অমিতাভ সরকার
দয়াল বিচার করো
অখিলবন্ধু ঘোষ
মঞ্চে গান চলছে। নতুন গান শুরু হবে, এমন সময় গায়ক বলে উঠলেন ঐ যা! সমবেত দর্শক, বাদ্যযন্ত্রীরা ভাবলেন কোথাও কিছু ভুল হয়ে গেল কি! সবার অকস্মাৎ বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই অবিচলিত সেই মানুষটি সুর ধরলেন, ওকে বলতে ভুলে গেছি সে যেন বাঁশি না বাজায়। নাঃ, ভুল কিছুই হয়নি।ওটা গানেরই লাইন। কিন্তু সুরের নাটকীয়তা সৃষ্টিতে এই মুগ্ধতা সৃষ্টি করার সহজাত ক্ষমতা ছিল যে মানুষটির তিনি অখিলবন্ধু ঘোষ। একাধারে গায়ক ও সুরকার। ওনার অননুকরণীয় গায়কীর ঢঙে এইভাবেই শ্রোতারা বুঁদ হয়ে থাকতো।
নামের সঙ্গে শিল্পীর স্বভাবেরও যেন পরিচিতি মিলে যায়। ‘অখিলবন্ধু’। হ্যাঁ, সবাইকে আপন করে নিয়ে বাঁচতেন। সঙ্গীত ছিল তাঁর সাধনা। ব্যবসায়িক বুদ্ধি খুব একটা ছিল না। প্রচারের হাতছানি কোনোদিনই সেভাবে ওনার মন টানেনি।
মধ্যবিত্ত মানসিকতা নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন। ওনার গান ভালো বাসলেও সঙ্গীতপ্রেমী বাঙালি শ্রোতা সে ভাবে খোঁজ রাখেনি, খোঁজ রাখেনি তৎকালীন বিদগ্ধ সমাজও।
জন্ম কলকাতার ভবানীপুর ১৯২০ সাল, ২০ শে অক্টোবর। বাবা বামনদাস ঘোষ, মা মণিমালা ঘোষ।
নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে সঙ্গীত চর্চা না থাকলেও ভাবুক ও লাজুক স্বভাবের অখিলবন্ধু ছোটো থেকেই গান শুনতেন, এবং শুনেই গান তুলে ফেলতে পারতেন। গানের শিক্ষা নিজের মামা কালীদাস গুহ, তারপর নিরাপদ মুখোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ নেন। রাগ সঙ্গীতে আগ্রহ ও পারদর্শিতা ছিল দারুণ। রাগপ্রধান গানে তাঁর মুন্সিয়ানা ছিল দেখার মতো।
ভবানীপুরের নাসিরুদ্দীন মেমোরিয়াল স্কুলে অখিলবন্ধুর শিক্ষাজীবন শুরু। এখানে সহপাঠী হিসাবে পেয়েছিলেন আরেক সুরস্রষ্ঠা শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। উভয়ের পরিবারের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তবে মাট্রিক পাস করে লেখাপড়ার চেষ্টা না করে পুরোপুরি গানে মনোনিবেশ করেছিলেন।
‘শিপ্রা নদীর তীরে’, ‘পিয়ালশাখার ফাঁকে ওঠে,
‘কবে আছি কবে নেই’, ‘ঐ যে আকাশের গায়’,
‘বাঁশরিয়া বাঁশি বাজাইও না’, ‘ও দয়াল বিচার করো’, ‘আজি চাঁদনী রাতি’, ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’, ‘সেদিন চাঁদের আলো’, ‘কোয়েলিয়া জানে’, ‘মায়ামৃগ সম’ প্রভৃতি কালজয়ী বেসিক গান, ‘মিলন নিশীথে গেল ফিরে’, ‘বরষার মেঘ ভেসে যায়’, ‘সে কুহু যামিনী’, ‘আমি কেন রহিলাম’, ‘ওগো শ্যাম বিহনে’ প্রভৃতি রাগপ্রধান গানের পাশে অপ্রকাশিত গানও যেমন অনেক, তেমনি যেহেতু অখিলবন্ধু ঘোষ নেপথ্যে গাওয়া পছন্দ করতেন না, তাই চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার প্রস্তাব অবলীলায় ফিরিয়ে দিতেন, ফলত চলচ্চিত্রে নেপথ্য কণ্ঠদান ‘মেঘমুক্তি’, ‘বৃন্দাবনলীলা’ -এ রকম হাতে গোনা নামমাত্র। মেগাফোন কোম্পানি তাঁর
দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেন,’তুমি মোর পাও নাই’, ‘কার মিলন চাও বিরহী'( যার একটি অপ্রকাশিত ও শিল্পীর মৃত্যুর অনেক পরে প্রকাশিত)। এছাড়া মেগাফোনে অখিলবন্ধুর রেকর্ড করা নজরুলগীতির মধ্যে ‘রসঘন শ্যাম’, ‘শূন্য এ বুকে’, ‘কুহু কুহু কোয়েলিয়া’, ‘নীলাম্বরী শাড়ি’,’ হে মাধব’ যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছিল।
তাছাড়া নিজের গানের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পীর গানেও অখিলবন্ধুর সুরসৃষ্টিও ছিল নজিরবিহীন। ৭৮ আর পি এম রেকর্ডের জে এন জি ৫৮৪০ (১৯৪৭) এবং এইচ ১৩০১(১৯৪৮) নম্বরে যথাক্রমে ‘একটি কুসুম যাবে’ এবং ‘ফাগুনের চাঁদ ডুবে গেল’ গানদুটির গীতিকার অখিলবন্ধু স্বয়ং। এছাড়া অনুপম ঘটক, দুর্গা সেন, দিলীপ সরকার, সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, স্ত্রী দীপালী ঘোষ, প্রবীর মজুমদার, রতু মুখোপাধ্যায় সবার সুরেই গেয়েছেন, তেমনি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়,সুনীল বরণ, মধু গুপ্ত প্রভৃতি গীতিকারদের গানেও তাঁর গাওয়া অসাধারণ গানগুলি আজও চিরস্মরণীয়।
এছাড়া সেই সময়ের অনেক বিখ্যাত গান অখিলবন্ধু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজস্ব ঢংয়ে
গাইতেন, গানগুলো তাঁর কণ্ঠে প্রকাশিত হলে হয়তো গায়নের একটা বিশিষ্ট ধরন শ্রোতাদের সামনে আসতে পারতো কিন্তু কিছুদিন বাদেই গানগুলো অন্যান্য শিল্পীদের রেকর্ডে প্রকাশিত হয়ে পড়তো, আর অখিলবন্ধুও এসব নিয়েও ভাবতেন না। ‘মোর মালঞ্চে বসন্ত নাই রে’ (তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান), ‘কোন দূর বনের পাখি’ (গায়ত্রী বসুর কণ্ঠে প্রকাশিত ও বিখ্যাত), ‘ঝিরিঝিরি ঝরনা বহে’ (অজিত রায়ের কণ্ঠে প্রকাশিত) এসব গান বহু সঙ্গীত জলসায় অসাধারণ ভাবে অখিলবন্ধু পরিবেশন করতেন এবং শ্রোতারা বিমোহিত হতো। এই অজাতশত্রু
অসুয়াশূন্য শিল্পীর গানের খাতা ছাড়া এসব গানের শিল্পীকৃত রেকর্ডিং আজ আর নেই।
জন্মগতভাবে নানাবিধ গুণের অধিকারী হয়েও ক্রমাগত চেষ্টা ও সাধনার দ্বারা নিজের একটা আলাদা জায়গা তৈরি করেন। এ ব্যাপারে তাঁর গুণবতী ছাত্রী এবং পরে স্ত্রী দীপালী ঘোষের অবদানও অনস্বীকার্য। ২৫ নম্বর টার্ফ রোডের সংসারটিকে সুখে দুঃখে সঙ্গীতকে নিরন্তর সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রচারবিমুখ লাজুক চাপা স্বভাবের অখিলবন্ধু ঘোষের পাশে এইরকম উজ্জ্বল পরিণতমনস্ক স্ত্রী যিনি নিজে শিল্পী ও সুরকার হিসাবে বিদুষী হয়েও ১৯৪৭ সালে বিয়ের পর প্রায় ১০ বছর সঙ্গীতচর্চাই সংসার দেখতে বন্ধ রাখেন। অনেক ছাত্রছাত্রীদের গান শেখালেও অখিলবন্ধুর আয় তেমন ছিল না। আর প্রাতিষ্ঠানিক প্রবৃত্তি না থাকায় মুখ ফুটে বলতেও পারতেন না। ফাংশন, রেকর্ডের আয়ও তেমন ছিল না। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় সারাজীবন হাসিমুখে পাশে থেকে স্বামীকে আজীবন আগলে রাখা এই সুখী দম্পতিকে ঈশ্বর সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। তবে সঙ্গীতপ্রাণা দীপালি ঘোষ ব্যক্তিগত জীবনেও সুরসিকা ছিলেন। শেষ জীবনে অখিলবন্ধু ঘোষকে অর্থকষ্টে পড়তে হয়। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সামান্য পেনশন ছিল ভরসা। তাও দু একবার বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র সাতষট্টি বছর বয়সে হঠাৎ অখিলবন্ধু ঘোষ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ১৯৮৮ সাল ২০ মার্চ। অণ্ডালে অনুষ্ঠান করে ওইদিন সকালে ফিরে এসে দুপুরে শরীর খারাপ বোধ করায় পি জি হাসপাতালে ঘণ্টাখানেক বিনা চিকিৎসায় তাঁকে ফেলে রাখা হলে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেও বেশ কিছুক্ষণ পরে যখন দেখার ব্যবস্থা করা হলো তখন যা হবার হয়ে গেছে। একালের জনপ্রিয় শিল্পী নচিকেতা চক্রবর্তী যথার্থই তাঁর ‘পুরোনো দিনের গান’ -এর এক জায়গায় বলেছেন ‘অখিলবন্ধু ঘোষ যতটা প্রতিভাবান/ পেলেন না তাঁর যোগ্য সম্মান ‘; শুধু তাই নয় চলেও গিয়েছিলেন চরম অবহেলা পেয়ে তাও বাঙালীদের কাছেই। ‘সারাটি জীবন কি যে পেলাম’, বা ‘যেন কিছু মনে করো না’, ‘কেন প্রহর না যেতে মরণের বীণা বাজে’ -প্রভৃতি গানের অমোঘ কথাগুলো যে অখিলবন্ধুর নিজের জীবনের কথাই হয়ে উঠবে তা সত্যিই কেউ কি জানতো!
কৃতজ্ঞতাঃ অখিলবন্ধু ঘোষঃ মুখোপাধ্যায় ,সন্দীপ এবং গুগল
(বিঃদ্রঃ- এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য কালের গহ্বরে হারিয়ে ফেলা বরেণ্য এই সুরসাধককে বর্তমান প্রজন্মের কাছে আরও ভালোভাবে চেনানো। এই লেখার দ্বারা কাউকে কোনোভাবে প্রভাবিত করা বা কারোর লেখার ভাবাবেগ ক্ষুণ্ণ হয়েছে এইরকম কিছু আদৌ না ভাবতে বিনীত অনুরোধ জানালাম।)
সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ
কৃষ্ণচন্দ্র দে
এই সংগীত সাধকের জীবন অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর কথা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, যখন প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রচারমাধ্যম এতটা উন্নত ছিল না, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় কীভাবে সঙ্গীত জগতে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বতন্ত্র জায়গা তিনি তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় উপেক্ষা করে সেই আমলে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটা সম্পূর্ণ ইন্সটিটিউশন। তাঁর কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয়, রেকর্ডকৃত গানগুলো যেন হৃদয়ের গভীর অন্তস্থল থেকে বেরিয়ে এসে শ্রোতাদের আত্মাকে প্রবলভাবে অনুরণিত করছে। এ যেন সাক্ষাৎ কোনো সাধুর ঈশ্বর ভজনা। আবার এই মানুষটিই যখন মঞ্চ আলোকিত করে অভিনয় করতেন, তখন দেখে কারোরই বোঝার উপায় ছিল না, যে মানুষটির দৃষ্টিশক্তি নেই। ওঁর সংলাপ বলা, হাঁটাচলার স্টাইল, অভিনয় এতখানি সাবলীল ছিল, যে সহ-অভিনেতারাও এই মানুষটির কর্মকুশলতা দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হতেন। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একবার উনি কলকাতা হেদুয়ার ফুটপাত দিয়ে কারোর কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটছেন। এক ভদ্রলোক ওঁকে দেখতে পেয়ে নাতিকে বললেন, ‘ওই দ্যাখ, কানাকেষ্ট যাচ্ছে।’ উনি শুনতে পেয়ে বলেছিলেন,’ঠিক বলেছ ভাই, আমি কানা-ই বটে। তবে শুধু আমি না, উপরে বৈকণ্ঠে বসে যে ব্যাটা মৌজ করছে, সেই কেষ্ট ব্যাটাও তো কানা।’ যাঁর কথা বলছি তাঁর নাম কৃষ্ণচন্দ্র দে। বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে শুধুমাত্র বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে-র কাকা হিসাবেই জানে। এছাড়াও যে, সে আমলে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র একটা বিরাট পরিচিতি ছিল, বর্তমান প্রজন্ম সেই সম্বন্ধে আদৌ তেমন অবহিতই নয়। কৃষ্ণচন্দ্র দে কিন্তু সমকালেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী, নিজে গাইতেন, সুর করতেন, অভিনয় করতেন, শুধু তাই নয় তাঁর সাবলীল অভিনয় -সেকালের যে কোনো চক্ষুষ্মান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকেও ছাপিয়ে যেত, নিজেও অসম্ভব পারফেকশনিস্ট ছিলেন। দর্শক, সহ-অভিনেতা গুণগ্রাহীরা তাঁর করিশমা দেখে অবাক হয়ে যেত। আজকের দিনে এসব ভাবা যায়!
জন্ম সিমলের মদন ঘোষ লেনে ১৮৯৪ মতান্তরে ১৮৯৩। জন্মতারিখ ২৪ আগস্ট। জন্মাষ্টমীর দিন জন্ম বলে নাম রাখা হয় ‘কৃষ্ণচন্দ্র’। বাবা শিবচন্দ্র, মা রত্নমালা। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন মা-বাবার কনিষ্ঠ পুত্র। ডাকনাম বাবু। ছোটবেলায় পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন, এর পাশাপাশি প্রিয় বিষয় ছিল, গান শোনা, গান গাওয়া, আর ঘুড়ি ওড়ানো। বাড়িতে কীর্তনীয়ারা গান গাইতে আসতো। কানে শোনার সঙ্গে সঙ্গে গানগুলো আত্মস্থ করে খুব তাড়াতাড়িই তা কণ্ঠে ধারণ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। একবার গরমের ছুটির সময় বাড়ির ছাদে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একভাবে আকাশের দিকে চেয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন। তখন ফোর্থ ক্লাসে (তেরো বছর বয়সে) পড়ছেন। ইস্কুলে ক্লাস করার সময় অনুভব করলেন চোখে অসহ্য জ্বালা করছে। মেডিকেল কলেজের ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তারবাবু
অন্ধত্বের লক্ষণ দেখতে পেলেও সুস্থ করার চেষ্টায় আই ড্রপ দিলেন। ব্যথা তো কমলই না, উপরন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দৃষ্টিশক্তি চিরতরে চলে গেল। ঘুড়ি ওড়ানো, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল, রইলো শুধু গান। তাতেই জীবনকে সঁপে দিলেন। শৈশবে পিতাকে হারিয়েছেন। আর্থিক অভাব-অনটনও অনেকটাই। গান শেখানোর খরচও আছে। মা কিশোর কৃষ্ণচন্দ্রকে জোড়াসাঁকোর কাছে হরেন্দ্রনাথ শীলের বাড়ি রেখে দিয়ে আসতেন, সেখানে সারাদিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর চলতো, অনেক নামজাদা ব্যক্তিরা আসতেন। কৃষ্ণচন্দ্র সেগুলো শুনতেন, মা বাড়ি নিয়ে আসলে গানগুলো অবিকল সেই ভাবে গাইতেন। হরেন্দ্রনাথ শীল নিজেও ভালো সুরবাহার বাজাতেন। তিনিই বালক কৃষ্ণচন্দ্রকে নিজের বাড়িতে রেখে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা দিতে শুরু করেন। তখন থেকেই শুরু। সঙ্গীতশিক্ষার জন্য কৃষ্ণচন্দ্র বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। প্রথমে খেয়ালিয়া শশীভূষণ ঘোষ, তারপর টপ্পা গায়ক সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একে একে কেরামতুল্লা খান, বদল খান, দবির খান, জমিরউদ্দীন খান, মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কীর্তনে রাধারমণ দাস প্রভৃতি সেকালের বিখ্যাত সব শিল্পীদের কাছে সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় তালিম নেন। অন্ধ হয়ে গিয়ে অন্তরে অন্য কিছু একটা শক্তি অনুভব করলেন, ঈশ্বর যেন বহির্লোকের দরজা বন্ধ করে অন্তর্লোকের দরজা খুলে দিলেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমী, কর্মযোগী, উদ্যমী কৃষ্ণচন্দ্র আপন দক্ষতায় একজন বড় সঙ্গীতশিল্পী হয়ে উঠলেন। এমনকি হিন্দি, উর্দু শেখার জন্য নিজে মৌলভী রেখে শিক্ষাগ্রহণও করেছিলেন। সেকালের কলকাতায় অনেক বর্ধিষ্ণু ব্যক্তিদের বাড়িতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসতো। নির্মল চন্দ্র স্ট্রিটের বেচারাম চন্দ্রের বাড়িতে ১৯১৬ সালে গুরু কেরামতুল্লা তাঁকে শিল্পী হিসেবে পরিচিত করান। কৃষ্ণচন্দ্র সেদিন বিদগ্ধজনের সভায় খেয়াল গান শুনিয়ে উচ্চ প্রশংসিত হন। আস্তে আস্তে এরকম আরো অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেতে শুরু করলেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে
এইচএমভি থেকে কৃষ্ণচন্দ্র দের গানের প্রথম রেকর্ড বের হয়। গান দুটি ছিল, যথাক্রমে-’’আর চলে না চলে না মাগো”, এবং ”মা তোর মুখ দেখে কি।” তবে গানদুটোর একটিও চলেনি। নিজের লেখা গান ‘’দীনতারিণী তারা” এইচএমভি থেকে বেরোনোর পর কৃষ্ণচন্দ্রকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গ্রামোফোন কোম্পানির ভগবতীপ্রসাদ ভট্টাচার্য সেইসময় কৃষ্ণচন্দ্রের গান শুনে মুগ্ধ হন। তারপর থেকে প্রতি মাসে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে কৃষ্ণচন্দ্রের একটা করে রেকর্ড বেরোতে শুরু করে, এবং অচিরেই তা জনপ্রিয় হয়। গ্রামোফোন কোম্পানিতে স্থায়ী শিল্পী হিসাবে যোগদান করেন কৃষ্ণচন্দ্র। রাগাশ্রয়ী গান থেকে শুরু করে বাংলা আধুনিক গানেও কৃষ্ণচন্দ্র নিজেই একটা মহীরূহ হয়ে ওঠেন। বাংলার কীর্তনের নিজস্ব ধারাকে অক্ষুণ্ণ করে তারই আদলে প্রচুর বেসিক গান তিনি তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন, সুরারোপও করেছিলেন। ‘স্বপন দেখিছে রাধারানী’,’শতেক বরষ পরে’,’নবদ্বীপের শোভন চন্দ্র’ -র পাশাপাশি ‘ছুঁইয়ো না ছুঁইয়ো না বঁধু’-র মতো পদাবলি কীর্তন, আবার ‘মেঘ হেরি নীল গগনে’, ‘ঘন অম্বরে মেঘ সমুদ্র’,’ঘন ডম্বরু তালে এলো’ প্রভৃতি রাগাশ্রয়ী বাংলা গান, আবার ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকে কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক অভিনীত ও গীত), ‘স্বপন যদি মধুর এমন’ বা স্বদেশী আন্দোলনের সময় মোহিনী চৌধুরীর কথায় নিজের করা সুরে ‘মুক্তির মন্দির সোপানো তলে’, বা ’হরে মুরারে মধুকৈটভারে’ প্রভৃতি গানগুলো কৃষ্ণচন্দ্র দের কণ্ঠে এক অনন্য মাত্রা যোগ করে। কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতও রেকর্ড করেছিলেন, যেমন-’তোমরা যা বলো তাই বলো’,’আঁধার রাতে একলা পাগল’, ’হে মহাজীবন’,’আমার যাওয়ার বেলায় পিছু ডাকে’। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে উনি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতা কৃষ্ণচন্দ্রকে পড়ে শোনাতেন, ক্রমশ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিও কৃষ্ণচন্দ্র অনুরক্ত হন। সুধীন্দ্রনাথের অনুরোধে কিছু রবীন্দ্রকবিতায় কৃষ্ণচন্দ্র সুরও বসিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলো নেহাৎই ঘরোয়া পরিবেশে, তার কোনো রেকর্ড বা সেইসব সুরের কোনো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। যদি সেটা করা যেত, বাংলা সংগীত যথেষ্ট উপকৃত হতো, সেটা বলবার অপেক্ষা রাখে না। কৃষ্ণচন্দ্রের গানে কাব্যিক ভাব, আর অপূর্ব প্রেমমাধুর্যের এক রসঘন সুরমূর্চ্ছনা শ্রোতাদের এক অনাবিল আবেশে আচ্ছন্ন করে রাখতো, এবং এত বছর পরেও তার কোনোই ব্যতিক্রম হয়নি। পরবর্তীকালে
তাঁর প্রিয় ভাইপো ও শিষ্য মান্না দে(প্রবোধচন্দ্র দে) কাকার স্মরণে ‘স্বপন যদি মধুর এমন’,’ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’,’জয় সীতাপতি’, ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে’ প্রভৃতি গানগুলো রেকর্ড করেছিলেন, এবং জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল। পাঠকেরা ভেবে দেখুন, তখনকার দিনে আজকের মতো প্রচারমাধ্যম এত সক্রিয় ছিল না, কম্পিউটার, স্মার্টফোন আসেনি, youtube ছিল না, মিউজিক সিস্টেম, রেকর্ড করার যন্ত্রপাতি এত উন্নত ছিল না, তার মধ্যেও এইসব সঙ্গীত সাধকরা কী অনায়াসে তাঁদের সেরাটুকু আপামর শ্রোতাদের কাছে উজাড় করে দিয়ে গেছেন, তুলনায় প্রতিদানে কিছুই পাননি বললেই চলে,পাওয়ার ভাবনাও তাঁদের মধ্যে ছিল না, ছিল শুধু নিরন্তর সাধনা আর সাধনা। মিষ্টভাষী, সদাহাস্যজ্বল, গৌরবর্ণের দেদীপ্যমান সুপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র সুন্দর বেশভূষা পছন্দ করতেন। জীবনের কোনো কষ্টকে কষ্ট বলে মনে করেননি। মানুষের ব্যবহারে মর্মাহত হলেও নিজের অপূর্ব ক্ষমাগুণে তা মাফ করে দিতে পারতেন। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম মঞ্চাভিনয়, ১৯২৪ সালে শিশির ভাদুড়ির আমন্ত্রণে অ্যালফ্রেড থিয়েটারে ‘বসন্তলীলা’ নাটকে বসন্তদূত চরিত্রে। তিনি মিনার্ভা, রংমহল, নিউ থিয়েটার সব জায়গাতেই কাজ করেছিলেন। থিয়েটারে অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে ‘সীতা’,’প্রফুল্ল’,’চন্দ্রগুপ্ত’,’জয়দেব’,
’দেবদাসী’, এমনকি রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক উল্লেখযোগ্য। এই নাটকের জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে গানও শিখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। থিয়েটারের পাশাপাশি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রেও গান গাওয়ার পাশাপাশি সফলভাবে অভিনয়ের দক্ষতাও দেখিয়ে গেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তখন নির্বাক থেকে সবাক যুগ আসতে শুরু করেছে।
১৯৩২ থেকে ১৯৪৬ অবধি সিনেমার গান করেছিলেন ও তাতে সুরও দিতেন।
দেবকী বসুর ‘চন্ডীদাস’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্যাপতি’,’আলোছায়া’,’ভাগ্যচক্র’,
’বামুনের মেয়ে’,’গৃহদাহ’,’চাণক্য’,’পূরবী’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে সার্থকতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ‘চন্ডীদাস’ সিনেমায় ‘ফিরে চলো আজি আপন ঘরে’,’সেই যে বাঁশি বাজিয়েছিলে’,’শতেক বরষ পরে’ গানগুলো খুবই সাফল্য পায়। এই চলচ্চিত্রে কৃষ্ণচন্দ্র নায়ক দুর্গাদাসের বন্ধু অন্ধগায়ক শ্রীদামের চরিত্রে অভিনয় করে জমিয়ে দেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রণব রায়, বাণীকুমার, শৈলেন রায় প্রভৃতি গীতিকারদের গানে যেমন কাজ করেছেন, তেমন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরেও গান রেকর্ড করেছেন। রেকর্ড, নাটক, সিনেমা থেকে কৃষ্ণচন্দ্রের আয় ভালোই হতো, তবে তার অধিকাংশটাই সংগীতের উন্নতিকল্পে ব্যয় করে গেছেন। অনুষ্ঠান করার জন্য যা পারিশ্রমিক পেতেন, তার পরিমাণ যত কম বা বেশিই হোক না কেন, অনুষ্ঠানের মধ্যে তা কখনোই খুলে দেখতেন না।
নিজের তিন ভ্রাতুষ্পুত্র -প্রণব দে,প্রবোধ দে, প্রভাস দে তাঁর সার্থক উত্তরসূরী। পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ সুরকার, গায়ক
কুমার শচীন দেববর্মনকে পাঁচ বছর সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছিলেন। বাংলা হিন্দি গুজরাটি উর্দু ,আটটি নাৎ মিলিয়ে প্রায় ছশো মতো গান রেকর্ড করেছেন কৃষ্ণচন্দ্র। ১৯৪২ সালে অভিনয়ের জন্য দুই ভাইপো- প্রণব, প্রবোধকে নিয়ে তিনি বোম্বে(মুম্বাই) চলে যান, সেখানে বাড়ি কেনেন, এবং অভিনেতা, গায়ক সুরকার, সংগীত পরিচালক হিসাবে নিজের পায়ের জমি শক্ত করেন। এখানে তিনি পরিচিত হন কে সি দে নামে। বোম্বাইতে মান্না দে-র প্লে-ব্যাকে গান গাওয়ার হাতেখড়ি তাঁর এই বাবুকাকার হাত ধরেই। ১৯৪২ সালে ‘তমান্না’ ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে মান্না দেকে সুরাইয়ার সঙ্গে ডুয়েট গাওয়ান। অভিনয়ের পাশাপাশি
সুরস্রষ্টা হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্র কিশোরকুমার, মুকেশ, মহম্মদ রফিকে দিয়ে বোম্বেতে বেশ কিছু সিনেমায় গান গাইয়েছিলেন।
বোম্বেতে অল্প সময়ের মধ্যে বেশ নাম করলেও ১৯৪৬ সালে একরাশ দুঃখ নিয়ে ওখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন। বোম্বাইতে কিছু মানুষকে বিশ্বাস করে তাদের দ্বারাই তিনি
ভীষণরকম ভাবে প্রতারিত হন। তবে কলকাতায় এসে বাংলা সিনেমায় প্রযোজনা করতে থাকেন, তাতে সাফল্যও আসে। ১৯৫৭ সালে ‘একতারা’ চলচ্চিত্রে শেষবারের মতো (অতিথি শিল্পী হিসাবে) তাঁকে দেখা যায়।
অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এখানেই চারুচন্দ্র বসুর কন্যা তারকবালার (মিস লাইট নামে পরিচিত ছিলেন) সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম আলাপ হয়। পরবর্তীকালে রংমহল থিয়েটারে কৃষ্ণচন্দ্র দের সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছিলেন মিস লাইট। দুজনে গোপনে শাস্ত্রমতে বিবাহ করেছিলেন বলে শোনা যায়। বিবাহিত জীবনে মিস লাইটের নাম ছিল রমা দে। তাঁদের এক সন্তানও ছিল। কিন্তু মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ছেলেটি মারা গেলে দুজনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে কৃষ্ণচন্দ্র বলে গেছিলেন, স্ত্রী তারকবালাকে যেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যায়টুকু দেওয়া হয়,(যদিও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি) এবং কৃষ্ণচন্দ্রের অবর্তমানে তাঁর বাড়ির সম্পূর্ণ অংশীদার তারকবালাই থাকেন।
এবার কলকাতা বেতারের কথায় আসি। ১৯৩৬ সালে ৮ ই জুন কলকাতা কেন্দ্রের সূচনা হলে কৃষ্ণচন্দ্র দ্বিতীয় শিল্পী হিসাবে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়ে ধ্রুপদী গান গেয়েছিলেন। তাছাড়া বাংলা গানে তিনিই ঠুংরি, খেয়াল, গজল ব্যবহার প্রচলন করেন। কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল প্রভৃতি গানে যশস্বী হলেও নিজেকে কীর্তনীয়া হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসতেন। পরবর্তীকালের সংগীতশিল্পীরাও তাঁকে
শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে কৃষ্ণচন্দ্রের শেষ বয়সের গাওয়া কোনো গান পুনরায় রেকর্ড করতে বলা হলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ’যে গান কৃষ্ণচন্দ্র দে গেয়েছেন, সেখানে আমি আর সেই গান কী গাইবো!’ পরবর্তীকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গানটি আর রেকর্ড করেননি। শচীন দেববর্মন, মান্না দে প্রমুখেরাও নানা স্মৃতিকথায় এই মহান সাধককে নানা ভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছেন।
শেষের দিকে ওঁর গান তেমন হিট হতো না। মাত্র ঊনসত্তর বছর বয়সে ১৯৬২ সালে ২৮ নভেম্বর কলকাতাতেই মারা যান কৃষ্ণচন্দ্র। সেইসঙ্গে একটা বর্ণময় যুগের অবসান ঘটে। সংগীতশিল্পী, সুরকার, প্রযোজক, অভিনেতা, নট এতগুলো ভূমিকায় একচ্ছত্র ভাবে একটা সময় কাজ করে গেছেন, সাফল্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু এরসঙ্গে সারাটা জীবনেই ছিল শুধু দুঃখ আর যন্ত্রণা। তাই গানগুলো সেই সময় হিট হলেও তিনি কিন্তু কোনোদিনই কোনো আত্মশ্লাঘায় ভোগেননি। জীবনটাকে তিনি ঠিকই চিনেছিলেন। সাফল্য আর ব্যর্থতা জীবন-মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। পাওয়া, না-পাওয়া সবকিছুই তিনি প্রাণের ইষ্টদেবতা শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেছিলেন। গানই হয়ে উঠেছিল তাঁর আরাধ্য পরমেশ্বর, শ্রোতারাই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরম সখা। তাই শত্রুকেও পরম মিত্রভাবে ক্ষমা করে দিতে পেরেছেন, ঈশ্বরের নামগানের মধ্যেই, যে ঈশ্বরের মানুষের মধ্যেই বাস, মানুষের মনই যেখানে তাঁর আরাধ্য মন্দির। ‘’অন্তর মন্দির মাঝে” – তাই সারাজীবন তাঁরই খোঁজ করে গিয়েছেন সুরের পথিক কৃষ্ণচন্দ্র। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। এই মহান পুরুষকারকে আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
ও কেন গেল চলে
পঙ্কজকুমার মল্লিক
তিনের দশক। এক সময় রবীন্দ্রনাথের কাছে খবর গেল, একটি যুবক কবির ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থের ‘শেষ খেয়া’ কবিতাটি নিজে সুর দিয়ে গেয়ে বেড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গানে সুর দিতে গেলে যে কবির অনুমতি লাগে, যুবকটি সেটা জানতো না। বাড়িতে লোক পাঠিয়ে রথীন্দ্রনাথ একেবারে জোড়াসাঁকোয় ডেকে পাঠালেন। সেই প্রথমবার। রবীন্দ্রনাথকে দুরু দুরু বুকে গানটি শোনালে কবি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন। কেমন লাগলো জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। তারপর অনেক বছর পরে আরেকবার। যথা সময়ে কবির কাছে রেকর্ডকৃত গানটি পৌঁছেও গেল। সেবার রবীন্দ্রনাথ নিজে এসে দেখা করলেন ।
সেদিন সে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বরানগরের বাড়ি ‘আম্রপালি’তে কবিগুরুকে গানটি শোনালে তিনি খুশি হয়ে গানটি চলচ্চিত্রে ব্যবহারের অনুমতি দেন। তখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা শুরু হয়নি। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কোনো কাজ করতে গেলে তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অনুমতি নিতে হতো।
রবীন্দ্রনাথের সব গানের কথা ও সুর তাঁর নিজেরই। যে সময়, অন্য কেউ তাতে সুর বসালে কথা পরিবর্তন করলে সেটা কবিগুরুকে অবমাননার সামিল হতো, সেই সময় দাঁড়িয়ে এই যুবকটি বাংলা চলচ্চিত্রে উক্ত গানটি ব্যবহারের জন্য কবির সম্মতি আদায় করেছিলেন, সে সময় ব্যাপারটা বেশ দুঃসাহসিক ছিল।
শুধু তাই নয়, আরো রবীন্দ্র-কবিতায় সুর করার সম্মতিও কবির থেকে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিনের এই যুবকটির নাম পঙ্কজ কুমার মল্লিক। পরবর্তীকালে একরকম তাঁর হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে তবলার সঙ্গত করা, এমনকি হারমোনিয়াম, পিয়ানোসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে আধুনিকতা দেখানো, অর্কেস্ট্রেশনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রবীন্দ্রপরিমণ্ডলের বাইরে বৃহত্তর জনমানসে রবীন্দ্রসঙ্গীত আরও জনপ্রিয় করতে পঙ্কজকুমার মল্লিকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাছাড়া গায়ক হিসাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ভজন, গীত, আধুনিক গান, লোকগান সবই গেয়েছেন।
সিনেমাটির নাম ছিল ‘মুক্তি’। সিনেমার গল্প তার মুখে শুনে কবিগুরুই এই নাম দেন। সিনেমার প্রয়োজনে ‘দিনের শেষে’ গানটির কিছু কথা পরিবর্তনের পরামর্শও দেন, এছাড়া ‘আমি কান পেতে রই’,’তার বিদায়বেলার মালাখানি’ গানদুটিও রবীন্দ্রনাথের অনুমতিক্রমে ‘মুক্তি’ সিনেমায় ব্যবহার হয়েছিল। সিনেমাটিতে গানদুটো পঙ্কজ মল্লিক আর কানন দেবী গেয়েছিলেন। ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি সিনেমায় পঙ্কজকুমারই গেয়েছিলেন। এইভাবে পরিচালক প্রমথেশ বড়ুয়া, পঙ্কজ মল্লিক, কানন দেবী এঁদের হাত ধরে বাংলা সিনেমায় প্রথম ব্যবহৃত হয় এই তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত। বিষয়টা আজকে ভাবলে অনেক সহজ মনে হবে। কিন্তু সেই দিনের কথা ভাবলে ব্যাপারটা বেশ বৈপ্লবিক এবং সাহসেরও ছিল। বর্তমান প্রজন্ম পঙ্কজকুমার মল্লিককে সেই ভাবে চেনেই না। চিনলেও বড়োজোর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সুরকার হিসাবে। ব্যস, ওইটুকুই। কিন্তু সেই দিনে পঙ্কজকুমার মল্লিকই ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী এসব পরিচয় বাদ দিয়েও এই বিনয়ী, নম্র, সদাশয় মানুষটির বিবিধ কর্মকাণ্ড আজ অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন।
জন্ম কালিঘাট। ১০ ই মে, ১৯০৫। বাবা মণিমোহন মল্লিক, মা মনোমোহিনী দেবী। নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবার। বাবার থেকেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর এই অনুরাগ তৈরি হয়। বাবার ইচ্ছেয় গান শেখা শুরু পণ্ডিত দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। সেখানেই ‘চয়নিকা’ বই থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। পরিচিতমহলে রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলো সুর করে গেয়ে বেড়াতেন। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে বঙ্গবাসী কলেজ, আর সেখান থেকে পড়াশোনা শেষ করে সঙ্গীতেই আত্মনিয়োগ করেন। ওই সময়ে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পঙ্কজ মল্লিকের সখ্য গড়ে ওঠে। দিনু ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে নাতি, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপিকার ও সঙ্গীত প্রশিক্ষক ছিলেন। তখন থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি পঙ্কজকুমারের আগ্রহটাও বাড়তে থাকে। প্রথম গান, ১৯২৬ সালে ভিয়েলোফোন কোম্পানি থেকে রেকর্ড করা ‘নেমেছে আজ প্রথম বাদল’। ১৯৩১-এ রেকর্ডকৃত প্রথম রবীন্দ্র গান ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন’ আর ‘তোমার আসন শূন্য আজি’।
সেই সময় মধ্যবিত্ত পরিবারে গান গেয়ে জীবনযাপন করাটাকে ভালো চোখে দেখা হতো না। তাছাড়া তখন পঙ্কজ মল্লিকের পরিবারের অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। আর্থিক কারণে বন্ধুর দোকানে দর্জির কাজ, রেলের অফিসে কেমিস্টের কাজ, এমনকি পাটের দালালি পর্যন্ত করতে হয়েছে। পরিবারে চল্লিশ জন মানুষ। সবার ভরণপোষণের চিন্তা মাথায় নিয়েও শুধুমাত্র অধ্যাবসায়, বিশ্বাস, আর সাহসের জোরে, পঙ্কজকুমার মল্লিক রেকর্ডে গান গাওয়া শুরু করেন। ১৯২৭ সালে ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে কাজ শুরু করেন। পরে এই সংস্থার নাম হয় অল ইন্ডিয়া রেডিও। এই আকাশবাণীতে অর্ধশতক কাল নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী এবং সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করেছিলেন। রেডিওতে নাট্যকার হিসাবে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো- সঙ্গীত শিক্ষার আসরও পরিচালনা করা। সেখানে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাছাড়া নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে পঁচিশ বছর কাজ করেছিলেন। ১৯৩১ সালে বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, রাইচাঁদ বড়াল, আর পঙ্কজকুমার মিলে মহালয়ার দিনে বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুরু করেন। ১৯৩১ থেকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। যেমন- নেপথ্য কণ্ঠসঙ্গীতের ব্যবহার, ইন্টারল্যুডের ব্যবহার, দৃশ্যপট অনুযায়ী গানের আবহ তৈরি, উপযুক্ত গানের নির্বাচন ইত্যাদি। রাইচাঁদ বড়াল, নীতিন বোস এবং তিনি এই অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি, তামিল, উর্দু চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। কুন্দনলাল সাইগল, প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী প্রভৃতি কিংবদন্তীর সঙ্গে অভিনয়ও করেছেন যেমন, তেমনই আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর, শচীন দেব বর্মন প্রভৃতি শিল্পীদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তো পঙ্কজ মল্লিককে গুরু মানতেন। হেমন্তের প্রথম দিকের রেকর্ডকৃত গানগুলোয় পঙ্কজ মল্লিকের প্রভাব লক্ষ করা যায়। তাঁকে ‘ছোট পঙ্কজ’ বলা হতো। পরে হেমন্ত গুরুর প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব গায়কী তৈরি করেন এবং যশস্বী হোন।
কে এল সায়গলকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখানো এবং সিনেমায় তা গাওয়ানো, কবিগুরুর অনুমতি নেওয়া – এ সবকিছুর কৃতিত্ব পঙ্কজ মল্লিকেরই। কিন্তু তিনের দশকের শুরুর দিকে বেতারে শিল্পী ও সুরকার হিসাবে পঙ্কজকুমার এবং রাইচাঁদ বড়াল দু’জনে একসঙ্গে কাজ করলেও টাইটেল কার্ডে রাইচাঁদের নামটাই বড় করে থাকতো। প্রমথেশ বড়ুয়া আসার পর তিনি বিষয়টা লক্ষ্য করে নিউ থিয়েটারর্সের বীরেন্দ্রনাথ সরকারকে জানালে ‘মুক্তি’ সিনেমার সময় থেকে এই অবস্থার বদল হয়, অফিসও আলাদা করে দেওয়া হয়। যেহেতু দুঃসময়ে নিউ থিয়েটার্স তাঁর পাশে ছিল, কোনো প্রলোভনেই পঙ্কজকুমার নিউ থিয়েটারর্স ছাড়েননি। তখন বাংলা শিল্পীরা বোম্বে চলে যাচ্ছে। বোম্বে যাওয়ার পঙ্কজ মল্লিককে প্রস্তাব আসলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাজ কাপুর, জার্মান পরিচালক পল জিলস কেউই তাঁকে এই সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। কিন্তু কিছুদিন বাদে অর্থাভাবে নিউ থিয়েটারস বন্ধই হয়ে গেলে পঙ্কজ মল্লিক ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পে বিনোদন বিভাগের উপদেষ্টা হিসাবে যুক্ত হন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ‘লোকরঞ্জন শাখা’য় যোগ দিয়েছিলেন।
প্রায় পাঁচ হাজারের মতো গানে সুরারোপ করেছেন, দেড়শোর মতো চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। ডাক্তার, মুক্তি প্রভৃতি তাঁরই অভিনীত চলচ্চিত্র। পরবর্তীকালে বাংলা না ছাড়াটাই পঙ্কজ কুমার মল্লিকের ভুল হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে তদানীন্তন সরকারের চাপে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রেডিওয়ে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর (১৯৩১ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি মহালয়ার দিন ভোরে রেডিওতে সম্প্রচারিত হতো, এরমধ্যে ১৯৩১ থেকে ১৯৩৬ অবধি প্রত্যেকবার পরিমার্জন করা হতো, ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সকাল চারটে থেকে বেতারে সরাসরি সম্প্রচার করা হতো, তবে ১৯৬৬ সালের পর থেকে রেকর্ডিং চালানো হয়, এখন আমরা যেটা শুনি সেটা ১৯৬৬ সালে রেকর্ড করা।) বন্ধ করে দেয়া হলো,
(জনগণের বিপুল রোষ আর বিক্ষোভের কারণে পরের বছর থেকে আবার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রচারিত হয়, আজও সেটাই চলছে) এবং যে সংগীত শিক্ষার আসরে সাতচল্লিশ বছর ধরে গান শিখিয়ে এসেছেন, কেন্দ্রীয় অধিকর্তা হঠাৎ অনুষ্ঠানটি বন্ধ করার চিঠি ধরিয়ে দিলেন। দুটো ঘটনাই ওঁকে খুব আঘাত দিয়েছিল। ১৯৩১য়ে সুরসাগর, ১৯৬২তে সঙ্গীত রত্নাকর, ১৯৭০য়ে পদ্মশ্রী, ১৯৭২য়ে দাদাসাহেব ফালকে, ১৯৭৭য়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতাচার্য পাওয়া, ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর সরাসরি অনুরোধে প্রথম ‘জনগণমন’ গাওয়া এবং রেকর্ড করার বিরল কৃতিত্ব যাঁর হয়েছিল, ১৯৫৯ ভারতীয় দূরদর্শনের উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন যে পঙ্কজকুমার মল্লিক তাঁর জন্যে শেষের দিকে ওই কষ্টগুলো কি না পেলেই চলত না! পঙ্কজ মল্লিক মাত্র বাহাত্তর বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৮ সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারী মারা যান। ‘প্রিয়া মিলন কো জানা’(কপালকুণ্ডলা, হিন্দি), ‘ও কেন গেল চলে’, ‘চৈত্র দিনের ঝরা পাতার পথে’, ‘জনম মরণ জীবনের দুটি দ্বার’, ‘চলে যায় মরীচিকা মায়া’,‘কব তক নিরাশ কি অন্ধিয়ারি’,’আয়ি নিত ন্যায়ি রুত কি বাহার আয়ি’,’মাহাক রাহি ফুলওয়ারি হামারে কি’(ডাক্তার,হিন্দি), ‘ইয়ে রাতে ইয়ে মওসম’,’দো নাইয়া মতওয়ারে’(মাই সিস্টার), ‘গুজর গায়া ওহ জামানা’- অজস্র গানের মধ্যে থেকে পঙ্কজ মল্লিকের স্বকণ্ঠের কিছু গান। জলদগম্ভীর আওয়াজ, অনন্য স্বরক্ষেপন, গভীর সুরেলা ভাব -পঙ্কজকুমার মল্লিকের গানের বৈশিষ্ট্য। তাঁর গান শুনলে শ্রোতারা আজও একটা নিবিড় আবেগে সংপৃক্ত হন। নিজেও খুব নিষ্ঠাবান এবং শৃঙ্খলাপরায়ন জীবনযাপন করতেন। কোনোদিন তার অন্যথা করেননি। কিন্তু উনি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে বাংলা তথা ভারতীয় সঙ্গীতের অনেক উপকার হতো।
শেষের কিছু কথা:
কিছু কথা শেষ হলেও শেষ হয় না। যেমন- পঙ্কজ মল্লিক স্মরণে কলকাতার রিচি রোডের নাম ‘পঙ্কজ মল্লিক সরণি’ রাখা হয়েছে। ২০০৬ সালে তাঁর নামে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১০ য়ে ম্যাডক্স স্কোয়ার পার্কে কলকাতা মিউনিসিপালিটি তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করে। জন্মশতবর্ষে তাঁর বাসভূমি ২/২ সেবক বৈদ্য স্ট্রিট, ডোভার টোরেস, বালীগঞ্জ, কলিকাতা-৭০০০১৯ -এই ঠিকানায় পঙ্কজ মল্লিক মিউজিক আর্ট অ্যান্ড ফাউন্ডেশন স্থাপন করা হয়।
লকডাউনের সময় সাম্প্রতিক সময়ে পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া কিছু লাইভ কনসার্টের রেকর্ড আহমেদাবাদ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো রবীন্দ্রসঙ্গীতের হিন্দি ও গুজরাটি সংস্করণ, যা সারা ভারতে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করবার জন্য পঙ্কজ মল্লিক গেয়েছিলেন ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ -র মধ্যে। দর্শকদের অনুরোধে বাংলা রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলোর পাশাপাশি হিন্দি ও গুজরাটি অনূদিত গানগুলো গেয়েছেন। গানগুলো ছিল-’এমনদিনে তোরে বলা যায়’,’সঘনগহন রাত্রি’,’হে মোর দেবতা’,’এসো হে বৈশাখ’, ‘তুমি কেমন করে গান করো’।