অরিত্রী দে
দ্বিতীয় পর্ব
ধানী সংস্কৃতির প্রতিবেদন
“গোলাভরা ধান গোয়ালভরা গরু পুকুরভরা মাছ / তোর কোথায় গেল ওরে বাঙালী!”
কৃষিই নৃ-গোষ্ঠীর প্রত্নস্মৃতি। বিশ্বব্যাপী কৌম কৃষিপ্রধান গোষ্ঠীর সমাজে গোলার বাইরে এক ছড়া ধান ঝোলানোর রীতি আজও বহালতবিয়তে আছে। আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি যার এক্তিয়ারভুক্ত, তাকে ‘বাংলা’ বলি। ভাত আর মাছ বিনে বাঙালী হয়না, তার রক্তেই আছে ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেব মেপে’র হিসেববোধ। বৃষ্টি থেকে ধরণী গর্ভবতী হবে, উৎপাদিত হবে ধান আর তাতে ঋণ শোধ হবে। স্পষ্টতই এটি একটি মাঙ্গলিক এষণা, তাই এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় লক্ষ্মীদেবীর শ্রী অনুষঙ্গ। ঘরে ঘরে বৃহস্পতিবারের পুজোয় গীত হয়-
“লক্ষ্মীর ভান্ডার যেবা স্থাপি নিজঘরে।
রাখিবে তন্ডুল তাহে এক মুঠা করে।।”
গৃহস্থের সঞ্চয়ের পথ নিশ্চিত করাই এর একমাত্র লক্ষ্য ছিল। সামাজিক এই মঙ্গল কারক- তন্ডুল তথা চাল। শতপথ ব্রাক্ষ্মণে বলা হয়েছে- স যো হ বা অন্নং সমষ্টি যজুরিতি বেদাব হান্নং রুন্ধে যৎ কিঞ্চনান্নেন জয্যং সর্বং হৈব তজ্জয়তি। অন্নকে যে সমষ্টিযজু বলে জানে সে অন্নকে বাঁধে ও অন্নকে দিয়ে যা কিছু জয় করা যায়, যেমন- ক্ষুধা, অভাব দারিদ্র্য, মৃত্যু, রোগ ব্যাধি, অযশকে জয় করে। ঐতরেয় ব্রাক্ষ্মণেও স্বীকার করা হয়েছে যার প্রচুর অন্ন আছে, সে’ই দেশে সম্মানিত। এভাবে অন্নের সঙ্গে সমৃদ্ধি, সামাজিক প্রতিপত্তি আর শ্রী’র তাৎপর্য জুড়ে গেছে। আবার গোব্রাক্ষ্মণের উত্তরভাগে অন্নাদ্বীর্যম বলা হচ্ছে। সুতরাং যথেষ্ট পরিমাণে অন্ন ভক্ষণে বল, বীর্য পাওয়া যাবে- এই ব্যাখ্যা বিশেষ খাদ্যশস্যটির পুষ্টিগুণ সম্পর্কেও অবহিত করে। এতে মূলতঃ থাকে কার্বোহাইড্রেট, যা শক্তি অর্জনে সহায়ক। প্রতি একশো গ্রাম ভাত থেকে ২.৯ গ্রাম প্রোটিন, ২৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট ও ০.৪ গ্রাম ফ্যাট পাওয়া যায়৷
ধান অর্থাৎ Oryza Sativa বাংলার তো বটেই, গোটা পূর্ব এশিয়ার প্রধান খাদ্যশস্য। ফলে চাষও হয় ব্যাপকভাবে। ধানের পূর্ব প্রজাতি Oryza Rufipogon বা বুনো ধানের এর বীজ নিয়ে চীনা কৃষকেরা চারাযোগ্য ধান রোপণ করেছিল। কার্যত ধানের দুটি উৎপত্তিস্থল- চীন ও ভারত। চীন ও জাপানে রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু বছর আগে ধান চাষ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় ধানই গোটা বিশ্বে সভ্যতার মুখপাত্র হিসেবে প্রথম ছড়িয়েছিল ইউরোপের মাধ্যমে। এই যে ধান থেকে অন্ন অর্থে চাল বা ভাতকে বোঝায়, তাতে সুস্পষ্ট অর্থগত এক কালানুক্রমিক সরণ আছে। বৈদিক অর্থে অন্ন বলতে খাদ্য বোঝাত, তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে- অন্নাদ্বৈ প্রজা: প্রজায়ন্তে যা কাশ্চ পৃথিবীং শ্রিতা:, অন্ন থেকেই বিশ্বের সব জীব জন্মায় তথা খাদ্যই জীবনের কারণ। পরাশর মুনির ‘কৃষি সংহিতা’য় যব, বাজরা, মারোয়া প্রভৃতি খাদ্যশস্যের কথা পাই। কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তীরীয় সংহিতায় প্রথম ‘বোনা ধান’ অর্থে ‘ব্রীহি’ শব্দটির ব্যবহার মেলে। ক্রমে সংস্কৃত ও পালি সাহিত্যে সরাসরি ধানের কথা আসে। শাক্যমুনি বুদ্ধ সম্বোধি লাভের পর মধু আর বার্লি দিয়ে তৈরি কেক খেয়েছিলেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুর খাদ্য তালিকায় যে কটি শস্যের কথা উল্লেখিত আছে, তার প্রথমটিই হল ‘ওদন’ (Odana)। এর অর্থ ঘি, মাংস ও বিভিন্ন ফলমূল মিশ্রিত সেদ্ধ ভাত। এইভাবে ভাতই হয়ে উঠল প্রধান খাদ্যশস্য। রামায়ণে যে সীতা বাঙালির মন জয় করে নিয়েছিল, মিথ অনুযায়ী সেই সীতাকে আমরা পেয়েছিলাম লাঙলের ফলাগ্রে। ‘সীতা’ অর্থ হলরেখা তথা লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করার ফলে মাটিতে যে দাগ পরে। বন্য মানুষের কৃষিকেন্দ্রিক হয়ে এক জায়গায় স্থিত হওয়া আর সভ্যতার সূচনা করার আখ্যানই সীতার আখ্যান। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের আগে বহু পরিশ্রমে কাঠের ফাল যুক্ত লাঙল দিয়ে বহু পরিশ্রমে স্বল্প জমিতে অগভীর ‘সীতা’ রেখাপাত করা যেত। পরে লোহার ফালে বেশি জমি অল্প সময়ে চষা সম্ভব হল, ক্ষুন্নিবৃত্তির নিবারণ সহজ হল। একারণে ঐ সময়ে উত্তর ভারতে উৎপাদন ব্যবস্থায় গভীর পরিবর্তনের কথা জানা যায়। একইসঙ্গে হালের বলদের প্রয়োজন হওয়ায় বিধান দিয়ে (যেমন শতপথ ব্রাক্ষ্মণে) যজ্ঞে পশুনিধন (ধেনু ও ষাঁড়) বন্ধ করা হল। ফালের কল্যাণে চাষে কম মানুষ নিযুক্ত হওয়ায় যে উদ্বৃত্ত শ্রমিক হল, তাদের কুটির শিল্পে আনা হল। কাঠ, ধাতু, চামড়া, পাথর, মাটি ইত্যাদি দিয়ে ঘরের ও প্রতিদিনের ব্যবহারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নির্মাণের কলাকৌশল শিখল তারা। বলা যায় ধান ও অন্যান্য অপ্রধান খাদ্যশস্য চষাকে কেন্দ্র করে যে কৃষ্টি গড়ে উঠল, এই আনুষঙ্গিক প্রকৌশলগত চর্চা তারই অঙ্গ। মানুষ খেতের পাশেই মড়াইশিল্প শিখল, আলপনা দিল, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি প্রভৃতি পশুকে গৃহপালিত করে তুলল। মনে পড়বে সীতার দুই সন্তানের একজন কুশ, যা তীক্ষ্ণাগ্র তৃণবিশেষের অপর নাম। ঘরের ছাউনি দিতে ও ধর্মানুষ্ঠানের কাজে এই ঘাস ব্যবহৃত হয়। এইভাবে সীতা তার সঙ্গে খামারি জ্ঞানভাণ্ডার বহন করে কৃষ্টিগত সামগ্রিক রূপের অনুষঙ্গ ধারণ করে থাকে।
বাংলাদেশে মূলত তিন রকম ধানের প্রচলন ছিল- আউশ, আমন, বোরো। আউশ মূলত উচ্চ ফলনশীল আষাঢ়ী ধান। কুমারী, কটকতারা, আটলাই প্রভৃতি এর রূপবৈচিত্র্য। আর হৈমন্তী বা আগুনী ধান আমন যথাক্রমে রোপা, বোনা ও বাওয়া- এই তিন রকমের হয়। আগে বাংলার ধান বলতে আউশ ধানকেই বোঝাত। ভাদ্র মাসে রোয়া ধানগাছের চারপাশে নিড়েন পড়তো রোষণা, চেঁচকো, পাতি, ওকরা, কালেয়া কানছিঁড়ে, কুলপো প্রভৃতি ঘাস টেনে উপড়ে ফেলার জন্য। পৌষে কাটা হয় মুড়ির ধান। বাংলায় মরশুমের সাথে মিলিয়ে যে ধান হত, কিছুকাল পরে সেচ নির্ভরতায় সেই প্রাকৃতিক খেয়ালও কাটিয়ে ওঠা গেল; কার্তিকী ধান বোরো চাষ শুরু হয়। যেমন- পশুশাইল, বানাজিরা, খৈয়াবোরো। এতক্ষণে বোঝা গেছে দেশি ধানের জাতের নামকরণ হত লোকায়ত মনস্তত্ত্ব থেকে। শিষে দানার বুনট অনুযায়ী খেজুরছড়ি, নারকেলছড়ি, বাঁশফুল, তুলসীমঞ্জরী; ধান কাটার মাস অনুযায়ী আশ্বিন ঝরিয়া, পশু পাখির নামে ঘোড়াশাল, বাঘ ঝাপটা, হাতিপাঁজর; আদুরে জামাই আর বউয়ের নাম অনুযায়ী জামাই নাড়ু, বৌ- ভোগ প্রভৃতি। এমনকি মহাকাব্যিক চরিত্রের নাম দিয়েও বাংলার ধানের নাম অজস্র- ভীমশাল, রামসাল, রাধা তিলক। আবার চৈতন্য দেবের ঐতিহাসিকতার প্রভাবে ধানের ‘গৌরনিতাই’ নামকরণও হয়েছে। মনে পড়ে স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের কথা যিনি সুন্দরবনের জনবসতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খাদ্য সুরক্ষার অনেক মৌলিক ব্যবস্থাপনার জন্য তার স্মরণে সুন্দরবনের একটি লবণ সহনশীল জাতের ধান ‘হ্যামিলটন’ নামে খ্যাত হয়। সংবাদ প্রভাকরে ১২৫৭ সালের একটি সম্পাদকীয়তে আষাঢ়ী ধান আর তাকে কেন্দ্র করে কৃষকের ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা বলা আছে- কৃষকেরা কর্ষণের সময়ে অর্থাৎ আষাঢ় শ্রাবণ মাসে যত পরিমাণে ধান নিয়ে খত লিখে দিত, পৌষ ও মাঘ মাসে তার দেড়া দিতে হত। কিন্তু দৈবত: কারোর জমিতে পর্যাপ্ত ফসল না জন্মালে সর্বনাশ ঘটতো, খতের লিখিত ধান উক্ত নিয়মে পরিশোধ করতে না পারলে ওই দেড়া ধানের খেত লিখে নেওয়া হতো। মৃত্যু ছাড়া চাষীদের সেই ঋণ থেকে উদ্ধার হওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। সেলিনা হোসেনের ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে দেখি কাহ্ন পাদের গোষ্ঠীর মানুষজন কেউ চাঙ্গারি বুনে, শিকার করে, দুধ ও মদ বিক্রি করে, মুদির দোকান চালিয়ে দিনাতিপাত করে। খিদের জ্বালা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। নগর থেকে দূরে বসবাসকারী নিম্নবর্গের মেয়ে বিশাখা ধানখেতের স্যাঁতসেঁতে মাটিতে শামুক খোঁজে। পাহাড়ের গায়ে গজিয়ে ওঠা কচি ধানের চারা হাওয়ায় দোলে অথচ সেই ফসলে অধিকার নেই ওদের কারোর। দেশাখ স্বপ্ন দেখে একদিন আর পশুশিকারের অপেক্ষায় তাকে থাকতে হবে না, রাজা নিজে এসে তাকে জমি দেবে, সোনার ফসল ফলবে তাতে। কিন্তু অন্নের প্রাচুর্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই এত সহজ হয়না, তাদের কল্পনায় সৃজন করতে হয় মাছ-ভাতের উৎসব। আসলে তো অন্নময়তাতেই মনের জন্ম, খিদের নিবৃত্তি না হলে জ্ঞানলাভের ইচ্ছেই আসত না, সভ্যতাও এগোত না। অন্নে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে যারা, সেই কৃষক আর মজুরেরা চিরকাল পরান্নজীবীদের দ্বারা শোষিত।
চাষীদের মূল কেন্দ্রীয় অন্নকেন্দ্রিক উৎসব বলতে ‘নবান্ন’। মাঠে ধান কাটা শেষ হলে গৃহস্থে শেষ বিড়া বয়ে আনা হয়, তা থেকে অঘ্রাণে চাল তৈরি করে পায়েস হয়। অবশ্যই এই অন্ন লক্ষ্মী দেবীকে উৎসর্গ করা হয়। আর খামার আলপনা দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। অকৃষি এলাকা বাঁকুড়ায় ‘জিউড় উৎসব’ পালিত হয়। এখানে মূলত জনার অর্থাৎ ভুট্টা হওয়ার প্রবণতা বেশি বলে নতুন ভুট্টা উঠলে তা দিয়েই নবান্ন পালিত হয়। আবার উত্তরবঙ্গের নবান্ন কে বলা হয় ‘নামান’। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘পল্লী বৈচিত্র্য’ প্রবন্ধে নবান্ন’র পরিবেশগত বিবরণ চিত্তগ্রাহী। বলাই বাহুল্য নবান্নের আয়োজনের সঙ্গে বাড়ির মহিলারাই যুক্ত থাকেন। এখানে বলা প্রয়োজন ধান কাটা ইত্যাদিতে মহিলা শ্রমিকদের জুড়ি মেলা ভার। ধান কাটার মরশুমে মহিলা শ্রমিক যোগানের জন্য একরকম বিশেষ বিবাহ প্রথা বাংলাদেশে প্রচলিত আছে। ফলন্ত ধানগাছকে নারী শরীরের সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার সংস্কৃতি আমাদের আছে-
“চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল;…আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই—নুয়ে আছে নদীর এ-পারে
বিয়োবার দেরি নাই—রূপ ঝ’রে পড়ে তার—”
(অবসরের গান, জীবনানন্দ দাশ)
এখানেই আসে জিহুড় পার্বণ বা ধানের সাধভক্ষণের কথা। আশ্বিন সংক্রান্তির সময় বহাল জমিতে লাগানো ধান গাছের শস্যে সাদা দুধ জমাট বেঁধে থোড় হয়ে যায়, একেই বলে ধানের গর্ভাবস্থা। বাঙালীর জীবনের বিভিন্ন লগ্নাচারে শিশুর জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত আশীর্বাদে, লাজ বর্ষণে, বধূবরণে, কনকাঞ্জলিতে, অতিথি সৎকারে, এমনকি শ্মশান যাত্রায় তন্ডুলের ব্যবহার বর্তমান।
আগে চাষীরাই ধান বীজ তৈরি করতেন, সংরক্ষণও করতেন। তাদের কাছেই থাকত ‘বীজ রেজিস্টার’। ভারতে সাতের দশকে তথাকথিত সবুজ বিপ্লব ঘটে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র সহ বিভিন্ন রাজ্যের হাত ধরে। এই বিপ্লবের পরপরই introduced হয়েছে রাসায়নিক সার-বীজ প্যাকেজ, অগণিত জনসংখ্যার পেট ভরাতে হবে। ফলে জৈবসার প্রয়োগ, ক্যানেলসেচ পদ্ধতি বন্ধ হয়ে শ্যালো, ডিপ ও মিনিডিপ টিউবকলের ব্যবহার বাড়ল। এতে ভূমি গর্ভের জলস্তর যেমন নামতে থাকলো, তেমনি অগভীর জলস্তর থেকে আর্সেনিক দূষণের প্রকোপ বাড়ল। আটের দশকের চাষের কাজে যন্ত্রের ব্যবহার আরো বাড়ে। ক্রমে কৃষির পুরোটা না হলেও অন্তত কিছুটায় কর্পোরেট স্থায়ী আসন লাভ করল, উচ্চ ফলনশীল টার্মিনেটর বীজ তৈরি হলো ও বাণিজ্য দায়িত্ব একচেটিয়া পুঁজিবাদী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হল। অন্য দিকে ১৯৯৪ তে GATT (General Agreement on Tariffs and Trade) চুক্তির ফলে Monsanto জাতীয় কৃষি বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে জেনেটিক মডিফায়েড বীজ ব্যবহার শুরু হল। প্রচুর দেশি প্রজাতির ধান চলে গেল। এই ধরনের বীজ প্রসঙ্গে বলা হলো যে এতে পোকা লাগেনা। ধান উৎপাদনে জ্ঞানী চাষীভাইরা জানেন পোকা ধানী বাস্তুতন্ত্রের অঙ্গ। যে পোকাকে রাসায়নিক সার দিয়েও পুরোপুরি সরানো যায় না, নতুন রকমের বীজে সেই পোকা একেবারে না লাগা বীজটির জিনগত কৃত্রিম ও ক্ষতিকর পরিবর্তন বিষয়েই আমাদের সচেতন করে তোলে। মানুষের খাদ্য শৃঙ্খলে ঢুকে পড়েছে প্রাকৃতিক এই ছন্দপতনের প্রভাব। স্পষ্টতই কর্পোরেট সংস্থাগুলির আয়ত্তে চলে এসেছে বীজ সংরক্ষণের অধিকার। তারাই কৃষককে তারই জমিতে নির্দিষ্ট কিছু ফসলই ফলানোর বায়না দিচ্ছে নগদ টাকার বিনিময়ে। ফলে ধানের সঙ্গে যে মিশ্র চাষ হতো সেটাও চলে গেল। আগে কৃষকেরা স্বতন্ত্রভাবে নিজের খেয়াল খুশি মতো সারাদিন ধরে খেতে চাষ করত, ‘টোকা’ ব্যবহার করত- তালপাতায় তৈরি ত্রিকোণাকার একরকম ঠান্ডা টুপি। সারাদিনের ক্লান্তি অপনোদনের জন্য ছিল ধেনো-মদও। এসব এখন আর নেই, আমাদের নাগরিকদের ঘর সাজানোর লোকসংস্কৃতির দৃষ্টি আকর্ষণকারী উপকরণে পরিণত হয়েছে। লেখক আনসারউদ্দিনের ‘গো রাখালের কথকতা’য় এই কৃষিকেন্দ্রিক গোষ্ঠী-সংস্কৃতিকে আগলে রাখার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। আরেকটি পৃথক বৈঠকি আলাপে তা নতুন করে স্বপ্ন দেখানোর দাবি জানাতে থাকে প্রসব যন্ত্রণার মত। ‘ধান ভানতে শিবের গান’ করে সেখানে নয়া আসর বসানো হবে।
অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন ছাড়াও প্রাচীন বাংলায়
নতুন বছর শুরু হতো,মুলত বছরের প্রথম দিন নতুন ধান,নতুন গুড় ( নলেন গুড়) দিয়ে তৈরী পরমান্ন বা পায়েস দেবী লক্ষ্ণী ও গনেশ কে দেওয়া হতো,তখন পয়লা বৈশাখ এর মতো নতুন পোশাক কেনা ও পরিধান এর রেওয়াজ ছিলো,অবস্থাপন্ন রা সোনা,রুপা গহনা কিনতেন
তখন বাংলা কে হিন্দি বলয়ের করওয়া চৌথ,ধন তেরস ছিলোনা,নবান্ন ছিলো বাঙালিয়ানার উৎসব
এখন নবান্ন বলতে প্রশাসনের ভবন, লক্ষ্ণীর ভান্ডার বলতে ভাতা,বখরা বলতে কাটমানি কমিশন তোলাবাজি বোঝায়, সেটা ছিলোনা