অম্বরীশ ঘোষ
বিষয় পরিচিতি
প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে অরণ্য, পাহাড়, নদী আর চা-বাগিচার পরিধি জুড়ে সমগ্র ডুয়ার্সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন নানান জনগোষ্ঠীর মানুষ। স্বতন্ত্র তাদের লড়াই, স্বতন্ত্র তাদের ইতিহাস। এই লড়াই আর ইতিহাসের একটি বৃহৎ পরিসর জুড়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর নারীদের কর্মতৎপরতা আর নিপুণতার অধ্যায়গুলো। তাদের নিয়েই এই ধারাবাহিক নানান জনগোষ্ঠীর বীরাঙ্গনা।
খরিয়া জনগোষ্ঠীর নক্ষত্র : মালা খরিয়া
দুধারে দর্শকরা দাঁড়িয়ে। সকলেই উত্তেজিত, সকলেই ফুরফুরে। খো খো খেলায় একটি মেয়ে অন্যদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি দক্ষতায় দর্শকদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে চিৎকার বাতাসে লেপ্টে ছড়িয়ে পড়ছে, “সাবাস মালা! সাবাস”। যাকে সবাই উৎসাহিত করছিল সেদিন তিনি মালা খরিয়া। খো খো, কাবাডি, কবিতা লেখা, গান গাওয়া প্রভৃতি নানাদিকে যার উৎসাহ ও অংশগ্রহণ মানুষের ভালো লেগেছে, মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
মালা খরিয়া যে জনগোষ্ঠীর মানুষ, তার নাম খরিয়া। উড়িষ্যা, অসম, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এই জাতি গোষ্ঠীর মানুষেরা। এরা অস্ট্রোএশিয়াটিক উপজাতীয়। এই জনগোষ্ঠীর পুরুষরা ‘ভগবান’ নামে ধুতি পরেন এবং মহিলারা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত শাড়ি পরেন। নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার ব্যবহার করেন। অলংকারগুলো সাধারণত পিতল, অ্যালুমিনিয়াম, রূপা ও সোনার তৈরি হয়। তিনটি ভাগে মূলত খরিয়ারা নিজেদের বিভাজন করেন – দুধ খরিয়া, ডুলকি খরিয়া এবং পাহাড়ি খরিয়া। দুধ খরিয়ারা সবচাইতে উচ্চাসনে। তারা সাধারণত কৃষিবিদ। তারপর রয়েছেন ডুলকি খরিয়া যারা কৃষিশ্রমিক বা সেই জাতীয় কাজে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তারপর রয়েছেন পাহাড়ি খরিয়ারা। তারা অন্যান্য নানান শ্রমদানের ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষ। বিয়ের ক্ষেত্রে একই গোত্রের খরিয়ারা সকলে ভাই বোন, তাই সমগোত্রে বিয়ে হয় না এদের।
কোচবিহার জেলার খাগড়িবাড়ী গ্রামে বসবাস করতেন মালা খরিয়া। পরবর্তীতে দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়িতে চলে যেতে হয় কর্মসূত্রে। যে গ্রামে কবিরাজী চিকিৎসা জগতের জনপ্রিয় মানুষ কার্মা খরিয়ার জন্ম, জিডিয়া কেরাকেটা নামে সমাজ সচেতন নারীরা জন্ম, ভীরু খরিয়া নামে অন্যকে বিনা খরচে নিজের জমিতে কৃষিকাজ করতে দেওয়া মানুষের জন্ম, সেই গ্রামের মেয়ে মালা খরিয়া শৈশব থেকেই দায়িত্ববোধে সচেতন ছিলেন। এই দায়িত্ববোধ নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি, নিজের জনগোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি। ১৯৭৫ সালের আগস্ট জন্ম মালা খরিয়ার। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আলিপুরদুয়ার কামাখ্যাগুড়ি হাই স্কুলে পড়ার পর আলিপুরদুয়ার মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। দারিদ্র নানাভাবে তার পথ আটকে দাঁড়ায়। কখনও আধপেটা কখনও বা না খেয়েই কাটে দিন। কিন্তু লেখাপড়া ছাড়া কাটেনি দিন। একটু বেড়ে ওঠার পর থেকেই নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেকেই জোগাড় করে চলতে হয়েছে। পশুপালন, জমিতে কাজ করা প্রভৃতি নানা উপায়ে জোগাড় করতে হয়েছে পয়সাটুকু। কিন্তু হাল ছাড়ার কথা ভাবেননি একবারের জন্যও। সকালে সূর্য একটু তেজ মেখে নেবার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যেত ঘরের কাজ ও মাঠের কাজ। গরু, ছাগল, মুরগী, হাঁসদের সামলানোর দিকটিও দেখতে হতো। বাড়ি থেকে হাই স্কুল ছিল চার কিলোমিটার দূরে। যাতায়াতের মাধ্যম দুই পা। নদী পার হওয়ার সাঁকো কখনো কখনো নিজের কঙ্কালটুকু মেলে দাঁড়িয়ে থাকতো। একবার পড়েও যান সাঁকো থেকে, কিন্তু পড়ে যায়নি হেরে যায়নি উদ্যম। দাঁতে দাঁত চেপে চালিয়ে গিয়েছেন লড়াই। পড়াশোনার পাশাপাশি মৌলিক লেখালেখি আকৃষ্ট করত তাকে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে-আয়োজনে সর্বাগ্রে তার কন্ঠ শোনা যায় :
জানা মালে আয়ো মোরা, জানা মালে
ধরিতি তারে তারে
পীরিতি তারে তারে, জানা মালে।
মালার কাছে এই বিষয়টি কষ্টের যে তার নিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের ভাষা প্রায় ভুলেই যাচ্ছেন। সাদরি ভাষায় তারা কথা বলেন। ভবিষ্যতে নিজের ভাষারক্ষার আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের স্বপ্ন দেখেন। ছিলাম গানের কথায়। ফাল্গুন মাসের মাধুর্য যখন প্রকৃতিকে জড়িয়ে ধরে, মালা গেয়ে ওঠেন মনের আনন্দে:
গেন্দা যে ফুলেলা
লাল পিয়ার ফুলেলা
যাবে সরি যাবে গিরি
হরে গেন্দা ফুল।
মালা যখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী তখন থেকেই গ্রামের মহিলাদের শিক্ষার জন্য সচেষ্ট হন। এমনকি নিজের গ্রামের সমবয়স্কদেরও তখন থেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াশোনা শেখাতেন। অভিভাবকরা সব সময় যে রাজি হতেন, এমনটা নয়। মেয়েদের কাজে পাঠাতে ব্যস্ত থাকতেন তারা। সেই সব কিছু উপেক্ষা করেও সেই শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতেন। নিজের অনেক কষ্টার্জিত উপার্জন থেকেই দু একটি খাতা কলমও কিনে দিতেন তাদের। যত বয়স বাড়তে থাকলো ততই সামাজিক পরিসরে বৃহৎভাবে মেলে ধরতে শুরু করলেন নিজেকে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে তৎপর হলেন। অসুস্থ মানুষেরা ঝাড়ফুঁক তুকতাকে বিশ্বাস করলে তাদের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করতেন। জাতপাত, ছোট-বড় সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদীও হতে শুরু করলেন। পরবর্তীতে শিক্ষিকা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হলো জোড়াই জুনিয়র বেসিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর ইন্দিরা গান্ধী শিশু নিকেতনে শিক্ষকতা করছেন। শিশুদের নানান মহামানবের জীবনী শোনানো তার শখ। বিষয়টিকে তিনি কর্তব্য বলেও মনে করেন। শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও নানান সতর্কতামূলক বিষয় শেখান তিনি। শিশুদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন তাদের সাথে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের শিশুদের জন্য সাধ্যমতো খাতা কলম বই কিনে দেন।
আঠারো বছর বয়স থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেন মালা খরিয়া। সাদরি ভাষার কবি তিনি। তবে একটা সময় নিজের জাতিগোষ্ঠীর লুপ্তপ্রায় ভাষাকে নিয়ে কাজ করবেন এই স্বপ্ন তিনি দেখেন। প্রতিনিয়ত নিজের ভাষা যাতে বিলুপ্ত না হয়ে যায়, সেই জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তিনি। ২০১৯ সাল থেকে নানান পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে তার কবিতা। প্রথম প্রকাশিত বই ‘মাঞ্জার’ যার অর্থ মুকুল। নিজের কবিজীবনকে উপভোগ করেন মালা। কবিতাযাপন যেন তার কাছে উৎসব। এই উৎসবে তিনি কখনো শামিল হয়ে যান হুল বিদ্রোহের বীর সেনানিদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে, কখনো বা প্রকৃতিকে চুমুক দিয়ে পান করতে:
সিধু তোয় আশরা রাহলে
উমানকের সভেকার মনে মনে।
হাওয়াকের ঝোকা সামরায় দেলে
আইগ জালালে উমানকের ছাতি মে।
কানু মুর্মু ছোটে ভাই তোর
তোরে দেখাল ডাহার হিটলাক ……
প্রকৃতিতে হারিয়ে যাওয়া মালা যেন তার ঠিকানা আর ফিরে পেতে চান না:
নাদিকের কিনারে কিনারে
কাশিয়াকে ফুল ফুইলহে
সাদা সাদা দিসেলা
হাওয়ামে লেহেরায়লা …..
নিজের জাতিগোষ্ঠীর বর্ণমালারা যেন হারিয়ে না যায়, অবলুপ্ত না হয়ে যায়, এটাই এখন মালা খরিয়ার পীড়ন। বর্ণমালাগুলো বইতে থাকুক, ভাষা পাক মুখে, কন্ঠে খেলুক নিজ জাতিগোষ্ঠীর ভবিষ্যতের শিশুদের, এটাই তার প্রার্থনা। সেজন্য নিজেকে উৎসর্গ করে সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন মালা।
ওরাঁও জনগোষ্ঠীর ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল : ফ্লোরা কেরকেট্টা
সেই রাত্রিটা ভীষণই দুর্যোগপূর্ণ ছিল। শিবু ওরাঁও- এর স্ত্রী সন্তান প্রসব করবেন। মাঝরাতে হঠাৎ প্রবল প্রসব বেদনা। ডুয়ার্সের চুনিয়া চা বাগান থেকে আলিপুরদুয়ার হসপিটাল অনেক দূর। একেই তো যানবাহনের সমস্যা তার ওপর দুর্যোগপূর্ণ মধ্যরাত্রি। বছর ত্রিশের আগের রাস্তাঘাট আর যানবাহনের সংকটের কথা শিবুর ভালোভাবেই জানা। প্রতিবেশীর থেকে ছাতা চেয়ে কোমরে গামছা বেঁধে নিয়ে শিবু দৌড় লাগালেন আগাপীট কেরকেট্টার বাড়িতে। হাতে লন্ঠন। প্রকৃতির ভয়াবহ চেহারার সামনে দুর্বল লন্ঠন জানান দিচ্ছে, যে কোন সময়ই তার সামান্য জৌলুসটুকুও নিভে যেতে পারে। অন্ধকার জমাট বেঁধে ওঁত পেতে আছে সেই সামান্য আলোটুকুও গিলে খেয়ে তার সার্বভৌমত্বের ঝান্ডা তুলে ধরতে। শিবু দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করেন আগাপীট কেরকেট্টার। সাথে করুণ আর্তি। মিনিট খানেক বাদে দরজা খুলল। আগাপীট কেরকেট্টা এবং তার স্ত্রী ফ্লোরা লন্ঠন হাতে দরজায়। ঘরের ভেতরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে তাদের আট মাসের সন্তান। শিবু হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ফ্লোরার পায়ে। স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠে গেছে। বাঁচাতে হবে এ যাত্রায়। আগাপীট কম বেশি অভ্যস্ত এই বিষয়গুলোতে। ফ্লোরা বাক্স নিয়ে পোশাকটা বদলে ছুটলেন শিবুর সঙ্গে। বাচ্চার খেয়াল রাখতে বললেন আগাপীটকে। ভোরবেলার দিকে শিবুর ঘর আলো করে জন্ম নিল সন্তান। শরীরে ক্লান্তি নিয়ে কিন্তু মুখ ভর্তি প্রশান্তির হাসি নিয়ে ফ্লোরা ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে। এইরকম নানান কঠিন সমস্যায় নিজের এবং আশেপাশের চা বাগানগুলোর মানুষের পাশে সর্বক্ষণ দাঁড়ান এই ‘নার্স বহিন’ ফ্লোরা কেরকেট্টা।
ওরাঁও জনগোষ্ঠীর মানুষ ফ্লোরা। ফ্লোরার পৈত্রিক ভিটে ছত্তিশগড়ের কুনকুড়িতে। বাল্য নাম ফ্লোরা কুজুর। তিন বোন এক ভাই, মেজো বোন ফ্লোরা। শৈশব থেকেই নানান দিকে আগ্রহী, নানান দিকে পারদর্শী। ওরাঁওরা বিশ্বাস করেন যে তাদের প্রধান দেবতা ধর্মেশ, যিনি তাদের মত অনুযায়ী এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন, বিশেষভাবে আশীর্বাদ করেছেন ফ্লোরাকে। স্কুলে প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় যে কোন স্থানে থাকতেন। বাৎসরিক ফলাফলের ভিত্তিতে স্কুলে একটি নিয়ম বিদ্যমান ছিল। যে প্রথম বা দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থানে থাকবে সে তার বাবাকে ফলাফল প্রকাশের অনুষ্ঠানের মঞ্চে ফুলের মালা পরাবে। ফ্লোরার বাবা অন্যান্য দিন আর যেখানেই থাকুন না কেন ফলাফলের দিন মেয়ের জন্য প্রাপ্ত সম্মানটুকু উপভোগ করতে ছুটে আসতেন স্কুলে। কিন্তু ভাগ্যের চাকা সব সময় সদয় থাকে না। নবম শ্রেণীতে যখন ফ্লোরা, তখন অসুস্থতার জন্য পরীক্ষা দেওয়া হয়ে উঠল না। বছর পঞ্চাশ আগের ছত্তিশগড়ের কুনকুড়িতে নারী শিক্ষার চল ততটাও ছিল না যে লেখাপড়া একবার বন্ধ হয়ে গেলে সমাজ বা বাড়ির লোকজন সে বিষয়ে আর আগ্রহ দেখাবে। পরবর্তীতে অষ্টম শ্রেণী পাস যোগ্যতা দেখিয়েই পালামৌতে নার্সিং ট্রেনিং করেন ফ্লোরা। তারপর ট্রেনিং নেন পাটনা তে। ওরাঁওরা বিশ্বাস করেন যে তাদের মৃত পূর্বপুরুষ যাদের তারা ‘পাকবলার’ বলে ডাকেন, তাদের আশীর্বাদ রয়েছে তাদের জীবনে। মৃত্যুর সময় তারা আশীর্বাদ রেখে যান জীবিতদের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। সেভাবেই পড়াশোনায় বিঘ্ন এলেও ‘পাকবোলার’দের ও দেবতা ধর্মেশের আশীর্বাদে নতুন দিশার সন্ধান পেলেন ফ্লোরা। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন। সেটা পাহাড়-পর্বত- সমতল যেখানেই হোক না কেন!
পাহাড়-পর্বত-সমতলের কথা যখন উঠেই এলো, তখন ওরাঁওদের সমাজে প্রচলিত একটি মতবাদ বা বিশ্বাসের কথা ছুঁয়ে যাই একটু। ভূমিকম্পের বিষয়ে ওরাঁওদের মনে একটি বিশ্বাস আছে। ওরাঁওরা বিশ্বাস করেন যে একটি বিশালাকৃতি কচ্ছপের পিঠের ওপর রয়েছে পৃথিবীটা। পাতাল থেকে অনবরত মাটি তুলে চলেছিল কেঁচোরা। সেই মাটি কচ্ছপের পিঠে ফেলে মই দিয়ে সমান করার চেষ্টা করে তারা। তাই পৃথিবীর কোথাও উঁচু উঁচু পাহাড়-পর্বত, কোথাও মালভূমি, কোথাও বা সমভূমি। এক নাগিনী ফনা তুলে বসে থাকে কচ্ছপের মুখের সামনে। পাহারা দেয় সে যাতে কচ্ছপ নড়াচড়া করতে না পারে। মাঝে মাঝে তাও কচ্ছপ লুকিয়ে চুরিয়ে একটু-আধটু নড়াচড়া করে ওঠে। ফলে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্পের।
সাম্প্রতিক চা বাগানের পরিস্থিতি যারা দেখেছেন, আঁচ করতে পারবেন সেগুলোর শ্রমিক তথা অধিবাসীদের কষ্টের যাপনের কথা। অভাব, টালমাটাল স্বাস্থ্য, অনটন প্রভৃতিতে জেরবার তারা। ফ্লোরা চুনিয়া চা বাগানে এই মানুষগুলোর পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো রয়েছেন। অসুখ-বিসুখের সমস্যায় দিনরাত জ্ঞান করেননি। যখনই ডাক পড়েছে, ছুটে গিয়েছেন। মানুষ নাইটিঙ্গেল ফ্লোরেন্সের সাথেও তুলনা করেন তার। এক সময় চলে আসতে হয়েছিল ডুয়ার্সের চুনিয়া চা বাগান থেকে কার্তিকা চা বাগানে। কিন্তু প্রায়শই অনুরোধ মাখা ডাক আসতো চুনিয়া থেকে। সাথে কার্তিকাতো নতুন সংযোজন রইলোই। কখনোই এই গরীব মানুষগুলোর থেকে পয়সা নিতেন না ফ্লোরা। কারো সামর্থ্য থাকলেও নিতেন না। বরং নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সব সময় পরিপূর্ণ রাখতেন তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ফার্স্ট এইড বক্সটাকে। একটি বিশেষ ঘটনা আজও লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়। সদ্য সন্তানের জন্ম দিয়েছেন ফ্লোরা। দ্বিতীয় সন্তান। সন্তানের বয়স একুশ দিন। নিজেও অসুস্থ। খবর এলো যে অন্যান্য মহিলারা ব্যর্থ হচ্ছেন একটি ডেলিভারি কেসে। ডেস্পারেট সিচুয়েশন! অগত্যা অসুস্থ শরীর নিয়েই ছুটে গেলেন। সাফল্যও পেলেন। নিজের শরীরের যন্ত্রনা ভুলে হাসিমুখে ফিরে এলেন সাফল্য এবং তৃপ্তির স্বাদ মেখে। আর ইনজেকশন নেবার প্রশ্ন এলে সকলের পছন্দের অপশন ছিল ফ্লোরা। একবার প্রতিবেশী জর্জ কুজুরের হাতে বড় শাল ঢুকে যায় লাকড়ি কাটতে গিয়ে। নতুন ব্লেড গরম জলে চুবিয়ে ঠান্ডা করে আঙুলের চামড়া কেটে বের করে দেন ফ্লোরা। এইরকম কত কত উদাহরণ লোকোমুখে ঘুরে বেড়ায় চুনিয়া চা বাগানে! একদিন দু’দিন নয়। কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে একনাগাড়ে এভাবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন ন ফ্লোরা। শারীরিক দুর্বলতার ও অসুবিধার কারণে দৌড়ঝাঁপ বেশ কিছুটা কমলেও একেবারে সরে আসতে পারেননি ফ্লোরা। নানান সময় নানান ভাবে পাশে থেকেছেন মানুষের।
ফ্লোরা শুধু যে অসুস্থ মানুষদের সেবাই করে গেছেন, তা কিন্তু মোটেই নয়। তার কর্ম পরিধি জুড়ে নিজের জনগোষ্ঠীর মানুষদের সংস্কৃতি রক্ষার অধ্যায়ও সমুজ্জ্বল। করম পূজা সহ নানান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছেলে মেয়েদের নাচ গান শেখান, অংশগ্রহণ করেন নিজেও। নিজের সংস্কৃতি ভুলে যাবার অর্থ ব্রহ্মাণ্ড মাঝে হারিয়ে যাওয়া, অস্তিত্বহীন হয়ে পড়া – এটাই ফ্লোরার ভাবনা। ফলে তরুণদের বিশেষভাবে বোঝান নিজের সংস্কৃতির গুরুত্ব, তাকে আত্মস্থ করার প্রয়োজনীয়তা। ফলে ভাদ্র মাসে উদিত চাঁদের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে তাদের সবচেয়ে জাঁকজমকের করম পূজা ও উৎসবে বা প্রতিবেশীদের বিয়ের গান পরিবেশনে বিশেষ ব্যস্ত থাকতে হয় ফ্লোরাকে। মানুষের আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছায় ফ্লোরা যেন প্রতিনিয়ত হয়ে ওঠেন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর!
প্রতিকূলতা বনাম প্রত্যয় : আশিকা ওঁরাও
‘একদিন মঁয় বহুত উপরে ডেকবু। বাদরি ছোঁকে আবু। দেশ লাগিন পুরস্কার লেইকে আবু’। এই কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললেন যে মেয়েটি, তার নাম আশিকা ওঁরাও। কথাগুলো বাংলায় অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তা হল, একদিন সবচেয়ে উঁচুতে লাফাব, আকাশ ছুঁয়ে আসব, দেশের জন্য পুরস্কার নিয়ে আসব। সাদ্রি ভাষায় নিজের মনের ইচ্ছাটা প্রকাশ করছিলেন আশিকা ওঁরাও। বলার সময় সামনের শ্রোতাদের মুখের দিকেও তাকাননি আশিকা। নজর ছিল দূরের দিগন্তে। চোখ মুখে কষ্ট, দৃঢ়তা, সংকল্প জেদ সমস্ত কিছুর একটা মিশ্র ভাব ফুটে উঠেছিল আশিকার চোখে মুখে। কে এই আশিকা ওঁরাও? ওঁরাও জনগোষ্ঠীর লড়াকু একজন নারী যিনি ২০২৩ সালে ভোপালের জাতীয় স্তরের ক্রীড়ায় অংশ নিয়েছিলেন।
আলিপুরদুয়ার জেলার ফোস্কারডাঙ্গা বলে একটি ছোট্ট গ্রামে জন্ম আশিকার। কষ্টের এবং লড়াইয়ের জীবনটা যেন শুরু হয়েছিল ভূমিষ্ঠ হবার আগেই। হ্যাঁ, ভূমিষ্ঠ হবার আগেই। তার জন্মের আগেই চিকিৎসক আত্মীয়-স্বজনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে হয় শিশু নয়তো মা যে কোনো একজন হয়তো বেঁচে থাকবে। এমনি এমনি তো আর চিকিৎসক কথাগুলো বলেননি! আশিকা যখন মায়ের পেটে তখনই তার মা আক্রান্ত হন টিবি রোগে। ফলে নানান ঔষধপত্র খেতে হয়েছিল তাকে। তাকে ঔষধগুলো না দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। মা দু’চোখে জল নিয়ে খেতেন ওষুধগুলো। বুঝতেন যে জঠরের সন্তানের কত বড় ক্ষতি হতে পারে এর জন্য! আশিকার ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় যতই এগিয়ে আসছিল, বাবা দিদি এবং অন্যান্য পরিজনদের দুশ্চিন্তা যতই বাড়ছিল। তারা প্রার্থনা করছিলেন সর্বশক্তিমান ধর্মেশের কাছে। পরিবারের যারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তারা প্রার্থনা করতে শুরু করলেন যিশুবাবার কাছে। অবশেষে জন্ম হলো আশিকার। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন তার মা ।
বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরেই হাই স্কুল। প্রথমেই বুধু এস. কে. প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং তারপর ফোস্কারডাঙ্গা উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষা দেন আশিকা। খেলাধুলায় মনোযোগ ছিল শৈশব থেকেই। শৈশবে ফুটবল খেলতেন, আকর্ষণ ছিল তীরন্দাজির প্রতিও। তীরন্দাজির প্রতি আসক্তি থাকার একটি কারনের নাম সাঞ্চি টোপ্পো। আশিকার এই আত্মীয় নিজেও ২০১৫ সালে তীরন্দাজিতে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়েছিলেন। আশিকার বয়স তখন সাত কি আট। তখন থেকেই আশিকা সাঞ্চি দিদির সাথে নানা স্থানে যাতায়াত করেন। ফুটবল এবং তীরন্দাজিতে সুনাম থাকলেও অন্যান্য ওঁরাওদের মতই সর্বপ্রাণবাদী প্রকৃতি উপাসক আশিকার ক্যারিয়ারে বিশেষ আলো ফুটলো যখন তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো লাফিয়ে আকাশ ছোঁয়া। তার দেবতা ধর্মেশ যেখানে অবস্থান করেন অর্থাৎ সূর্যের দিকে লাফ দেওয়া। উচ্চ লম্ফনের অনুশীলন শুরু করলেন আশিকা। বুঝতে পারলেন যে তার অভীষ্ট লাভ হবে এই বিভাগটির ধারাই। এ্যথলিট হিসেবে হাইজাম্পই তার দাঁড়াবার জায়গা। তার লক্ষ্য হবে উঁচু, উঁচু, উঁচু, অনেক উঁচু …..
সংসারের আর্থিক লড়াইতে টিকে থাকাই দায় হয়ে ওঠে তার পরিবারের। বাবার অসহায় উদাস দৃষ্টি উঁচু নয় বরং নিচে। শরীকি ভাগ বাটোয়ারার পর এক চিলতে চাষের জমির মালিক হলেন আশিকার বাবা। তার ওপর নির্ভর করে সংসার চালানো অসম্ভব। ফলে দিনমজুর হিসেবে দিন পার হচ্ছিল তার। আর অনটনের মধ্য দিয়ে দিন পার হচ্ছিল পরিবারের তিন সন্তান, স্ত্রীর। প্রতিদিন দু’বেলা ভর পেট খাওয়া আর দু’একটা করে মোটা কাপড়ের পোশাকের মালিক হওয়াই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় তাদের। আশিকার বাবার ভগ্ন দেহে এই কঠিন দৌড় দীর্ঘ হলো না। আশিকার বয়স যখন পনেরো, বাবা স্ট্রোক করলেন। আপন করে নিলেন ইহলোক ছেড়ে পরলোককে।গৃহবধূ আশিকার মা যেন একসমুদ্র জলে পড়লেন। আর্থিক টানাপোড়েন কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন আশিকা আর তার পরিবার। দিন কয়েকের মধ্যেই মাও যুক্ত হয়ে গেলেন দিনমজুরির কাজে। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বাবার মৃত্যুর আগেই। স্কুল যাওয়ার আগে কখনো দাদুর বাড়িতে, কখনো দিদির বাড়িতে কখনো বা না খেয়েই ছুটতেন কিশোরী আশিকা। আশার এক টুকরো আলো বলতে সুমন ঘোষ নামের একজন শিক্ষক দশম শ্রেণী পর্যন্ত কোন পারিশ্রমিক না নিয়ে পড়াশোনায় সহযোগিতা করতেন আশিকাকে। ওঁরাদের খাদ্যাভ্যাসও সামান্য সঙ্গী হয়েছিল আশিকার। নানা পশুপাখির মাংস, কচ্ছপ, বাইম, কাঁকড়া প্রকৃতি যা কিছু যখন সংগ্রহ হতো, তখন সেটাই সেই দিনের মেনুতে মুখ্য হিসেবে স্থান পেয়ে যেত। ওঁরাওদের বাড়ি ঘরের দেয়ালের নিম্নাংশ রঙ্গিন করা হয়। চারচালা ঘরের চার ধারে থাকে বারান্দা। ঘরের দেয়ালে গাছ, লতাপাতা, পাখি আঁকা থাকে। এ’কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা থাকে না যে এর কোন কিছুই আশিকাদের বাড়িতে নেই। চাল ও চার দেয়াল টিনের। ছোট্ট ঘর। একইভাবে তৈরি রান্নাঘরটা আরো ছোট। দুটো ঘরই দুই দুই বার আক্রান্ত হয়েছে হাতির দ্বারা। ধানের গন্ধে পাগলের মত ছুটে এসে হাতি ভেঙ্গে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। ঝড় বৃষ্টির মাঝে মৃতপ্রায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাড়িটা। ভেতরে আতঙ্কে প্রহর গোনে আশিকারা।
ওঁরাও মহিলারা কারমা শিকড়ি বা নাকফুল, খংশ্ বা খোপার রুপোর কাঁটা, পায়ের নখে মুদদী প্রকৃতি নানান অলংকারে সেজে ওঠেন তাদের নানান পরব বা সামাজিক আয়োজনগুলোতে। সামর্থ থাকুক বা নাই থাকুক, আশিকার মন কখনো অলংকারে সেজে ওঠার দিকে যায়নি। বরং মাঠ ফেরত মুখের ওপর জমে থাকা ঘামবিন্দুগুলোকেই তার অলংকার বলে মনে হয়েছে। ঢোল, মাদল, বাঁশি, খঞ্জনি, নাগরা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের সুমিষ্ট আয়োজনের মাঝে বসেও তার মন ছটফট করে মাঠের জন্য। প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘন্টা অনুশীলন করেন আশিকা। জেলার অপরপ্রান্তে কামাখ্যাগুড়ি ইউথ ক্লাবের হয়ে যখন খেলতেন আশিকা, তখন এক ক্রীড়া আয়োজনে আশিকার দেখা হয় সুপরিচিত ক্রীড়াবিদ ও শিক্ষক পরাগ ভৌমিকের সঙ্গে। তালিম নেওয়া শুরু করেন পরাগ স্যারের থেকে। প্রতিযোগিতার স্তর পেরোতে পেরোতে ডাক আসে কলকাতা থেকে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক অনটন। মায়ের অনুরোধে প্রতিবেশী তথা পরিচিতজনেরা অনেকেই পাশে দাঁড়ান সহযোগিতার জন্য। কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন দুই প্রতিবেশী কাকু। কলকাতায় থাকাকালীনই ডাক আসে ভোপালে আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য। অন্যান্য শিক্ষকদের অনুরোধ করা হয় আশিকাকে ভূপাল এ নিয়ে যাবার জন্য। যা কিছু হাতে ছিল তাই নিয়েই দাঁতে দাঁত চেপে আশিকা রওনা হলেন ভোপালে। আশিকা বিশ্বাস করেন যে তার অধ্যবসায় ও অনুশীলন তাকে একদিন আরও অনেক বড় সাফল্য এনে দেবেই। কিন্তু অগণিত মানুষ যারা আশিকার লড়াইটা দেখেছেন, তারা সাফল্যের এই ধাপটা দেখেও বড্ড খুশি। তারাও বিশ্বাস করেন যে ধর্মেশ এর আশীর্বাদে এবং সকলের শুভাকাঙ্ক্ষায় আশিকা একদিন ঠিক আকাশ ছুঁয়ে ফেলবেন।
সমাজসেবা যার রক্তে-মজ্জায় : লিম্বুদের ফুলমায়া সুব্বা
গ্লোবালাইজেশন বা এইরকম কঠিন উচ্চারণের উন্নতি সূচক শব্দগুলো যেমন দিয়েছে অনেক, তেমনই নিয়েছে বহু কিছু। নগর, শহর, মফ:স্বল শহর, গ্রাম, বনবস্তি সর্বত্রই আছড়ে পড়েছে এর প্রভাব। এই জন্যই পাহাড়- জঙ্গল- ঝর্ণায় বসবাস করা মঞ্চে লামার মতন অসংখ্য মানুষ ভুগছেন ডিপ্রেশনে। প্রকৃতির ঢেলে দেওয়া সত্তাও হার মানছে প্রায়শই। অনিদ্রা, খাবারে অরুচি প্রভৃতি সমস্যায় জর্জরিত এই মানুষটির পাশে যিনি দাঁড়িয়েছেন এবং অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক করে তুলেছেন, তিনি ফুলমায়া সুব্বা। লিম্বু জনগোষ্ঠীর এই মানুষটি এমনই অসংখ্য মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের জীবনমুখী করে তুলছেন। পঞ্চে লামা বারো বছর ধরে নানান চিকিৎসা করাচ্ছিলেন, কিন্তু লাভ হচ্ছিল না কিছুই। অবশেষে ফুলমায়া সুব্বার নজরে এলো বিষয়টি। তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং বিশ্বাসের দ্বারা পঞ্চমে লামার মনের গিঁটগুলো ছাড়িয়ে দেন। একই কথা শোনা যায় মঞ্জু লামা, সোনিয়া রাই প্রমুখের মুখ থেকেও। তারা বলছেন যে ফুলমায়া দিদি আমাদের অন্তঃশক্তিটাকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করেছেন, পাশে থেকেছেন। ফুলমায়া সুব্বা এটা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে আমাদের মনকে শুদ্ধ রাখা বিশেষ জরুরী। নানান উপায়ে মনকে শুদ্ধ ও সুন্দর করে তুলতে হবে। প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখতে হবে। প্রকৃতিতে লেপটে থাকলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে, আর ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়াই তো আমাদের জীবনের লক্ষ্য। আত্মা, মন, শরীর এরা একে অপরের সাথে আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত। এই সম্পর্ক গুলোর মধ্যে সুমধুর ভাব বজায় রাখতে মানুষের খাদ্যাভ্যাসকেও লাগাম পরানো জরুরী। তবেই পথ সুগম হবে। ক্রোধ এবং আক্রোশকেও লাগাম দিতে পারবে মানুষ। এভাবেই নানান মানুষকে জীবনের রাস্তার সন্ধান দিয়ে চলেছেন ফুলমায়া সুব্বা। সহজ সরল ভাষায় তিনি বলেন যে সামাজিক জীব মানুষ অথচ জীবনের ইঁদুর দৌড়ে সেই মানুষ যদি সমাজকেই ভুলে যায়, তবে তার চেয়ে যন্ত্রণার বিষয় আর কিই বা হতে পারে!
ডুয়ার্সের রাজাভাতখাওয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ফুলমায়া সুব্বা। শৈশব থেকেই সঙ্গী হিসেবে পান দারিদ্র্যকে। চরম অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা তার। স্থানীয় বামনি বস্তি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু হয়। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর চলে যেতে হয় অসমে। শিলং এর একটি নেপালি স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন এবং ফিরে আসেন রাজাভাতখাওয়াতে। নানান সমস্যায় আর এগোলো না লেখাপড়া। শৈশব থেকেই ‘দাদিমা’ এবং মায়ের সাহচর্যে বেড়ে ওঠেন তিনি। মায়ের পেটে তার বয়স যখন আড়াই মাস তখনই বাবা পরলোকগমন করেন। মায়ের জীবনের একটি ট্র্যাজিক দিকের কথাও তুলে ধরতে হয় তাকে নিয়ে আলোচনায়। তার মায়ের বয়স যখন বারো তখন মায়ের দাদারা জোর করে বিয়ে দেন মায়ের। পাত্র রিটায়ার্ড আর্মি। ফলে খাওয়া পরার অভাব হবে না বোনের, এটাই ছিল তাদের যুক্তি। অথচ যুক্তির কোন পাশে কিভাবে যেন বাদ চলে গেল ভয়ংকর একটি দিক। পাত্রের আগের পক্ষের বিয়েতে চৌদ্দটি সন্তান এবং পাত্র বেশিরভাগ সময়ই নেশায় বুদ হয়ে থাকে। মায়ের যন্ত্রণা, কষ্ট, অপুষ্টি আর অশান্তির গল্পগুলো শৈশব থেকেই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন ফুলমায়া। মনে জেদ চেপে যায় যে বড় হয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষদের পাশে সাধ্যমত দাঁড়াবেন। বিধবা হওয়ার সময় মায়ের বয়স ছিল একেবারেই কম ফলে সকলের কথা ও মতামতের মান্যতা দিয়ে চব্বিশ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার আবদ্ধ হন বিবাহ বন্ধনে। আগের থেকে আরো বেশি বেশি করে ‘দাদিমা’র স্নেহ যত্নে বেড়ে উঠতে থাকেন ফুলমায়া। নিজেদের ছোট্ট জমিতে ফসল ফলাতে ব্যস্ত থাকতে হতো মাকে। খাদ্যশস্য, সবজি, পাট প্রভৃতির পরিচর্যার পাশাপাশি দু ‘চারটি পশুপালনের কাজে সব সময় ব্যস্ত থাকতেন মা। মায়ের আদর্শ আর নিষ্ঠা খুব স্পর্শ করত তার মনকে। যতটুকু যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট আর তৃপ্ত থাকতে চাইতেন মা। মানসিক প্রশান্তির মৌখিক পাঠ দিতেন মেয়েকে।
মাতৃগর্ভ থেকেই যেই মেয়েটি মৃত্যুকে দেখে বড় হলেন, মৃত্যু তাকে খুব বেশি বিচলিত করতে পারেনি। না হলে এভাবে জীবনের জয়গান গেয়ে মানুষের পাশে সুখে দুঃখে দাঁড়াতে পারতেন না ফুলমায়া। অনেক মৃত্যু দেখেছেন ফুলমায়া। প্রিয়জনেরা একের পর এক পাড়ি জমিয়েছেন মৃত্যুর দেশে। তবুও এই জীবনটাকেই সত্য বলে ভালবেসেছেন তিনি। একত্রিত বছর বয়সে পরলোকে পাড়ি জমান মা। মায়ের মৃত্যুর তিন মাসের মাথাতেই মাত্র বারো বছর বয়সে কলেরার কাছে পরাজিত হয়ে মৃত্যুর বুকে ঢলে পড়লো ভাই। উনিশ বছরের ফুটফুটে দিদি সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে হারিয়ে গেল মৃত্যুর দেশে। নেপালে মামীকে পৌঁছে দিতে গিয়ে হারিয়ে গেল দাদা, আজও ফিরে এলো না আর। তাছাড়াও মামা, মামি, কাকু প্রমুখ পরিজনদের মৃত্যু মিছিল দেখেছেন তিনি। অশ্রুগ্রন্থি থেকে অঝোরে ঝরেছে জল। তবুও জীবনের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন ফুলমায়া। শৈশব থেকেই পূজা পাঠ, ভক্তি শ্রদ্ধা দেখে অবাক হতেন প্রতিবেশীরা। বাড়িতে মাছ- মাংস আনলে অস্বস্তি বোধ করতেন তিনি। প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনেরা বলতো, এই মেয়ে বড় হয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে যাবে। খিলখিলিয়ে হাসতেন ফুলমায়া। বলতেন যে সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যাব।
যারা সঙ্গ দোষে ভুল জীবনসঙ্গীর সান্নিধ্যে কিংবা আরও নানান প্রতিকূলতায় জীবন থেকে সরে গেছে কিংবা ভুল পথে চলতে শুরু করেছে, তাদের সঠিক পথে এনে জীবনকে উৎসবে পরিণত করার দায়িত্বে আত্মনিয়োজিত রয়েছেন ফুলমায়া সুব্বা। তবে শুধু সমাজ সেবার দিকটিকেই আলোচনায় রাখলে অন্যায় করা হবে তার প্রতি। আলোচনায় অবশ্যই উঠে আসা উচিত সংগীতশিল্পী ফুলমায়া সুব্বার কথাও। ১৯৮৯ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অডিশন দেবার সুযোগ আসে এবং ১৯৯৩ সালে প্রথম সুযোগ আসে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে সংগীতশিল্পী হিসেবে উপস্থাপনার। কন্ঠে যেন জাদু আছে ফুলমায়ার। অসংখ্য নেপালি গান এবং নিজ সংস্কৃতির গান তার কন্ঠ নিক্ষিপ্ত হয়ে পৌঁছায় শ্রোতাদের কানে। নানান সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চেও দেখা গিয়েছে তাকে। ১৯৯৪ সালে কালিম্পং টাউন হলে অনেক গুণীজনের সামনে গান গেয়েছিলেন তিনি। যদিও নেপথ্যে ছিল অল ইন্ডিয়ার রেডিও। এখনও সূর্য যখন অস্ত যায়, শেষ বিকেলের ফুরিয়ে যাওয়া আলোটুকুর এপারে বসে গুনগুনিয়ে ওঠেন ফুলমায়া:
কৌলি সুনৌলি
সিন্দুরে জান শুনিলৌ বট্টা
তিওলাউনু পাইনানি সখি
তিওলাউনু পাইনা …..
গান গেয়ে হাততালি পেয়ে খুশি থাকেন ফুলমায়া কিন্তু অনেক বেশি খুশি থাকেন সেইসব মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে, যারা জীবনের আলোর দিকটির থেকে ক্রমশ সরে সরে আসছিলেন নানা প্রতিকূলতায়। যারা মন থেকে দুর্বল হয়ে পড়েন, তাদের একান্তে গান শোনান ফুলমায়া। প্রকৃতি, মানুষ, ঈশ্বরের যোগসূত্র বোঝান। প্রেম বোঝান। এই প্রেম না থাকলে সংসারই যে ধ্বংস হয়ে যাবে! গৃহে শান্তি রাখার বিষয়ে বোঝান মানুষকে। পাশাপাশি লিম্বু জনগোষ্ঠীর মানুষরা যাতে এক সুন্দর যোগসূত্রে বাঁধা থাকে, সেদিকেও তিনি অতন্দ্র প্রহরী। লিম্বু সংস্কৃতির একজন আদর্শ ধারক বাহক হিসেবে মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে। কিন্তু তার আক্ষেপ যে তিনি তাদের নিজস্ব বর্ণমালা অর্থাৎ কিরাত-সিরিজংগা লিপির বিষয়ে তরুণ প্রজন্মের লিম্বুদের সেভাবে ওয়াকিবহাল করে উঠতে পারেন না। তবুও তাদের নৃত্য সংগীত প্রভৃতি দিকগুলো নিয়ে তিনি অত্যন্ত যত্নশীল। বিভিন্ন পূজার আর্চ্চা যেমন উদৌলি উবৌলি, মাংহিম প্রভৃতিতে তার আস্থা রয়েছে। আস্থা রয়েছে কর্তব্যপরায়ণতায়। আর সেই জন্যই তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটে যান বাগড়াকোট, আঠাশ বস্তি, জয়ন্তী, বক্সা প্রভৃতি স্থানে। জয়গান করেন মনুষ্যত্বের।