তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

অধ্যায়: তেরো 

এক মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে অন্য মেলাপ্রাঙ্গণ। 

দু’টিই জনতার ভিড়ে উবুথুবু। দু’ জায়গাতেই পসরা সাজিয়ে বসেছে বিক্রেতারা ক্রেতার অপেক্ষায়। আবার ক্রেতারাও সতত বিচরণশীল এখানে-ওখানে কাঙ্খিত বিক্রেতার অন্বেষণে। চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি দু’ জায়গাতেই, কেবল এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে যাতায়াতের জন্য রয়েছে অদৃশ্য দরজা, সেই দরজা তালা লাগানো, চাবি থাকে দিগদর্শকের কাছে। তাকে যে চিনতে পারে এবং নিজেকে সমর্পণ করতে পারে তার হাতে সে দু’টি মাঠেই অবাধ বিচরণের সুযোগ পায়। একটি মাঠে মোহগ্রস্ত মানবকুল চলেছে জীবনের অনিবার্য আকর্ষণে, জানেনা কী উদ্দেশ্য-বিধেয়। সেখানে চলা মানেই জীবন এবং জীবন মানেই জৈবনিক সাধ-আল্হাদের অমোঘ টান। বংশ পরম্পরায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলছে মানুষ কোন এক প্রচ্ছন্ন মায়ার বশবর্তী হয়ে, সেখানেই মায়াপ্রকল্প বিরাজমান এবং কেউ তা বুঝতে পারে না। অন্য মাঠ জাদুজগৎ, সেখানে প্রতিভাত চলন-বলনের ভাবার্থ যদিও তা যারা থাকে তাদের বোধগম্য হয় না। জীবনযাপনের মর্মার্থ সেখানে স্পষ্ট হতে পারে তার কাছেই যে পথপ্রদর্শকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে জানে। 

মায়াপ্রকল্পের অধীনস্থ মেলার মাঠ থেকে তাকে এবার নিয়ে আসা হল জাদুজগতের অধীনস্থ মেলার মাঠে। সেখানে সময় থেমে ছিল, স্থির ছিল চলমান জনতার মিছিল। যে মুহূর্তে যে অবস্থায় মূল মেলার মাঠ থেকে সে এলো সেই অবস্থাতেই দণ্ডায়মান ছিল জাদুজগৎ। হয়তো কেউ এক পা বাড়িয়েছিল চলাচলের প্রক্রিয়াতে সে ঠিক তেমনই থেকে গেল এই জাদুজগতের আবহে, সমস্ত ঘটমান কার্যাবলী দাঁড়িয়ে রইল এমনই সমান ও সুষম নিয়মের আবর্তে। মূল মেলার মাঠে, যা মায়াপ্রকল্পের আওতায় সেখানে জীবন যেমন চলছিল তেমনই চলতে লাগল, কোন থেমে যাওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া বা এগিয়ে যাওয়া ঘটল না। সেখানে জীবন চলছিল বরাবরের নিয়ম মেনে, নিয়মের কোন ব্যতিক্রম দেখা গেল না কোথাও। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটল কেবল জাদুজগতে। সেখানে তার বয়স এগিয়ে গেল, সে হয়ে গেল পূর্ণবয়স্ক আর  মেলাপ্রাঙ্গণের জনজীবন থেমে রইল সময়ের এক সুনির্দিষ্ট বিন্দুতে। অদৃশ্য দরজার তালা খুলে তারা এসে ঢুকল যেখানে যে সময়ে। কোটিকল্প তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল,

‘এবার এই মানুষগুলি এখানে চলতে থাকবে। আমি এদের চালিয়ে দেব। এখানে যেসব ঘটনা ঘটতে থাকবে এখন থেকে সেসব কিন্তু ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে মূল মেলার মাঠে। সেই হিসেবে আমরা সবসময় পিছিয়ে থাকব, কিন্তু যা যা ঘটনা ঘটে গেছে মায়াপ্রকল্পের মাঠে সেগুলি হুবুহু আবার ঘটতে থাকবে এখানে, কোথাও একচুল হেরফের ঘটবে না কেবল তোর পরিণত হওয়ার ব্যাপারটা ছাড়া। তোকে যেহেতু চলতি সময় থেকে এগিয়ে দিতে হল তাই জাদুজগতে একই মেলার মাঠ থেমে গেল। ব্যাপারটা কেবল জাদুজগতেই সম্ভব, এখানে সমস্ত নিয়ম হেরফের করা যায়। কিন্তু মূল মেলার মাঠে নিয়মের কোন হেরফের ঘটানো চলবে না। ওখানে মানুষ যাকে জানে স্বাভাবিক জাগতিক নিয়ম হিসেবে তাকে তেমনই রেখে দিতে হবে। একথা তোকে আগেও বলেছি। মূল যে মেলার মাঠ সেখানে জগৎ ও জীবন চলমান অবস্থায় থেকে যায় সর্বক্ষণ, বর্তমান কেবলই এগিয়ে যেতে থাকে ভবিষ্যতের দিকে। বর্তমান কখনো স্থির দাঁড়িয়ে যায় না, ফিরে যায় না অতীতে বা ভবিষ্যৎ হাজির হয় না বর্তমানে। সময় সতত বিচরণশীল একমুখী চলনে যাতে ধারাবাহিকতার নিয়মে কোনোমতেই ব্যাঘাত না ঘটে। জগতের সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম, যদি সেই নিয়ম একচুল এদিক-ওদিক হয় তো পুরো জাগতিক কাঠামোটাই বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। সব নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে কেবল এই জাদুজগতে, কারণ এটা এক অন্য মাত্রা দিয়ে গড়া। আবার এখান থেকেই চতুর্মাত্রিক সেই মূল মেলার মাঠ কিভাবে পরিচালিত হবে তার পরিকল্পনা তৈরি হয়। এখানে তোকে আমি ভবিষ্যতে এগিয়ে নিয়ে গেলাম, আবার ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব। একটা কথা জেনে রাখবি, যদিও জানলে তুই অবাক হয়ে যাবি তবুও তোকে বলতেই হবে, সেটা হল এই যে তোকে নিয়ে আমি জাদুজগতে এলাম এটা কিন্তু তোর এক বিকল্প সত্ত্বা। তোর অন্য একটি সত্ত্বা কিন্তু মূল জগতে অথবা মায়াপ্রকল্প অধীনস্থ মেলার মাঠে থেকেই গেছে। তুই সেটা বুঝতেও পারছিস না, কিন্তু সে চলছে ওখানে তার নিজের মত স্বাভাবিক জগতের নিয়মে। এটাও ওই ধারাবাহিকতার নিয়ম বজায় রাখার জন্যই যাতে তোর গোটা জীবন থেকে এখানে যতক্ষণ থাকবি সেই সময়কালটা বিলুপ্ত না হয়ে যায়। ওখানে তোর প্রতিভূ হয়ে যে আছে সে জানেও না যে তুই আছিস এখানে, তার ওখানকার চেতনা থেকে গেছে তার মধ্যে ওখানকারই নিয়মে। এই কাণ্ড ঘটছে এখানে আর যে সমস্ত  মানুষ দেখছিস তাদের সবার ক্ষেত্রেই। সবাই জাদুজগতে উপস্থিত বিকল্প সত্ত্বা হিসেবে। অর্থাৎ সবারই রয়েছে দ্বৈত সত্ত্বা। ধারাবাহিকতার নিয়ম অগ্রাহ্য না করার জন্যই এরকম ব্যবস্থা অনিবার্য।’

তার মাথার মধ্যে সমস্ত কিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে বসেছিল। কার না ভাবলে অবাক লাগে যে সে একই ব্যক্তি দু’জন হয়ে উপস্থিত রয়েছে দু’ জায়গাতে ? ব্যাপারটা আজগুবি মনে হলেও সে ইদানীং অবিশ্বাস করতে পারছে না। এ যাবৎকাল যেসব কীর্তিকাণ্ড সে চাক্ষুষ করেছে তার ভিত্তিতে কোনোকিছুকেই তার অবাস্তব বা অবিশ্বাস্য বলে মাথায় আসে না। জাদুজগৎটাকে সে তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে আর সেটা তো অবিকল সে যেখানে থাকে সেই মূল মেলাপ্রাঙ্গণের আদলেই হুবুহু গঠিত এবং সেটা চলমান থাকে তার পথপ্রদর্শকের অঙ্গুলিহেলনে। মায়াপ্রকল্প অথবা মূল মেলার মাঠ এবং এই  জাদুজগৎ, দু’টি যে দুই আলাদা জায়গা তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যদিও তার দিগদর্শক বলেছে যে জাদুজগৎটা আসলে একটা ভড়ংবাজি। কিন্তু এটা তো খুবই সত্যিকথা যে এই ভড়ংবাজি দিয়েই রচিত হয়ে চলেছে গোটা জাগতিক পরিকল্পনা যেখানে দেখা যাচ্ছে তাকে এবং সমসাময়িক জনতা ও ঘটনাবলীকে মূল মেলার মাঠে যেটা আসলে অন্যকথায় এক মায়াপ্রকল্প। যদি তাই হয় তো এই ভড়ংবাজিটাই প্রকৃত জায়গা যেখান থেকে পরিচালিত হয় গোটা জগৎ। এটা কি তাহলে বিশ্বপিতার রন্ধনশালা যেখানে নির্মিত হয় নানান সুখাদ্য নানান জাগতিক কাঠামো হিসেবে ? অথবা বিশ্বনিয়ন্তার কারখানা হল এই ভড়ংবাজি কিংবা জাদুজগৎ যেখানে সে তার শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। যাই হোক না কেন, সে বুঝে গেছে, সাদামাটা যে জগৎটা ভেসে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে সেখানে আছে এমনসব বিস্ময় যাদের প্রত্যক্ষ করার প্রস্তুতি হিসেবে ক্রমাগত বিস্মিত না হয়ে থাকাই যুক্তিযুক্ত, বরং এমন মানসিক গঠন মজবুত রাখা উচিত যাতে সবকিছুকেই গ্রহণযোগ্য বলে ভাবা যায়। তাই সমস্ত বর্ণনা এতক্ষণ ধরে শুনেও সে নিরুত্তর থাকল, পরবর্তী কী কথা তাকে শুনতে হয় তার অপেক্ষায়। তবে এতক্ষণের বর্ণনার পর যে বিরতি দেখা গেল তারপর অন্য কোন প্রসঙ্গ উত্থাপনের আগে সে দেখতে পেল জাদুজগতে উপস্থিত জনসম্প্রদায়ের গতিশীলতা, সেই পূর্বোক্ত জাদুহস্তের মৃদু সঞ্চালনে। পরক্ষণেই সে শুনতে পেল দৈববাণীর মত তার জন্য প্রদত্ত নির্দেশ,

‘এবার তুই লোকজনকে ধরে ধরে যে প্রশ্ন করে যেতে চাস করে যা। কেউ তোকে উত্তর না দিতে চাইবে না। আর সঙ্গে থাকছি আমিও। দেখবি সবাই মনে করবে আমরা কোন এক অমূল্য বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে চলেছি যার জন্য সাড়া দেওয়া প্রত্যেকেরই পবিত্র দায়িত্ব। ভাবিস না, এগিয়ে যা। তোর সামনে যারা রয়েছে তারা সবাই সাধারণ জনতা,  ছাপোষা মানুষ মাত্র।’ 

কথাটা যে সত্যি তা সে তার চারপাশে থাকা ভিড়ের মানুষগুলিকে দেখেই বুঝল। এরা প্রত্যেকেই ভিড়ের মধ্যে রয়েছে, রয়েছে উহ্য হয়ে। কারোর দিকেই কেউ তাকাচ্ছে না বিশেষ নজর দিয়ে, কারোর মধ্যেই নেই বিশেষ বর্ণ বা বৈচিত্র্য। এই সাধারণ মানুষগুলি সত্যিই সাধারণ, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তারা দোকান চালায়, অফিস করে, নানারকম ধান্দায় নিযুক্ত সংসার প্রতিপালনের নিমিত্ত। তাদের কেউই গায়ে অসাধারণত্বের তকমা ধারণ করে রাখেনি। এই সাধারণ জনতার নানাজনকে ধরল সে বা তারা দু’জনেই অভীষ্ট প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়ার লক্ষ্যে। তারা কেউ বা খাচ্ছিল, কাজের অবকাশে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এক এক করে লোককে ধরে ধরে সে একটাই প্রশ্ন রাখল সবার জন্য,

‘খিদে পাচ্ছে বলে তো খায় সবাই, তুমিও খাও। কিন্তু খেতে হবে কেন ?’

সবাই প্রশ্নটাকে শুনল মনোযোগ দিয়ে এবং উত্তরও দিল ভেবেচিন্তে। বোঝা গেল কেউ ব্যাপারটাকে হাল্কা করে নিল না। অধিকাংশ লোকের কাছ থেকে উত্তরটা পাওয়া গেল দু’রকম। একদল বলল, 

‘বেঁচে থাকার জন্য।’

অন্যদল একই উত্তর দিল একটু ঘুরিয়ে,

‘না খেলে বেঁচে থাকা যাবে না,’ অথবা, ‘না খেলে মরে যেতে হবে।’

মুষ্টিমেয় কয়েকজন একটু অন্য উত্তর দিলেও শেষপর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রসঙ্গেই ফিরে এলো। প্রশ্ন করা হল বহু মানুষকে এবং উত্তর পাওয়া গেল একটাই। সে বলল,

‘তাহলে তুই কী দেখতে পেলি ? বেঁচে থাকাটাই মানুষের মূল উদ্দেশ্য। সবাই ছুটছে এই বেঁচে থাকাটাকেই মূল লক্ষ্য করে। যাবতীয় কার্যকলাপ এই উদ্দেশ্য কেন্দ্র করেই এবং এটাই প্রাথমিক ও মৌলিক লক্ষ্য।’

কিন্তু তার মনে তখন অনেক প্রশ্ন। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,

‘বেঁচে থাকতে গেলে মানুষকে আর কত কাজ করতে হয় ? কত অর্থ উপার্জন প্রয়োজন ? এতো এতো কাজকর্ম মানুষের কেবল বেঁচে থাকার জন্য ? এতো এতো সম্পদের মোহ, এতো এতো বিলাস, আমোদ-প্রমোদ, নাম-যশ, এতো এতো সব বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি পাওয়ার পিছনে ছুটে মরা কেবল বেঁচে থাকার জন্য ?’

‘অবশ্যই,’ সে জানাতে থাকল, ‘এগুলি সবই বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াকে স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে দেওয়ার জন্য। কত আরামপ্রদ করা যায় বেঁচে থাকাটাকে। সবই সেই একমেবদ্বিতীয়ম বেঁচে থাকার আনুষঙ্গিক ও প্রাসঙ্গিক।’

‘কিন্তু কেবল বেঁচে থাকাটা মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। অনেকেই কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে বা আদর্শের জন্য হেলায় জীবন দিয়ে দেয়। বেঁচে থাকা তার কাছে তখন তুচ্ছ।’

‘সেটা ব্যতিক্রম। কিন্তু সেখানেও জানবি অন্যভাবে বেঁচে থাকার প্রশ্ন জড়িত। ওই যে বললি, নামযশ, সেটা চায় কেন মানুষ ? নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই। এখানেই রয়েছে আরও বড় লক্ষ্যের কথা। বেঁচে থাকাটা একেবারেই প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু এটাও বলতে পারিস আসল উদ্দেশ্য নয়। সেটা আরও বড়, তার ব্যাপ্তি নিছক বেঁচে থাকা কেন্দ্রিক নয়। বেঁচে তো থাকতে চায় সবাই, সেটাই তো প্রথম লক্ষ্য। তোর প্রশ্নের জবাবে সবাই বললও সেটা। জীবমাত্রের মূল উদ্দেশ্য এই বেঁচে থাকা। জগৎ পরিচালিত এই মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই। তার জন্যই মানুষের এতো কাজকর্ম, এতো সংগ্রাম, এতো পড়াশুনা, এতো খাটাখাটুনি, ছলচাতুরি, হম্বিতম্বি সব। কেবল বেঁচে থাকার জন্য। জন্মের পর থেকে যত সে বড় হতে থাকে তার ভিতরে গেঁথে যায় এই ইচ্ছে। যে কোনও প্রকারে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি বেঁচে থাকলেই আমার অস্তিত্বের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটবে। বেঁচে থাকাটাই আমার একমাত্র কাজ, যেভাবে পারি।’

সমস্তকিছুর এমন সহজ-সরল ব্যাখ্যা তার পছন্দ হচ্ছিল না। সে অনেক বড় কোন বিষয় জানার আশা করেছিল। এটা কি সত্যি তেমন কোন অজানা বিষয় হল ? এই তুচ্ছ ব্যাপারটাকে জানার জন্য এতো কাঠখড় পোড়ানোর কোন মানেই ছিল না। নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে সে বলল, 

‘আসলে জীবমাত্রেই বেঁচে থাকতে চায়, এটা জানার জন্য এতো পরিশ্রমের কোন দরকার ছিল না। এটা সবাই জানে। এতো জটিলভাবে বিষয়টাকে জানতে গেলাম কেন ?’

‘এই কারণে যে জানলেও ব্যাপারটাকে সবাই ভুলে থাকে। মানুষের হাজারটা লক্ষ্য, হাজারটা চাহিদা। বাড়ি চাই, গাড়ি চাই, ক্ষমতা চাই, শ্রেষ্ঠত্ব চাই, ধনসম্পদ চাই, সাফল্য চাই, উচ্চপদ চাই, নেতৃত্ব চাই, যশ চাই ইত্যাদি কত কী। কিন্তু কেন চাই কে ভাবে ? চেয়ে না পেলেই যত অশান্তি। পেলে কী হবে, কী কাজে লাগবে ? আমি ফকির হয়েও থাকতে পারি, রাজা হলেও আপত্তি নেই। যা খুশি হই না কেন কী কারণে কিছু হওয়ার আকাঙ্খা আমার ? কে ভাবে সেই কথা ? কেবল চাহিদার লম্বা তালিকা বানাতেই থাকে। কিন্তু উদ্দেশ্য একটাই, বেঁচে থাকা। কেবলই বেঁচে থাকা। ব্যস।’

‘সেটা কেউ না জেনেই এতো কাণ্ড ঘটিয়ে বেড়াচ্ছে ?’

‘তা তো তুই নিজেই দেখতে পাচ্ছিস। তার জন্যই তো উত্তরটা অনুসন্ধান করতে গিয়ে এতো জটিল প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হল। তার জন্য তুই আবার রেগেও গেলি। কিন্তু কী করা যায় বল্ তো ? কেউ তো সাদা কথায় নিজেকে প্রকাশ করে না, বলে না কী তার উদ্দেশ্যবিধেয়। সে নিজেও কি জানে ? জানলেও কাউকে জানাবে না। সবাইকে ভুল বোঝাবে আর বিভ্রান্ত করবে। কেন তুমি পড়াশুনা করছ ? উত্তরে বলবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য, উচ্চপদ পাওয়ার জন্য, সমাজের সেবা করার জন্য। সোজাসুজি কেউ বলবে না যে বেঁচে থাকার জন্য বা নিজেকে বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াতে সামিল করার লক্ষ্যে। কেন তুমি নেতা হতে চাইছ, কেন তোমার ক্ষমতা দখলের মোহ ? উত্তরে বলবে, মন্ত্রী হওয়ার জন্য বা রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার জন্য যাতে দেশের উন্নতি ঘটাতে পারি, জনগণের মঙ্গল ঘটাতে পারি। সত্যিকথাটা বলবে না কেউ যে এটাই আমার বেঁচে থাকার প্রকরণ। এভাবে যাকেই তুই প্রশ্ন করবি কেন তুমি তোমার কাজটা করছ, সে তোকে কিছু না কিছু একটা অন্য উত্তর দেবে যা পুরোটাই বিভ্রান্তিকর, কেউ বলবে না যে সে তার কাজটা করছে নিছক বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে। কেন তুমি ব্যবসা করছ, কেন শিল্পস্থাপন করছ, কেন গান গাইছ, কেন লিখছ, কেন খেলছ, কেন ইত্যাদি ইত্যাদি যা প্রশ্নই করিস না কেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সে তোকে বড় বড় উদ্দেশ্যের কথা বলবে যার পুরোটাই মেকি এবং সাজানোগোজানো। সোজা উত্তরটা দেবে না কেউ তোকে, বলবে না, যে কাজটা আমি করছি সেটাই আমার বেঁচে থাকা। তাই এই জানা উত্তরটা জানতে আমাদের যেতে হল এমন ঘুরপথে। মানুষ যা করে পৃথিবীতে সব নিজের টিকে থাকার জন্য, নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এটাই সোজা উত্তর। আর কোন দ্বিতীয় উদ্দেশ্য নেই। যতই গালভরা মহৎ উদ্দেশ্যের কথা জাহির করুক না কেন কেউ নিজের নানাবিধ বিচিত্র কাজের সপক্ষে জানবি সেসবই গালগল্প। বেঁচে থাকাটাই হল সবার একমাত্র উদ্দেশ্য।’

কথাগুলি শুনে সে ভাবতে লাগল। মানুষের যত প্রকারের আয়োজন কেবল তার বেঁচে থাকার জন্য ? এই যে বিজ্ঞানীর উদ্ভাবন, আবিষ্কারকের আবিষ্কার, দেশনায়কের দেশ শাসন, সমাজসংস্কার, বিদ্রোহ, বিপ্লব, যুদ্ধবিগ্রহ, নানাবিধ প্রতিষ্ঠা অর্জন ইত্যাদি সবই বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে ? সে ভেবে ভেবে বুঝল, নয় বা কেন। বেঁচে থাকার জন্যই তো মানুষ চিকিৎসা করায় যাতে সে সুস্থ থাকতে পারে, সুস্থ থাকলেই সে বেঁচে থাকবে। বেঁচে থাকাকে কত আরামদায়ক করা যায় তার জন্যই মানুষ নানা অধরাকে হস্তগত করার প্রচেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে দিবসরাত। তার সমস্ত সাজসজ্জা বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। সভ্যতা এগিয়ে চলেছে, সমাজ পরিচালিত হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখেই। যদি না মানুষ বেঁচে থাকে তাহলে কোন কাজের কোন মূল্য থাকবে কি ? অথচ এই সাদা কথাটা কেন মানুষ সোজাভাবে প্রকাশ করে না ? কেন সোজাকথা সোজাভাবে বলায় তার অত অনীহা ? তার একটা কারণ হতে পারে, সে নিজেও জানে না এই প্রাথমিক ইচ্ছেটার কথা। না জেনেই ছুটে মরছে হাজারটা ভ্রান্ত উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়ে। বা এমনও হতে পারে যে সে জেনেও না জানার ভাণ করছে। কোন্ বিষয়টা সঠিক বুঝতে পারছিল না সে নিজেই। তাই প্রশ্ন করল,

‘এই সারসত্যটা কেন মানুষ প্রকাশ করতে চাইছে না ?’ 

‘তার জন্য মানুষকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। আসলে জন্মের পর বেঁচে থাকাটা এমনই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দাঁড়িয়ে গেছে যে কেউ আর তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে না। তাকে বহুবিধ কাজকর্ম এবং উদ্দেশ্য ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তার সামনে একের পর এক এসে হাজির হতে থাকে রঙবেরঙের লক্ষ্যসমূহ। তাদের সামনে পড়ে সারাজীবন তাকে নাজেহাল হয়ে যেতে হয়। সে ভাবে, ওই লক্ষ্যগুলি পূরণ করা আমার আসল কাজ। সভ্যতা যত এগিয়ে যায় চাহিদার পরিধিও ততই বাড়তে থাকে। সেইসব চাহিদা তার সামনে হাজির হতে থাকে আর সে ভাবে আমাকে সব পেতে হবে। জীবন তার ভরে যেতে থাকে সীমাহীন অভাবের মোহে। এখানে আর সে ভাবতে পারে না বা ভাবার অবকাশ পায় না যে বেঁচে থাকাটাই জীবনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। সেটা তখন সুপ্ত হয়ে যায়, থাকে অবচেতন মনে। তার সমগ্র চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে নানা জাতীয় প্রাপ্তির প্রত্যক্ষ বাসনা। তার তাড়না তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সে নিজের মূল উদ্দেশ্যবিধেয়র কথা ভুলে যায়, ভুলে থাকে। জীবন কেটে যায় কোন্ ফাঁকে বোঝাই হয় না।’ 

মেলার মানুষজনকে দেখছিল সে। সবাই ক্লান্তিহীন চলাচলে ব্যস্ত হয়ে রয়েছে। এই চলাচল ঘোষণা করছে তার বেঁচে থাকা, চলাচল থেমে গেলেই সে মুছে যাবে, হারিয়ে যাবে, তার কাজকর্মই জানিয়ে দিচ্ছে যে সে বেঁচে আছে। যদি মানুষ কাজকর্ম বন্ধ করে বসে যায় তো তার কোন প্রাসঙ্গিকতা থাকে না, সে তখন বেঁচেও মরে থাকে। শুনে সে প্রশ্ন করল,

‘বেঁচে থাকাটা যে মূল উদ্দেশ্য সেটা মুখে ঘোষণা করে না যদিও লোকজন সেটা নিশ্চয় প্রকাশ পায় তার এই অবিরাম চলাচলে ? সেটাই তো তুমি বলতে চাইছ ?’

‘অবশ্যই। জীবন মানেই চলাচল, বেঁচে থাকা মানেও তাই। চলাচল মানেই কাজ, আর মানুষের যেকোন কাজ বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াতে অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন কাজ ভালোবাসে, সেই কাজটা যদি সে করতে পারে তাহলে সেটা সে করে জীবনকে ভালোবাসে বলেই, বেঁচে থাকার উৎসাহ তাকে পরিচালিত করে বলে। বহু মানুষ রয়েছে যাদের এমনসব কাজ করতে হয় যেসব তারা একদমই করতে ভালোবাসে না, দায়ে পড়ে করতে হয়। কিসের দায় ? জীবনধারণের দায়, বেঁচে থাকার মোহ বা উৎসাহ। এই উৎসাহ যার না থাকে সে জীবন্ত অবস্থাতেই মৃত হয়ে যায়, মেলার মানুষজনের চলাচলে সামিল হতে পারে না। এসব মানুষকেও তুই খুঁজে পাবি এই ভিড়ে যারা জীবনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। তারাও উপস্থিত ভিড়ের মধ্যে, যদিও জনতার অবিশ্রাম চলাচলের অংশ হিসেবে নেই তারা। জানবি, ভিড়ের মানুষগুলির কার্যকলাপই জানায় যে তারা বেঁচে থাকার মূল লক্ষ্যে পরিচালিত, সেসব কাজ পছন্দের হোক অথবা অপছন্দের। কর্মহীন ব্যক্তি একমাত্র ব্যতিক্রম, সে বেঁচে থাকার মূল উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়। সে ভিড়ে থেকেও ভিড়ে নেই। তাকে নিয়ে সমাজ বা সভ্যতা মাথা ঘামায় না। জনতার ভিড়ে থেকেও সে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। দেখতেই তো পাচ্ছিস, মেলার ভিড়ে যারা চলমান তারা সবাই বর্তমানেই বিচরণশীল, যেসব মানুষ অতীত হয়ে গেছে তারা কেউ নেই, যেহেতু মেলার ভিড় মৃত সমস্ত মানুষদের সামিল করতে জানে না অবিরাম চলাচলে। থাকে না এখানে ভবিষ্যতের মানুষরাও। মেলার ভিড়ে কেবল বর্তমানের মানুষগুলির কাজকর্ম ও চলাফেরা প্রতিফলিত, কারণ বেঁচে থাকা ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবেই বর্তমান কেন্দ্রিক। মানুষের বেঁচে থাকাটা অতীতও নয় ভবিষ্যতও নয়, একেবারেই বর্তমান। আর তাই মেলার ভিড়ে যেসব মানুষের চলাচল দেখতে পাচ্ছিস তারা সবাই বর্তমানেরই বাসিন্দা। যে জীবনের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল, বেঁচে থাকা যার জন্য অর্থহীন সে অতীত হয়ে যায় বলে মেলার ভিড়ে থেকেও নেই। তাদের নিয়ে ভিড়ের চলাচল যেমন ভাবে না আমরাও তাদের ভুলেই থাকব। ভিড়ের সামগ্রিক চলাচলে মুখ্য হয়ে আছে সেই জনতা যাদের মূল উদ্দেশ্য বেঁচে থাকা, তাদের সমস্ত কার্যকলাপ কেবলই বেঁচে থাকার আনন্দে ও উৎসাহে পরিচালিত।’

দিগদর্শকের সুদীর্ঘ বক্তব্য সে বিনা বাক্যব্যয়ে শুনে গেল। প্রতিবাদ করার মত কিছুই তার মাথায় এলো না। চলমান  জনতার দিকে সে তাকিয়ে রইল নির্বাক, দেখতে লাগল তাদের বহুধা বিভক্ত যাতায়াত আর নানাবিধ কার্যকলাপ। তাদের চলাচল বৈচিত্র্যমণ্ডিত, কার্যকলাপও তাই। প্রত্যেকটি মানুষ প্রত্যেকের তুলনায় ভিন্ন, যদিও তাদের কাজ সমশ্রেণির হতেও পারে, যদিও তাদের চলাচলও হতে পারে সমধারায়। যতই বৈচিত্র্য থাকুক না কেন, সবাই চলেছে একই উদ্দেশ্য সামনে রেখে। প্রত্যেকেই সমাজের অঙ্গীভূত অবস্থায় সভ্যতার এগিয়ে চলার সঙ্গে সামিল এবং সংসার প্রতিপালনের জন্য ব্যস্ত বা ব্যতিব্যস্ত। তাদের কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তাদের জীবনের এত এত পসরার আয়োজন কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্য। তাদের প্রত্যেকের সামনেই হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ উদ্দেশ্য এবং তারা সবাই সেইসব আপাততগ্রাহ্য উদ্দেশ্যগুলি পূরণের জন্যই জীবনপণ করে এগিয়ে চলেছে। কেউ চাইছে ক্ষমতার শীর্ষে যেতে, কেউ চাইছে পড়াশোনায় এক নম্বর হতে, কেউ ব্যস্ত শিল্প স্থাপনে বা বাণিজ্যে সফল হতে, কেউ চায় নামী শিল্পী বা লেখক বা গায়ক হবে, কারো উদ্দেশ্য কোন প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ট পদ, কেউ চাইছে খেলায় সাফল্য, কেউ চাইছে লোক ঠকাতে ইত্যাদি কত যে উদ্দেশ্যে পরিচালিত চলমান জনতা তা বলে শেষ করা যায় না। এই ভিড়ে রাজনীতিক, বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক, ছাত্র, শিক্ষক, অভিনেতা, সমাজবিদ থেকে শুরু করে কে নেই ? সবাই নিজের নিজের আপাতদৃষ্ট উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে এবং কেউ একথা মাথায় রাখছে না যে তার একমাত্র মূল উদ্দেশ্য হলো বেঁচে থাকা। তার সমস্ত ব্যাপারটাকে সত্যিই এবার খুব তাজ্জব বলে মনে হলো। সে জানতে চাইল,

‘বেঁচে থাকা যে মূল উদ্দেশ্য ওটা ভাবতে বাধা কোথায় বা কেন ?’

‘বাধা এখানেই যে ওই ভাবনাটা ক্লান্তিকর ও বিরক্তিকর। যদি মানুষ ওই মূল ভাবনাটাকে আসল লক্ষ্য বলে ভাবে তো তার কাজকর্মের এত উৎসাহ আর থাকবে না। আপাতদৃষ্ট উৎসাহগুলি অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মানুষ সেসব নিয়েই ভাবে এবং ব্যস্ত থাকে। যদি মানুষ জানে যে বেঁচে থাকাটাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য অথবা সেটাকেই সে মুখ্য বলে ধরে নেয় তো সেটা তার জন্য হয়ে যাবে বড়ই ঘ্যানঘেনে বিষয় এবং কাজেকর্মে তার আর তেমন উৎসাহই থাকবে না। সে জানবে, যেমন-তেমন ভাবে বেঁচে থাকলেই যদি হয়ে যায় তো সেটুকুই করি, আমার অত অনন্ত চাহিদা রেখে কী আর হবে ? সবই তো মূল্যহীন। কেউ কি এমন ভাবে ? তাহলে তার কাছে বেঁচে থাকাটাই আকর্ষণ হারাবে। তাই মানুষ মনে রাখে না, বেঁচে থাকাটাই তার জন্য প্রাথমিক উদ্দেশ্য। তার সামনে তাই এত হাজার হাজার উদ্দেশ্যের পসরা। সেসবের আকর্ষণই তাকে কাজ করায়, বেঁচে থাকার ব্যাপারটা থাকে অবচেতন মনে। প্রকাশ্য থাকে না করোও কাছেই।’

‘এবার বুঝলাম, কেন সে বেঁচে থাকা তার মূল উদ্দেশ্য সেটা বলে না।’

সে বেশ সোৎসাহে বলল। উত্তরে জানালো দিগদর্শক,

‘হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই একটা বড় কারণ। তবে জানবি যে এই প্রাথমিক বা মূল উদ্দেশ্যটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকাও একটা প্রধান বিষয়। বেঁচে থাকা জীবনের মূল লক্ষ্য সেটা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ভুলেই থাকে মানুষ। ভুলে না থাকলে কী বিপদ তা তো জানালাম তোকে। আর সবচেয়ে বড়কথা, ভুলে থাকলে কোন ক্ষতি হয় না মানুষের, তার চলাচল বা কাজকর্ম কিছুই থেমে থাকে না। বরং যেমন তোকে জানালাম, এই নির্মম সত্যিকথাটা জানলেই মানুষ থেমে যেতে পারে। তাই সে না চাইলেও তাকে জাগতিক নিয়ম বা বিশ্বনিয়ন্তা বিষয়টা ভুলিয়ে রাখে। সমস্ত জীবন মানুষ এভাবে বিষয়টাকে ভুলে থেকেই কাটিয়ে দেয়।’

‘তাহলে এই বিষয়টাই মানুষের মূল ও একমাত্র চালিকাশক্তি ?’

‘একদম তাই।’

‘এটাই তার মূল ও একমাত্র উদ্দেশ্য জীবনের ?’

এবার তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেল পথপ্রদর্শক। খানিকটা বিরতি নিয়ে সে বলল,

‘এখানে একটা কিন্তু আছে। তোকে থামতে হবে এই জায়গাটাতে। জীবনের সমস্ত কাজকর্ম ও চলাচলের মূল চালিকাশক্তি হলেও বেঁচে থাকাটাকেই তুই কিন্তু জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলতে পারিস না। খেয়াল করে দ্যাখ্, আমি বারবার এটাকে মূল বা প্রাথমিক উদ্দেশ্য বলেছি। কেন জানিস, এর চেয়েও বড় একটা উদ্দেশ্য রয়ে গেছে। সেটাই হলো শেষ ও সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য। সেটা মানুষের অন্তরের আরও সুপ্ত বা গুপ্ত বাসনা। সেটা আরও অজ্ঞাত তার কাছে। আমি কিছুক্ষণ আগে তার উল্লেখ করেছিলাম কোন এক প্রসঙ্গে। মনে পড়ে কি ?’

তার মনে পড়লো ঠিকই। এই কথোপকথনের গোড়ার দিকে উঠেছিল প্রসঙ্গটা। সে যখন বলেছিল, মানুষ চায় খ্যাতি ও নামযশ, তখন সেই প্রসঙ্গে সে বলেছিল, এই নামযশ কী উদ্দেশ্যে চায় মানুষ। এবং সেখানেই সে বলেছিল যে তার পিছনে আরও একটা বড় উদ্দেশ্য রয়েছে যা ব্যাপ্তিতে আরও ব্যাপক। সেই প্রসঙ্গ তখন তখনই চাপা পড়ে গিয়েছিল অন্য বিষয়ের মোড়কে, সেও সব ভুলে গিয়েছিল। এবার তার মনে পড়লো বিষয়টা। তাহলে বেঁচে থাকাটাই মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য নয় ? এটাকে একমাত্র উদ্দেশ্য ভেবে সে এতক্ষণ বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। এখন বুঝলো, তা নয়। সে এখন জানল, অন্যরকম। বেঁচে থাকাটা মানুষের প্রাথমিক লক্ষ্য মাত্র। তার চেয়েও বড় একটা লক্ষ্য রয়ে গেছে তার। সেটা চূড়ান্ত এবং তাকে কেন্দ্র করে মানুষের চলাফেরা। আবার তা নাকি আরও অজ্ঞাত, আরও রহস্যে ঘেরা তার পরিচয়। সে আরও বিভ্রান্ত হতে লাগলো। বুঝতে পারল না এইসব উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের এখানেই সমাপ্তি কিনা। যদিও তাকে বলা হলো যে এটাই চূড়ান্ত উদ্দেশ্য, তবুও সে ভয় পেতে লাগলো আবার না নতুন কোন উদ্দেশ্যের আবির্ভাব ঘটে। সে খানিকটা ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করল,

‘সেই চূড়ান্ত উদ্দেশ্যটা কী ?’

‘বলছি,’ পথপ্রদর্শক জানাতে লাগলো, ‘তার আগে জেনে রাখ্ যে তোর বয়স যেমন এগিয়ে আছে আপাতত তেমনই থেকে যাচ্ছে। জাদুজগতের কাঠামোতেই তুই থেকে যাচ্ছিস যেহেতু আবার প্রয়োজন হতে পারে লোকজনকে ধরে ধরে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার। মূল মেলার মাঠে যাবি যখন তোকে আবার স্বাভাবিক করে দেব। বলেছি তো, ওখানে তোর এক প্রতিভূ বর্তমান আছে এখনও। এখান থেকে যাবি যখন ওখানে তুই তার সঙ্গে মিশে যাবি। কোন অসুবিধেই হবে না। এখন যেমন থাকছিস তেমনই চলতে থাক। খেয়াল রাখিস, তুই বড় হয়েই আছিস।’

সেটা তাকে না বললেও হত, কারণ সে যে বড় হয়ে আছে তা সমস্ত অস্তিত্ব দিয়েই উপলব্ধি করতে পারছিল। বড় কি ছোট, সেই অনুভূতি নিশ্চয় সবার মধ্যেই থাকতে বাধ্য। কিন্তু সে বিষয় নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। তার যেটা মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হল মানুষের কোন্ বস্তুটা চূড়ান্ত লক্ষ্য। সেই প্রশ্নটাই সে করল আবার,

‘আমাকে বল, মানুষের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কী ?’

ধীরস্থির ভঙ্গিতে কোটিকল্প জানালো,

‘তুই জেনেছিস, মানুষের প্রাথমিক বা মূল উদ্দেশ্য হলো বেঁচে থাকা। এবার পরবর্তী প্রশ্ন এবং এটাই চূড়ান্ত।

কতদিন ?’

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *