেয় সবাই । আবার এমন মানুষ আছে যাঁরা এগিয়ে এসেছে শুধু মানবিক যন্ত্রণা থেকে তাঁদের কথা কেউ জানতে পারে না । কারণ তাঁরা হৃদয়ের যন্ত্রণার মিডিয়ায় মানুষের যন্ত্রণা অনুভব করে । কেউ জানে না সে কথা । জানে তাঁরাই যাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে এই মানুষগুলো । কারণ এই সমস্ত মানুষ মানুষের জন্য কাজ করে কোনো স্বীকৃতির আশা নিয়ে নয় । প্রচারবিমুখ মানুষগুলোই প্রকৃতপক্ষে করে নিঃশব্দ মানবিক বিপ্লব । যে বিপ্লব অন্ধকারকে আলো দেয় । ‘কাজ করে যাও, ফলের আশা কর না ‘ – গীতার এই শ্লোকের এঁরাই তার প্রকৃত উদাহরণ ।

যে মানুষগুলো শুধু আলোতে থাকার জন্য অন্য মানুষের উপকার করে, তাদের চিনতে অসুবিধে হয় না । কিন্তু সেই আলোতে অন্ধকারে থাকা মানুষগুলো ক্ষণিকের জন্য হয়ে যায় বোবা । কারণ এই মানুষগুলো আলোতে থাকা মানুষদের চিনে উঠতে পারে না । কারণ তাঁরা শামুকের মতো নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে গা বাঁচাতে, কিন্তু সজাগ থাকে ক্ষিপ্র চোখে । শক্তি কবি তাই বলেছেন, ‘মানুষ যা আছে, আছে শামুকের মতন গুটিয়ে/বারান্দায়, খর চোখ খুঁজে ফেরে ক্ষিপ্র গতিবিধি…।’ আসলে এই মানুষগুলো প্রতিটি ব্যাপারেই তারা দামের কথা ভাবে । সেই দামে আচ্ছন্ন থাকে এমনভাবে যার ভিতরটা এক আর বাইরেটা আর এক । কবির কথায়—

‘দামের কথা তোমরা যারা দোকানদারি করছো ভাবো

আমার ছায়া সঙ্গে নিয়ে সকল পথেই একলা যাবো

ঘর ছেড়ে কার বাহিরে ডাক, বাহির ডাকছে ঘরের কোণে 

সব ব্যাপারেই লিপ্ত আছি আপনা-ভিতর অন্য মনে..।’

এই মানুষগুলো নিজেদের যেমন ভালো বোঝে, অন্ধকারে থাকা মানুষগুলো তেমন কি বোঝে । বুঝলেও এর উত্তর তাদের অসাধ্য । কবি তাই প্রশ্ন করেছেন, ভালো কি মানুষ চায়? শুধু এটুকু বলেই তিনি থেমে থাকেন নি । তিনি বলেছেন, কাঠ, পাথর যেমন তার ভালো বোঝে, সেভাবে কি মানুষ চায় । তাঁর কবিতার লাইন থেকে আবার বলি—

 ‘ভালো কি মানুষ চায়? ভালো চায় কাঠ ও পাথর ।

 অনেক পাথর আছে নদীতীরে, ঝর্ণার নিকটে–

জানে কার কাছে থাকলে সুখে ও শান্তিতে থাকা হতো,

থাকা হয়, সবই জানে, মানুষের মত নয় ওরা !’

আবার পরক্ষণেই ওই মানুষদের হয়ে এ কথার উত্তর দিয়েছেন কবি । বলেছেন, ‘আমি কি আর পাথর, আমায় লাগাবে একটুতে?/মানুষ আমি, কী মনে হয়? মানুষ সহ্য করে..’

সহ্য করতে করতে একদিন মানুষগুলো অপেক্ষা করে মৃত্যুর । সেই অপেক্ষা কবির ভাষাতে, ‘আবার জীবন এসে শুয়ে পড়বে সেই একই খাটে/ মৃত্যুর অপেক্ষা করবে, কিংবা কিছু আমলকি কুড়িয়ে/ যাবে বাড়ি…।’

এভাবেই জীবন মৃত্যুর মধ্যে অন্ধকারে থাকা মানুষগুলোর ছোটাছুটি । যেখানে কেউ চলে যায় আবার কেউ পড়ে থাকে সন্ত্রস্ত হয়ে । 

‘চলেছে প্রতিদিন এই চলচ্ছবি, জীবনমৃত্যুর–

কাঁধে কাঁধে দিয়ে এই ছোটাছুটি বাহিরে ও ঘরে-

কখন কাহারে মনে পড়ে, তার যদি মনে পড়ে?

যেতে হয়, কেউ চলে যায় ।

 যারা পড়ে থাকে

তাদের সন্ত্রস্ত করে রাখে—

এই যাওয়া, এই চলে যাওয়া..।’

এভাবেই জীবন মৃত্যুর পথে বেঁচে থাকে মানুষ । কেউ সেখানে বাঁচে একা, কেউবা শুধুই ভিড়ে । কবি বলেছেন এই বেঁচে থাকার জন্যই সে বাঁচে । সেই বাঁচার জন্য সে কাঁদে । কবি আবারো বললেন—

‘তবুও মানুষ বাঁচে, মৃত্যু আছে বলে বেঁচে থাকে

মৃত্যু তো জীবন নয়, ধারাবাহিকতা নয় কোনো

ভিড়ে বাঁচে, একা বাঁচে, মানুষের সমভিব্যাহারে

বাঁচে, বেঁচে থাকে–এই বাঁচতে হবে বলে থাকে বেঁচে—

মানুষ যেভাবে কাঁদে…..’

না, মানুষ আজ সেভাবে কাঁদে না । হয়তো বা কাঁদে । আমরা দেখতে পাই না । দেখতে পাই মানুষ আজও বাঁচার তাগিদে খাবার খুঁজে বেড়ায় শ্মশানে কিংবা ডাস্টবিনে । লকডাউন চলাকালীন সেই ছবি ফুটে উঠেছিল পথে পথে । অথচ অভুক্ত মানুষগুলো কোনো দোষ ছিল না । মানুষের বাঁচার জন্য এই ছবির করুণ দৃশ্যে মানুষের চোখে জল আসে না । কিন্তু অসহায় মানুষগুলোর ভিতরের কান্না দেখতে পেয়েছিলেন কবি । তাদের এই কান্না মানুষের জন্যই তাও তিনি দেখছিলেন । সেই মানুষগুলোর পাশে মানুষকেই দাঁড়াতে আহ্বান করলেন—- 

‘মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাড়াও

মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মতো পাশে দাড়াও

মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও ।’ 

‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’– শক্তি চট্টোপাধ্যায়

3 thoughts on “বই আলোচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *