মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

চতুর্থ পর্ব

ভাদুড়ীদের ভিটেতে মনাজেঠার (শঙ্কর চক্রবর্তী) মুদিখানার ভগ্নাবশেষ

আমার প্রিয় তিনতলা বাড়িটার কথায় না হয় আবার পরে ফিরব। এখন এই ছয় ঘর এক ফালি উঠোন থেকে সংকীর্ণ গলি দিয়ে বার হয়ে বড় রাস্তায় উঠে আসি। এই তিনতলা বাড়ির পাশের বাড়িটা ভাদুড়ীদের। 

আর ভাদুড়ীদের এই অংশে একটি মুদিখানার দোকান চালাতেন মনাজেঠা৷ দোকানটার আকর্ষণ আমার কাছে কিছু কম ছিল না। ওই দোকানে আমার প্রথম দোকান করার হাতেখড়ি৷ তখন রাস্তাঘাট এত বেগবান যান সঙ্কুল ছিল না৷ মা আমাকে টুকটাক দরকারে পাঠিয়ে দিত দোকানে৷ রাস্তাটা পার হয়ে দোকানে গিয়ে বারান্দায় ওঠার আগে পর্যন্ত ঠাকুর নাম জপার মত বিড় বিড় করতে করতে যেতাম খরিদ করার দ্রব্যের নাম৷ ভুলে যাওয়া স্বভাব আমার নতুন না৷ দোকানে দাঁড়িয়ে নামকটা বলে হাঁফ ছেড়ে বারান্দায় রাখা বেঞ্চে বসে পা দোলাতে থাকতাম৷ তখন এত প্যাকেটের যুগ ছিল না৷ সরষের তেলের টিন থেকে আসা ঝাঁঝালো গন্ধ, বস্তায় খোলা নুনের চিটচিটে ভাব, নানা মশলা, গুড়ের ডিব্বা থেকে গুড়ের বাস সব মিলেমিশে বাতাস অদ্ভুত ভাব ধরে থাকত৷ কাচের হরলিক্সের শিশি বাড়িয়ে দিলে শিশির ওজন মেপে নিয়ে ওদিকে একটা ছোট্ট বাটখাড়া চাপিয়ে কি সুন্দর তেল তুলে তুলে মাপা হত৷ কত সাইজের ঠোঙা, নানা মাপে কাটা কাগজ সাজানো থাকত ঠিক ঠিক পরিমাণের মালের জন্য৷ ভেতর দিকের একটা অন্ধকার ঘরে বেশি বেশি মাল মজুত করা থাকত৷

মনাজেঠার কাছে আমায় কোনো আব্দার করতে হত না৷ গেলেই কাগজের টুকরোতে মোড়া ডালমুট বা এক টুকরো মিছরি পেয়ে যেতাম হাতে৷ মানুষ তখন বোধ হয় খুব বেশি লাভ ক্ষতির হিসাবে মেতে থাকত না৷ সেই ভালবাসাটুকুর কথা ভাবতেই আজও এত দিন পরে মনটা কেমন অন্য রকম হয়ে যায়৷ 

কখনও কখনও দোকানে ভিড় থাকলে অপেক্ষা করতে হত ৷ কে না জানে বড়দের গল্প গিলতে ছোটদের ভীষণ ভাল লাগে৷ মনাজেঠার দোকানে জোরদার আড্ডা জমতো৷ সেই আড্ডার মধ্যমণি হতেন প্রায়শই এক গিলে করা পাঞ্জাবি, ধপধপে ধুতি পরা ব্যক্তি৷ সবাই তাঁকে ‘মাষ্টার মশাই’ বলে সম্বোধন করত, আমার বাবাও ৷ পরে একটু বড় হলে বুঝলাম উনি কালনার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব চিত্তরঞ্জন রায় ৷ দীর্ঘদিন ছিলেন শহরের প্রথম নাগরিক ৷ এখন ভেবে দেখি, তখনকার আড্ডা ছিল অনেক খোলামেলা ৷ মানুষ নিজের মতামত ব্যক্ত করলেই রাজনৈতিক শত্রু হয়ে যেত না।

আর একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলা ভালো, খোলা বস্তায় রাখা চিনি নুন ইত্যাদি খেয়েও তখনকার মানুষ দিব্যি ভালই থাকত৷ 

পরবর্তীকালে মনাজেঠা এই দোকানে মুদিখানার পাশাপাশি লেপ তোষক বানানোর ব্যবসারও চেষ্টা করলেন৷ দোকানে ঝুলতো বেড কভারও ৷ সেই সময় অবশ্য আমি আর দোকানে বসে পা দুলিয়ে আড্ডা শোনার মত ছোট ছিলাম না৷ 

মনিজেঠা আর মনাজেঠা কেউই আজ আর এ পৃথিবীতে নেই ৷ মনাজেঠার দোকানটারও কোনো অস্তিত্ব নেই আজ ৷ মনিজেঠার দোকানেরও মালিক পাল্টে গেছে ৷ আধুনিক যুগোপযোগী রঙচঙে পশরা সেজেছে তাতে ৷ কিন্তু ঐ মানুষগুলো থেকে গেছেন পাড়ার সব পুরোনো বাসিন্দাদের মনে ৷ কোনো কোনো লোড শেডিংয়ের রাতে বর্তমানের হাইমাস্টগুলো কানা হয়ে গেলে চোখ বুজলে দেখা যায় সেই পুরোনো ছবি৷

এই দুই দোকানের মাঝে আর একটি দোকান‌ও ছোট্ট থেকে দেখে ছিলাম, বস্তুত ইদানিং তার জন্য দোকান শব্দটা ব্যবহার করলে নব্য যুগের খোকা খুকিরা নাক সেঁটকাবে। কারণ সেটা একটা ষ্টুডিও ছিল। হাতে হাতে ডিজিট্যাল ক্যামেরা আর দামি মোবাইল নিয়ে ঘোরা এই প্রজন্ম অবশ্যই পাড়ায় একটা ষ্টুডিও থাকার গুরুত্ব কল্পনা করে উঠতে পারবে না। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমাদের পাড়ায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে দু দুটো ষ্টুডিও ছিল। আমি যতদূর স্মরণ করতে পারি, আলোচ্য ষ্টুডিওটা চালাতেন সুধীর জেঠু। পেছনে ডার্ক রুমে তারে ঝুলতো সারি সারি ক্লিপ আঁকা ভেজা ভেজা ছবি। রাস্তার ওপরের ঘরে বেতের চেয়ার, কাঠের টাট্টু ঘোড়ার পেছনে দেওয়াল জোড়া ব্যাকগ্রাউন্ড আঁকা। আকাশ, সিঁড়ির ধাপ, থাম না কি আর‌ও অন্য কিছু ছিল সেই পটে, তাই আজ আর স্পষ্ট মনে নেই। শুধু মনে আছে এইখানে আমার অনেক ছবি তোলানো হয়েছিল। আমাদের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছিল বিরাট টেলিফোনে ছদ্ম ডায়ালরত আমার ছবি। আর অবশ্যই মনে আছে সেই ষ্টুডিওর অন্দরে রিল থেকে সাদা কালো কাগজের ওপর ছবি ফুটে ওঠা দেখার অপার আনন্দের কথা। কালো সাদা মহিলারা তারপর দক্ষ তুলির টানে কি সুন্দর সিঁথিভরা লাল সিঁদুর আর টিপে জীবন্ত হয়ে উঠতেন।

পরবর্তীকালে জেঠুর ছেলে নবকুমারদা ষ্টুডিওটা বেশ ঝকঝকে করে সাজিয়ে বারান্দা অব্দি বাড়িয়ে দিয়েছিল। ততদিনে ছবির বাজার রঙিন থেকে রঙিনতর হয়েছে। অ্যালবাম, ফটোস্ট্যান্ড ইত্যাদিও বিক্রির জন্য রাখতো। কিন্তু কোনো কারণে নবকুমারদা ওর ব্যবসার স্হান পাল্টে পুরোনো বাসস্ট্যান্ডে চলে গেল। সেখানে ছায়াছবি পুরোনো নামেই নতুন দোকান চালু হয়।

সেই পাড়ার আর একটি ষ্টুডিওর মালিক ছিল তপনকাকা। দোকানের নাম চিত্ররূপা। সেটা ছিল ঠিক বর্মণ ডাক্তারখানার মোড়ে। মসজিদে যাওয়ার গলির ডানহাতে। খুব হাসিখুশি তপনকাকার ষ্টুডিওটাও মোটামুটি এক‌ই রকম ছিল। আলাদা ডার্করুম আর ব্যাকড্রপ সিন, বেতের চেয়ার, কাঠের ঘোড়া এই সব দিয়ে সাজানো সেই ষ্টুডিও একদিন তার রমরমা দিন পেরিয়ে অন্ধকারে ডুবে গেল। কাকা তারপরেও অনেক দিন ছবি তুলতে নানা জায়গায় যেতেন লোকের ডাকে।

হায় রে হায়! সারা ভারতজুড়ে এমন সুন্দর আলো ছায়ামাখা ষ্টুডিওগুলোর দিন সত্যিই গিয়েছে। চুপচুপি দুই চখাচখিকে ছবি তোলানোর জন্য অচেনা কোনো ষ্টুডিওতে উঁকি দিতে হয় না।পাসপোর্ট ছবির তাগিদ পড়লেই মানুষ বোধ হয়‌ ইদানিং ষ্টুডিওমুখো হয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *