অর্ণব রায় 

 যে দেওর আইবুড়ো কালে ছিল হাতের বাছুর, তাকে খাল কেটে উলু দিয়ে বরনডালা, ঘরে এনে, সকালে ঘাড়ে বুকে কপালে সিঁদুর, ক্রমে হেঁশেলে ফাট, দুরে দূরে, দুই ভাই, ব্যবসার দুই দ্বীপ, স্বার্থের দুই দ্বীপ, এক বাড়ি, তবু দূরে, হঠাৎ সাতদিনের জ্বর সূতিকা ওলাওঠা কি নিতান্ত ফোঁড়া কাটাতে, কী করে কী হল কেউ বলতে পারে না, অদ্দেষ্ট, কপালে করাঘাত, পট করে সেই বৌখানা মরে গেলে, হতবাক, কান্নাকাটি, সংসারে অচল অবস্থা, অশৌচকাল, শেষে শ্রাদ্ধকর্ম, মুখে মাছ, দেওর কি আবার কোলের বাছুর কোলে, এসবের মধ্যে কী হয় কী হয়, তা নিয়ে যে গল্প, তা এই।   

  তদুপরি মধ্যিখানে মাতৃহারা অবোধ বালক। অবোধ আক্ষরিক। দুনিয়ার বোধ নাই। অস্থানে হাসে। রাস্তার লোক ধরে ধরে মাতৃশ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করে। ন্যাড়ামাথা। বলে, আসবেন কিন্তু শনিবার, কেমন! বলে আবার হাসে। সদ্য কেউ শিখিয়েছে, অচেনা মানুষকে ‘আপনি’ করে কথা বলতে হয়। কে চেনা আর কে অচেনা, তা আর কেউ শেখায় নি। যত লোক তার তার বাবার দোকানের সামনে দিয়ে যায়, সবাই তো চেনা। জগতে অচেনা কে! ঠাহর করতে পারে না। তার ঘসা কাচের বুদ্ধিতে সবাই ‘আপনি’ হয়ে যায়। 

  দিনমানে ব্যবসায় মনস্ক। মাঝে মাঝে তবু উঠে যেতে হয়। চৌদ্দ দিন কেটেছে একরকম লোকচক্ষুর আড়ালে। পুরুষমানুষের দিন, স্ত্রী গত, চলে কী প্রকারে! পরিবার, বোনেরা ইত্যাদি। মাছের ডিমের মত জোট বাঁধতে চায়। বা শৈশবের পুনরায় রচনা হয়ত। বারান্দা। সারি সারি শোকতপ্ত আত্মীয় মেয়েপুরুষ। পরস্পর সম্বন্ধে বাঁধা। অল্প কথা ও দীর্ঘশ্বাসে গাঁথা লম্বা মালা। অনিদ্রা। এমনকি ঘুমেও বিড়বিড়, শ্বাস। মাঝে মাঝে সাদা থানেক কাপড়ে রক্ত ফুটে ওঠার মত কান্না, এদিক ওদিক ভিজিয়ে দিচ্ছে। বড় চেনা দৃশ্য। বারবার নানারূপে ঘুরেফিরে দেখা। মেয়েরা বৌ-রা কাজে অকাজে বারবার উঠে যাচ্ছে। মুখে আঁচল দিচ্ছে। বসে থাকা মানুষজনকে পাশ কাটিয়ে, অল্প নিচু, হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে, যেন জলের ওপরের পানা, শাড়ির তলা ফত্‌ফত্‌ করে, যাচ্ছে আসছে। তারও শেষ আছে। সকলেরই সংসার। যেখানে যেখানে। ফিরে যেতে হয়। যারা আরও কিছুদিন থেকে যায়, নিকটতর যারা, তাদের দিয়ে ক্ষীরের পুতুল গড়া আর ভাঙা। এইসব শাড়ির ঘের, আঁচলের বিস্তার উঠে গেলে, মানুষ চলে গেলে— তার স্থান প্রকট হয়। এই কথাটুকু আরও একবার বুঝিয়ে দিয়ে তারা স্থান ছেড়ে উঠে চলে যায়। 

  শরীর থেকে রক্ত বের হওয়া যেমন। কেটে যাওয়া, থেঁতলে যাওয়া, চিরে যাওয়া, ফেঁড়ে যাওয়া, নুনছাল ওঠা, মাংস খুবলে উঠে যাওয়া— যা কিছু আশু যন্ত্রণাদায়ক, সেরকম কোনও কিছু নয়। শুধু নিঃসারে ক্ষতমুখে কিছু একটা জমে ওঠা, আর বেরিয়ে যাওয়া। পুরুষমানুষের শোক, ক্ষরণ, অন্তঃত স্ত্রীবিয়োগে, সেরকম গম্ভীর ও একান্তে দুর্বল হবে বলে ধরে নেওয়া হয়। তার বাইরেও পুরুষ আছে। সামলাতে পারে না। হাউহাউ কাঁদে। ক্ষেপে ওঠে। বেশ্যাবাড়ি যায়। 

  তবু পেট। তবু কেন, সবার ওপরে পেট। ব্যবসা। দোকান। মাল আসে, মাল যায়। থিতু কাস্টোমার কিছু। আরও থিতু ইদানিং। মাল নিতে এসে ‘আহা’, ‘উহু’ দিয়ে যায়। মাঁচ মিনিটের কেনাকাটা দশ পনের কুড়ি। যার যেমন টান ও দুঃসংবাদে কৌতুহল। প্রথম দিন সাতেক একদম কাঁঠালে মাছি। কী হল, কীভাবে হল। আনুপূর্বিক বারবার বলাটাও একটা উৎসব। যন্ত্রণাতম মুহূর্তে বারবার গিয়ে গিয়ে যন্ত্রণা অল্পে অল্পে ধুয়ে যায়। বলাটা যন্ত্রের বলা হয়ে পড়ে। ‘আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। সকালেও তো ওর দিদির বাড়ি, ওই তো ফুলতলায়, সেই দিদির বাড়ি গেল। ফিরতে ফিরতে দুপুর। তখনও কিছু নেই। রান্নাবান্না করল। খেতে দিল। নিজে খেল। একটু শুয়ে উঠে বলল, মাথাটা ঘুরছে। বলতে বলতে বমি হল একবার। সোমেশ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। যেতে যেতেই কেমন নেতিয়ে গেল। সোমেশ ডাক্তার দেখে বলল, ব্যাপার ভালো ঠেকছে না, হসপিটালে নিয়ে যাও। হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ঢোকাতে না ঢোকাতেই সব শেষ। দুবার হেঁচকি তুলল। একবার বড় করে তাকাল। ব্যাস্‌। ট্রিটমেন্ট করার সময়ই দিল না’। এই জায়গাটিই সবচেয়ে যাকে বলে বেদনা মোচড়ানো। মাটিতে কোদাল মারতে মারতে ফোয়ারা। চোখ ভিজে আসে। গলা ধরে আসে। বারবার বলে বলে ক্রমে মাটি শক্ত পাথর। কোদাল মারা হয়। পাথরের স্বাভাবিক গলায় ঘটনা বলে যায় বক্তা। যেন বা অন্যের জীবন। বলতে বলতে বারবার নতুন ডিটেল যোগ হয়। কিছু ডিটেল বাদ পড়ে। আবার এসে জোটে। বলতে বলতে বক্তা শ্রোতাদের মধ্যে নিজেকে বসে আফশোষে মাথা নাড়তে দেখে। 

  বালক রাতের নিশুতিতে বুকে পা তোলে। অস্বস্তিতে মোচড়ায়। গোঙানি। লালা। গরম। ফ্যানের অবিরাম শব্দ। মৃতবাড়ির সহবৎ, একা থাকতে দিতে নেই। যার জন্য আব্রু, সে-ই যখন নেই, ঘরের, একান্ত শোবার ঘরের দরজা হাট করে খোলা। দিনে আর রাতে। বিশেষ যখন বাড়ি ভর্তি লোক। যখন অশৌচকাল। কেউ না কেউ, দিদিমতন, মাসী বা কাকীমতন, ছোট থেকে দেখা মানুষ যারা, রাতের কোনও না কোনও প্রহরে একবার মশারির ওপার থেকে ভেতরের আবছায়ায় উঁকি মেরে, নীল রাতের আলো, ফ্যানের হাওয়া, শীতলতা ও হাওয়া, দেখে যায়। অকস্মাৎ মৃত্যুর এত কাছাকাছি হয়ে , এতটা ওলট-পালট, রাতের ঘুমটুকু ঠিকঠাক হচ্ছে কি না। যদি না হল, কিছু বা টসকে গেল, সারাসকাল চা খেতে খেতে, এত এত লোকে এত এত ফল দিয়ে গেছে, বঁটি পেতে সেই পাহাড়সমান ফল কাটতে খোসা ছাড়াতে, প্লেটে প্লেটে দিতে, ধরে ধরে ‘খাও রে’ ‘খাও রে’ করে হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে সারাক্ষণ ঘুরেফিরে সেই এক কথা— রাতে ঘুম হল না। আর বলার আছেই বা কী! টেলিফোন এসে গিয়ে মুখে মুখে বসে মানুষ বোবা। ঘুম হবেই বা কীভাবে— মরজগতে যা কিছু ঘটে, যা কিছু অভিঘাত, সকলের সফট্‌ টার্গেট তো ওই, ঘুম। যদি বা শরীর ভেঙে এল, আর বইতে পারছে না, চোখের পাতা দুহাতে ধরে টেনে বন্ধ করল, তো সেখানে বল্লম তলোয়ার নিয়ে স্বপ্নের অক্ষৌহিনী। সারারাত ছুটিয়ে মারবে। সকালে যখন উঠবে, যেন কুস্তি করে উঠেছে। সারা শরীরে ব্যাথা। ক্লান্তিতে মাথা ঝুলে পড়েছে একদিকে। চোখ মেলার পর বেশ কিছুক্ষণ স্বপ্ন আর বাস্তবের তফাত যে করা যাবে না, সে বিষয়ে বহুজনে বহুবার সাবধান করে গেছেন। 

  আর সে যে কী বিচিত্র জগত! যত তার বাস্তব তাকে গলা টিপে ধরতে যায়, তত মনের গভীরের মন পাকা কলার মত পিছলে পিছলে যায়। জেগে থাকতে যত দুঃখ, ঘুমের তলায় তত মজার কান্ডকারখানা। দুঃখ পেতে পেতে দুঃখ পেতে পেতে মনের তলদেশ হেসে ফেলে। ট্যাঁপা ছিল পাড়ার হিরো। বচ্চনের মত চুল, হাঁটা, প্যান্টের ঘের। সে দুম করে ফুটবলার হয়ে গেল। কাদের যেন একর একর জমি অন্য কেউ বেচে দিচ্ছে আর ট্যাঁপা সেখানে ভ্যান, মানে সাইকেল ভ্যান, নিজের না, অন্য লোকের, নিয়ে গিয়ে শেষবারের মত ফুটবল খেলে আসছে। সে ফুটবল সে খেলছে ভ্যান চালিয়ে চালিয়ে। বড্ড তাড়া। যে গতিতে জমি বিক্রি হচ্ছে, তার সাথে ফুটবল খেলে পারা যাচ্ছে না। দুশ্চিন্তা চটের বস্তার মত, একটার ওপর আর একটা জমা হচ্ছে। এছাড়া ট্রাফিক পুলিস, সাদা পোশাক, কোমরে কালো বেল্ট, বেলুনের মত শোঁ শোঁ আকাশে উঠে যাচ্ছে। এদিকে সারা শহরজুড়ে ছোট ছোট মানুষের সাইজের ঊটেদের ট্রাফিক জ্যাম। সে শহর আবার কিছুটা মালদা, কিছুটা বাঁকুড়ার মাচানতলা, বেশীটাই রাণীগঞ্জ এন এস বি রোড। লোকে স্বপ্নে মা কালী পায়, শিববাবা কূলদেবতা পায়, বাবা-মা আরও যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, তাদের তো হামেশাই পাচ্ছে। এখানে শোকের পূর্ণপ্রহর কেটে যেতে চলল, মরা বৌ-টা একবার চুলের ডগাটাও দেখিয়ে গেল না! নানারকম উল্টোপাল্টা অচেনা অজানা লোকের মিছিল। আজেবাজে গান, কোলাহল আর দৌড়োদৌড়ি। 

  ঘুমের তলার ছুটোছুটি ভুড়ভুড়ি কাটতে কাটতে সারফেসে। শরীর মোচড়ায়। ঠোঁটে বিড়বিড়। কখনও সশব্দ। উঁকি মেরে যাওয়া দিদি মাসী কাকীমা (মা অবধারিত ততদিন বাঁচে না। বাঁচলে, ভগবান তাঁকে শক্তি দিন) দেখে, ভাবে শোকের তাড়স, স্তব্ধ হয়, খানিক থমকায়, শ্বাস তো পড়তেই হয়, সোজা ও লম্বা, তারপর নাড়িয়ে দেয়, ঠেলে জাগায়, জাগ্রতদের জগতে তুলে আনে। মৃতের জন্য শোক মূলতঃ জীবিতের অসুবিধের বয়ান। যে কোনও মৃত্যু, সুনিশ্চিত হওয়া মাত্র অবধারিত প্রশ্ন, নিকটতম করে, বা নিকটতম-র জন্য পাশের মানুষ করে,আমার কী হবে? প্রশ্ন এখানে বিকটতর, কেননা মাঝে অবোধ বালক। দিদি মাসী কাকীমা চলে যায়। ঘরের ভেতর হালকা অন্ধকারে সে প্রশ্ন নতুন নতুন মূর্তি ধরে জেগে ওঠে। বড় হতে হতে তার মাথা ছাদ ছুঁয়ে যায়। বিরাট প্রশ্ন ওপর থেকে ক্ষুদ্র মানুষের দিকে লোহা চোখে তাকিয়ে থাকে। সে দৃষ্টি সহ্য হয় না। ক্ষুদ্র মানুষ ঘুমকে আশ্রয় ভাবে, নিরাময় ভাবে। ঢুকে পড়তে যায়। 

  বস্তুর নিজস্ব আভা একদিনে হয় না। একই জায়গা থেকে নিয়ে ব্যবহার করে তাকে একই জায়গায় পুনরায় রাখলে, ধোয়া মোছা, সর্বোপরি মনোযোগ, নারীর মনোযোগ, বস্তু, সামান্য কাপ-থালা-বাটি-সাঁড়াশি-ছাঁকনি-হাতা— বস্তু ও তার স্থান, নতুন মানে পায়। অন্যের ঘরবাড়িতে রান্নাঘরে অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে যে আলগা লাগা, তা এই বস্তু ও বস্তুস্থানের সম্মিলিত আভার চিৎকৃত প্রতিবাদ। সে প্রতিবাদ সংসারী নারী, দিদি-মাসী-বৌদি সবচেয়ে বেশী টের পায়। পারতপক্ষে ঢুকতে চায় না। কিন্তু কৌতুহলও আছে। উঁকি দেয়। কথাচ্ছলে, কাপ ডিস রাখার ছলে একবার তদন্ত করে যায়। চোখের তদন্ত। মুখ অন্য কথা বলে। আর এই রান্নাঘর আগলে রাখা, অন্যকে প্রবেশাধিকার না দেওয়া, আমার রান্নাঘর আমার সংসার ইত্যাদি, সেই অশান্তিরই আখ্যান কিছু সাহিত্য ও প্রায় সব টিভি সিরিয়াল, সে কথা থাক। যখন আগলে রাখার মানুষটাই হঠাৎ করে নেই, তখন সে আভার প্রতিবাদ, বাধ্য হয়েই, লোকের ভীড়ে, হাতের ছোঁয়ায়, সরানো-নড়ানো, যেখান সেখান থেকে নিয়ে নিজের মত রেখে দেওয়ায়, উদলা, ‘জিরা কই রে’ ‘নুন কই রে’, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। 

  এই আলগা অস্বস্তি, অন্যের সাম্রাজ্যে নাড়াঘাঁটা, শুরুতে বহু আত্মীয়ের উপস্থিতে শোক উথলে ওঠে। বিশেষ যাদের মেয়ে, মেয়ের মায়ের। আর বাড়ির বৌ-এর যদি মা না-ই থাকে! দাদারা বিয়ে দিয়ে বেড়াল পার করে থাকে! আমাদের গল্প, আমরা যা ইচ্ছে যেকোনও দিকে নিয়ে যেতেই পারি। তাছাড়া যাকে দেখে এই গল্পের বীজ, সেই সত্যিমানুষের থেকেও তো গল্পকে ঠেলে ঠেলে যতদূর সম্ভব দূরে সরাতে হবে! তো, এই মরে যাওয়া বৌ-এর মা নেই। আহা! মরে গেল! কারোর মেয়ে নয় গো! শুধু মরে যাওয়া বৌ, এই পরিচয়। সেই বৌ-এর নিজের সুবিধের সংসার, রান্নাঘর, সংসার এক থাকার কালে, বা হাঁড়ি ভিন্ন হওয়ার প্রয়োজন না পড়ার কালে, আইবুড়ো দেওর, এই রান্নাঘর, এক ও অভিন্ন, এই ঘরেই ছিল, নিঃসপত্ন অধিকার ও রোয়াব, ছিল। তখন কৌটোবাটা, গ্যাসওভেন, হাঁড়িপাতিল, থালা-বাটি-সসপ্যান, অন্য অন্য হিসাবে সাজানো ছিল। তার ছবি সিঁদুর মাথায় (যেন তাই হয়,ঠাকুর!) চিতায় ওঠা পর্যন্ত  মনে স্থির। আজ বছরের, বহু বহু বছরের নদী সাঁতরে, মাঝখানে হাঁড়ি বিভাজন, সংসারে ফাট, একই বাড়িতে অবাধগতি রোধ, নতুন এক ঘর, নতুন করে হাঁড়ি পাতিল, নতুন করে হেঁশেল,  নতুন বস্তুসম্ভারে ব্যবহারের আভা তৈরি করা, নিত্যনতুন সমস্যায় সুখে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে থাকা ও কোলের বাছুর কোলছাড়া হয়ে সামনে খলবল করা, কাঁটা, দুই আপাতপূর্ণ সংসারে তুলনা, অসম, কেননা বালক অবোধ, এপারে মৃতবৎসা। অতঃপর সমস্ত ছক উলটে মৃত্যুর হেঁটে চলা যাওয়া। বাড়ির প্রথম বৌ। আদি হেঁসেলের সামনে দাঁড়িয়ে পরিবর্তিত আভায় ও পরিস্থিতিতে যারপরনাই থমকায়। তখন আরও মহিলামহল পাশে। তারাও স্থানু। মরে যাওয়া বৌ-এর রাজত্বে প্রবেশের পূর্বে এই যে থমকানো, যেন বা কিছু বদ্ধ বাতাসের গায়ে এসে লাগা, কিছু অন্য ঘ্রাণও হয়ত, তারা এই নিয়ে পরে একজোট হয়ে গলা চেপে আলোচনা করবে, একে চলে যাওয়া প্রাণের তার সংসারের প্রতি টান, অতএব প্রেতের কারসাজি সাব্যস্ত করবে। তাদের গায়ে ঘন ঘন কাঁটা দেবে। এ ওকে তা দেখাবে। সংসারের কেজো কথাবার্তার তলে তলে, শোকের তলে তলে ভয় প্রবাহিত হবে। যেহেতু প্রেত, জীবৎকালের স্বভাবের সাথে সম্পর্করহিত, ফলত আতঙ্কের। যত দ্রুত সম্ভব গয়া যাওয়া আবশ্যক, এই সিদ্ধান্ত অবধারিত আসবে। আপাতত অভুক্ত পুরুষ ও বালক। তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে কর্মব্যস্ততায়। 

  আবশ্যক উঠোন ও উঠোনে শোয়ানো বধূ নিয়েও প্রচুর কথা। এ দৃশ্যে বালকের অবোধ থাকা আশির্বাদ। কেননা শোকের ভার। তার অবোধ ভাব পক্ষান্তরে অপরাপর আগত জনের জন্য শোক ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা দ্বিগুণ করে। ওই সেই মূল চিন্তা, আমার কী হবে! যার সে ভাবনা ভাবার শক্তি নেই, তার জন্য পারিপার্শ্ব ভাবে, এর কী হবে! দুনিয়া শুষ্ক, কঠোর, কন্টকময়, অর্থচালিত। নিজের দানা নিজে খুঁটে কেড়ে নিতে হবে। ভাবনাকারীরা পিঠে একবার হাত রেখে একে একে পশ্চাদপটে ম্লান। মিলিয়ে যাবে। পড়ে থাকবে পিতা। এমত সন্তান নিয়ে তার সংসার কিছু হাঁসের পালকে জল, ভেসে ভেসে চলছিল না। এবার প্রকৃতই তাকে টানতে হবে। দিনযাপনের ভারে মাথা নুয়ে এলে, শরীরের প্রতিটি অস্থি দু-টুকরো হওয়ার উপক্রম হলে, পুত্রে বিরক্তি, পিতৃত্বে ধিক্কার, সামগ্রিক জন্মচক্র বংশরক্ষা ইত্যাদি বিশ্বাসে চওড়া ফাট ধরবে। দিগন্তে দ্বিতীয় নারীর সম্ভাবনা নানারূপ আশংকায় গ্রীষ্মদুপুরের দূরবর্তী মরীচিকার মত কেঁপে কেঁপে উঠবে। বৌদিদির ভূমিকা এখানে দ্বিধার। বা বহুতর টানাপোড়েনে চৌচির। সংসার অপূর্ণ, পূর্ণকরণ আবশ্যক, (কীই বা বয়স, পুরুষ, সোনার আংটি আবার বাঁকা ইত্যাদি), আবার দ্বিতীয় রমণী, তার চাওয়া-পাওয়া, সর্বোপরি অবোধ সপত্নিপুত্র ও মৃত সতীনের ছায়া। কিন্তু সেসব যখনকার কথা তখন। আপাতত উঠোন। পিতৃপুরুষের দেহ শোয়ানোর দাগের ওপর শোয়ানো বধূর দেহ। মাথার কাছে ধূপ। সাদা চাদর, গাঁদার মালা, রজনিগন্ধার স্টিক, বাঁশের মাচা, ঘিরে ধরা জনতা, কান্না চাপার চেষ্টা ও থেকে থেকে হরিধ্বনি। দেহ তুলে নিয়ে যাওয়া আর শ্মশানের পর্ব আরও বিস্তারিত ও গভীরচারী। 

  এক শ্মশান বহু শ্মশানের স্মৃতি আনে। সমস্ত পূর্বকৃতি, যেহেতু শবানুগমন মড়াপোড়ানো পূন্যকাজ, সমাজে স্বীকৃত, এক শবদাহ বহু শবদাহের গল্প টেনে আনে। জঙ্গীপুর, জিয়াগঞ্জ, বহরমপুর, হালিশহর, ক্যাওড়াতলা, নিমতলা, মনিকর্ণিকা। কিঞ্চিত অসম্পর্কীয়, পাড়াতুতো বা ক্লাবের ছেলে, শ্মশানযাত্রী, দেহ থেকে সামান্য তফাত রেখে, জটলা করে এইসব গল্প পাকাবে। পাকাক। যেমন, যে-ই মরুক, শব শ্মশানের মাটি স্পর্শ করতে না করতে কয়েকজন নিভৃততর কোনও অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবেই যাবে। তারা সব ঠেক জানে। অথবা তাদের জোগাড় তাদের সঙ্গেই থাকে। যেমন সব দলেই একজন দুজন এমন, যারা সব সামগ্রীর প্রকৃত দাম জানে। বাজারের থেকে কম জানে। কম করতে জানে। তারাই অগ্রবর্তী। সেনাবাহিনী যদি, বা এক একটি যুদ্ধযাত্রা, জীবনও, এরা পথের বাধা, জঙ্গল বৃক্ষরাজী অপসারণকারী, সবকিছু যোগাড়যন্ত্র, চুল্লির কপাট নেমে আসা শুধু নয় (কাঠের চিতার গল্প আলাদা, অন্য ধারায় বইবে, তা অন্যত্র বলার), মৃতের নিকটতমকে ঘাট থেকে তুলে সাবাধানবানীসহ বাড়ি ঢুকিয়ে, লোহার ও নিম দাঁতে কেটে, অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছুতেই শ্রাদ্ধকার্য্য, মৎসমুখী লোক খাওয়ানোতে আসতে চায় না, ‘ওরে শ্মশানবন্ধুকে আসতে হয় রে’, বারবার বলে বলে, কথা ফেলতে পারবে না, এমন কাউকে দিয়ে বলিয়ে, খাওয়াদাওয়ার দিন, লাজুক, একপাশে এসে বসে থাকে, যেন সমুদ্রের অন্ধকার তলদেশের মাছ, হঠাৎ সূর্যালোকে, বিহ্বল। আপাতত শব ছুঁয়ে বসে থাকা, শীতের মধ্যে ঘিনঘিনে বৃষ্টি, শ্মশানের মেঝে, চুল্লির ধারেপাশে নয়, তবু, পচা ফুল পাতা ভাঁড় শ্মশানসামগ্রী, থিকথিকে কাদা, দাহের জন্য দীর্ঘ লাইন, ক্লান্তি, কড়া হ্যালোজেনের আলোর বল্লম নিদ্রাহীন চোখে, তীক্ষ্ণ, বিধঁছে। 

  ঘড়ির প্রতি দৃষ্টিপাত বা সময়ের বোধ রাতকে প্রহরে ভাঙে। এমত পরিস্থিতিতে জেগে থাকা ভবিষ্যতের বহু গল্পের উপাদান। ‘সে কী অবস্থা! সারারাত শ্মশানে বসে। বসার একটা জায়গা নেই। তার ওপর শীতকালে বৃষ্টি। রাত তিনটের পরে লাইন পেলাম, জানেন! ভগবান এক একটা দিন সত্যিই দেন বটে!’ শেষের বাক্যটি শ্রোতার কাছ থেকেও আসতে পারে। সময়ের জ্ঞান রাতকে নানা প্রহরে ভেঙে নানারূপ ইমোশানের সাথে গুলে দেয়। অন্যথায় রাত নির্জ্ঞান, নিথর, উদাসীন, বয় কি বয় না বোঝা যায় না। প্রহরে প্রহরে তফাত নেই। ধৈর্য্য শেষ প্রায়। সহ্যের সীমানায় বসে পাখি ডাকে। আকাশের পদতল ফাটে, ক্রমে রাঙা হয়। 

  শ্মশানযাত্রী শ্মশানে, দেহ চুল্লীতে বা চুল্লীর প্রতিক্ষায়। নবীন লেখক দেখবে, মহাকালের গনগনে হাঁ খুললে, দেহের ওপরের নামমাত্র আচ্ছাদন, সাদা ফিনফিনে বস্ত্রখন্ড, আগে ধরে। লোম চুল ধরে কি না দেখার আগে লৌহগরাস ঘটাং বন্ধ হয়ে যায়। প্রবীণ লেখক এসবের দিকে নিরাসক্ত তাকান। তার কোনও না কোনও লেখায় ব্যবহৃত শ্মশানবিবরণী তার মনের ভেতর পঠিত হয়। তিনি অতৃপ্ত হন। ভাবেন, দেখার কত বাকী! যা দেখি, লেখায় তার কতোটা ধরা এখনও বাকী! 

  সব জনপদ গঙ্গা পায় না। সভ্যতা জল চায়। পাশে খাল। স্তব্ধগতি। তাতেই অস্থিদান। নাভিকুন্ড দান। অতঃপর কাকস্নান। স্ত্রীবিয়োগে বিহ্বল, অন্ততঃ রীতি, পাশ থেকে কেউ না কেউ ধরে ধরে সিঁড়ি নামায়। কোনওমতে জলস্পর্শ। কচুরিপানা জলঝাঁঝি সরিয়ে নাকমুখ বুঁজে ডুব। এই জলে এত জনপদের এত স্মৃতি! প্রতি বিন্দু জাগ্রত। ভেজা শরীর, উঠে এলে, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম প্রেত লেগে থাকে।  

  অতঃপর লুচি-মেঠাই-এ যোগদান। অনিচ্ছায়। জোর করা হয়। একরকম শারীরিক জোর। বিহ্বলতা ভাঙাতে জোর লাগে। পিঠে জোরে জোরে চাপড় মারা, বিড়ি ধরিয়ে এগিয়ে দেওয়া, নানারকম ফালতু এদিক ওদিকের কথা বলা— যা কিছুই হতে পারে। আশঙ্কা এই, এ বুঝি শ্মশানেই রয়ে যায়! ধারণা এই, সদ্য ছেড়ে যাওয়া আত্মা শ্মশান থেকেই নিকটজনকে সবচেয়ে বেশী টানে। 

  ঘটনা মালদা অঞ্চল হলে শ্মশান সাদুল্লাপুর। শ্মশান সাদুল্লাপুর হলে খাওয়া ‘হাতি পেয়ে লুচি’। আলুর তরকারি। বোঁদে। রসগোল্লা। কাঁচের গুলি মার্বেলের থেকে একটু বড় সাইজের। সব কেজি দরে। লুচি এনে ঝুরি করে ওজন মেশিনে, ঝুড়ির ওজন বাদ। তরকারি বালতি করে, বালতি বাদ। খাওয়া হলে আবার ওজন। বিয়োগ। হিসাব। লুচির সাইজে পুর্ণাঙ্গ হাতির পায়ের ছাপ। অতএব নাম। কেউ একজন দায়িত্বে। দাদা গম্ভীর, তদারকে ব্যস্ত। খাদ্যে অনাগ্রহ। বিশেষ অ-বয়েসে যাওয়া যখন। সকলে নয়। মাদকের প্রভাবে, খাটনির অজুহাতে, বহু শবদাহের বৈরাগ্যে, খায়। হয়ত সামান্য আড়াল রেখে খায়। 

  যে দাদা গৃহে থেকে বিদেশ, ভিন্ন প্রবেশপথ, ভিন্ন আকাশ, কেননা পাঁচিল, সে পাঁচিলও দিনে দিনে মনে মনে আকাশে ঠেকেছে, ভাদ্রবৌ ম’লে, কী করতে হয় কী বলতে হয়, অস্বস্তি, একসাথে বড়ো হওয়া বা সুদূর অবিবাহকাল, সাহায্যে আসে না। বৌ, নিজের বৌ-এর কাছে ঘুরঘুর করে। বৌ বোঝে। তারই তো হাতের বাছুর। ঠেলে পাঠায়। নিজে যায়। 

  মাছের ডিমের মত জড়িয়ে থাকার দিন বাড়ে, লোক বাড়ে। শ্রাদ্ধ ও মৎসমুখীতে চরম। ছাদে প্যান্ডেল। প্যাণ্ডেলে ছবি। ছবিতে মালা। চন্দন। ছবির সামনে ধূপ। এক এক বারে এক এক প্যাকেট। মন্ত্রে শোক উথলায়। হরিধ্বনিতে উপচে পড়ে। মহিলামহল, যে যেখানে কাজে, চোখে আঁচল দেয়, কান্নায় ভাঙে কেউ কেউ। কেউ তাদের দুহাতের বেড়ে ধরে। হাত থেকে ট্রে, থালা, কাপডিশ নিয়ে নেয়। সবটা বধূর শোক নয়। হতে পারে না। এক হরিধ্বনি এযাবৎ শোনা সব হরিধ্বনির স্মৃতি আনে। শোক আনে। পিতার শোক মাতার শোক, কারও বা স্বামীশোক ভাতৃশোক। এক শোকের পিঠের ওপর আরও আরও অতীতের শোকের ভার চাপে। যে যতো বৃদ্ধা, তার তত ভার। যত বয়স তত অশ্রু। 

  সে-ও একসময় মেটে। লোকসমাগম ফিকে হয়। যে বয়সকালে মাথার চুল। সংসারে হাতড়ানো শুরু হয়। বাটি-ঘটি-কৌটো-বাসন সব লুকোচুরি খেলে। রাত্রে তাকের ওপর রাখা হল, সকালে নেই। আধবেলা ধরে খুঁজলেও নেই। দুদিন পরে হয়ত খাটের তলায় পাওয়া যাচ্ছে। এসময় বৌদিদি ঢোকে। আশৌচকালে আরও সকলের সাথে বস্তুর আভা ভেঙে ঢুকেছিল। সচল হয়েছিল। এখন সাবেক হেঁশেল, তবু কিছু আলগা। ব্যবহারে অপরিচয়ের আড় ভাঙে। তবু বাধা। দখল সম্পুর্ণ হয় না। যেন বা ভাড়া বাড়ি, সাবলেট। বালক প্রবল সহায়ক। আসা যাওয়া করার কাঁচের সাঁকো। যে কপাট কলহে বন্ধ হয়েছিল, বিপুলতর বিপদে খুলেছে। পুরোটা খোলেনি। উভয় পক্ষেরই গলার ভেতর বিবাদের স্মৃতি, শুকনো ঝোঁপ, কাঁটা খরখর করছে। এ পক্ষ মুহ্যমান, ও পক্ষ প্রাণপণে ছাইচাপা দিচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। যেন বা মাঝখানে শোকও নেই। দিনাতিপাতের কথা হয়। চাল চিনি তেল নুনের কথা হয়। 

  এ গল্পের শেষ নেই। শেষদৃশ্যে মুখোমুখি স্থির, ফ্রিজশট, এরকম কিছু হলে ভালো হয় বলে লেখকের মত। কিন্তু শেষ দৃশ্যই নেই। আসা যাওয়া চলতে থাকে। হেঁশেল কখনোই পুরোপুরি নিজের হয় না। প্রতিবার একটু বাকী থেকে যায়। এছাড়া স্ত্রী বিয়োগে স্বাবলম্বী হওয়ার দিন আসে, এরকম ধারণায় কোলের বাছুর কোলের থেকে দূরে যেতে চায়। বয়সও হয়েছে। মধ্যবয়স। চপলতা বেমানান। 

  দিন কাটে। রাত হয়। বালক ঘুমের তাড়সে পিতার বুকে পা তোলে। পিতা সে পা নামায়। মুখের লালা মোছে। সারাদিন দোকানের গোড়ায় থুবো বেড়ালের মত বসে থেকেছে। সহস্রবার বিরক্তি, রাগ, ধমক, হতাশা। বালক ফিরে ফিরে হাসে। লোকে ভাবে, দেবতার দয়া এ কী রূপে! পিতা, ব্যবসায় নিমগ্ন। একখানা চোখ এদিকে ফেলে রাখতে হয়। রাতেও সে চোখে পলক পড়ে না। ঘুম এসে দখল করে না। বয়স সকলেরই হচ্ছে। তরোয়ালের ধারের দুনিয়া। কঠোর, একাকী, নিষ্ঠুরতাচালিত। এ বালকের কী হবে? যে ভাবনা পিতার-মাতার, কিছুদিন অন্যলোক ভেবেছিল, এখন আবার পিতার কাছে ফিরে এসেছে। সে দুশ্চিন্তায় শিউড়ে উঠে পিতা তাকিয়ে তাকিয়ে সিলিং ফাটিয়ে ফেলে। রাতের স্তব্ধতা তাকে হাতির পায়ে পেষে। দুরের দিকে চোখ পড়ে গেলে বুক চেপে আসে। যে ভগবানের বিচারে তার এই দশা, তাকে পুনরায় ভরসা করে ‘ঠাকুর দেখো’ বলতে বাধে। সে দূর থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আজকের দিনটা গেছে, কালকের দিনটা যেন কেটে যায়, এটুকুই বলে। কাকে বলে, জানে না। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *