মলয় রায়চৌধুরী

চার 

দেবেশ রায় প্রথম বলেছিলেন যে হাংরি আন্দোলন থেকে নকশাল আন্দোলনের দিকে সময় একটা বীক্ষার মাধ্যমে প্রসারিত হয়েছিল, কিংবা এই ধরণের কোনো কথা, তারপর অনেকেই নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের ভাবনার একটা যোগসূত্র খুঁজতে চেয়েছেন । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে রফিক উল ইসলাম জিগ্যেস করেছিলেন যে দুটো আন্দোলনের নিজেদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা । সুনীল বলেছিলেন যে নকশাল আন্দোলনে অনেক মহৎ আত্মত্যাগ হয়েছিল, অনেক তরুণ মারা গিয়েছিল । 

আমার মতে দুটোর মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তা সময়-পরিসরের রেশের । হাংরি আন্দোলনের চিত্রকর অনিল করঞ্জাই আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় নকশাল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন আর পুলিশ ওনাদের রাতের মিটিঙের কথা জানতে পেরে স্টুডিও ভাঙচুর করে যাবতীয় পেইনটিঙ নষ্ট করে দিয়েছিল । অনিল, করুণা আর ওদের ছবি আঁকার দলের যুবকরা আগেই খবর পেয়ে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিল, অনিল দিল্লিতে আর তারপর এক মার্কিন যুবতীর সঙ্গে আমেরিকায় ; করুণা চুলদাড়ি কামিয়ে, চেহারা পালটিয়ে সপরিবারে পাটনায়, সেখানে দাদা করুণাকে একটা রঙিন মাছের দোকান খুলে দিয়েছিলেন । আমার কাকার মেয়ে পুটি উত্তরপাড়ার বাড়ির বড়োঘরের কড়িকাঠ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছিল, তার কারণ যে নকশাল যুবকটিকে পুটি ভালোবাসতো তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে লোপাট করে দিয়েছিল । 

ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আমার এক মাসের সাজা হয়ে গিয়েছিল ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬৫ আর কলকাতা হাইকোর্টে উকিলের খোঁজে আমি নানা লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করছিলুম । জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সদ্য লণ্ডন ফেরা ব্যারিস্টার করুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে, ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে কপি নিয়ে যাবতীয় কাগজপত্র দিয়ে আসতে হচ্ছিল, তাঁর বাড়িতে,  লোহাপট্টিতে, যাতে কলকাতা হাইকোর্টে রেজিস্ট্রারের দপতরে জমা দেয়া যায় । এদিকে কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, নানা জায়গায় রাত কাটাই, পকেট ফাঁকা হয়ে যায় আদালতের কাজে আর দুবেলা খেতে । অনেককাল স্নান না করলে যে নিজের গা থেকে নিজেরই মাংসের গন্ধ বেরোয় তা তখন জেনেছিলুম । বন্ধুবান্ধবরা, সুবিমল বসাক ছাড়া, সবাই হাওয়া ।

তার মাঝেই ২২-২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ খাদ্য আন্দোলনে সারা বাংলা বন্ধ ডাকা হয়েছিল, মনে আছে । তখনকার কলেজ স্ট্রিট এখনকার মতন ছিল না, একেবারে ফাঁকা থাকতো, দিনের বেলাকার মিছিল সত্বেও, সন্ধ্যে হলেই অন্ধকার । বস্তুত, পুরো কলকাতাই একেবারে আলাদা ছিল । রণবীর সমাদ্দারের একটা লেখায় পড়েছিলুম যে নকশাল আন্দোলনের প্রকৃত সময়টা হলো ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ ; আর কোলকাতা হাইকোর্ট আমার মামলা এক দিনেই সেরে ফেলেছিল, ২৬ জুলাই ১৯৬৭ তারিখে, আমার দণ্ডাদেশ নাকচ করে । তাই হয়তো কেউ-কেউ মনে করেন যে হাংরিরা ১৯৬৭-পরবর্তী কালখণ্ডকে নকশালদের হ্যাণ্ডওভার করে দিয়েছিল । সময়-পরিসরকে হ্যাণ্ডওভার করার প্রক্রিয়া চলে আসছে সেই ব্রিটিশ-বিরোধিতার সময় থেকে। প্রফুল্ল চক্রবর্তী ওনার ‘মার্জিনাল মেন’ বইতে লিখেছিলেন যে দেশভাগের পর বহু তরুণ লুম্পেন প্রলেতারিয়েত হয়ে ওঠে এবং তাদের থেকেই পশ্চিমবঙ্গে মাস্তানদের জন্ম । বস্তুত মাস্তানরও সময়-পরিসরকে ক্রমশ হ্যাণ্ডওভার করে চলেছে এখনকার জিঙ্গোবাদী রাজনীতিকদের করকমলে ।

ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে স্বদেশি আন্দোলনের যে রেশ আরম্ভ হয়েছিল, সেই রেশ নানা বাঁক নিয়ে যখন দেশভাগের ঘুর্ণিতে পড়ল তখন তার চরিত্র পালটে গেল, তার আগে সেই রেশে তেমন অ্যাড্রেনালিন ছিল না বলা চলে । এই রেশটাই হাংরি আন্দোলনের উৎসভূমি । এই রেশকে প্রথমে কৃষক নেতারা এবং পরে তরুণ সমাজ নিয়ে যান নকশাল আন্দোলনে এবং এই রেশকেই কেন্দ্র করে বামপন্হীরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসেন। এই রেশই নন্দীগ্রামে পৌঁছোবার পর বামপন্হীরা দিশেহারা হয়ে পড়েন আর তৃণমূল ক্ষমতা দখল করে । রেশটা থাকে জনগণের মাঝে । আমার মনে হয়, সব সময়েই থাকে,চিরকাল থাকে । 

হাংরি আন্দোলনের পরে-পরেই নকশাল আন্দোলন ঘটেছিল অথচ যাঁরা হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও পুলিশের কাছে নালিশ করেছিলেন তাঁরা কেন আসন্ন উথালপাথাল টের পাননি ? হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্যজগতের মূল্যবোধ-মালিক ও প্রকাশক-বাজারের জোতদারদের উৎখাত করতে চেয়েছিল, জন্তুজানোয়ারের মুখোশ পাঠিয়ে বিদ্যায়তনিক জোতদারদের টপলেস অর্থাৎ গলা কেটে ফেলতে চেয়েছিল, সাহিত্যিক ক্ষমতাকে দখল করে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিল লিটল ম্যাগাজিনের মাঝে, জুতোর বাক্স রিভিউ করতে দিয়ে এবং শাদা ফুলস্কেপ কাগজকে ছোটোগল্প নামে বাজারি কাগজে জমা দিয়ে সাহিত্যিক জোতদারদের দলিদস্তাবেজ বেদখল করতে চেয়েছিল । এগুলো কোনোরকমের ইয়ার্কি বা প্র্যাঙ্ক ছিল না।

যাঁরা নালিশ ঠুকেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিদ্যায়তনিক প্রতিনিধিরাও ছিলেন যাঁদের হাংরি আন্দোলনকারীদের পাঠানো কার্ডে FUCK THE BASTARDS OF GANGSHALIK SCHOOL OF POETRY ঘোষণা পড়ে অপমানবোধ হয়েছিল, জানোয়ার ও দানবের মুখোশ পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল । অথচ তার কয়েক বছর পরেই নকশাল তরুণরা শিক্ষকদের গলা কাটা আরম্ভ করলেন, জোতদারদের বাড়ি লুঠ করে দলিল-দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিলেন, জমি দখল করে বিলিয়ে দিলেন ভাগচাষিদের । নকশাল আন্দোলনকারীরা জোতদারদের বেদখল করার সময়ে, বাড়িতে-খামারে আগুন ধরিয়ে দেবার সময়ে FUCK THE BASTARDS -এর পরিবর্তে বাংলা ও চোস্ত হিন্দি গালাগাল দিয়েছিল, জোতদার আর ভূস্বামীদের মুখোশ চামড়াসুদ্দু ছিঁড়ে উপড়ে নিয়েছিল । 

নকশাল তরুণরা এসে দেখিয়ে দিল যে হাংরি আন্দোলনকারীদের এই কাজগুলো ঠাট্টা-ইয়ার্কি করার ব্যাপার ছিল না, তা ছিল চোখে আঙুল ঢুকিয়ে বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার প্রক্রিয়া । জোতদারদের বিরুদ্ধে যে ইতর বুলি কথাবার্তায় প্রয়োগ করে ক্ষান্ত থেকেছিলেন নকশালরা, তা নিজেদের লেখায় নিয়ে এসেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা যাকে মধ্যবিত্ত পরিবারের বিদ্যায়তনিক ও গ্লসি পত্রিকার চাকুরে আলোচনাকারীরা বলে এসেছেন অশ্লীল ও অশোভন । আলোচকরা ভুলে গিয়েছিলেন যে ছোটোলোকদের ভাষা অমনই হয়। নকশাল আন্দোলনের কবিতা  কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালির ভাষার আওতার বাইরে বেরোতে পারেনি বলেই মনে হয় । 

যেমন কৃষ্ণ ধর-এর ‘একদিন সত্তর দশকে’ কবিতাটি :-

শিকারকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে

অন্ধকারে মিলিয়ে যায় জল্লাদের গাড়ি

শহরের দেয়ালে দেয়ালে পরদিন দেখা যায় তারই কথা

সে নিদারুণ তৃষ্ণায় একবার জল চেয়েছিল

যে যন্ত্রণায় নীল হয়ে একবার ডেকেছিল মাকে

তবু স্বপ্নকে অক্ষত রেখেই সে

বধ্যভূমিতে গিয়েছিল

একদিন সত্তর দশকে।”

স্বপন চক্রবর্তী লিখেছিলেন :-

আমরা সাহায্য চাইনি’

আমরা সাহায্য চাইনি

কারণ আমরা বদল চেয়েছি।

চেয়েছি ক্ষিদের মানসিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে

একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।

.কোনদিনই আমরা কমিউনিস্ট হতে চাইনি।

এখন সময়

মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।

মানুষের জন্যে আমাদের মানুষের মত হতে শেখাচ্ছে।

আমরা চাইনি ইজ্জত খুইয়ে ঘাড় হেঁট করে পেট ভরাতে।

আমরা বদল চেয়েছি

চেয়েছি ক্ষিদের যন্ত্রণার বিরুদ্ধে

একটি সকাল, দুপুর, রাত সময়, কাল, অনন্ত সময়।”

নির্মল ঘোষ তার ‘নকশালবাদী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘অনস্বীকার্য, নকশালপন্থী কাব্যচর্চায় আঙ্গিকের চেয়ে বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর এর ফলে বক্তব্যে বহুক্ষেত্রেই আবেগের প্রাধান্য দেখা গেল, যা শেষপর্যন্ত পাঠক মানসকে প্রায়শ প্রভাবিত বা প্রাণিত করতে সমর্থ হয়নি।’ পক্ষান্তরে, কবিতার শৈল্পিক মানের এ বিতর্কে অর্জুন গোস্বামী নকশালবাদী কবিতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন, ‘এটা সত্তরের দশক। এই দশক প্রত্যক্ষ করেছে শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিতশ্রেণীর লড়াই। এই দশকেই প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রকে উপরে উপরে যতই শক্তিশালী বলে মনে হোক না কেন আসলে তারা হলো কাগুজে বাঘ। স্বভাবতই এই দশকের মানুষের সচেতনতা অনেক বেশি। আমরা এমন কোন কবিতা পড়তে চাই না যাতে আছে হতাশা, আছে যন্ত্রণার গোঙানি। আমরা এমন কবিতা পড়তে চাই যাতে ধরা পড়বে শোষণের আসল স্বরূপ, যে কবিতা পড়ে অনুপ্রেরণা পাবেন লক্ষ লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষ এবং যে কবিতা প্রকৃতই হবে শোষিতশ্রেণীর সংগ্রামী হাতিয়ার। আমাদের মধ্যে অনেকে বলেন কবিতা হলো এমন একটা জিনিস যা ঠিক স্লোগান নয়। আমাদের বক্তব্য হলো কবিতার বিষয় ও কবিতার আঙ্গিক এই দুটোর মধ্যে আগে বিষয়, পরে আঙ্গিক। বক্তব্যকে সাধারণের উপযোগী করে বলার জন্য কবিতা যদি কারুর কাছে স্লোগান বলে মনে হয় তবে সেই স্লোগানই হলো সত্তরের দশকের শ্রেষ্ঠ কবিতা।’

হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমিও বলেছিলুম,  “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়-বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয় ; উন্মাদের মতন চিৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্ট-যন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না ।” বাসব রায়কে দেয়া ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন যে মলয়ের কবিতায় অত্যধিক অব্যয় থাকে, চিৎকার থাকে । এই প্রেক্ষিতে নকশালদের সঙ্গে হাংরিদের তুলনা করা চলে, যেমন ত্রিদিব মিত্রের বিখ্যাত কবিতা ‘হত্যাকাণ্ড’ । হাওড়া স্টেশানের প্ল্যাটফর্মে বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে ‘হত্যাকাণ্ড’ কবিতাটা পড়ে ভিড় জমিয়ে ফেলেছিল ত্রিদিব মিত্র ।

হাংরি আন্দোলনের গ্রন্হ রিভিউ করতে গিয়ে শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা। অনেকেই প্রায় সমসময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে তুলনা করে এদের অরাজনৈতিক তকমা দেন, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হাংরি জেনারেশন যে প্রশ্ন তুলেছিল তা ছিল নকশালদের তোলা প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক। এমনকী তুমুল প্রচার পাওয়া এবং নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরি করা সত্ত্বেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত হাংরি আন্দোলনের থেকে পিছিয়েই রাখতে হয়।” শৈলেন সরকার যে বইটি আলোচনা করেছেন তাতে কোনো কারণে সম্পাদকমশায় হাংরি আন্দোলনের রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো অন্তর্ভুক্ত করেননি । করলে স্পষ্ট হতো যে হাংরি আন্দোলন অরাজনৈতিক ছিল না ।

প্রবুদ্ধ ঘোষ হাংরি আন্দোলন ও নবারুণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে আলোচনা করার সময়ে বলেছেন, “বাড়ি ভেঙ্গে পড়ার শব্দ তখনই শোনা যায়, যখন তা শোনার জন্যে কেউ থাকে। সাহিত্যের কাজ কী? ক্যাথারসিস করা? মানে, মোক্ষণ? বরং হাংরিদের লেখা প্রতিমুহূর্তে ক্যাথারসিসের উল্টোদিকে হাঁটে। মোক্ষণ করা, শান্তি দেওয়া তাঁদের কাজ নয়, বরং আপাতশান্তির বোধটাকে আঘাত করাই মূল উদ্দেশ্য!” একটু আগে আমি যেকথা বলেছি, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান-সাহিত্যের জোতদারদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে চেয়েছিল হাংরি আন্দোলনকারীরা, তাদের কাজের দ্বারা, লেখার দ্বারা, ড্রইং দ্বারা, সেকথাই বলেছেন প্রবুদ্ধবাবু । তবে প্রবুদ্ধবাবু একটা কথা ভুল বলেছেন, যে হাংরি আন্দোলনকারীরা কেবল আত্মবীক্ষণ ও আত্মআবিষ্কারে আলো ফেলতে চেয়েছেন। হাংরি আন্দোলনকরীরা যদি তাই করতেন তাহলে যে কাজগুলোকে মধ্যবিত্ত আলোচকরা ‘অসাহিত্যিক’ ব্যাপার বলে তকমা দেগে দেন তা তাঁরা করতেন না, বিভিন্ন বিষয়ে ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করতেন না । নকশালরা যে মূর্তির গলা কেটে প্রতীকিস্তরে বিশেষ মূল্যবোধকে আক্রমণ করেছিল, শিক্ষকদের খুন করেছিল, তার সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ-খুনের আক্রমণাত্মক কাজগুলো তুলনীয় ।

সুবিমল বসাকের একটা কবিতা এখানে তুলে দিচ্ছি, যা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল :-

‘হাবিজাবি’

আমারে মাইরা ফেলনের এউগা ষড়যন্ত্র হইসে

চারো কোনা দিয়া ফুসফুস আওয়াজ কানে আহে

ছাওয়াগুলান সইরা যায় হুমকে থিক্যা

অরা আমারে এক্কেরে শ্যায করতে সায়

আমি নিজের ডাকাইতে্যা হাতেরে লইয়া সচেত্তন আসি

কেউ আইয়া চ্যারায় দিশায় চ্যাবা কথা কয় না

আমি সুপসাপ থাকি

ভালাসির গুছাইয়া আমি কথা কইতে পারি না

২ কইতে গিয়া সাত হইয়া পড়ে

১৫ সাইলে ৯ আইয়া হাজির হয়

ছ্যাব ফেলনের লাইগ্যা বিচড়াইতাসি অহন

আহ, আমার দাঁত মাজনের বুরুশ পাইতাসি না

বিশ্বাস করেন, কেউ একজনা আমার মুহের সকরা খাবার খাইসে ।

(হাংরি বুলেটিন নং ১৮ থেকে)

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন “হাংরিদের ‘ক্ষুধা’ বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব মতামত ছিল ; এই ক্ষুধা আসলে নিজেকে দগ্ধ করে সত্য আবিষ্কারের ক্ষুধা। সত্য, যা ক্রমাগতঃ এমনকি নিজেকেও ছিঁড়েখুঁড়ে উন্মোচিত করে চলে। তাকাই ফাল্গুনী রায়ের কবিতায়, “আমার বুকের ভিতর লোভ অথচ হৃদয় খুঁজতে গিয়ে বুকের ভিতরে/ রক্তমাংসের গন্ধ পাচ্ছি কেবল”। আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলেন, ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তাহলে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবে না বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্‌কোর্স তৈরি করেছে।” 

প্রবুদ্ধবাবু আরও বলেছেন, “পণ্যসময়ে বেঁচে থেকে, কিচ্ছু না-পেয়ে বেঁচে থেকে, হতাশার অবিমৃষ্য বোধ তৈরি হয়। ’৬০-’৭০ র দশকের ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের আশাহীনতার অভিঘাত নৈরাশ্যের জন্ম দেয়; এমনকি সাহিত্যেও। আর, সেই নৈরাশ্যকে এড়িয়ে গিয়ে কবিতা বা গদ্য লেখা যায় না। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়… শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। এই স্বপ্নহীনতাকে বাড়িয়ে তোলে পুঁজিবাদের দমবন্ধ চেপে বসা। ভারতের তথা বাংলার অর্থনীতি-মডেলকে সাজানোর দোহাই দিয়ে বিদেশি শস্যবীজ এবং সবুজ বিপ্লবের সাথেই আমদানি হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর, নগরায়ণের মুখ খুলতে থাকে। ’৯০ র দশকের পরে যে বীভৎস হাঁ-তে ঢুকে যেতে থাকবে ভারতবর্ষের একের পর এক গ্রাম-মফস্বল।”

১৯৬৮ সালে বিনয় ঘোষ ‘কলকাতার তরুণের মন’ নামক প্রবন্ধে লিখছেন- “গোলামরা সব উঁচুদরের ঊর্ধ্বলোকের গোলাম, আগেকার কালের মতো তাঁদের হাত-পায়ের ডাণ্ডাবেড়ি দেখা যায় না। তাঁদের ‘স্টেটাস’ আছে, ‘কমফর্ট’ আছে, ‘লিবার্টি’ আছে। তাঁরা নানাশ্রেণীর ব্যুরোক্র্যাট টেকনোক্র্যাট ম্যানেজার ডিরেক্টর ইঞ্জিনিয়ার সেলস-প্রমোটার বা ‘অ্যাড-মেন’- যাঁরা যন্ত্রের মতো সমাজটাকে চালাচ্ছেন। ব্যক্তিগত ভোগ-স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাধীনতার একটা লোভনীয় মরীচিকা সৃষ্টি করছেন তাঁরা সাধারণ মানুষের সামনে এবং দিনের পর দিন বিজ্ঞাপনের শতকৌশলে নেশার পিল খাইয়ে সেই ভোগস্বাধীনতার স্বপ্নে তাদের মশগুল করে রাখছেন।”। ’৬০-’৭০ র অবক্ষয়ী অথচ পণ্যপ্রিয় ভোগসমাজের কথা সেইসময়ের মতন করেই লেখেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকাররা। আর, ভবিষ্যতের পণ্যসমাজের একটা আভাসও থাকে। “আপাতত প্রতীয়মান ধূম্রজালে জড়ানো ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর একজন দৈত্যভৃত্য বলে,  ‘আপনার গোলাম, আকা কি হুকুম যা বলবেন যা চাইবেন জীবনে তাই হাজির… একটি সিগারেট। …একটি সিগারেট। পাঁচ বছরে একটি টিভি সেট। দশ বছরে একটি গাড়ি আর বিশ বছরে সিগারেট খেতে খেতে একবার সারা দুনিয়ায় চক্কর দেব। বাতাস স্তব্ধ। অবাক হঠাৎ মেঘের আকাশ-কাঁপানো অট্টহাসি।”[ঘটনাদ্বয় ও তাদের সাজসজ্জাঃ রবিউল] 

বোর্দ্রিয়ারের মতে, উত্তর-আধুনিক সমাজে শ্রেণিবিভাগ আর শুধুমাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকছে না, বরং তা এখন নির্ভর করছে ভোগের ওপর। কে কোন পণ্য ভোগ করছে, তার ‘ব্র্যাণ্ড’ এবং দামের ওপর নির্ভর করছে তার শ্রেণিঅবস্থান। অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, পণ্যকৌশলে ভুলিয়ে দিতে চাওয়া দেশকাল-ইতিহাস আর, এমনকি প্রকৃত যৌনতা, সামাজিকতা, সবকিছুরই মৃত্যু ঘটছে- তখনই অধিবাস্তব টেনে নিয়ে চলেছে ‘ভার্চ্যুয়াল’ জগতে, এই সত্য তো হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখাতে উদ্ঘাটিত হয়েছে! বস্তুতঃ, তাঁদের লেখায় তাঁরা এটাকেই আক্রমণ শানাতে চেয়েছেন। আজকের মানুষের পরিসর-মাফিক রূপবদলের কথা আমি লিখেছি আমার ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ নামের অধিবাস্তব গল্পে আর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ফাঁসিয়েছি ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ নামের অধিবাস্তব কাহিনিতে — যা কিনা সময়-পরিসরের সঙ্গে অ্যাড্রেনালিনের রেশ এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রক্রিয়া ।

হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা-মকদ্দমা করে তাদের বিক্ষিপ্ত করে দেবার পর, প্রতিষ্ঠানের লেখকরা লেখালিখি করে দেখাতে চাইলেন, নকশাল আন্দোলন মধ্যবিত্ত রোম্যাণ্টিকতা ও কাঁচা প্রেমের মতো, বামপন্থা মানেই তা ভ্রষ্ট সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায় এবং আসলে নিরাজনীতিই মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলে! হাংরিদের পর থেকে তাদের বিরুদ্ধতাকারী পঞ্চাশের ও পরবর্তী সাহিত্যিকরা এহেন ভাবনাগুলোকে সচেতন ভাবেই প্রতিষ্ঠানের  মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন । প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন “আশির দশকের বাংলা সাহিত্য থেকেই আর, ’৯০ পরবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক ও ‘এলিট’ পত্রিকার সাহিত্যগুলি কিছু অবয়ববাদী বা স্ট্রাক্‌চারালিস্ট ধাঁচা (স্টিরিওটাইপ) এনে ফেলল। যেমন, নকশাল ছেলেটি লেখাপড়ায় মারাত্মক ব্রিলিয়াণ্ট ছিল, ‘ভুল’ রাজনীতির পাল্লায় পড়ে গ্রামে গেল রাজনীতি শিখতে ও ডি-ক্লাস্‌ড হতে, তার প্রেমিকা উচ্চবিত্ত ঘরের এবং যৌনসম্পর্কের বিশদ অনর্থক বর্ণনা, পুলিশের গুলিতে বা অত্যাচারে পঙ্গু হল, আদতে লড়াইটা এবং মতাদর্শটা ব্যর্থ হল এবং অ্যাপলিটিক্সের ওপরে সমাজসেবার ওপরে ভরসা রাখল ব্যর্থ নায়ক! এই অবয়ববাদী ধাঁচায় ফেলে প্রতিষ্ঠানগুলি বিক্রি বাড়াতে লাগল তাদের সাহিত্যের। আর, তার সাথেই ক্রমে ‘সক্রিয় রাজনীতি’ ও বামপন্থা থেকে বিমুখ করে দিতে লাগল বিশ্বায়ন পরবর্তী প্রজন্মকে। 

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন, “হাংরি-দের গল্পের এবং গদ্যের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে, মুক্তসমাপ্তি। অর্থাৎ, কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন না লেখক; হয়তো স্থির সিদ্ধান্ত হয় না কোনও। অন্ততঃ, যে সময়ে তাঁরা লিখছেন, সেই সময়ে অচঞ্চল বিশ্বাস কিছু নেই, কোনও স্থিতি নেই, সিদ্ধান্তে আসার ভিত্তি নেই। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। 

আসলে মুক্তসূচনা এবং মুক্তসমাপ্তির জনক হলেন জীবনানন্দ দাশ । ‘মাল্যবান’ যেভাবে শেষ না হয়েও শেষ হয়েছে, তা থেকে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় । এই শৈলী প্রয়োগে পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় কবির বা লেখকের নয়। প্রবুদ্ধবাবুকে অবশ্য একথা বলার যে, নকশাল আন্দোলন বা ফিদেল কাস্ত্রোর আন্দোলনও ছিল মুক্তসমাপ্তির, আন্দোলনের পরে কি ঘটবে তা আগাম পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল না । নকশাল আন্দোলনকারীরা জানতেন নিশ্চয়ই যে পশ্চিমবঙ্গ বলতে ভারতবর্ষ বোঝায় না । চারু মজুমদার কি জানতেন না যে চীন আদপে তিব্বত দখল করার পর মাও-এর সাম্রাজ্যবদী দিকটাকে ফাঁস করে দিয়েছে? এখন চীন যা করছে তার ভিত তো মাও-এর গড়ে দেয়া। 

প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন, “নবারুণ কবিতার সংজ্ঞাও একপ্রকার নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। ঠিক যেভাবে হাংরি-রা তাদের কবিতার ধারণা স্বতন্ত্র করে দিয়েছেন । নবারুণের কবিতা চিরাচরিত চাঁদ-ফুল-তারার রোম্যাণ্টিকতা অস্বীকার করে। কবিতা যে ‘লেখার’ নয়, বরং কবিতা ‘হয়ে ওঠার’ বিষয়, তা স্পষ্টতর হয় অস্থির সময়ে- “কবিতা এখনই লেখার সময়/ ইস্তাহারে দেওয়ালে স্টেনসিলে/ নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে/ এখনই কবিতা লেখা যায়…”। কবিতার আসন্ন সম্ভাবনাও লিখে রাখেন শেষ পংক্তিগুলিতে। “কবিতার জ্বলন্ত মশাল/ কবিতার মলোটভ ককটেল/ কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা/ এই আগুনের আকাঙ্খাতে আছড়ে পড়ুক”। হাংরি আন্দোলনকারীরাই প্রথম বলেছিল যে কবিতা চাঁদ-ফুল-তারা ইত্যাদির ব্যাপার নয় । আমি আমার কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধে এ-কথা ষাটের দশকেই বলেছিলুম ।

প্রবুদ্ধবাবু বলেছেন, “এখানেই কবিতাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নেওয়ার ভাবনার সাথে মিল পাওয়া যায় হাংরি-দের। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়। আর, এখানেই মনে পড়ে মারাঠি কবি নামদেও ধাসালের লেখা। দলিত জীবনের আখ্যান এবং প্রতিটি পংক্তিতে উল্লেখযোগ্য ঘৃণা; এই ঘৃণাই আসলে জীবন, এখান থেকে ভালবাসার জন্ম।” 

এখানে উল্লেখ্য যে নবারুণ ভট্টাচার্যের বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষিত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের, কলকাতার সংস্কৃতি জগতের মানুষ । অপরপক্ষে হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায় এসেছিলেন চাষি পরিবার থেকে; এমনকি কলকাতার সাহিত্যিকদের টিটকিরি প্রতিহত করার জন্য তিনি পতৃদত্ত নাম হারাধন ধাড়া বর্জন করতে বাধ্য হন।  সুবিমল বসাক এসেছিলেন তাঁতি পরিবার থেকে যাঁর বাবা স্যাকরার কাজ করতে বাধ্য হন এবং মোরারজি দেশাইয়ের গোল্ড কনট্রোলের দরুন দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন। অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি, বাড়ি ফিরে কলকাতার রাস্তায় হকারি করতেন, ঠেলায় করে কয়লা বেচতেন, ফুটপাতে ছিট কাপড় বেচতেন । এই ধরণের জীবনে জড়িয়ে হাংরি-দের লেখায় পরিপার্শ্বের প্রেক্ষিতে আত্ম-কে আবিষ্কার জরুরি হয়ে ওঠে , জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্‌স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্‌স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে…”। বরং দৈনন্দিন যুদ্ধদীর্ণ ‘অসুস্থ’ জীবন থেকেই উঠে আসে ‘Aesthetics’-র সারবত্তা। আর, কবির নিশ্চয়ই দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের প্রতি; হাংরি-দের সেই নিজেকে, ভাষাকে, কবিতাকে, নাটককে,  ছিঁড়েখুঁড়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছানোর উপলব্ধিকে ঔপনিষদীয় বলা ভুল হবে না ।

রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্‌’ অর্থাৎ’অপর’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, যতোটা ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্‌কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা রাজনিতিতে , তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো ও রাজনীতিগুলো । হাংরি আন্দোলনকারীদের যেভাবে জেলে পোরার চক্রান্ত হয়েছিল, একইভাবে প্রতিষ্ঠানের আরও বৃহত্তর চক্রান্তে একের পর এক হত্যা করে নিশ্চিহ্ণ করা হয়েছিল নকশালদের, সমাজকে ‘শুদ্ধ’ করে তোলার জন্য। 

অরবিন্দ প্রধান সম্পাদিত ‘অপর : তত্ব ও তথ্য’ বইতে সমীর রায়চৌধুরী লিখেছেন, “নিজেদের রয়ালিস্ট, প্রকৃত খ্রিস্টিয়, প্রগতিবাদী ইত্যাদি নির্দিষ্টাত্মক বিশেষণের খপ্পরের ছাঁচে ফেলে দেওয়ার তোড়জোড়ে সাম্রাজ্যবাদী চেতনার জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছেন ঔপনিবেশিক শ্রেষ্ঠত্ববোধসম্পন্ন লেখকরা, ফলে তাঁদের টেক্সটে আশ্রিত হয়েছে চরম অপরত্ব-বোধ । দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপন্যাসিক জে. এম. কোয়েতসে তাঁর ‘ওয়েটিং ফর দ্য বারবারিয়ানস’ গ্রন্হে দেখিয়েছেন কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য অপরায়নের প্রক্রিয়া কার্যকরী করে । এই প্রক্রিয়া তার নিজের শ্রেষ্ঠত্ব, এগিয়ে থাকা, সভ্যতাকে শ্রেয় এবং অপরের অসত্বিত্বকে হেয় করতে সাহয্য করে । কেবল টেক্সটে নয়, জীবনের সব এলাকাতে এভাবে স্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজ হয়ে ওঠে ।” বলা বাহুল্য যে হাংরি আন্দোলন আর নকশাল আন্দোলনকে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ‘অপর’ তকমা দিয়ে সমাজ থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, যেমন আফ্রিকার আদিনিবাসদের মুছে ফেলতে চেয়েছিল ইউরোপের শাসক-সমাজ ।

নারায়ণ সান্যালের বিবরণীতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার এক অজানা কথা উঠে আসে। “কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর-মশায়ের মর্মরমূর্তির যেদিন মুণ্ডচ্ছেদ হয় তার মাসখানেকের মধ্যে সিপিএম (এম. এল) দলের এক নেতৃত্বস্থানীয় ছাত্রনেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হয়েছিল! ঘটনাচক্রে সে আমার নিকট আত্মীয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কট্টর নকশাল। আমার পেচকপ্রতিম বিরস মুখখানা দেখে সে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, ‘বিশ্বাস কর ছোটকাকু! মূর্তিটা যে ভেঙ্গেছে তাকে আমি চিনি। গত বছর হায়ার সেকেন্ডারিতে সে বাংলায় লেটার পেয়েছে। ওর সেই বাংলা প্রশ্নপত্রে প্রবন্ধ এসেছিল তোমার প্রিয় দেশবরেণ্য নেতা। ও লিখেছিল বিদ্যাসাগরের উপর।”

অধিকাংশ আলোচক বলেন হাংরি আন্দোলন এবং নকশাল আন্দোলন দুটিই ব্যর্থ্য এবং তাদের ব্যর্থতার কারণও এক : প্রথমত, প্রশাসনিক আক্রমণ ; দ্বিতীয়ত, আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ ; তৃতীয়ত, আন্দোনের সদস্যদের মধ্যে বিভাজন ; চতুর্থত, তাঁদের কার্যকলাপ । আমি শুধু বলতে চাই যে দুটি আন্দোলনই বাংলার বৌদ্ধিক সমাজে ছাপ ফেলেছে এবং তা ‘ব্যর্থ্য’ তকমা দিয়ে চাপা দেয়া যায় না ।

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *