পাঠক মিত্র

ছকের বাইরে’ মানেই এক আইডেনটিটি

ছকের বাইরে মানে বলা যায় গন্ডির বাইরে বা নকশার বাইরে । আবার ‘প্লান’ কথাটার মানে ছক যা আগে থেকেই নির্ধারিত করাকে বোঝায় । সে মানুষের জীবন চলা হোক বা সমাজ হোক । কিন্তু লেখকের লেখনীর ক্ষেত্রে তা কি ? কবির কবিতা লেখা, গল্পকারের গল্প লেখা, ঔপন্যাসিকের উপন্যাস লেখা কি তাঁদের ছক । আর তাঁদের সেই কাজের বাইরে বলতে কি তা তাঁদের ছকের বাইরে ? লেখনী বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নের ‘হাঁ’ বা ‘না’ একেবারেই পৃথকভাবে বলা যায় না । কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি কোনও একটি নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে বিচরণ করেন নি । 

কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ছকের বাইরে’ প্রবন্ধ গ্রন্থের কথামুখে অবশ্য বলেছেন, সৃষ্টিমুখীনতায় শিক্ষায়তনিক শৈলির বাইরের সৃষ্টিই তাঁর ‘ছকের বাইরে’ l এটা ঠিক যে কোন শিক্ষায়তনিক শৈলি বহির্ভূত হল ছকের বাইরে । কিন্তু সাহিত্যের শিক্ষায়তনিক ক্ষেত্রটির কোন নির্দিষ্ট পথনির্দেশ নেই । তবে প্রত্যেক সাহিত্যিক তাঁর নিজস্ব চর্চাপথে একটা পথের ইঙ্গিত দিতে পারেন । কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর এই প্রবন্ধ-গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘কেন লিখি’-তে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন । চারটি বিভাগ নিয়ে এই গ্রন্থ যেখানে তাঁর নিজস্ব সৃষ্টিশীলতার ভাবনা অতিক্রম করে পৌঁছে যায় আর এক ভাবনার শৈলিতে । মৌলিক ভাবনা, ব্যক্তিত্ব, স্রষ্টা ও তাঁদের বিশেষ কোন সৃষ্টির সমালোচনা ও সাক্ষাৎকার তারই পরিচয় বহন করে । সাক্ষাৎকার বিভাগে একটি তাঁরই দেওয়া আর-একটি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের সাক্ষাৎকার তাঁর নেওয়া । সর্বমোট আঠাশটি নিবন্ধের সংকলনে গ্রন্থটি । নিবন্ধগুলির যে বিভাগ হিসেবে তিনি বলেছেন তা তিনি গ্রন্থটির সূচিপত্রে ও কলেবরে কোথাও পৃথকভাবে পর্ব-অনুযায়ী উল্লেখ করেন নি । কিন্তু সূচীপত্রে এক অনুচ্ছেদের ছায়া থেকে কথামুখে উল্লেখিত চারটি বিভাগের চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে । 

কথাকারের কথা সাহিত্যের সীমানার মধ্যে স্পষ্ট থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকতা থেকেই তিনি ছোটোদের সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথকে এক অনন্য ভাবনায় উপস্থাপন করেছেন। ‘সহজ পাঠ’ থেকে ছোটোদের গল্প পাঠের মাধ্যমে শুধু তাদের মনের বিকাশ ঘটতে সাহায্য করে না, বড়দের মধ্যে তার পাঠ্যসীমা ঘুচিয়ে দেয় । এভাবে তিনি বিভূতিভূষণ, সতীনাথ ভাদুড়ি, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেন চন্দ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের নির্দিষ্ট কিছু সৃষ্টি ও তার অনুসারী আলোচনায় উঠে এসেছে সাহিত্যের ক্রম বিবর্তন যেখানে প্রত্যেক লেখকের পৃথক সত্তাকে তিনি আলাদাভাবে তুলে ধরেছেন । এমনকি চলচ্চিত্রের আঙিনা থেকে রাজেন তরফদারকে নিয়ে তাঁর শিল্পীসত্তার সাথে তাঁর জীবনের একাত্ববোধের ছবি পাঠকের কাছে তুলে ধরে এক বোধ তৈরি করবে । নাট্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্রর হাত ধরে বাংলা থিয়েটারের বিবর্তন শুধু হয়নি, তিনি আধুনিক স্তরের এক মাইলস্টোন । তাছাড়া রবীন্দ্রনাথকে আলাদাভাবে তিনি চিনিয়েছেন তাঁর নাটকের ভাষায় । সাহিত্য ও শিল্পের নির্দিষ্ট আলোচনায় কথাকারের ভাবনা এক আলাদামাত্রায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ।

সেই স্পষ্টতায় প্রথম বিভাগ ‘মৌলিক ভাবনা’ । এই বিভাগে ছয়টি নিবন্ধ।  প্রথমটি ‘কেন লিখি’ । কেন লিখি এ প্রশ্ন প্রতিটি লেখকের নিজস্ব ভাবনা থাকলেও তার উপসংহারে বিশেষ পার্থক্য না থাকতে পারে । বিশেষ করে যাঁরা সমাজ ও মানুষের জীবনের বিন্যাসে সময়ের তথাকথিত ছবিকে বিদ্রুপ করতে পারে । আবার কেন লিখি, কি লিখি -সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখকদের লেখায় আমরা নানাভাবে যেটুকু  পরিচিতি পাই, তা সময়ের পটকে অতিক্রম করে না । আবার লিখলেই সকলেই লেখক হয় না । এ বিষয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ কবিদের সম্পর্কে যেমন বলেছেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কি লিখবেন, কেন লিখবেন’ কোন লেখার জন্ম দেওয়ার পদ্ধতিগত দিককেই সাধারণত নির্দেশ হিসেবে ধরা যায় । কিন্তু মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কেন লিখি’ নিবন্ধে বলছেন–‘লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই যে-সব কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানানোর জন্যই আমি লিখি ।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘… অন্য লেখকরা যাই বলুক না কেন..কোন সন্দেহ নেই যে তাঁরা কেন লেখেন তার জবাবও এই ।’ তবে কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায় ‘কেন লিখি’ নিবন্ধে তিনি নানা প্রক্রিয়া ও পরিক্রমার মাধ্যমে তাঁর লেখার কেন-তে উত্তরণের ইঙ্গিত দিয়েছেন । এই উত্তরণের পথে বিমল মিত্র থেকে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে রুশ, ফরাসী ও আমেরিকান সাহিত্যপাঠের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রকৃত চক্ষুউন্মোচন ঘটেছে বলে তিনি ব্যক্ত করেছেন । এই উন্মোচনকালীন সময়ে এই বাংলার বুকে গতশতাব্দীর সত্তর দশকে বহমান এক রাজনৈতিক আলোড়ন । সেই আলোড়নের রেশ ধরে কথাকার মনে করেছিলেন তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তিনি বিপ্লব করবেন । অতঃপর ইমার্জেন্সি । এই সময়ের আহ্বানে উপলব্ধি করেছেন যে লেখালেখি করে বিপ্লব হয় না । বরং বিষয়কে কিভাবে আড়াল করে প্রকাশ করতে হয়, তা উপলব্ধি করেছেন। সেই প্রকাশ ভঙ্গিমায় লেখকের দায় মানস-ক্ষেত্র প্রস্তুত করা বলে মনে করেছেন । শুধু তাই নয়, সেই ক্ষেত্র থেকে যাতে রাজনীতিবিদরা কাঙ্খিত পথে মানুষকে নিয়ে যেতে পারে । কিন্তু সেই পথ লেখক ও রাজনীতিবিদদের কাছে পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে কিনা তার ইঙ্গিত তিনি করেন নি । যদিও টলস্টয় ও এঙ্গেলসের কথা-প্রসঙ্গ এনে বলেছেন লেখক ও শিল্পীর উৎকর্ষতা কোথায় । সেই উৎকর্ষতায় রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন তাঁর লেখকজীবনের জরুরী । রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রতিটি পুরনো স্তরকে ভেদ করে নতুন নতুন বোধে পৌঁছতে পারেন । সেই বোধ থেকেই তিনি বলেন, ‘কেন লিখি’ । বলতে পারেন, ‘একসপ্তাহ কিছু না লিখলে, একটি ছত্র না পড়লে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি । নানা ধরণের ছোটখাট মনোবিকার ঘটে । লিখবার শ্রম গ্রহণ করলে, ফের স্বাভাবিক তাজা সুস্থ বোধ হয় ।’ তাই সুস্থ বোধ নিয়ে ‘কেন লিখি’ নিবন্ধের শেষ লাইনে বলতে পেরেছেন, আমি খাঁচার ইঁদুর হতে চাই না বলেই লিখে চলেছি ।

খাঁচার ইঁদুর হতে চান নি বলেই কথাকার সভ্যতা সংকটময় হয়ে ওঠার সমস্যা দেখতে পেয়েছেন। আধুনিক সভ্যতার অভিশাপ হিসাবে ক্ষুধা, ব্যাধি, আণবিক বিপর্যয় বা পরিবেশ বিপর্যয় যার প্রভাবে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু, পঙ্গুত্ব মানব সভ্যতার কালান্তক সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন । এই সংকট ও সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে কবিগুরু বিচলিত হয়েছিলেন । তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ লেখা আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে । ‘শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’- কবির এ বাণী যেন শাশ্বত। শাশ্বত হয়ে থাকার জন্য কথাকার চট্টোপাধ্যায় পাঠকের গোচরে আনার জন্য একটি চলতি কথা উল্লেখ করেছেন, তা হল ‘রাষ্ট্রের দাদাগিরি’ । এই দাদাগিরি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে অস্ত্র, রক্ত আক্রমণে বিরুদ্ধ মত ও বিশ্বাসকে নিশ্চিহ্ন করার খেলা করছে । রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এই খেলায় শান্তি বন্দি আজ । অথচ সবাই গণতন্ত্রের দোহাই দিচ্ছে । আবার অস্ত্র মজুত করছে । শান্তিবিহীন, হিংস্রতার আচরণে মানবসমাজে যেভাবে হনন ও অর্ধহননের আয়োজন চলছে দেশে দেশে– এটাই আধুনিক মানব সমাজের বৃহত্তম সংকট বলে কথাকার মনে করেন । তাঁর মনে করা কথা শুধুই কথা নয় । আজকের ধ্বংসের প্রাসঙ্গিকতার উল্লেখ তাতে স্পষ্ট । ধ্বংসের কারণকে যেমন স্পষ্টভাবে বলেছেন, আবার ধ্বংস রোধ করার কারণ দেখিয়েছেন। বিজ্ঞানের কল্যাণময়তা ধ্বংস রোধ করতে পারে । আর এই কল্যাণময়তা তখনই সম্ভব হবে বলে কথাকার মনে করেন, যদি পরিশুদ্ধ-ধর্ম, শান্তি, শুভবুদ্ধি, শিল্পসাহিত্য ও মানবিক নান উপসঙ্গের সাহায্যে বা উচ্চ সাযম্যবাদের মন্ত্রে প্রভাবিত হতে পারে । কিন্তু সাম্যবাদ একটি রাজনৈতিক ‘ইজম’-এর মন্ত্র। সব রাজনীতিবিদদের কাছে সেই মন্ত্র সার্বজনীন হতে পারে না, তাঁদের কাঙ্খিত হতে পারে না । যদিও লেখক সেই মানস-ক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছেন, যাতে রাজনীতিবিদরা কাঙ্খিত পথে মানুষকে নিয়ে যেতে পারে । 

লেখকের দায় বলে যে মানস-ক্ষেত্র’র কথা বলেছেন তা আজকের লেখালেখির জগতে সেখানে এক ব্যাধির কথা উল্লেখ করেছেন । তা হল ‘নার্সিসিজম’ । সোজা কথায় যাকে নিজের ঢাক নিজে পেটানো ছাড়া আর কিছু নয় । তাছাড়া ‘প্যারানইয়া’ নামক আরো এক ব্যাধির কথা বলেছেন যে ব্যাধি হল একপ্রকার সন্দেহবাতিকতা । এই বাতিকে সবাইকে শত্রুভাবা একপ্রকার স্বাভাবিক। যে স্বাভাবিকতায় রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র দলপোষিত নানা পরিচয়চিহ্নে পৃথিবীকে বাসযোগ্যহীন করে তুলছে । ‘প্যারানইয়া ও নার্সিসিজম’ নিবন্ধে তিনি বলেছেন রাষ্ট্র ও নেতাদের এই রোগ কিভাবে জনজীবনে অদ্ভুতভাবে জরুরি করে তুলেছে । তখন লেখকের নির্দেশিত কাঙ্খিত পথ বলে আর তার অস্তিত্ব বজায় থাকছে না ।

কাঙ্খিত পথ যাই হোক না কেন, সেই পথে মানবতাবাদ না থাকলে মানুষের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে । স্বাধীনতা, দেশভাগ রাজনৈতিকভাবে এক কাঙ্খিত পথ হলেও, সেই পথ এ দেশে আজও সংকটমুক্ত হয়নি । সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে যখন মানবিক মূল্যবোধ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়ছে । এ প্রসঙ্গে কথাকার উল্লেখ করেছেন, দেশভাগ a process of continuous erosion of human values. সেই ক্ষয় প্রজন্মের পর প্রজন্মে বয়ে চলেছে । মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় । এই অবক্ষয়ের চিত্র সাহিত্যের ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে । যাকে পার্টিশন সাহিত্য বলে । দেশভাগের দু’দশকের মধ্যে রচিত সেই সব সাহিত্য ইতিহাসের দলিল । যে দলিলে মানুষের অশ্রু, রক্ত, হাহাকার, মনুষ্যত্ব বিকৃতি বা উৎপাটনের জটিল মনোবিকলন নথিভুক্ত হয়েছে । কিন্তু দেশভাগের সত্তর বছর পরেও সমস্যা অব্যাহত । তদানীন্তন সময়ের সমস্যা আর আজকের সময়ে দেশভাগের সমস্যা একেবারে এক নয় । আজকে এই ভাগে তৈরি হয়েছে সীমানা (বর্ডার) সমস্যা । সীমানাজুড়ে সবরকমের পাচার, খুন, সন্ত্রাসের সমস্যা । সমাধানের প্রশাসনিক নানা চেষ্টা থাকলেও সমস্যা হ্রাসের চিহ্নমাত্র নেই । আর সীমানা সমস্যা সমাধানের নামে আজ দেশপ্রেমের নবসঙ্গীতে বাতাস ভরে উঠছে বিভাজনের চেহারায় । এই চেহারায় মানুষের শুভকামনা অবরুদ্ধ হয় বেআইনি শক্তির অপ্রত্যক্ষযোগে । এই নতুন পরিস্থিতির জন্য নতুনভাবে সাহিত্য সৃষ্টি জরুরি বলে প্রাবন্ধিক তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন । প্রাবন্ধিক কথাকার এই সমস্যা সম্পর্কে যথার্থ বলেছেন, ‘নতুন সন্দর্ভ তৈরিতে শুধু ১৯৪৭ এর রক্ত-ঘাম-কান্নার ইতিহাস নয়, সত্তর বছর পেরিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র যেমন ‘বর্ডার’ প্রয়োজনকে কায়েমি স্বার্থের কাজে লাগাচ্ছে, বৃহত্তর মানুষের শুভকামনাকে অবরুদ্ধ করে, বেআইনি শক্তিকে অপ্রত্যক্ষভাবে বহাল রাখছে–নতুন পরিস্থিতির সাহিত্য রচনা জরুরি..।’ আজকের বর্ডার নিয়ে নতুন ভাবনাকে আড়াল করতে সম্প্রতি দেশপ্রেমের যে আবেগকে খুঁচিয়ে তোলা হচ্ছে, সাহিত্যিকরা সে পথে হাঁটবেন না বলেই কথাকার প্রাবন্ধিক আশা করেন ।

অন্য সমস্যাকে আড়াল করতে দেশপ্রেমের আবেগ তোলা রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থ বটেই।  এই স্বার্থ সাধারণ মানুষের কাছে অধরা থেকে গেলে প্রকৃত হৃদয়বৃত্তির রাজনীতি দিয়ে তা মোকাবিলা করতে হয় । কিন্তু আজকের এই রাজনীতির অস্তিত্ব সম্পর্কে তর্ক হতে পারে । তবে সেই অস্তিত্ব সম্পর্কে সাহিত্যিকদের আবেগ কোন পথে হবে, কতটা বা রাজনৈতিক ভাবাবেগের সাথে সম্পৃক্ত হবে ? এমনই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে অনেক কথা বলেছেন কথাকার প্রাবন্ধিক তাঁর ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ নিবন্ধে । দেশীয় বিদেশীয় সাহিত্য ও সাহিত্যিকের উপমা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন সেই গীত । নিবন্ধটির শেষে বাংলার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন প্রসঙ্গে সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের আবেগের কথা তুলে ধরেছেন । যে আবেগে বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশের মিছিলের পাল্টা মিছিল আর এক অংশের । অনেকেই সরকারি পুরস্কার খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছেন । বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিগত আবেগ সমষ্টির চেহারায় এমনভাবে মিশে যাওয়ার ঘটনার সাথে জালিয়ানওয়ালা হত্যাকান্ডে রবীন্দ্রনাথের আবেগ থেকে গতশতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাট দশকের খাদ্য আন্দোলনের কথা তুলে ধরেছেন । রবীন্দ্রনাথ যে প্রেক্ষিতে তাঁর ‘নাইটহুড’ খেতাব ত্যাগ করেছিলেন, খাদ্য আন্দোলনে সেই প্রেক্ষাপট ছিল না বলে কি তদানীন্তন সাহিত্যের কান্ডারী ও কর্মী সেই পথ অবলম্বন করেন নি । অথচ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের প্রেক্ষাপটে সে পথে অনেকেই গেলেন । রবীন্দ্রনাথের সাথে তুলনার বাইরে লেখক দেখালেন আজকের সমস্ত প্রতিবাদের আবেগ শুধু ব্যক্তিগত থাকে না । যার মধ্যেও নিয়ন্ত্রণ করে বাজার । আর বাজারিকরণে মানবিক আবেদনের আড়ালে প্রতিবাদের প্যাকেজে প্রকাশ পায় রাজনৈতিক জ্যাকেট । সেই জ্যাকেটজাত হয়েছেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের সাথে যুক্ত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই। বামফ্রন্টের আমলেই সংস্কৃতি ও শিল্পের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটেছিল । সোভিয়েত পতন ও বাজারনির্ভর মুক্ত পুঁজির বিশ্বায়নে সকল পুরনো ধারণাকে  আমূল বদলে দিয়েছে বলে লেখক ঐতিহাসিকের হব্সবমের মতকে মান্যতা দিয়েছেন । আর এই পরিবর্তন এরিক হব্সব্বমের এক বইয়ের কথা তুলে ধরে বলেছেন, আমরা যা যা জানছি, দেখছি তা সবই এক ভার্চুয়াল বাস্তব । যে বাস্তবে শিল্প বাজার আর ইন্দ্রিয়ের দ্বন্দ্বে টালমাটাল এক দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছে।

বিশ্বায়নের ঘেরাটোপে পুঁজির নিয়ন্ত্রণে আজ রাজনীতি থেকে সাহিত্য শিল্প সবই । পূর্ববর্তী সময়ে ছোটগল্পে গল্পকারের সৃষ্টির প্রেক্ষিতে যে আইডেনটিটি তৈরি হত, আজ বিশ্বায়ণের যুগে তা যেন ভোঁতা হয়ে পড়েছে বলে প্রাবন্ধিক মনে করেছেন । পাশাপাশি আর এক নবজাতক আজ যৌবনোদীপ্ত চেহারায় হাজির হয়েছে তা হল সর্বপ্রকার মৌলবাদ । যার ফলে সাম্প্রদায়িক সমস্যা দীর্ঘকালীন । আড়াল থেকে যার সুতো নাচায় ক্ষমতা ও রাজনীতি । প্রযুক্তির সওয়ার হয়ে এমন সামাজিক সমস্যা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে । তাই সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও সম্প্রীতি নিয়ে যে ধারায় আগে সাহিত্য লেখা হয়েছে সে ভাষার পরিবর্তন জরুরি বলে কথাকার মনে করেন । এ সম্পর্কে লেখকদের দৃষ্টি ব্যাপক ও বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন । শুধু লেখকদের নয়, কথাকার চান সম্পাদক, প্রকাশক, পাঠকসমাজ সকলেই গুরত্ব সহকারে তেমনভাবে দৃষ্টিপাত করবেন । 

বিশ্বায়নের ছকে পুঁজির নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সুতোয় নাচে যেখানে সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি সেখানে লেখকদের দৃষ্টির ব্যাপক বিস্তৃত না থাকলে সাহিত্যের ভাষার পরিবর্তন সম্ভব নয় । প্রযুক্তিগত সংস্কৃতির নতুন যুগের রাজপথে নইলে ধান ভাঙতে শিবের গীত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না । তবে নতুন করে সৃষ্টির আইডেনটিটি তৈরি সম্ভব ছকের বাইরে বিস্তৃত হতে পারলেই । ‘ছকের বাইরে’ তা কথাকারের সেই আশাবাদকেই সমর্থন করে । 

‘ছকের বাইরে’

সাধন চট্টোপাধ্যায়

বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ

কলকাতা-৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *