মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
একাদশ পর্ব
ছোটবেলায় চারপাশে যে সমস্ত মানুষজন আমাদের ঘিরে ছিলেন তাদের সবারই কথা এই ধারাবাহিক লিখতে বসলে মনের কোণে কম বেশি উঁকি দিয়ে যায়। নাম ধরে কোনো পাড়া কখনই আমার পাড়া ছিল না, কেন না, রাস্তা পার হলেও পাড়া পাল্টে যায়, কখনও পাশের বাড়িও অন্য পাড়ার হয়ে যায়। আমার এই গল্পের সীমানা তাই আমার সেই সব পরিচিত মানুষেদের ছুঁয়ে যাচ্ছে যাদের সাথে নানা কারণে নিত্য যোগাযোগ ঘটতো।
আজ পঁচিশে বৈশাখ এই লেখাটি লিখতে বসে একজনের আবছা মুখ মনের চোখে ভেসে উঠলো হঠাৎ। আর আজ পঁচিশে বৈশাখ বলেই তাঁর কথা আমায় শ্রদ্ধার সঙ্গে সবার আগে স্মরণ করতে হবে।
বাঙালি ঘরে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়ে গান বাজনা চর্চা করবে না তাই কি হয়! আর আমাদের সেই ছোট্টবেলায় গান বাজনা চর্চার প্রধান দুটি উপকরণ ছিল হারমোনিয়া আর তবলা। নাচের ঝোঁক যে ছিল না তা নয়, খুব ছোট থাকতে নাচের তালিমও শুরু করিয়েছিলেন বাবা মা, কিন্তু আমি শিশুসুলভ দুষ্টুমিতে তালিমের প্রতি নিয়মানুবর্তী ছিলাম না। ফলে সেই শিক্ষা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। স্কুলে শিক্ষিকারা ব্রতচারী, গান, নাচ শেখাতেন। সবার সাথে আনন্দের সঙ্গে যোগ দিতাম।
তখন পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছি। একটা হারমোনিয়ামের মালিক হলাম। আমার মামা মানস চক্রবর্তী নিজে গানের চর্চা না করলেও সঙ্গীতের অনুরাগী ছিলেন। হারমোনিয়ামটা কেনার পেছনে মামারও অবদান ছিল।
অন্যর হারমোনিয়ামে আলপটকা রিড টিপে আনন্দ পাওয়া আর নিজের দক্ষতায় সঙ্গীত পরিবেশন করা এক নয়। নিজের একটা হারমোনিয়াম হাতে পেয়ে এই কথাটাই হয়ত মনে হয়েছিল।
তারপর একদিন আমাদের বাড়িতে এলেন ৺অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তাঁকে আগে দেখলেও সেইভাবে জানতাম না তাঁকে। শুনলাম উনি আমায় গান শেখাবেন। এইভাবেই আমার প্রথাগত গানের চর্চা শুরু হল। বাড়ি থেকে ওনাকে দাদু সম্বোধন করতে বলা হয়েছিল। দাদু আমাকে গানের হাতেখড়ি দিলেন।
এরপর কখনও আমাদের বাড়িতে উনি আসতেন, আবার বেশির ভাগ সময় উনি ওনার বাড়িতে আমায় চলে যেতে বলতেন। গান শেখার চেয়েও এই শিখতে যাওয়াটাতে আমার বেশি আগ্রহ ছিল। ওনার বাড়িতে এক একা যাওয়াটা আমি উপভোগ করতাম। গঙ্গার পার্শ্ববর্তী নিচের রাস্তার কথা আমি আগেও উল্লেখ করেছি। সেই রাস্তার উপর হাবু সাহার বিখ্যাত বাড়ির পিছনেই ওনাদের বাড়ি ছিল। ভোঁদা ময়রার দোকানের পাশের গলি দিয়ে গেলে নিচের রাস্তায় নেমে বাঁ হাতে ঘুরে কয়েক পা হেঁটে হাবু সাহাদের বাড়ি। ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে হলেও পাকা রাস্তার পাশে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়িতে উঠতে হতো। সিঁড়িতে উঠে রাস্তা ধরে আট দশ পা এগিয়েই গান দাদুর বাড়ি। আসলে সত্যিই আমাদের ডাঙ্গাপাড়া গঙ্গার তল থেকে বেশ উঁচু । নিচু বলেই তো তা নিচের রাস্তা।
আর যদি এই রাস্তায় না যাই তবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ডান হাতের যে কোনো গলি ধরা যায়। সেক্ষেত্রে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার মজাটা বাদ যেত। কাছেই, অথচ এই গলিপথের মজাটা সে বয়সে বেশ লাগতো।
ছাদের দু দিকে দুটো ঘর। কখনও উত্তরের দিকের ঘরে, কখনও বা দক্ষিণের দিকের ঘরে দাদু হারমোনিয়াম নিয়ে বসতেন। সারা সপ্তাহের রেওয়াজ ঠিক মতো হয়েছে কি না বাজিয়ে দেখে নিতেন, নতুন গান তোলাতেন আমার খাতায় নিজের হাতে আগে স্বরলিপি লিখে দিয়ে।
স্কুলের প্রার্থনা সংগীত ছিল অনেকগুলো। তার থেকে রবীন্দ্রসংগীতও যেমন শিখিয়ে ছিলেন তেমনি নজরুল, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালও শিখিয়েছিলেন। দাদুর তোলানো ‘মন জাগো মঙ্গললোকে’ আমার এই প্রিয় প্রার্থনার গানটির কথা আজ বিশেষ করে মনে পড়ছে।
দাদুর বাড়ির আর সকলেই আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসতেন। বস্তুত এই বাড়ির আশেপাশের সকলকেই আমাকে স্নেহের চোখে দেখতেন তার একটা বড় কারণ হলো, হাবু সাহাদের মূল বাড়ি সংলগ্ন একটা বাড়িতে আগে আমার মামাবাড়ির সকলে ভাড়া থাকতেন। কর্মসূত্রে আমার মায়ের বাবা ফণীভূষণ চক্রবর্তী কালনায় অনেক বছর ছিলেন। আমার জন্মের পর দাদুর বদলি হলে সকলে মেদিনীপুর চলে আসেন।
যাই হোক, গান শেখার এই পর্ব খুব বেশি দিন চলে নি কারণ গান দাদু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এই গান দাদুর কথায় মনে পড়লো ও বাড়ির জামাই কেষ্টজেঠুর কথা। ঝিকিপিসির সাথে কেষ্টজেঠুর বিয়ে হয়েছিল। ভালো নাম দ্বিজেন দাস। কেষ্টজেঠুদের বাড়ি ছিল মিউনিসিপ্যাল রোডের ওপর বর্মণ ডাক্তারবাড়ির থেকে আর দু চার পা এগিয়ে টাইপ ইস্কুলের সামনে।
কেষ্টজেঠুরা চার ভাই। বড় প্রয়াত দীপক দাস কালনার বিশিষ্ট সাহিত্যিক। কালনার ইতিহাস নিয়ে নিয়মিত চর্চায় ছিলেন। খুব ছোট থেকেই দাদুর সাথে এই বাড়িতে আনাগোনা ছিল আমার। কেষ্ট জেঠুর বাবার কথা আমার এখন মনে পড়ে না। কিন্তু, ঠাকুমা অর্থাৎ কেষ্টজেঠুর মায়ের কথা, ওদের বাড়ির টিয়াপাখির কথা আমার বেশ মনে আছে। কেষ্ট জেঠুর একটা বই বাঁধাইয়ের দোকান ছিল এই বাড়িতেই। আমার অমর চিত্রকথা, বা এই রকম চটি বই কিছু জমে গেলেই ওগুলো বাবা বাঁধাই করতে দিয়ে দিত। কেষ্ট কাকাও কিছু কিছু লিখতেন। ছড়াপত্র পরতে ওনার লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেটা অনেক পরের কথা। ছোটবেলায় আর যে কারণে কেষ্টজেঠুতে ভালো লাগতো তা হল, কাগজ ভাঁজ করে কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে উনি দারুণ নক্সা করতেন। কাগজের ভাঁজ খুলে মেলে ধরতেন বিস্ময়। অনেক বছর পর আমার ছোট্ট ছেলেকেও ওনার হাতে এই কাগুজে কারুকার্য দেখে একই রকম অবাক হতে দেখেছি। কেষ্টজেঠু আর তার ভাই কানুকাকা আমার ছেলের বড় টিকটিকি আর টিকটিকি। এই অদ্ভুত নামে ডাকার পেছনে একটা কারণ তো ছিলই। সেটা নাতি আর দাদুদের ভেতরের ব্যাপার আর কি! মনে হয় বাড়ির সামনের অংশে কয়েক বছর আগে কানুকাকা একটা দোকান করেছিল। সেই দোকানের দেওয়ালে প্রায় কুমীর সাইজের টিকটিকির সাথে মোলাকাত হতো আমার পুচকে নীলের। আর আমি তো কেষ্টজেঠুর মুখে চিরকাল নেড়ি ডাকটাই শুনে এলাম।
এই ভালোবাসার মানুষরা আজ কেউ আছে, কেউ নেই। কালের চাকা গড়গড়িয়ে চলেছে শুধু নিজের খেয়ালে।