তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)

সত্যব্রত সামশ্রমি (১৮৪৬ – ১৯১১)

এই সংখ্যায় যে ভারততত্ত্ববিদের আলোচনা করা হবে তাঁর জন্ম অবশ্য বঙ্গদেশে নয়, তবে কর্ম এই বাংলায়। বাংলার অন্যতম বেদ বিশেষজ্ঞ পন্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমি জন্মেছিলেন বিহারের পাটনা শহরে ১৮৪৬ সালের ২৮ মে। পিতার নাম রামদাস চট্টোপাধ্যায়।  চট্টোপাধ্যায় এর পুত্র কিভাবে সামশ্রমি হলেন সে বিষয়ে পরে আসছি। যদিও তাদের আদি নিবাস ছিল বর্ধমানের কালনাতে। সত্যব্রত কর্মজীবনে আইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং কর্মকালের শেষে তিনি বিচারপতিও হয়ে ছিলেন। চাকুরী জীবনে তিনি বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন; তবে একটি ব্যাপারে তিনি ছিলেন প্রাচীনপন্থী। তা হলো তিনি পুত্রদের বিলাসিতা বা সাহেবিয়ানা একদম পছন্দ করতেন না। বরং চাইতেন পুত্ররা প্রাচীন কালের আদর্শ অনুসরণ করে গুরুগৃহে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে।

    আর বাল্য বয়স থেকেই সামশ্রমির মনে ঈশ্বর ভক্তির ভাব ছিল। আট বছর বয়সে তাঁর উপনয়নের পর গুরু গৌড় গোস্বামীর অধীনে সরস্বতী মঠে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল শিক্ষা গ্রহণের জন্য। সেখানে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে পাণিনির ‘অষ্ঠাধ্যয়ী ‘ এবং পতঞ্জলি র ‘ মহাভাষ্য ‘ রপ্ত করে ফেলেন। দীর্ঘ বারো বছর গুরু আশ্রমে অতিবাহিত করে তিনি বেদ এবং ব্যাকরণে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। আর কুড়ি বছর বয়স থেকেই তিনি পন্ডিত ব্যক্তিদের সাথে বেদ আলোচনায় অংশ নিতেন এবং কোনো জটিল প্রশ্ন থাকলে তার সমাধানও করে দিতেন। এই ভাবে তিনি অতি অল্প বয়সেই একজন বেদ বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। সেই সময় সত্যব্রত বুন্দির রাজার আমন্ত্রণে তাঁর রাজ্যসভায় বেদ আলোচনায় যোগদান করেন। সেই রাজ্সভায় এই তরুণের বেদ সম্পর্কে পাণ্ডিত্য দেখে মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে ‘ সামশ্রমি ‘ উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন থেকেই তিনি তাঁর পৈতৃক উপাধির পরিবর্তে এই প্রাপ্ত সম্মান নামের সাথে ব্যাবহৃত হতে থাকে
   ১৮৬৭ সালে তিনি বারাণসী থেকে ‘প্রত্নকেন্দ্র নন্দিনী ‘ নামে সংস্কৃত ভাষায় একটি সাময়িক পত্র প্রকাশ করেন। আট বছর এই পত্রিকাটি সগৌরবে চলেছিল। এই পত্রিকা – টির মাধ্যমে তিনি ভারতের প্রাচীন সাধনা ও গৌরব সম্পর্কে লিখতে থাকেন। ভারতবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে এই পত্রিকার অবদান অপরিসীম।

   ১৮৬৮ সালে তিনি নবদ্বীপের খ্যাতিমান স্মার্তপন্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের নাতনীকে বিবাহ করেছিলেন। এ নিয়ে একটি মজার গল্প আছে। একবার নাকি পন্ডিত ব্রজনাথকে নবদ্বীপে গিয়ে এই তরুণ বেদবিশেষজ্ঞ সত্যব্রত তর্ক যুদ্ধে পরাজিত করেন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ব্রজনাথ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে সত্যব্রতের বাবা কে এর বিহিত করতে বলেন। রামদাস পড়েন ফ্যাসাদে; তিনি ব্রজনাথকে বলেন সেইই বলুক কি করলে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হবে। চতুর বিদ্যারত্ন রামদাসকে বলেন তাঁর একমাত্র নাতনীকে বিবাহ করলে তিনি সত্যব্রতকে মার্জনা করবেন। আর তখন থেকেই নাদিয়ার সারস্বত সমাজে তিনি জায়গা করে নেন।

প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ রজেন্দ্র লাল মিত্রের উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ‘বিব্লথেকা ইন্ডিকা ‘ গ্রন্থমালায় সামবেদ সংকলনের পরিকল্পনা করেন, তখন এই দায়িত্ব তিনি সাগ্রহে সত্যব্রতকে দেন। তিনিও মনের মত কাজ পেয়ে পূর্ন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এদিকে ১৮৭৫ সালে তাঁর পিতৃ বিয়োগ হলে তিনি পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় বসবাস শুরু করে তিনি নিজের টাকায় একটি মুদ্রাযন্ত্র কিনে ফেলেন। এই মুদ্রাযন্ত্রের দৌলতে তিনি সামবেদ সংকলনের সাথে সাথে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ন বই প্রকাশ করেন; যা তাঁর ভারতবিদ্যা চর্চাকে সমৃদ্ধ করেছিলো। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বেদ শাস্ত্রের অধ্যাপক ও পরীক্ষক ছিলেন। ভারতবর্ষের বৈদিক যুগ সম্পর্কে তিনি অনেক অজানা তথ্য পরিবেশনের জন্য ‘ ঊষা ‘ নামক একটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিন যুক্তি সহযোগে বেদের নানা বিষয় ও ঘটনাকে তুলে ধরতেন, যা আজকের দিনেও ভীষণ প্রাসঙ্গিক।

    সামশ্রমি মহাশয় সমস্ত বেদের সংকলন ও ভাষ্য প্রদান করেছিলেন, সেগুলি ব্যতিরেকে ভারতবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রটি মূল্যহীন হয়ে পড়বে। শৈশব থেকে বাংলার বাইরে মানুষ হলেও বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম প্রেম। তাঁর উদ্যোগে সম্পাদিত ও প্রকাশিত বাংলা গ্রন্থগুলি হলো: ‘ ত্রয়ী ভাষা ‘ ‘ ‘ ত্রয়ী চতুস্থয় ‘ শতপথ ব্রাহ্মন ‘ ‘সামবেদ সংহিতা ‘ , ‘ উপনিষদ ‘ এবং ‘ দেবতাতত্ত্ব ‘ ।

   ১৯১১সালে ১জুন বঙ্গদেশের এই খ্যাতিমান বৈদিক পন্ডিত কলকাতা শহরেই নি:শব্দে  ইহলোক ত্যাগ করেন। অথচ, আমরা কজনেই বা তার নাম জানি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *