তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)

ইতিহাসাচার্য স্যার যদুনাথ সরকার (১৮৭০ – ১৯৫৮)

( প্রাককথন: ভারতবিদ্যাচর্চা কলামে আজ যার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হবে তিনি পুরোনো দিনের একজন শুধু  ভারতখ্যাত নয়, বিশ্বেও তাঁর কীর্তি সমাদৃত। বর্তমানের  স্কুল কলেজে ইতিহাস পড়ুয়া ছাত্র -ছাত্রীরা এই আদর্শনিষ্ঠ ও পন্ডিত  ঐতিহাসিকের  সারস্বতসাধনা সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। অথচ তাঁর সামগ্রিক জীবন সম্পর্কে যদি অবহিত হয়  তাহলে আমাদের পড়তে পড়তে  বিষ্ময় জাগাবে। একজন ইতিহাসের সাধরণ ছাত্র ও মাষ্টারমশাই হিসাবে তাঁর সম্পর্কে একটি দীর্ঘ আলোচনা করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। তাই কিছু কিছু করে কয়েকটি পর্বে  স্যার যদুনাথ সর্ম্পকে লিখব।)

প্রথম পর্ব 

বাংলাদেশের রাজশায়ী জেলার করচামারিয়ার জমিদারবাড়িতে যদুনাথের জন্ম হয় ১৮৭০ সালের ১০ ডিসেম্বরে। পিতা রাজকুমার সরকার গ্রামের বাড়িতে একটি ভালো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন প্রধানত ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের বই সংগ্রহ করে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজকুমারকে রাজশাহীর ব্রাহ্মসভার ট্রাস্টি নিযুক্ত করেছিলেন। সেই সূত্রে পুত্র যদুনাথের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তবে সেই সম্পর্ক পরবর্তীতে শিথীল হয়ে গিয়েছিল নানা কারণে।
   যদুনাথ গ্রামের স্কুলে প্রথম পাঠ নেন।সাতবছর বয়সে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু এক বছরের আগেই তিনি কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। কোলকাতায় থাকাকালীন রাজকুমার যদুনাথকে নিয়ে দেবেন ঠাকুরের কাছে যান। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়। ১৮৮৭ সালে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন এবং স্কলারশিপ পান। ১৮৮৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। সেই সময় হিন্দু হোস্টেলে তাঁর সহ আবাসিক ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার সুরেশ চক্রবর্তী। তাঁর প্রেরনায় যদুনাথ ফুটবলে আকৃষ্ট হন। তিনি বাল্যবয়সে রুগ্ন ছিলেন, ফুটবল খেলার দৌলতে তাঁর স্বাস্থ্য সুদৃঢ় হয়। যাইহোক তিনি ইংরেজি ও ইতিহাস নিয়ে বি. এ. পরীক্ষা দেন ১৮৯১ সালে ইতিহাসে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেও দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় হন। ১৮৯২ সালে ইংরেজি এম. এ. পরীক্ষার সঙ্গে দেখা যায় যে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনটি পেপারে তিনি গড়ে নব্বয় শতাংশের বেশি নম্বর পান।ব্রিটিশ সরকার তাঁকে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যাণ্ডের জাওয়ার বৃত্তির প্রস্থাব পেলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।এর পর তিনি পাঁচ বছর পড়াশোনা করেন এবং পি.আর.এস. স্কলারশিপ পান। বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করে তিনি একটি থিসিস লেখেন ‘India of Auranzeb ‘ (১৯০১) নামে।
    ইতিমধ্যে এম. এ. পাশ করে তিনি ১৮৯৩ সালে রিপন কলেজে (এখনকার সুরেন্দ্র নাথ কলেজ) ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এরপর তিনি রিপন কলেজ ছেড়ে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন এ ১৮৯৬ সালে যোগ দেন। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে বৃত্তির থিসিসের পরবর্তী অংশের কাজ করতে থাকেন। কি অসাধারণ ধীশক্তি যদুনাথের , যে অধ্যাপনা করছেন ইংরেজি সাহিত্যের আর গবেষণা করছেন ইতিহাসের। ১৮৯৮ সালে ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসে মনোনীত হয়ে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যাপক রূপে যোগদান করেন। কিন্তু পরের বছর তিনি বদলি হয়ে পাটনা কলেজে চলে যান। তারপর বছর খানেক বাদে তিনি আবার প্রেসিডেন্সীতে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে ১৯০১ সালে তার প্রথম বই ‘India of Aurenzeb’ প্রকাশিত হলে ঐতিহাসিক মহলে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পাটনা কলেজে পড়ানোর পর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আহবানে সাড়া দিয়ে তিনি সেখানের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। কিন্তু দুবছর যেতে না যেতে সেখানকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মর্মাহত হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। এরপর তিনি আবার ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের মধ্যে দিয়ে কটকের বিখ্যাত র‍্যাভেনশন কলেজের একই সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। মজার ব্যাপার হলো হলো একই সঙ্গে তিনি বাংলাও পড়াতেন। বর্তমান সময়ে যা ভাবায় যায় না। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন আবার ইতিহাসেও অসাধারণ ব্যুৎপত্তি প্রদর্শন করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি  দুইটি বিষয়ে ক্রমাগত নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ইতিমধ্যে জোরকদমে তাঁর ইতিহাস গবেষণার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে পাটনাতে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯২৬ সালে পাটনা কলেজ থেকে তিনি প্রত্যক্ষ শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর পুরোপুরি পেশাদার ঐতিহাসিক হিসাবে তিনি ইতিহাস গবেষণা কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রকাশিত হতে থেকে একের পর এক বিখ্যাত ইতিহাস গবেষণা গ্রন্থ। এগুলির মধ্যে তাঁর ভারতবিদ্যাবোধের পরিচয় পাওয়া যায়।           

( ক্রমশ )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *