মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস 

অষ্টম পর্ব 

পুরোনো সেই দিনের কথার ঝুলি খুলে বসলে কেবলই হারাতে বসা সহজ জীবন যাপনের ছবিগুলো চোখের ওপর ঘুরে ফিরে আসে। ভাদুড়িপাড়া, ডাঙাপাড়ার সেই সব দিনগুলোর সব হয়ত খুঁটিনাটি মনে নেই। কিন্তু আছে তো কোথাও। জন্ম থেকে প্রায় পাঁচ বছর ছিলাম ৺উমাপদ ভাদুড়ির বাড়িতে। ভাড়াবাড়িতে থাকা কি সে বয়সে বোঝার কথাও নয়, আর বোঝার মতো কোনো পরিস্থিতিতেও পড়িনি। উমাদাদু, ঠাকুমা, বাবুনকাকা এদের যথেষ্ট স্নেহে আমার দিন কাটতো। মিনুপিসির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। পিসির দুই ছেলের সাথে আমার ছবি এখনও আমাদের আ্যলবামে আছে। ধ্যাবড়া কাজললেপা তিনটে মুখ দেখলে আমার খুব মজা লাগে।
অনেক উঁচু রোয়াকের ওপর দাদুদের দোতলা বসত ঘর। পুব পশ্চিমে। আর ভাড়া ঘরদুটি উঠোনের একদিকে উত্তর দক্ষিণে। এক পাশে কুয়ো, কলঘর। মাঝে বাগান। খিড়কির দরজার পরই পুকুর। সে পুকুরের মালিকানা কার ছিল জানি না। বাড়ির প্রধান ফটক ছিল মনাজেঠার মুদিখানার পাশ দিয়ে। ওই দোকানসহ বড় রাস্তা সংলগ্ন আরও অনেক দোকান বাবুনকাকাদেরই ভাড়া ছিল। ওই পাড়ায় অনেকটা অংশই ভাদুড়িদের ছিল, যা পরে পরে ওদের হাতছাড়া হয়।

ওই বাড়িতে আমি পিয়ানো দেখেছিলাম। আর দেখেছিলাম কাঠের স্ট্যাণ্ডে ধাপে ধাপে রাখা মাটির কলসিতে পানীয় জল পরিশ্রুত করার ব্যবস্হা। এমন ফিল্টারের ছবি পরে প্রাথমিক স্কুলের বইয়ে দেখেছিলাম। আমাদের হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়েও এই ফিল্টার ছিল স্কুলে ভর্তির পর জেনেছি।
আর একটা জিনিস দেখেছিলাম ভাদুড়িদের রান্নাঘরে, ঘুঁটে গুল আঁচের উনুনের ওপর মোটা পাইপ ঢাকা দিয়ে আঁচ দেওয়ার পর ধোঁয়াটা বাইরে পাঠাবার ব্যবস্হা। এখনকার ঝকঝকে কিচেন চিমনি ও বিবিধ ওয়াটার পিউরিফায়ারের যুগে এসব তোমাদের কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে। তবে এই অদ্ভুত সুন্দর চিমনি আমি ভোঁদাদাদুদের বাড়িতেও দেখেছিলাম। পরের দিকে পিয়ানোটা আর ওই বাড়িতে দেখিনি। পুরোনো ছায়াছবিতে পিয়ানো দেখলে এখনও আমার সেইটির কথা মনে পড়ে।
ওই বাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ছিল অনেক দিনের। গান বাজনা ছাড়াও দাদু থিয়েটারের ভক্ত ছিলেন। মিনু পিসির গানের প্রশংসা সবার মুখে ফিরতো। আমার যদিও প্রয়াতা পিসির গানের কথা কিছুই মনে নেই। পিসির থেকে বয়সে অনেকটা ছোট ভাই বাবুনকাকাকে কালনার সবাই চিত্রদীপ ভাদুড়ি নামে চেনে ও তার নানা বাদ্যযন্ত্রর ওপর দক্ষতার কথাও সকলে জানে, এ ছাড়াও গীতিকার ও সুরকার হিসেবে তার পরিচিতি।
অত ছোটবেলায় বাড়ির মানুষদের এত সব গুণের হিসাব জানতাম না। শুধু এটুকু জানতাম ওই উঁচু রোয়াকে সারাদিন খেলনাবাটি খেলা যায়, পাশের ঘরে ভাড়া থাকা ছোট বাবুভাইয়ের সাথে দুষ্টুমি করা যায়, আর অপরূপ মুখশ্রীযুক্ত আটপৌড়ে ঠাকুমার মুখে চোখ রেখে গল্প শোনা যায়।
মাটির সরায় জড়াজড়ি করে বেড়ে ওঠা ইতুর লতাদের দোলে দোলে উমনি ঝুমনির গল্প গেঁথে যায় মনে।
বাবুনকাকার পিসির বাড়িও ছিল কাছেই। ওনার স্বামী প্রহ্লাদ স্যান্যাল ওকালতি করতেন। তখন শহরের অনেক বাড়িতেই গরু ছিল। ওনাদের বাড়িতেও ছিল। সেই কারণেই হয়ত আমি বাবুনকাকার পিসিকে হাম্বাদিদা বলে ডাকতাম। হাম্বাদিদা মাটি দিয়ে খুব সুন্দর খেলনার জিনিস যেমন পুতুল, উনুন, হাড়ি এসব আমায় বানিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তো প্ল্যাস্টিক খেলনার দেখা পাওয়া যায় নি। মিলত লোহা বা এলুমিনিয়ামের খেলনাপাতি। হাম্বাদিদার খেলনাগুলো আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। মাঝে মাঝে কেশবপুর থেকে পদ্মপিসি এসে থাকত, বাবুভাইদের সাথে মিলে মিশে খুব আনন্দ হতো।ওই বাড়ির দিনগুলো একদিন ফুরিয়ে গেল।

ভাই হওয়ার পর পর আমরা রাস্তার উল্টোদিকে দাদুর ডিসপেনশারি কাম বসত বাড়িতে চলে এলাম। বাবুভাইয়ের বাবা কোথায় বদলি হয়ে সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন।  বাবুভাইদের সাথে বড়দের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল। জানি না, তারা এখন কোথায় কেমন আছে।
কিন্তু পাড়াতেই থাকার জন্য বাবুনকাকাদের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিলই, ছিল বন্ধন।
বাবুনকাকার মা, আমার প্রিয় ঠাকুমার মারা যাওয়াটা আমার কাছে খুবই কষ্টদায়ক ছিল। উমাপদদাদু মারা যাবার আগে বাবুনকাকার বিয়ে হয়ে গেছিল। মণিককিমাও ওই বাড়িতে আগে যেমন স্নেহ পেতাম, তেমনি স্নেহ করে আজও।
বড় হবার পর বাবুন কাকার ঘরে আছে আরও কিছু অমূল্য স্মৃতি। সরস্বতী পুজো উপলক্ষে যুগেরদীপ আর অগ্নিবীণা ক্লাবের জন্য গান বেঁধেছিল বাবা। যুগেরদীপ ক্লাবের সেবার সম্ভবত পঁচিশ বছর পূর্তি ছিল। প্রসঙ্গত কালনার বাসিন্দা নন, এমন পাঠকদের জন্য বলে রাখি কালনার  সরস্বতী পুজো দুর্গাপুজোর থেকেও বেশি চমকদার। আর থিম সং টং আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। বাবুনকাকার সুরে আমরা কয়েকজন সেই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলাম। অবশ্যই আমাদের লিড সিঙ্গার ছিল রুমুদি। রুমু পালিতের গলার মোহমুগ্ধ আমি সেই স্কুল জীবন থেকেই‌। বাকি আমরা যারা ছিলাম তারা আহামরি কেউকেটা কেউ নই। কিন্তু সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়ে ছিলাম। তখন ভালো রেকর্ডিং স্টুডিও কিছু ছিলনা। দিনের হট্টগোল থেকে বাঁচার জন্য রাতে গান রেকর্ড হয়েছিল। বাবুনকাকার বাড়িতে ঘন ঘন রিহার্সালের পর এক রাত জেগে যখন রেকর্ডিং শেষ হল তখন আসন্ন সরস্বতী পুজোর আনন্দ যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল। পরে যখন প্যাণ্ডেলে সেই গান বাজতে শুনেছি, ভীষণ রোমাঞ্চ লেগেছিল।

যখন কম্পিউটার প্রথম প্রথম পশ্চিমবঙ্গে প্রয়োজনীয় বলে মনে হল, তখন টাইপ শেখার মতো ঘরে ঘরে কম্পিউটার শেখার তাগিদ তৈরি হল। ভাদুড়িবাড়ির ঘর ভাড়া নিয়ে তখন সফ্টটেক কম্পিউটার সেন্টার চালু করল অলোকদা (চ্যাটার্জী)।  আমি টাইপ শিখেছিলাম বহু বছর, এবার কম্পিউটার সেন্টারে আনাগোনা শুরু করলাম। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। কিছু দিন কাজের থেকে অকাজ অর্থাৎ অফিস টফিস না শিখে খানিক পেন্ট টেন্ট করে আমি ক্ষান্ত দিলাম। 

চারিদিকে যখন ব্যাণ্ডের হাওয়া বইছে ঝিরি ঝিরি, তখন বাবুন কাকার বাড়িতে মাঝে মাঝে কিছু গানের আড্ডার কথা আজও মনে পড়ে। অবশ্যই সেখানে প্রবীর কাকার (প্রবীর মণ্ডল) গলা শোনা যেত। ওই রকমই কোনো এক দিনে আমরা জেলা বইমেলার সাংস্কৃতিক মঞ্চে অনুষ্ঠান করছিলাম। ছোটরা বড় হয়ে দূরে দূরে সরে গেছি। কিন্তু আরও আরও ছোটদের রোজ সুরে তালে দুলতে কাছে ডাকে বাবুনকাকার ‘তরঙ্গতীর্থ’।
ভাদুড়িবাড়িতে আমার প্রথম অনেক কিছুই তাই বাড়িটার অনেক পরিবর্তনের পরেও ওই বাড়িতে একটু সময় কাটাতে ইচ্ছে করে মনে।  সামনে রাস্তার ওপর স্টুডিও আর নেই, মুদিখানার ঘর ধুলোয় মিশেছে। তবুও বাড়িটার লোহার নক্সা করা দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, ওই দোতলার বিরাট ছাদ, ছাতে শুকতে দেওয়া জাল দিয়ে ঢাকা বড়ির গন্ধ আমায় কোনো এক বনেদি অস্তিত্বর ঈঙ্গিত দেয়। মনে করিয়ে দেয় ‘প্রথম আলো’ বা ‘কলকাতার কাছেই’ ইত্যাদি বইয়ে পড়া নানা চিত্রকে, যে সব চিত্র আমাদের পরের প্রজন্মের কাছে শুধু গল্প হয়েই থেকে যাবে।

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *