মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
দ্বাদশ পর্ব
আমাদের পাড়ায় সব পাল্টে যাওয়া বদলে যাওয়ার হাওয়ার মাঝে যখন ছেলেবেলার এক টুকরোও চোখে পড়ে তখন যে মনে কি আনন্দ পরশ লাভ করি তা বলে বোঝাতে পারবো না। বড় রাস্তার ওপর এমনই এক টুকরো ঘর বারান্দা হলো আমাদের পাড়ার টাইপ স্কুল, মর্ডান কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট। একটা পুরোনো বনেদী বাড়ির একতলার সামনের অংশটুকু আমাদের টাইপ স্কুলের এলাকা। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নিতান্ত ভালো মানুষ আমাদের স্যার অমল শীল।
বর্মণ ডাক্তারবাবুদের কালীবাড়ির গলি, তারপর একখানা বাড়ি ছেড়ে টাইপ স্কুল। গলির প্রথম বাড়িটার কথা যেটুকু মনে পড়ে, কালো কোলাপ্সিবল গেটযুক্ত রাস্তা সংলগ্ন বারান্দা। বাইরে থেকে যেটুকু নজরে আসতো তা বুঝিয়ে দিত বাড়িটা আইন ব্যবসায়ীর। পরবর্তী কালে তা হাত বদল হয়ে অন্য রূপটান করেছে। কিন্তু তার পাশের বাড়িটা আজও পলেস্তরা খসা পুরোনো খিলান, ছোকরা ওঠা মোটা থাম নিয়ে বিদ্যমান। শুনেছিলাম এই বাড়িটা কালনার প্রখ্যাত রাসবিহারী ডাক্তারবাবুদের। এর বাকি অংশ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা ছিল না। যেতে আসতে শুনতাম সামনের ঘরের থেকে খট খট শব্দ ভেসে আসা, বারান্দায় হয়তো ঠেস গুটিকয়েক সাইকেলের।
পাড়ার স্কুল পাস দাদাদের অবশ্য গন্তব্য ছিল এই টাইপ স্কুল।
আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলেই বাবা বললেন টাইপ স্কুলে ভর্তি হবার কথা। কারণ টাইপ জানাটা তখন ভালো চাকরির জন্য আবশ্যিক ছিল, এখনকার কম্পিউটারের জ্ঞানের মতই। পারলে শর্ট হ্যান্ডও শেখ। আরও ভালো।
তাই এতদিন যে খটাখট আওয়াজ বাইরে থেকে শুনেছি সেই খটাখট যন্ত্রঘরে এবার প্রবেশ করতে হল। ঘর ছোট হলেও তিন দিকের দেওয়ালঠেসা লম্বা লম্বা টেবিলে কালো কাপড়ে ঢাকা সারি সারি টাইপ মেশিন। পশ্চিম প্রান্তে স্যারের টেবিল চেয়ার। দেখে দেখে অভ্যাস করার জন্য শক্ত কাগজে আঁটা মেটেরিয়াল, বই, নিউজ পেপার।
সঠিক কী-তে সঠিক আঙুল বসানোর ধরণ, বুড়ো আঙুলে স্পেশ দেওয়া শিখে এ বি সি ডি লেখা শুরু হল। যেন নতুন করে হাতেখড়ি হল। তারপর ছোট শব্দ, বড় শব্দ পার হয়ে “The quick brown fox jumps over the lazy dog” আমার ফুলস্কেপ পাতায় সারি দিয়ে দাঁড়ালো।
প্রাকটিস শেষে স্যার সংশোধন করে দিতেন। তারপর এক দিন আমার স্পিড মাপাও শুরু হলো।
ইচ্ছে ছিল এর সাথে শর্ট হ্যান্ডও শিখব আস্তে আস্তে। কিন্তু কলেজের পড়ার বাইরে জড়িয়ে গেলাম টিউশনি ব্যাচে, কিছুটা হাত খরচের তাগিদাতেই। স্যার বললেন, যথেষ্ট সময় দিতে না পারলে শর্ট হ্যান্ড ভালো হবে না। আসলে যেটুকু দেখেছি, ওটা আর একটা ভাষাশিক্ষারই নামান্তর। তাই সেই ইচ্ছেটা আর পূরণ হলো না।
এই টাইপ স্কুলের সুবাদেও একটা বন্ধুবৃত্ত তৈরি হলো। কেউ সিনিয়র, কেউ জুনিয়ার, কেউ পূর্ব পরিচিত, কেউ বা নতুন মুখ। সবারই প্রাকটিস শ্লট আলাদা কিন্তু ধীরে ধীরে দারুণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলো। তার অন্যতম কারণ ছিল আমাদের সরস্বতী পুজো। এই ছোট্ট ঘরটাতেই স্যারের নেতৃত্বে আমরা পুজোর আয়োজন করতাম। স্কুল জীবনে জমিয়ে পুজোয় অংশ নেওয়া আমি এই পুজোটা পেয়ে যেন বেঁচে গেলাম। ছাত্র ছাত্রীরা মিলে বাজার করা, আল্পনা দেওয়া এই সবে মেতে থাকতাম। আর সব থেকে আকর্ষণীয় ছিল পুজোর প্রীতিভোজের আগে বছর বছর গ্রুপ ছবি তোলা, যে ছবি সাল সম্বলিত হয়ে বাঁধাই হয়ে ঝুলতো স্কুলের দেওয়ালে।
কাছাকাছি কোনো বাড়িতে রান্না খাওয়া হতো। নতুন পুরাতন বেকার সকার নানাবিধ ছাত্রছাত্রীদের সমাগমে ও আড্ডায় মুখরিত থাকতো সরস্বতী পুজোর দিনগুলো। সফল প্রাক্তনীরা আবার পুজোয় সাধ্যমত আর্থিক সাহায্যও করত।
টাইপ ও শর্টহ্যান্ড শেখা এখন চাকরিপ্রার্থীদের আবশ্যিক সিলেবাসে না থাকলেও আমাদের প্রিয় অমল স্যারের মর্ডান টাইপ স্কুলটি এখনও বড়ঘড়ির কাছে কালনার বুকে বিরাজমান। জানি না যুগধর্ম অনুযায়ী পরিবর্তিত সামাজিক চাহিদায় টাইপ স্কুলে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমেছে কি না কিন্তু একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে কালনার অগুন্তি ছেলে মেয়েকে নতুন জীবনের দিশা দেখিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
বড়ঘড়ির কথা শুনে অনেক নতুন কালনাবাসী হয়ত একটু ভুরু কুঁচকে ভাববে। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় হাওড়া স্টেশনের বডঘড়ির আগে আমরা বর্মণ ডাক্তার মোড়ের থেকে কয়েক পা এগিয়ে মিউনিসিপ্যাল রোডের ওপর বড়ঘড়িকে চিনেছি। ঘড়ির দোকান তখন অ্যান্টিক হয়ে যায়নি সেল ফোনের দাপটে। আর হাতঘড়িহীন পথযাত্রীদের সহায় হতে পারতো কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসা রেডিও ঘোষকের গলা অথবা কোনো দয়ালু বিবেচক মানুষের ব্যবস্থাপনায় রাস্তার পাশে সময় দেখার বিশেষ ব্যবস্থা। ঘড়ির ব্যবসায়ী ঘোষেরা তাদের বাড়ির সামনে
একটা বড় আকারের ঘড়ি টাঙিয়ে এই জনসেবার কাজটা করেছিলেন। বহু বছর ধরে তাই ওই স্হানটা বড়ঘড়ি বলে পরিচিত ছিল। এখন সেই বড়ঘড়িও নেই আর ঘড়ির দোকানগুলোর রমরমাও নেই। হাতে হাতে সেলফোন সময় জানান দিচ্ছে। ঘন ঘন ঘড়ির ব্যাটারি পাল্টাবার বা ছেঁড়া ব্যাণ্ড পরিবর্তন করার প্রয়োজন অনেকের আর নেইও। পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জন্য আবশ্যিক ঘুম ভাঙানোর এলার্ম বাজা ঘড়িও একই কারণে প্রায় বাতিল। বাধ্য হয়েই ঘড়ির ব্যবসা বন্ধ করে অন্য পেশার সন্ধান করতে হয়েছে অনেক বনেদী ঘড়িবাড়ির পরবর্তী প্রজন্মকে। শহরের বুকের বেশির ভাগ ঘড়ির দোকানই তাই অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে।