অম্বরীশ ঘোষ

বিষয় পরিচিতি 

প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে অরণ্য, পাহাড়, নদী আর চা-বাগিচার পরিধি জুড়ে সমগ্র ডুয়ার্সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন নানান জনগোষ্ঠীর মানুষ। স্বতন্ত্র তাদের লড়াই, স্বতন্ত্র তাদের ইতিহাস। এই লড়াই আর ইতিহাসের একটি বৃহৎ পরিসর জুড়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর নারীদের কর্মতৎপরতা আর নিপুণতার অধ্যায়গুলো। তাদের নিয়েই এই ধারাবাহিক নানান জনগোষ্ঠীর বীরাঙ্গনা।

ওরাঁও জনগোষ্ঠীর ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল : ফ্লোরা কেরকেট্টা

সেই রাত্রিটা ভীষণই দুর্যোগপূর্ণ ছিল। শিবু ওরাঁও- এর স্ত্রী সন্তান প্রসব করবেন। মাঝরাতে হঠাৎ প্রবল প্রসব বেদনা। ডুয়ার্সের চুনিয়া চা বাগান থেকে আলিপুরদুয়ার হসপিটাল অনেক দূর। একেই তো যানবাহনের সমস্যা তার ওপর দুর্যোগপূর্ণ মধ্যরাত্রি। বছর ত্রিশের আগের রাস্তাঘাট আর যানবাহনের সংকটের কথা শিবুর ভালোভাবেই জানা। প্রতিবেশীর থেকে ছাতা চেয়ে কোমরে গামছা বেঁধে নিয়ে শিবু দৌড় লাগালেন আগাপীট কেরকেট্টার বাড়িতে। হাতে লন্ঠন। প্রকৃতির ভয়াবহ চেহারার সামনে দুর্বল লন্ঠন জানান দিচ্ছে, যে কোন সময়ই তার সামান্য জৌলুসটুকুও নিভে যেতে পারে। অন্ধকার জমাট বেঁধে ওঁত পেতে আছে সেই সামান্য আলোটুকুও গিলে খেয়ে তার সার্বভৌমত্বের ঝান্ডা তুলে ধরতে। শিবু দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করেন আগাপীট কেরকেট্টার। সাথে করুণ আর্তি। মিনিট খানেক বাদে দরজা খুলল। আগাপীট কেরকেট্টা এবং তার স্ত্রী ফ্লোরা লন্ঠন হাতে দরজায়।  ঘরের ভেতরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে তাদের আট মাসের সন্তান। শিবু হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ফ্লোরার পায়ে। স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠে গেছে। বাঁচাতে হবে এ যাত্রায়। আগাপীট কম বেশি অভ্যস্ত এই বিষয়গুলোতে। ফ্লোরা বাক্স নিয়ে পোশাকটা বদলে ছুটলেন শিবুর সঙ্গে। বাচ্চার খেয়াল রাখতে বললেন আগাপীটকে। ভোরবেলার দিকে শিবুর ঘর আলো করে জন্ম নিল সন্তান। শরীরে ক্লান্তি নিয়ে কিন্তু মুখ ভর্তি প্রশান্তির হাসি নিয়ে ফ্লোরা ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে।  এইরকম নানান কঠিন সমস্যায় নিজের এবং আশেপাশের চা বাগানগুলোর মানুষের পাশে সর্বক্ষণ দাঁড়ান এই ‘নার্স বহিন’ ফ্লোরা কেরকেট্টা।

                      ওরাঁও জনগোষ্ঠীর মানুষ ফ্লোরা। ফ্লোরার পৈত্রিক ভিটে ছত্তিশগড়ের কুনকুড়িতে। বাল্য নাম ফ্লোরা কুজুর। তিন বোন এক ভাই, মেজো বোন ফ্লোরা। শৈশব থেকেই নানান দিকে আগ্রহী, নানান দিকে পারদর্শী। ওরাঁওরা বিশ্বাস করেন যে তাদের প্রধান দেবতা ধর্মেশ, যিনি তাদের মত অনুযায়ী এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন, বিশেষভাবে আশীর্বাদ করেছেন ফ্লোরাকে।  স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় যে কোন স্থানে থাকতেন। বাৎসরিক ফলাফলের ভিত্তিতে স্কুলে একটি নিয়ম বিদ্যমান ছিল। যে প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে থাকবে সে তার বাবাকে ফলাফল প্রকাশের অনুষ্ঠানের মঞ্চে ফুলের মালা পরাবে।  ফ্লোরার বাবা অন্যান্য দিন আর যেখানেই থাকুন না কেন ফলাফলের দিন মেয়ের জন্য প্রাপ্ত সম্মানটুকু উপভোগ করতে ছুটে আসতেন স্কুলে।  কিন্তু ভাগ্যের চাকা সব সময় সদয় থাকে না। নবম শ্রেণীতে যখন ফ্লোরা, তখন অসুস্থতার জন্য পরীক্ষা দেওয়া হয়ে উঠল না। বছর পঞ্চাশ আগের ছত্তিশগড়ের কুনকুড়িতে নারী শিক্ষার চল ততটাও ছিল না যে লেখাপড়া একবার বন্ধ হয়ে গেলে সমাজ বা বাড়ির লোকজন সে বিষয়ে আর আগ্রহ দেখাবে। পরবর্তীতে অষ্টম শ্রেণী পাস যোগ্যতা দেখিয়েই পালামৌতে নার্সিং ট্রেনিং করেন ফ্লোরা। তারপর ট্রেনিং নেন পাটনা তে।  ওরাঁওরা বিশ্বাস করেন যে তাদের মৃত পূর্বপুরুষ যাদের তারা ‘পাকবলার’ বলে ডাকেন, তাদের আশীর্বাদ রয়েছে তাদের জীবনে। মৃত্যুর সময় তারা আশীর্বাদ রেখে যান জীবিতদের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।  সেভাবেই পড়াশোনায় বিঘ্ন এলেও ‘পাকবোলার’দের ও দেবতা ধর্মেশের আশীর্বাদে নতুন দিশার সন্ধান পেলেন ফ্লোরা। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। সেটা পাহাড়-পর্বত- সমতল যেখানেই হোক না কেন!

                              পাহাড়-পর্বত-সমতলের কথা যখন উঠেই এলো, তখন ওরাঁওদের সমাজে প্রচলিত একটি মতবাদ বা বিশ্বাসের কথা ছুঁয়ে যাই একটু।  ভূমিকম্পের বিষয়ে ওরাঁওদের মনে একটি বিশ্বাস আছে। ওরাঁওরা বিশ্বাস করেন যে একটি বিশালাকৃতি কচ্ছপের পিঠের ওপর রয়েছে পৃথিবীটা। পাতাল থেকে অনবরত মাটি তুলে চলেছিল কেঁচোরা। সেই মাটি কচ্ছপের পিঠে ফেলে মই দিয়ে সমান করার চেষ্টা করে তারা। তাই পৃথিবীর কোথাও উঁচু উঁচু পাহাড়-পর্বত, কোথাও মালভূমি, কোথাও বা সমভূমি। এক নাগিনী ফনা তুলে বসে থাকে কচ্ছপের মুখের সামনে। পাহারা দেয় সে যাতে কচ্ছপ নড়াচড়া করতে না পারে। মাঝে মাঝে তাও কচ্ছপ লুকিয়ে চুরিয়ে একটু-আধটু নড়াচড়া করে ওঠে। ফলে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্পের।

                     সাম্প্রতিক চা বাগানের পরিস্থিতি যারা দেখেছেন, আঁচ করতে পারবেন সেগুলোর শ্রমিক তথা অধিবাসীদের কষ্টের যাপনের কথা। অভাব, টালমাটাল স্বাস্থ্য, অনটন প্রভৃতিতে জেরবার তারা।  ফ্লোরা চুনিয়া চা বাগানে এই মানুষগুলোর পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রয়েছেন।  অসুখ-বিসুখের সমস্যায় দিনরাত জ্ঞান করেননি। যখনই ডাক পড়েছে, ছুটে গিয়েছেন। মানুষ নাইটিঙ্গেল ফ্লোরেন্সের সাথেও তুলনা করেন তার। এক সময় চলে আসতে হয়েছিল ডুয়ার্সের চুনিয়া চা বাগান থেকে কার্তিকা চা বাগানে। কিন্তু প্রায়শই অনুরোধ মাখা ডাক আসতো চুনিয়া থেকে। সাথে কার্তিকাতো নতুন সংযোজন রইলোই। কখনোই এই গরীব মানুষগুলোর থেকে পয়সা নিতেন না ফ্লোরা। কারো সামর্থ্য থাকলেও নিতেন না।  বরং নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সব সময় পরিপূর্ণ রাখতেন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ফার্স্ট এইড বক্সটাকে। একটি বিশেষ ঘটনা আজও লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়। সদ্য সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ফ্লোরা। দ্বিতীয় সন্তান। সন্তানের বয়স একুশ দিন।  নিজেও অসুস্থ। খবর এলো যে অন্যান্য মহিলারা ব্যর্থ হচ্ছেন একটি ডেলিভারি কেসে। ডেস্পারেট সিচুয়েশন! অগত্যা অসুস্থ শরীর নিয়েই ছুটে গেলেন। সাফল্যও পেলেন। নিজের শরীরের যন্ত্রনা ভুলে হাসিমুখে ফিরে এলেন সাফল্য এবং তৃপ্তির স্বাদ মেখে। আর ইনজেকশন নেবার প্রশ্ন এলে সকলের পছন্দের অপশন ছিল ফ্লোরা। একবার প্রতিবেশী জর্জ কুজুরের হাতে বড় শাল ঢুকে যায় লাকড়ি কাটতে গিয়ে। নতুন ব্লেড গরম জলে চুবিয়ে ঠান্ডা করে আঙুলের চামড়া কেটে বের করে দেন ফ্লোরা। এইরকম কত কত উদাহরণ লোকোমুখে ঘুরে বেড়ায় চুনিয়া চা বাগানে! একদিন দু’দিন নয়। কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে একনাগাড়ে এভাবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন ন ফ্লোরা। শারীরিক দুর্বলতার ও অসুবিধার কারণে দৌড়ঝাঁপ বেশ কিছুটা কমলেও একেবারে সরে আসতে পারেননি ফ্লোরা। নানান সময় নানান ভাবে পাশে থেকেছেন মানুষের।

                ফ্লোরা শুধু যে অসুস্থ মানুষদের সেবাই করে গেছেন, তা কিন্তু মোটেই নয়। তার কর্ম পরিধি জুড়ে নিজের জনগোষ্ঠীর মানুষদের সংস্কৃতি রক্ষার অধ্যায়ও সমুজ্জ্বল। করম পূজা সহ নানান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছেলে মেয়েদের নাচ গান শেখান, অংশগ্রহণ করেন নিজেও। নিজের সংস্কৃতি ভুলে যাবার অর্থ ব্রহ্মাণ্ড মাঝে হারিয়ে যাওয়া, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া – এটাই ফ্লোরার ভাবনা। ফলে তরুণদের বিশেষভাবে বোঝান নিজের সংস্কৃতির গুরুত্ব, তাকে আত্মস্থ করার প্রয়োজনীয়তা। ফলে ভাদ্র মাসে উদিত চাঁদের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে তাদের সবচেয়ে জাঁকজমকের করম পূজা ও উৎসবে বা প্রতিবেশীদের বিয়ের গান পরিবেশনে বিশেষ ব্যস্ত থাকতে হয় ফ্লোরাকে। মানুষের আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছায় ফ্লোরা যেন প্রতিনিয়ত হয়ে ওঠেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *