মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস 

দশম পর্ব

বর্মণ ডাক্তারখানার মোড় থেকে দক্ষিণের রাস্তা ধরলে বাঁ হাতে ডাক্তারবাবুর চেম্বারের আর এক দরজা। ডান হাতে অমর কাকার সেলুন আর তারপর সাইকেল সারাইয়ের দোকান। বাঁ হাতে এর পরের বাড়িটা কালনার মানুষের কাছে একটা সময়ের দর্পণ হয়ে আছে বাড়ির একতলার বাসিন্দা মানসী পালের কারণে। ডাঃ দিলীপ বর্মণের ওই বাড়িতে দীর্ঘদিনের বাস ছিল হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মানসী দিদিমণির। শিক্ষিকা হিসাবে বিদ্যালয়ের ভিতরে বাইরে পরিচয়ের বাইরে তাঁর একটি বৃহত্তর পরিচয় আছে। তিনি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী। আমাদের ক্লাসরুমের চেনা মানুষটিকে যখন দূরদর্শনের পর্দায় সংগীত পরিবেশন করতে দেখতে পেতাম তখন কি একটা অন্য অনুভূতি হতো! আসলে তখন পর্দার মানুষগুলো এত সহজলভ্য ছিল না। দিদিমণি ও ওনার ভাই পার্থবাবুর একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা ছিল। কালনার মানুষকে উৎকৃষ্ট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপহার দিতে মাঝে মাঝেই সেই সংস্থাকে সচেষ্ট থাকতে দেখেছি। তৎকালীন রবীন্দ্রসদনের সেই নৃত্য গীত নাট্য মুখরিত সন্ধেগুলো আজও হীরকছটা নিয়ে উজ্জ্বল পুরোনো মানুষদের মনে।


আমরা বিদ্যালয়ে দিদিমণিকে আমাদের মতন করে পেতাম। আর ভরা প্রেক্ষাগৃহের সামনে আমাদের দিদিমণির দলের অনন্য উপস্হাপনা অন্য এক জগতে নিয়ে যেত। সত্যি বলতে কি, আমাদের বিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে যত নাম ডাক তার সিংহভাগ কৃতিত্ব মানসী দিদিমণির ছিল।
কতদিন ওনার ঘরে গেছি স্কুলের অনুষ্ঠানের‌ বাড়তি রিহার্সালের জন্য ডেকেছেন বলে। এক চিলতে ঘর বারান্দায় টেবিল চেয়ার সরিয়ে নাচের স্টেপ তুলছে কেউ কেউ। হারমনিয়াম ধরে বাজিয়েই চলেছেন তিনি অক্লান্ত ভাবে। ওনাকে ঘিরে গানের দলের মেয়েরা।
আবার কখনও গিয়ে খুলে ধরেছি ‘উনিশ শো ছেচল্লিশ সাত চল্লিশ’ – এই লাইনগুলো আর একবার বুঝিয়ে দেবেন? বাড়িতে পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ক্লাসে যা বলেছিলেন ঠিক বুঝতে পারি নি, বা নোট করতে পরি নি।আমাদের ছোটবেলায় সব বিষয়ের টিউশন নেবার চল ছিল না। স্কুলের ওপর অনেকটা নির্ভর ছিলাম আমরা।
একটুও রাগ না করে বোঝাতে বসে যেতেন।
দিদিমণি পরে বাড়ি করে সিদ্ধেশ্বরী পাড়ায় চলে যান। এক সুরমূর্ছনার বলয় যেন‌ সরে যায় পাড়া থেকে।
ওই বাড়ির আর এক বাসিন্দার কথাও বলতে হয়। কারণ তিনিও কম বিখ্যাত মানুষ ছিলেন না। তিনি অর্থাৎ কবি বিবেকানন্দ সেনগুপ্ত সপরিবারে বেশ কয়েক বছর এই বাড়িতে কাটিয়ে পাকাপাকি ভাবে কাটোয়ায় চলে যান।
এই পরিবারের কাছে আমি যে কি পরিমাণ স্নেহ আর প্রশ্রয় পেয়েছি তা বলে বোঝাবার নয়। জেঠু জেঠিমা আর তাঁদের দুই ছেলে বাপিদা আর ছোটবাবুদার কাছে ছিল কতই না আব্দার, অত্যাচার। ওনাদের ঘরের সরস্বতীর সামনে আমার হাতেখড়ি হয়। এখনও মনে আছে আমরা সবাই মিলে কলকাতার চিড়িয়াখানা জাদুঘর দেখতে গেছিলাম। কবি জেঠু এল আই সি অফিসে কর্মরত ছিলেন। পরে কাটোয়ায় চলে গেলেও যোগাযোগ অটুট ছিল। নানা কাজে কালনায় এলে আমাদের ঘরেই উঠতেন। আমাকে লেখালেখির নেশায় টেনে আনার পেছনে আমার বাবা ছাড়া আর যাঁরা আছেন তার মধ্যে বিবেকানন্দ জেঠু অবশ্যই প্রধান একজন।‌


ওই বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের বিরাট বাড়িটা ছিল তারক ঘোষের। পরে ঠাকুর পাড়ার তারাপদ সাহা এই বাড়ি কিনে নেন। দোতলা বাড়ি। সুবিশাল তিনতলা ছাদে ঠাকুর ঘর ছাড়াও একটা কাচের জানালা দেওয়া বড় ঘর ছিল। সারা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিল সাবেকি আসবাব পত্র। সামনে পিছনে বাগান। বাড়ির মাঝখানেও ছিল উঠোন।
তারাপদ সাহার স্ত্রী শেফালি সাহা আমার বাবাকে ভাই ডাকতেন। এবং আমার নিজের কোনো পিসি না থাকায় আমি জ্ঞান হওয়া থেকে শেফালি পিসিকেই নিজের পিসি জানতাম। ভাই বোনের মধ্যে যেমন পারিবারিক বন্ধন থাকে আমাদের দুই বাড়িতে তেমনি ছিল। ভাইফোঁটা, পুজোতে দেওয়া নেওয়া তো সাধারণ ব্যাপার। পিসি ছিল আমাদের মুস্কিল আসান।
পিসির ছয় ছেলে। কালনার ঠাকুর পাড়াতে বাড়ি ছিলই। বাড়িতে বড় করে লক্ষ্মী পুজো, পরবর্তীতে কালী পুজোও চালু ছিল। বড় ছেলের বিয়ের পর ভাদুড়ীপাড়ায় তারক ঘোষের বাড়িটাও কিনে নেন পিসেমশাই। ফলে আমাদের খুব আনন্দ হয়েছিল। আর পিসিকে অনেক বেশি করে দেখার সুযোগ হয়েছিল। পরিশ্রম করে প্রায় শূণ্য থেকে শুরু করে পিসেমশাই ব্যবসাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। আনাজ সবজির আড়ত ব্যবসা থেকে ধীরে ধীরে ওদের পরিবারের ব্যবসা নানা ক্ষেত্রে বেড়েছিল। একই রকম ভাবে ঘর সংসার আত্মীয় স্বজনকে যত্ন ও সেবার মাধ্যমে অমানুষিক পরিশ্রম করে বেঁধে রেখেছিল পিসি।
বাড়িতে নানা পূজার্চনা সর্বদাই লেগে থাকত।‌ থাকত আত্মীয় যাতায়াত। পিসির রান্নার হাত দুর্দান্ত। আমরা হয়ত রাত করে বাইরে থেকে ফিরেছি, বেলাবেলি কোথাও যাবার ট্রেন ধরার আছ। পিসির ঘরেই পাত পড়তো আমাদের। কখনও অসুস্থ শরীরে শুয়ে থাকলেও পিসির স্নেহের স্পর্শের অভাব হতো না।
পিসিরা যখন এ পাড়ায় আসে তখন আমি যথেষ্ট বড় কিন্তু পাড়ার ছোটদের খেলাধুলা করার জায়গা হয়ে গেল পাঁচিল ঘেরা বাড়ির সামনের নিরাপদ জায়গাটা।


আমাদের নাটকের দলের রিহার্সালের জন্য‌ আমরা তখন জায়গা খুঁজে পেতাম না তখনও পিসির শরণ নিতে হতো। বাড়ির একতলার বৈঠকখানা  অথবা তিনতলার সেই অনেক কাচের জানালাওয়ালা হাওয়াময় ঘরটি আমাদের দখলে আসতো কয়েক ঘণ্টার জন্য। আমাদের ব্যারিকেড দলের ছোটদের গ্রুপটার মহড়ার সাথে খানিক মজা দুষ্টুমি সবই চলত। পাড়ার প্রায় সব খুদেকেই আমাদের দলে এনে ফেলেছিলাম আমরা। পিসির বড় নাতি বাবু (প্রশান্ত) আমাদের দুই ভাই বোনের খুব নেওটা ছিল। আর ছিল আর এক নেওটা বোন কৃষ্ণা। ওরা ছাড়াও পকাইরা তিন ভাই, যুধাজিৎরা দুই ভাই, অসিতরা দু’জন, টুবাই, টুবলি, তৃষা, পটল, তন্ময়, প্রদীপ আরও অনেকে ছিল আমাদের খুদেদের দলে। আমার ভাই ছিল একটু কড়া শিক্ষক অন্তত নাটকের ব্যাপারে বড্ডই শাসনে রাখতে ওদের। কিন্তু পিসির বাড়িতে রিহার্সালের সময় হওয়া আনন্দগুলো হয়ত ওদের আজও মনে আছে।
পিসেমশাই গত হয়েছেন। তবু এই বয়সে পিসি এখনও সচল, অটল কর্তব্য কর্মে। বহতা সময় হয়ত যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে কিন্তু ভুলিয়ে দিতে পারে নি আমাদের পরিবারে শেফালিপিসির অবদানকে।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *