শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে  তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ’ উপন্যাস।)

মনের জ্বালা কারে কইরে সই

       বাস করি নিজের ভিটেয় 

       দ্যাশ আঁর কই

ঘুমের মধ্যেই আঁর হৌড়ি মণিবালা কাঁদি কাটি একসার। কোন দুনিয়ার কথা মনে হইড়ছে কে জানে। হেথেনের হৌড় হরকালে গেছে দিন তো কম হয় নি। পাঁচ হোলামাইয়ার মা হই গেছেন।  সংসারের ভার সামলাইতে দিন যাইত। কে কার দিকে নজর দিব। দুই জা আর ওগো সন্তানাদি লই বিরাট সংসার। হুরান বাড়ির জ্ঞাতিগুষ্টি ছাড়ি আই নতুন বাড়িতে উইঠছে। চোয়ের সামনে বিশ কানি জমির উপরে বড় পুকুর কাটা হইল। হুইরের মাটি দিই বাড়ির ভিটা হইল।  চাই চাই দেইখল দূর তুন। মনের মধ্যে কত চিন্তা আই বাসা বাঁধে। এই বাড়ি বই দেয়া যায় ওই মাঠটা ক্যামনে ক্যামনে বাড়ি হই যার, দুনিয়াটা এইভাবেই যেন বাড়ে কমে। হোটলা হোটলি লই এক বাড়ি তুন অন্য বাড়ি যাইবার লাই তোড়জোড়। ভেতরটা তো ভাঙি যার, কেউ কী দেয়ের নাকি। হায় হায় রে এমন ভাগাভাগি কী হরানে সয়! এই ওরে গলায় জড়াই ধরে, কত দিনের সুখ দুঃখের কথা কয়। শুইছে, বইছে, এক চুলায় রান্না কইরছে, নিজের বাড়িঘর বলি বড় গলায় হরিচয় দিছে। হক্কলে সমীহ করি বড় বাড়ির বউ বলি সম্মান দিছে। কীইবা করার আছে, সংসার বড় হইলে গায়ে গা লাগাই ক্যামনেই বা থাইকব। তবুও ভেতরটা আনচান কইরলে হুরা বাড়িটা দু’এক পাক ঘুরি আই মন জুড়ায়। এই ঘর ওই ঘরের লগে গা ঘেঁষাঘেষি করে। কত দিনের কত গন্ধ নাকে ভাসে। ইচ্ছা করে সেগুন কাঠের দরজাগাইন খুলে আর বন্ধ করে। খাটের মধ্যে দুই চাইরবার গড়াই লয়। যদি সম্ভব হইত হুরা ঘরখান উডাই নতুন বাড়িতে লই যাইত। হেথেনেরা তো আর ভোজবাজি জানে না। পাঁচ ছয় হুরুষের বাড়ি। কেন্নে কেন্নে এই বাড়ি হইছে হেইডাও তো জানে না। হেইদিন হেথাগো এইরকমই কষ্ট হইছিল। কনডাই যে হক্কলে চলি গেল। কত হুরুষ যে নিশ্চিহ্ন হই গেল, কেউ জানে না। কোনও একখান ছবিও নাই যে দেই দেই প্রণাম কইরব, খালি বাঁশের চোঙায় অস্তি হড়ি আছে সারি সারি। নতুন বাড়িতে তো হেথারা  লই যাইতও দিত ন। কয়েক যুগ আগে আরও কয়েক জ্ঞাতিরা আর এক বাড়ি বানাই উঢি চলি গেছে। লতায় পাতায় হ্যাঁচাই যে আছে কারও এত তাগিদ নাই যে আঁশ ছাড়াই সম্পর্কখান খুঁজি বার কইরব। হাশ দিই চলি যায়, মুয়ের দিকে তাকায় না। অত হুরুষ বাদে অসঝ হালন করার নিয়মও নাই, এককালে যে শোক দুঃখে হেথাগো পূর্ব হুরুষরা যে চোয়ের জল হালাইত হেইঢাও অন টের হাওন যায় না। এতদিন হরে ফের আর এক পিড়ি গাঁট ছাড়ি চলি যার, তাতে কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ আছে! সংসার বুইঝঝেননি বড় নিষ্ঠুর, হয়োজন হুরাইল তো হিছন হিরে তাকায় না।  ভালোবাসি কয়জনা আর টানি ধরে, চোয়ের জল ঝরায়। এই মাটি, এই বেড়া, এই শাল গাছের খুঁটি, দেইখতে দেইখতে টিনের চাল, লোহার শিক দিই জানালা, ঘর হই যায়, কাঠের চই কোনায় কোনায়। বড় বাড়ি তুন দেয়া যায় যেন দক্ষযজ্ঞ চইলছে। মন কি চায় যাইবার লাই, কিন্তু যাইত তো হইব।

স্বপনটা ভাঙি যায় আঁর হৌড়ি হাত পা ছোড়ে। বুইঝত হারেন না কনডাই আছে, বড় বাড়িতে না নতুন বাড়িতে। এত সময় গেছে, এই ঘরটারে মনের লগে জুইড়ত হারে ন । বিছানায় হুই মনে করে বড় বাড়িতে হুই আছে। আসল কথা হইল এই ঘরের মধ্যেই যে নিজেরে বন্দী করি রাইখতে রাইখতে চৌকাঠ হর্যন্ত সীমানারে ভাবে নিজের জীবন, ভরাট জীবন। তাহাই দেখে নাতিপুতির চোখ দিই দেখে। সত্য মিথ্যা যা বোঝায়, তারে লই ভাবনা চিন্তারে চটকায়, আর খালি হুরান জীবনেরে আঁকড়াই ধরে। বড় বাড়ির বউঝিরে নাম ধরি ডাকি সুখ দুঃখের কথা কয়। এই লই নাতিরা হাসাহাসি কইরলে বাড়ির হক্কলে কয়, ‘ওনারে কইতে দে, বুইঝত হারস না মনের জ্বালাখান তো জুড়ায়, বাঁচি থাওনের রসদ তো হায়।’ কেন্নে কেন্নে হেথেনে গান্ধী বাবার কথা মনে তো রাইখছে। ওনারে যে নাথুরাম গুলি করি মাইরছে সে কথাখান বেমালুম ভুলি গেছে, ভাবে উনি অনও হাঁঢি চলি গোটা ভারত ঘুরি বেড়ায়। দ্যাশটা যে ভাগ হইছে, সেই শোধও নাই। কারোরে যে ডাকি জিগাইব, মনের সেই ইচ্ছাখানও হারাই ফেইলছে। এইরকম জীবন নিজের ইচ্ছায় কিনা জানে না কেউ, জিগাই কোনও সদুত্তর মিলে না, বেশি কথা কইলে ঝাঁঝাই ওঠে। এখনও কয় ভারত কত বড় দ্যাশ, এমন দ্যাশ বিশ্ব ভ্রমান্ডে আছে নি।  নাতি নাতনিদের কাছে টানি আদর করি চুমা দেয়। কেনডে হেথেনে ভুলি যাইত হারে কার্জন সাহেব বাংলা ভাগ কইরত চাইলে মাইনষের ভিতরে নাকি আগুনের ফুলকি উঢি ছড়াই হইড়েছিল জনে জনে। হেথেনে অনও ভুইলত হারে না। গুন গুন করি গায় কবিগুরুর লেয়া গান – বাংলার মাটি, বাংলার জল/বাংলার বায়ু, বাংলার ফল/ পুণ্য হউক পুণ্য হউক/পুণ্য হউক হে ভগবান। আঁর হৌড়ি গান গাইতে গাইতে চৌয়ের পানি ঝরায়। কার্জন সাহেব নাকি লম্বা চওড়া বক্তিমা মেরে   পূব বাংলার মুসলমানদের মনে বিষ ঢুকাই দিছিল – কইলকাতায় যত উন্নতি হইছে ভাগাভাগি হইলে মুসলমানরা  সংখ্যাগরিষ্ঠ হইব এই বাংলায়, সুখের সাগরে ভাইসব, যা হেথেনরা এতকাল হায় ন। হের তুন হইতেই তো  মুসলমানদের মনের মধ্যে বঞ্চণার বীজ পুঁতি দিই চলি গেল যা অন শক্তপোক্ত গাছ হই ডালপালা মেইলছে, দ্যাশটা ভাগও হইল আর ইংরেজদের ইচ্ছাপূরণও হইল। আসলে  বাঙালি জাত এক থাইকলে ইংরেজদের অত্যাচার কইরতে অসুবিধা হইব, হেথেরা ভালা করি জানে। আঁর হড়ালেখা না জানা হৌড়ি বুইঝত হাইরল, দ্যাশের মাইনষে বুইঝল না। অন দেইখলে কেই বা বুইঝব হেই মানুষটা অন্ধকারে এক কোনায় হড়ি থাইকতে ভালোবাসে, হক্কল কিছু তুন নিজেরে আলাদা করি রাইখছে, ইচ্ছা করি, না এই হরিবর্তনটা মাইনত হারেন না, কে কইব। মাঝেমধ্যে আঁই তো খোঁচাই। রাগিমাগি যায়। এত রাগ মাইনষের লগে মাইনষের হয়। কেন্নে কেন্নে হুইনছে কত কথা। রবি ঠাকুরের ছবিখান ঝোলানো আছে আঙ্গ বড় ঘরে। সকাল হইলে এক চিলতে রোদ আই হড়ে লেপাপোছা মাঢির মেঝেতে।  হেথেনরে টানি আনি চেয়ারের উপরে বসাইলে হেই রোদ ছিটকাই আই হড়ে আঁর হৌড়ির দুই পায়ের হাতায়। চোখ চলি যায় হেই হটোর দিকে, গুনগুনাই উডে, এই বুড়া বয়সেও গলার সুর আছে বেঢির – ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে, মোদের ততই বাঁধা টুটবে।’ কনডাই হুইনছেন মা এই গান। ‘ মনে কি আর আছে রে মা। কত কথাই তো হুইনছি। থাই থাই মনে হড়ে।’ আসলে কি হইছে, সুযোগ হাইলেই হেথেনে সময়েরে আঁকড়াই ধরি বাঁইচত চায়। অনের জগতটারে মনের তুন অস্বীকার করে। তবু আই কি মুখ হিরায় চান না একবার, দেইখবেন ভাল লাইগব।

‘বৌ হুইনছতি বঙ্গভঙ্গ হইলে পূর্ব বঙ্গের মুসলমান চাষাভুষা মানুষ খুশিতে ডগমগ হইছিল। কেন হেথাগো মনে এত আনন্দ এর সারমর্ম বুইঝতে আঁর সময় লাইগছে। নিজের মনেরে জিগাইলাম ভাগাভাগি হইলে এত নাচানাচিই বা করে ক্যান! একই জাতের লগে মন কষাকষি করি মাইনষে কি টিকি থাইকতে হাইরবনি।’ মা আমনের বুদ্ধিখানের তারিফ না করি তো হারিয়েন না। হরাধিন দ্যাশের জ্বালাপোড়া হেই কবে তুন দ্যাশের মাইনষের শরীলে ঘা হই পুঁজ গলি গলি হড়ের। ‘সে আর বইলতে। ভাঙন যে ধরি গেছে হেই ভাব কেন্নে টের হাইলাম জানস, হুরাডা আঁরে বুঝাইছিল হজরত মিঞা। যুক্তিডা অস্বীকার করিইবা ক্যামনে, আঙ্গ গায়ে তো থুতু হড়ের। হেগুনে ভেতরে ভেতরে হুঁশের। কয় কি জানস, কইলকাতা শহরে কত কিছু হইছে, আঙ্গ হিয়ানে কি হইছে! আঙ্গ হোলামাইয়াগুনের কী দশা হইব কন চাই। মুসলমানদের উন্নতির লাই আমনেরা ক ভাবি দেইখছেন? হেই তো কত পিড়ি ধরি আমনেগো জমিতে চাষবাস করি খাই। এইভাবে আর কদ্দিন চইলব, নিজের হায়ে কোনোদিন দাঁড়াইতাম হাইরতাম ন। জিগাইলাম তুমি এত জ্ঞানের কথা কনতুন শিখছ। বইলল, জমায়েত তুন হুইনছি। হোনেনন বুঝি আঙ্গ মোসলমানদের নতুন দল হইছে মুসলিম লীগ। নেতারা আরও কত কথা কইছে। কার্জন সাহেব কইছে বাংলা ভাগ হইলে মুসলমানেরা সুখের মুখ দেইখব। বুইঝলাম মনের মধ্যে সাহেবরা ইচ্ছা করি বিষ ঢুকাই দিছে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে শত্রুতামি লাগাই দিছে। এইবার আগুন লাইগব। কানে আইছে স্বদেশীরা বিলিতি কাপরজামা হোড়াইতে শুরু করি দিছে। হেথাগো কিছুই আর ব্যবহার না কইরবার লাই হচার করের। কইলকাতা গেছিল আঁর ভাশুর।’ আমনে তো কম যান না মা। ‘এমন কতা কইস না, যেইটুক শিখছি, বেগ্গাইন তো হুনি হুনি, না হয় কে আর আঙ্গরে শিখাইব। ভাশুর আঁর কত গপ্পই না করে, কতক বুঝি কতক বুঝি না। জগৎ সংসারে আঁই এমনিই আবোধা এই সকল কথার উত্তর কেমনে দিমু জানি না। কবিগুরু কইলকাতায় হিন্দু-মুসলমান হকলরে লই রাখিবন্ধন উচ্ছব পালন কইরছে, হক্কলে রাতে মিলমিশ করি থাইকত হারে। কত মিছিল নাকি হইছে, সভা সমাবেশ হইছে, পথ চইলতে চইলতে গানও গাইছে  আঁর ভাশুরও ওই দলে যোগ দিছে, হিন্দু মুসলমান মিলি রাখি হইরছে। এমন মিলনের কথা তো কস্মিনকালেও হুনিন। কইলকাতায় কত আজব কাণ্ডই না ঘটে। কবিগুরু উপদেশ দিছে – জমিদার প্রজাদের, গ্ৰামের প্রধান গ্ৰামের লোকদের, ইস্কুলের হোলারা হেথাগো বাড়ির পাশের লোকদের এই উচ্ছবের কথা বুঝাই কইব। এইসব দেইহুনি হেথেনের তো রোমকূপ খাড়া হই গেছে, দ্যাশে হিরি জনে জনে দুগাল ভরি মনের মাধুরী মিশাই এমন করি কয়, হক্কলে হুনি তো আকাশ তুন হড়ে। হরাধিন মানুষরে আরও হরাধিন কইরবার লাই ইংরেজ সরকার কত ফন্দিই না আঁটে।’ 

সকালে ঘুম তুন উডি আঁর হৌড়ি কি যেন বিড়বিড় করের। ঠাউর নমষ্কার কইরত ভুলি গেছে। এইরকম বেবোলা হইতে কোনোদিন দেই ন । স্বরাজ স্বরাজ কই এক ঘোরের মধ্যে চলি গেল। শব্দটাতে যেন কত মায়া, কত না স্বপ্ন চোয়েমুয়ে খেলি বেড়ার। নিজেরে ধরি রাইখত চায় ওই সময়টাকে ঘিরে। কিন্তু হাইব কই। কারও লাই বই তো থায় না সময়, ঘটনার ধাক্কায় ধাক্কায় ঠেলি ঠেলি আঙ্গরে কন্নাই লই চলি যায়, কে কইব। আঁর হৌড়ির কি মাথা খারাপ হই গেছে, দিন দিন কেমন হাগলের মতো বকের। ‘আঁরে হাগল কচের, তোরা নিজেরাও কি কম হাগল। ঘরবাড়ি টুকরো টাকরা হইলে ভিতরটা ফালা ফালা হই যার, আর দ্যাশের মাইনষের মন  ভাঙি গেলে হেইডা তো আগুনে ঘি ঢালনের মতোই দাউ দাউ করি জ্বলের।’ কথাখান আঁর হৌড়ি খারাপ কয় ন। খাঁ খাঁ করি উইঠলে এমন কথা বার হই আইয়ে। তারা ভুক্তভোগী তারাই টের হায়। ‘টের তো আঁই হাইছি রে, হকল কথার অর্থ ধইরতাম হারি ন। কেউ কইছিল ‘স্বদেশ বান্ধব’, কেউ আবার কইছিল ‘ব্রতী’, ঢাকার ‘অনুশীলন সমিতি’, কইলকাতার ‘যুগান্তর’-এর কথা তো গ্ৰামের মানুষ মুখস্ত করি হালাইছিল। আঁর ভাশুর অরবিন্দের গপ্প হুনাইল। তিনি কইতে লাইগলেন রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা। হেই কথার মাথামুণ্ড আঁর মগজে কিছুই ঢুইকল না।’ আঁর হৌড়ি একবার কথা শুরু কইরলে আর থাইমতে চায় না। দ্যাশ দ্যাশ করিই গেল, খানাদানা সব ভুলি যায়। ওমা দেই কারও ধরন ছাড়াই চকির তুন নামি ধপাস করি মাডিতে বই হড়ে। কথার জোর যে শরীলরে চাগাই তোলে, কথার হিঠে কথার জন্ম হয়, ভুলি যাওনের ভয়ে শব্দগুনরে ছুড়ি ছুড়ি মারে। যেদিকে যেমন খুশি যাইব, তাইতে তেনার কী আসে যায়, কথাতেই তো সুখ, সময় আর ভাবের অনুভব তো আর কোনদিন হিরি আইত ন। হরের কথাটা কয় ‘ মানিকতলার বোমা,  বারীন ঘোষ,কানাইলাল’। স্মৃতিতে ডুব মারে, আর কি কিছু মনে থায়। ‘গলাখান হুয়াই গেছে, এক গেলাস জল দে’। ঢক ঢক করি গিলি খায়। দেই তো আঁই অবাক। এত তৃষ্ণা লাইগছে ব্যাডির।

‘বুইঝসনি বউ, তোরা যতই কস আঁই তো ভারতেই আছি।  কোনও উত্তর তো খুঁজি হাই না দ্যাশটা এক থাওনের লাই এত কেন লড়াই হইল, মারামারি, হাতাহাতি, ভাঙ্গভাঙ্গি কোনটা বাদ রইল! কেউ জুইড়বার লাই লড়াই করে, আর কেউ কয় আমরা এক থাইকতাম চাই না।’ মাইনষের মনের হদিশ ক্যামনে খুঁজি হাইয়ুম। কেউ এমুই যায় তো আর এক দল অন্য মুই ছোটে। ‘ নারে বউ কী বেজার মুখ করি আলমপুরের মাইনষে পিছপা হইছিল কী কমু! হাতির পাঁচ পা দেইখছিল ভাগাভাগির সময়, ফের জোড়া লাইগলে মন তুন মাইনত হারে ন। মুসলমানদের মনে ফুলার সাহেব বিষ ঢুকাই দিছিল। হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই এই কথা তন আর কেউ বিশ্বাস করে ন। এমন অবস্থা হইছিল এ ওর ছায়া মাড়াইত চাইত না, অন্য দিকে ঘুরি চলি যাইত। ইন্তেকাব মিঞা কইত আমাগোরে দোষ দিয়া আর কী লাভ, মুসলিম লীগ কইতে আছে, মুসলমানের লাই একটা প্রদেশ চাই, বাংলা আসাম প্রদেশ হয়োনে হক্কলের মনে খুশির জোয়ার আইছিল, এক্ষণ দেয়েন না কেমন ভ্যাদা মারি গেছে, বাজ ভাঙ্গি হইড়ছে বেগ্গুনের মাথার উপরে, ফের এক হই যাওনে মুসলমানরা বুক চাপড়ার। আঁই জিগাইলাম তোমরা কী হিন্দুদের লগে এক থাইকতে চাও না। হে কয় একবার মন চিড়  ধইরছে, আঁই জানি না, কন্নাই যাই থাইমব। দিদি আমনেগো লগে তো আঙ্গ কোনো শত্রুতামি নাই, কিন্তু হিন্দু জমিদাররা আঙ্গরে মানুষ বলি জ্ঞান করেন এতকাল। দ্যাশের নেতারা যে দিকে চইলতে কইব, সেদিকেও আমরা চইলব, মৌলবী ইমামরাই তো কয় এই দ্যাশরে একদিন না একদিন মুসলিমদের দ্যাশ বানাইব। কংগ্ৰেস আঙ্গ লগে নাকি সুবিচার করে ন। ইংরেজরাও আঙ্গরে কাঁচকলা দেখাইছে, আঙ্গ মুসলমানদের লাই আলাদা প্রদেশ বানাই ফির জুড়ি দিছে, এইডা তো সরকার ঠিক করে ন। আঁই কইলাম, তাইলে আমাগো দ্যাশ কোনডা হইব? হে কয়, এই কথাখানের উত্তর আঁর কাছে নাই। ইন্তেকাব কলেরা হই মরি গেছে, গ্ৰাম কে গ্ৰাম মরি  ছারখার হই গেছে, আঁইও তো যমের দুয়ারে চলি গেছিলাম, কোনপ্রকারে ঈশ্বরের কৃপায় বাঁচি গেছি। বউ তোরা বুইঝত ন কী দশায় ছিলাম আমরা, ডাক্তার বদ্যি নাই, ঔষুধ পথ্যি নাই, ঘরে ঘরে কান্দন, আঁর দেওর ননদ লই আঙ্গ বাড়ির ছজন, বড় বাড়ির পাঁচজন কাতরাই কাতরাই হরান দিল। মাইনষে বুইঝল না, খালি ধর্মের নাম করি আলাদা হইত চায়।’ ওমা তাইলে হেই সময়েই দ্যাশ ভাগের বীজ হোঁতা হই গেছিল! হরের ভাগাভাগি হুরান ভাগেরই জের। ‘কী কছ ইগাইন তুই বউ, হরে আবার কবে দ্যাশ ভাগ হইল?’ হেইডা আমনে বুইঝবেন না মা। ‘ কী বুইঝতাম ন, তুই ভালা করি ক না। আঁর তো ভালা করি মনে আছে আঁর ভাশুর দেই আইছে কইলকাতার মাইনষের রাস্তাঘাটে নাকি হক্কলের মুয়ে মুয়ে ফেরে ‘বন্দেমাতরম’, কার জানি লেয়া?’ ‘বঙ্কিমচন্দ্র লিখছে’ ‘ বরিশালে ওই গান গাইছে বলে ইংরেজের হুলিশ কী মারটাই না মাইরছে’ আমনের এতগাইন কেন্নে মনে আছে? ‘ জীবনের কত উডাহড়া, কত আর মনে আছে, ভুলি গেছি রে মা। অন যাইবার সময় হইছে, কোয়াল ভালা দ্যাশটা ভাগ হওয়ার তুন বাঁচি গেছে।’ আঁর মাইয়া মুখ খোলে, ‘কী কও ঠাম্মা?’ আরে মাইয়া চুপ কর, হেথেনরা আর স্মরণ করাইছ না, সময়টা চাপা হড়ি আছে, হড়ি থাইকতে দে। ‘ আরে তোরা মা মাইয়া কী বলাবলি করছ, আরে হুনাই ক।’ 

আঁর হৌড়ি তো চুপ করি থাওনের মানুষ না। কথার পর কথা উথলাই উঠে জল গরম হইলে যেমনটা হয় তেমন। জালিয়ানওয়ালাবাগের কথা উইঠলে দুঃখে শরীল হাঁডি যায়। চোখ দিই জল হড়ে আর বিলাপ করে। ‘হায় হায় রে মানুষগুনেরে গরু ছাগলের মতো মাইরছে। হেথাগো হরানে কোনো মায়াদয়া নাই। ব্রিটিশের বেডারা মাইনষের বাচ্চা না অন্য কেউ, কে জানে,  পাগলা কুত্তার মতো ঘেউ ঘেউ করি কামড়ায়। প্রতিবাদ হইছিল, হিন্দু মুসলমান হক্কলেরে লই অসহযোগ আন্দোলন হুরা ভারত ছড়াই গেছিল। শেষমেশ গান্ধীর কথা মাইনষে হোনে ন, হিংসা হইছে। কেনই বা হইত ন, শয়ে শয়ে মানুষ মইরছে, সাধু সাজা কী উচিত হইব।’ সময় তো আর থামি রয় ন, নিজের মতো আগাই আইছে। কত ঘটনা দ্যাশের বুকে ঘটি গেছে, কেউ আর কইত হাইরব নি, মনের ভেতরে আটকাই রইছে, নতুন আই হুরানেরে ধাক্কাই হালাই দিছে। ‘কথাখান তুই ভুল বলস ন। দেশবন্ধু হুইনছিলাম চেষ্টা কইরছে শের-ই-বাংলারে একলগে লই। মাষ্টারদা সূর্যসেনের কথা ভুলি যাওন যায় নি। গ্ৰাম গঞ্জের মাইনষে এককারে অস্থির হই গেছে। কী অত্যাচারটাই না কইরছে। অমানুষরা ফাঁসি তো দিল, মরা মানুষটাকে বঙ্গোপসাগরের জলে ভাসাই দিছে। হেই লই কম দুঃখ তো হায় নি দ্যাশের লোক, ডুকরাই ডুকরাই কাঁইদছে। হরাধিন দ্যাশের এর তুন ভালা ক্যামনে হইব। এর হরের কথা আঁর আর স্মরণে নাই। কেউ আর কয়ও ন। কে আর কইব। কইলকাতা আর চাঁটগায় হুলিশের গুলি খাই মরি গেল আঙ্গ বাড়ির স্বদেশীরা। অন তো আঁই বুড়া হই গেছি। উপরের তুন খবর হইলে ড্যাং ড্যাং করি চলি যাইয়ুম।’ হকলটা আর কথার কথা নি। কথার মধ্যেও তো কত কথা ঘুমাই থায়। আঁর মাইয়া ফোঁপাই ফোঁপাই কাঁদে। বলি কাঁদছ ক্যান। তোর ঠাম্মা কি অনই চলি যার। বুড়া হইলে মাইনষের মনের মধ্যে মরার চিন্তা আয়ে। একপা থায় মর্তে আর এক পা থায় যমরাজের ঘরে। তন মনে হয় বেবাক গল্পের জীবনটাকে জাপটাই ধরি।  আর হক্কলটা আই যদি জীবনের লগে মিশি যায় তাইলে তো কথাই নাই। দুঃখে দুঃখে হরান যায়। মায়ার বাঁধন আলগা হইবার ভয় আই সামনে যন   খাড়ায়, এতকাইলের হিসাব নিকাশ বেগ্গাইন উল্টাপাল্টা হই যায়। তোর ঠাম্মা আঁরে হোনাই কিয়ের লাই জানস নি, স্মৃতিভ্রম হইবার আগে ভাবনার মালা গাঁথি রাইখত চায়। আঙ্গরে জোড়া লাগাইত চায়। বাইরের উডানে কলাবাগানে কলার ভারে কলাগাছগুন নোয়াই হইড়ছে, হেইদিগেই কোনো কথা না কই চাই থায়। মিনমিন করি কয়, ‘বউ, এই রোদের তাপ আর ভালা লাগের না, আঁরে ঘরে দিই আয়। কত ফল তো ফলাইছি, অন তো নইড়ত চইড়ত হারি না, মাজাখান বাঁকি গেছে, বেশি কথা কইতাম গেলে দম আটকাই আয়ে। বুড়া মাইনষের বেশিদিন বাঁচা উচিত ন। একখান কথা কই, আঁই মইরলে আঁর হোলারে কইচ যেন তোর হৌড়ের মঠের হাশে আঁরে হোড়ায়, আঙ্গ বাড়ির হরমুল দিই যেন মুখাগ্নি করে, গাছের কাঠ দিই জ্বালায়। আঁর চিতার আগুন আর ধোঁয়া আঙ্গ বাড়ির চাইরদিক ঘুরি ঘুরি উপরের দিকে উডি যাইব, উইড়তে উইড়তে ভগবানের হায়ের কাছে আছাড় খাই হইড়ব।’ হ্যাঁগো মা, আমনের যা মনে হায় কইতে আছেন, আমনের নাতি হুতি কথাগাইন তো হোনের, কী ভাইবব কন না। আঁর কথা হুনি হেথেনের চোখ ছলছল করি উডে। শোক সামলাইবার লাই এক গ্লাস জল চায়। কয় কত কথা, ‘আঙ্গ দ্যাশ কত বড় দ্যাশ, চৈতন্যের দ্যাশেই আঁই মরুম।’ গান ধরে –

        এ পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে

        সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে;

        সেই নগদ তলব তাগিদপত্র নেমে আসবে যবে।।

        আমার যখন মহাঘুমে বুজিবে দুই চোখ

        পাড়াপড়শি প্রতিবেশী পাবে কিছু শোক;

        শেষে আমি যে এই পৃথিবীর লোক 

         ভুলে যাবে সবে।।

এই আগুন নিভত ন, ক্যামনে নিভব। লকলক করি যে আগুন ওঠে সহজে কী বুজানো যায়। নিজের রাজত্ব কায়েম কইরব বলেই না মাইনষের পাগলামি যন ছড়াই ছিটায় যায়, কে কইত হারে, কনমুই ছুইটব। এই এক আজব দুনিয়া, চাওন পাওনের হিশাব কইষতেই দিন কাবার করে, কী হাইব, কতটা হাইব, কে জানে। খালি কয় আঁর আত্মার আত্মীয়, হেগুনেরে লই দল ভারি কইরতাম হাইরলেই দুনিয়া জয় করি হালাইয়ুম। ‘মার মার কাট কাট করি দা’র এক কোপে ধড় তুন মুণ্ড আলাদা করি দিমু। বেজাতের মাইয়া গুলারে শাদি করুম, ইজ্জত লই খেলা করুম। কী আনন্দ ! দ্যাশ তুন তাড়াই ছাড়ুম।’ কারা এই দলে নাম লেখাইছে? হেছন তুন উস্কানি দের এইসব কুকামে, আঙ্গ গ্ৰামের লোক জাইনত হারে না, বুইঝত হারে না।

আঁর হৌড়ি ইগাইন বিশ্বাসও করে না। মনের ঘরে হোকা বাসা না বাঁধাই মঙ্গল। ভাবের ঘরে চুরি না করলেই নিজের জগতে ডুব দিই থাকন যায়। কত নতুন নতুন ঘটনা আঙ্গ দ্যাশে ঘটি যার, জমিজোত ভাঙ্গি একসার হর, রাস্তাঘাট, বাড়িঘরদোর দোকানপাটের চেহারা সুরত হাল্টি যার, মাইনষের মনের ভাব হাল্টাইত ন, হেইডা আবার হয় নি! আঁর হৌড়ির চারধারে কত লম্বা লম্বা গাছ, ছায়ারা  দিনে রাইতে ভাঙ্গিচুরি যায়, হোলামাইয়াগুন গোল্লাছুট, ডাংগুলি, হাডুডু খেলি বেড়ায়, ঘরে মন্দিরে শাঁখ বাজে, জেলেরা জাল হালাই হুইরে মাছ ধরে, চুলার কাছে রাঁধাবাড়ার ছ্যাঁৎ ছুঁত শব্দ, ছুটকিয়াগুন ভেটকায়, কাঁদি ভাসায়, কত আবদার করে, বৌঝিরা গালগপ্পো হাড়ে, কুত্তাগুন ঘেউ ঘেউ করি ডাকে, ধানের পালার গন্ধ, খড়ের গাদার ছড়াছড়ি, এই যেন এক মায়া,  সংসারের এমন মায়ায় জড়াই  শুই বসি থায় আঁর হৌড়ি। ইয়ার তুন বেশি কিছু হেথেনে জানে না, হুইনতেও চায় না। জাতপাত লই এত কানাকানি দলাদলি হানাহানি হেথেনের মাথায় যে ঢুকাইব হেই অবসর কন্নাই। দ্যাশের মাইনষে বোঝে দ্যাশ আগাইব, আঁর হৌড়িরা হিছাইব, হিগাইন ভালা না মন্দ আঁই জানি না, হেইডা বুঝি সময়ের চক্করে দরজা জানালাগাইন বন্ধ রাইখলে খারাপ না, বিষাক্ত ধোঁয়া ঘরে ঢুইকত হারে না, তন মন দুইডাই ভালা থায়, যেমন আঁর হৌড়ির ভালা আছে। আঁর হৌড়িদের জগৎ অন্ধকার, আঙ্গ জগতে আলো, হত্যেক দিন ভালামন্দ খবর যায় আর আইয়ের, কারা বানার খবর, কারা আঙ্গরে হোনাই আহ্লাদে আটখানা হয়, বুঝি না। তবে এইডা বুঝি ওরা খবর বেচে, কারও হয় লাভ, কারও হয় লোকসান, আঙ্গ দ্যাশখান দখল করার লাই হেথাগো কারসাজির অন্ত নাই। আইজকাল আবার এক নতুন চিন্তা আই কুঁরি কুঁরি খার, দ্যাশের মাইনষে আঙ্গরে নিজের মানুষ ভাবে তো? বড় শক্ত প্রশ্ন, কিন্তু হাঁচা উত্তর দিবার মতো কোনো লোক নাই। আঁই হিন্দুর ঘরের বউ, বাজার যাওন মানা। কিন্তু লবন তেল মশলা ছাড়া আর কদ্দিন চইলব, ঘরে তো কোনো হুরুষ মানুষ নাই। হৌড়ি সাবধান করে ‘পঞ্চমী তুই বাজারের দিকে হা বাড়াস না, দুই দিন বাদে আঁর হোলা শহর তুন আইলে কেনাকাটি করি দিব, না হয় তদ্দিন আতেলাই রাঁধ।’ এইটা কি একখান কথার কথা হইল, মা। মাইয়াডার মুয়ে ক্যামনে আলুনী খানা তুলি দিমু কন চাই। গ্ৰামের হাটে বাজারে হিন্দুর ঘরের বউরে ঘোমটা মাথায় দেই মুরুব্বীগোছের কেউ ট্যারা চোয়ে চায়। দুই-চারখান হিন্দুর দোকান ছিল, হেথেনরাও টোনটিটকারী মাইরতে ছাড়ে না। কেউ কেউ কয়, ‘এই আবার ক্যামন বেশরমের বেআক্কেলে কাণ্ড। মাইয়া মাইনষে হাট বাজার কইরত আইব।’ রাজিয়ার বাপ দেই আঁরে চিনি হালাইছে – ‘দিদি, আমনে তো আঁরেও কইতে হাইরতেন, আঁই তো কামে কাজে আমনেগো বাড়ি যাই।’ নিজের হআতরত থাইখতে তোমারে বিরক্ত কইরতাম কিয়ের লাই। ‘এইডা একখান কথার কথা হইল দিদি।’ রাজিয়ার বাপই শেষে কিনিকাডি দিল। মনে মনে ভাইবলাম দ্যাশ নয় একদিন পশ্চিমাদের কাছে তুন স্বাধীন হইব, কিন্তু মাইয়ামানুষ কবে হুরুষ মানুষ তুন স্বাধীন হইব।

আঁর হৌড়ির মনডা কদ্দিন ধরি খারাপ। খালি দোম মারি আছে। কথা কইলে উত্তর দেয় না, ঝাঁঝাঁই উডে। জিগাইলে কয় ‘তোরা আঁর দুঃখের কী বুঝবি?’ কত কারনেই হেথেনের দুঃখ হয়। দুঃখের বোঝা ভার হই গেলে আর নিজে নিজে সইতে হারে না। তন নিজের শরীরটাকে ঝাঁকাই উডি বসি হড়ে চকি তুন লম্বা টুলের উপরে। হালকা হইত চায়। শরীল হালকা হইতে চাইলেও মন কি হালকা হইত হারে। তন তো হাঁউমাউ করি কাঁদে। এই কাঁদা কোন ঘটনার লাই কে জানে। হেথেনে নিজেও কি জানে? কি জানি কোনোও সুখের ঘটনার জের আর শোকের মুহূর্তের লগে একসাথ হই এমন একটা ভাব আই হাজির হইছে কিনা, নিজে ছুঁইতেও হারেন না, ধইরতেও হারেন না, হিয়ের লাই তো এত যন্তন্না, কইতেও হারেন না, বুঝাইতেও হারেন না। হাগলের মতো লেংচাই লেংচাই হাঁডে এমাথার তুন ওমাথা। স্মৃতির ভাঁজ খুলি খুলি চায়। বইলত চায়, বইলত হারেন না। জিভ জড়াই যায়। সনটা ছিল নাকি আঁর প্রথম হোলা জন্মানোর  বছর। হেই বছর কালা জ্বর যে ঘরে ঘরে আই বংশ উজাড় করি দিব, কনও কেউ ভাইবত হারে ন। হক্কলে কইতে শুরু কইরল, ভগবানের মার, মাইনষের ক্ষমতা কন্নাই যে রুইখব। চিতা জ্বলের। একখান লাশ হোড়ার তো আর একখান কাঁধে করি নামার হরিবোল হরিবোল করি। ঘর তুন এক হোলার মরা লই চলি যার তো নতুন অতিথির আঁতুড়ঘর তুন ওঁয়া ওঁয়া কাঁদনের শব্দ হোনা যার। এমন এক অচেনা অজানা সময় আই ঘিরি ধরে। হৌড়ি ঘর বার করে। এই ভাবের কি নাম দন যায় নিজেও বুঝি উইঠত হারে না। এইরকম ঘটনার ধাক্কা সামলাইতে সামলাইতে দিন কাবার রাত কাবার মাস কাবার বছর কাবার হয়। বুড়া হই গেছে না, কত কথা গুছাই গাছায় কইত চায়, চোয়ের জল হড়ে, মুখ খোলে না, এমনি বিধির বিচার। ছিল তো হক্কল কথা পাট পাট করি সাজানো কিন্তু গেল কন্নাই! কালের হেডে ঢুকি গেছে। ইগাইন কত ওজনের ছিল অন বেবাক ঘটনাই হাতলা হই গেছে। হেথেনের মাথায় হালকা চুলের মাঝখানে দু’একখান কাঁচা চুল উঁকিঝুঁকি মারে। অভ্যাসের বশে ডান হাত বাঁ হাত মোচড়াই খোঁপা বাঁধে। ওই সময় আঁর মাইয়া আই ইনাই বিনাই ভুলাই দিত চায় – ‘ যা গেছে, গেছে, হুরান কথা লই চটকাচটকি করি লাভ আছে নি আর, হামনের দিকে তাকান।’ ‘তাকাইতাম তো হারি না, হুরা অন্ধকার লাগে, কারা যেন গর্ত খুঁড়ি রাইখছে, আঁই চইলতে গেলে যে উষ্ট্রা খাই হড়ি যাই।’ হেথেনে আবারও গুনগুন করে, টানি টানি সুর বার করি আনে। আহা কী মধুর লাগে, কারা যেন শাঁখ বাজায়, কারা যেন আজান দেয়, এট্টু এট্টু করি জীবনের মানেখান গোল গোল হই ঘুইরতে লাগে, কী হুইনছি আর কী না হুইনছি, মাঝখানে মাঝখানে এমন ভাবের উদয় হয়, বুঝি উইঠতাম হারি না আকাশে বাতাসে কী সুর ভাসি বেড়ায়, সুযোগ হাইলেই আঁরে আই জাপটাই ধইরত চায়। কনডাই যে চলি যাই, জগৎ মিথ্যা না জগৎ সত্য এই কথার উত্তর দিবার লাই মানুষ খুঁজি হাই না। আঁর হৌড়ি নিজের ঘরে হিরি হিরি চলি যাইত চায়। যাইত কী হারে, যাইবার ভান করে। ভানের মধ্যিখানে মাটিরে ছুঁই দেইখবার কান্দনঃ

     মাটির মানুষ মাটি হবে মাটি আসল ঠিকানা 

     এই পৃথিবী মায়ার বন্ধন ক্ষণিক সুখের নিশানা ।।

     আপনজনা আছে মত তারাই তাদের মনের মতো

     সুখের সাথি দুঃখে সাড়া দিতে কেহ চাহে না

     নিজে নিজে বুঝতে পারবে বুঝাইতে পারবে না ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *