তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)

মহামহোপাধ্যায় সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ (১৮৬৯-১৯২০)

ভারতগৌরব সতীশচন্দ্র বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খানকুলা গ্রামে ১৮৬৯ সালে জন্মগ্রহন করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম পীতাম্বর বিদ্যাবাগীশ। তাঁদের কৌলিক পদবী ছিল আচার্য। শৈশবেই তিনি পিতৃহারা হন। আর্থিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। গ্রামের প্রাথমিক পাঠ শেষ করে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস নবদ্বীপে চলে আসেন। সেখানকার হিন্দু স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ  হন। সেই সময় নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজের দ্বারা আয়োজিত এক বিশেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি বিদ্যাভূষণ উপাধি অর্জন করেছিলেন।

   ১৮৯৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করার পর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারী কলেজে অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। একই সঙ্গে তাঁর নিজস্ব পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি সেই সময় নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছ থেকে কাব্য ও ন্যায় শাস্ত্রের উপর পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। এই অধ্যাপনায় থাকাকালীন সময়ে বুদ্ধিস্ট টেক্সট সোসাইটির অনুরোধে সরকারী কর্তৃপক্ষ তাঁকে দার্জিলিং পাঠিয়েছিল। এই প্রবাস জীবন তাঁর কাছে আশীর্বাদের মতো হয়েছিল। ১৮৯৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত দার্জিলিং এ অবস্থানকালে তিনি সেখানকার তিব্বত পরিব্রাজক ও বৌদ্ধ শাস্ত্রে সুপণ্ডিত শরৎচন্দ্র দাসের সঙ্গে যৌথভাবে ইংরেজি – তিব্বতী অভিধান সংকলন করেছিলেন। দার্জিলিং থাকাকালীন অবস্থায় তিনি সেখানে অবস্থানরত এক তিব্বতী লামা পন্ডিতের কাছ থেকে তিব্বতী ভাষাটা ভালোভাবে রপ্ত করে নেন, যা তাঁর পরবর্তী সারস্বত সাধনায় ভীষণভাবে কাজে লেগেছিল।

দার্জিলিং থেকে ফিরে আসার পর তার কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা হয় কলকাতার সংস্কৃত কলেজ।  সেই সময় কলকাতায় শ্রীলঙ্কা ও ব্রহ্মদেশের কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন, যাদের কাছ থেকে তিনি পালি ভাষাটাও রপ্ত করে নেন। ঠিক এই সময়েই স্যার আশুতোষ এর উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালি তে এম. এ.  চালু হলে সতীশচন্দ্র এম.এ., পালিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এখানে একটা জিনিষ মনে রাখা দরকার যে সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিতে কোনো উপযুক্ত পরীক্ষক না থাকায় উত্তরপত্রগুলি সব লন্ডনে বিখ্যাত পালি বিশেষজ্ঞ স্যার রিজ ডেভিস এর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি সতীশচন্দ্রর উত্তরপত্র পড়ে তাঁর পালি ভাষার পান্ডিত্যে অভিভূত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে এক চমৎকার পত্র লেখেন সতীশচন্দ্রের প্রশংসা করে। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে বদলি হয়ে আসেন। ইতিমধ্যে তাঁর বৌদ্ধ, পালি এবং সংস্কৃতে মূল্যবান ভারতবিদ্যা বিষয়ক রচনা দেশ – বিদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।
  

তাঁর সম্পাদনায় বিখ্যাত Indology: Past, Present and Future ‘  সারা ভারত জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ছিল, A History of Indian Logic , যেখানে তিনি অতীব যত্ন সহকারে যুক্তি তর্কের জটিল বিষয়ের সহজ সরল ভাষ্য প্রদান করেছিলেন। ভারতে, বিশেষত বৌদ্ধ ও পালি সাহিত্য ও দর্শনের উপর তিনি ব্যুৎপত্তির পরিচয় রেখেছিলেন। ১৯১০ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত হন।
   সতীশচন্দ্র ভারতবিদ্যা চর্চার ধারাটিকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর মূল চর্চার কেন্দ্রে ছিল কাব্য, দর্শন, ন্যায় শাস্ত্র। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অটুট ছিলো। সেখানে বাংলা এবং ইংরেজীতে বহু মূল্যবান প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন। সতীশচন্দ্র ১৯২০ সালে মাত্র একান্ন বছর বয়সে ইহজগত ত্যাগ করেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *