তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)

মহামহোপাধ্যায় প্রমথনাথ তর্কভূষণ (১৮৬৫-১৯৪৪)

উনিশ শতকের শেষার্ধে কিঞ্চিৎ অপরিচিত এক বাঙালি ভারতবিদ্যাচর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি প্রমথনাথ তর্কভূষণ। প্রমথনাথের জন্ম উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ার এক বৈদিক ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৬৫ সালে। তাঁর পিতা তারাচরণ তর্করত্ন ছিলেন কাশি মহারাজের প্রধান পণ্ডিত। প্রমথনাথের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ভাটপাড়ার চতুষ্পটিতে। সেখান থেকে কাব্যের পরীক্ষায় সফল হবার পর তিনি ধর্মশাস্ত্র, সাংখ্য দর্শন, ন্যায়শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। জানার প্রবল আগ্রহে  তিনি ১৮ বছর বয়সে কাশী গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি সাক্ষাৎ করলেন তখনকার দিনের বিখ্যাত পণ্ডিত স্বামী বিশুদ্ধানন্দর সঙ্গে। তিনি স্বামীজির কাছে নিজের মনের কথা খুলে বললেন, যে এক দিকে জ্ঞানতৃষ্ণা অন্যদিকে পারিবারিক দ্বায়িত্ব সামলানো। তিনি প্রমথনাথকে সেখানকার সংস্কৃত পাঠশালার শিক্ষক নিযুক্ত করলেন।এইভাবে তিনি অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করে স্বামী  বিশুদ্ধানন্দর সঙ্গে গভীর শাস্ত্র আলোচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। ক্রমে  ক্রমে তিনি ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন এবং একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত হিসাবে সমগ্র ভারত জুড়ে তাঁর কর্মকাণ্ডের খ্যাতি বিস্তৃত ছিল।কাশীর পণ্ডিত সমাজ প্রমথনাথকে ‘ তর্কভূষণ ‘ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
    এই সময় তিনি সংস্কৃতে কয়েকটি খন্ডে কাব্যও রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে ‘ রাস রসো দয়ম ‘ এবং শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ চরিতম ‘ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কাশী থাকাকালীন প্রমথনাথ তাঁর গুরু স্বামী বিশুদ্ধানন্দর সঙ্গে কাশ্মীর ভ্রমণে গিয়েছিলেন সেখানকার মহারাজের আমন্ত্রণে। এই ভ্রমণ নিয়ে তিনি ‘ জন্মভুমি ‘ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে বাংলাতে কয়েকটি সংখ্যায় লিখেছিলেন। এখানে তিনি ভূস্বর্গের অপূর্ব বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন।
   কাশী থেকে কলকাতায় ফিরে এসে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটেছিল বিপ্লবী ‘ ডন সোসাইটির ‘।  এমনকি যোগাযোগ ঘটেছিল স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গেও। তাঁরই প্রেরণায় তিনি বেলুড় মঠের মুখপত্র  ‘ উদ্ধোধন ‘ এ গীতার বঙ্গানুবাদ ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির অনুরোধে তিনি জিমুত বাহনের লেখা ‘ কাল বিবেক ‘ এবং হিমাদ্রী রচিত ‘ চতুর্বর্গ চিন্তামনি ‘ গ্রন্থের সম্পাদনা করেছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি বেশকিছু সংস্কৃত গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন।
    তিনি দীর্ঘদিন কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯১১ সালে ভারত সরকার তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্যের জন্য প্রমথনাথকে  ‘ মহামহোপাধ্যয় ‘ উপাধী তে ভূষিত করে। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যর অনুরোধে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন কিন্তু এইজন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিক নিতেন না। তাঁর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিলো হিন্দু ধর্মের সংস্কার সম্পর্কিত বেশ কিছু নিবন্ধ। যেগুলি ‘ সনাতন হিন্দু ‘ নামে গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছে। । এই মহান ব্যাক্তিত্ব ১৯৪৪ সালে ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন। ভারতবিদ্যচর্চায় তাঁর অনবদ্য অবদান আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে উচিত। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *