মহাদেব মণ্ডল
লেখক পরিচিতি
জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের চূড়াভান্ডার গ্রামে ১৯৯২ সালের ৪ মে মহাদেব মণ্ডল জন্মেছেন। বাবা মঙ্গল মণ্ডল, মা ভাগ্য মণ্ডল। গরুমারা অভয়ারণ্য এবং লাটাগুড়ি জঙ্গলের খুব কাছের গ্রামেই তিনি বড় হয়ে উঠেছেন। তাই প্রকৃতির প্রতি এক গভীর টান তাঁর ছোটবেলা থেকেই। তাঁর চর্চা এবং বিশেষ পছন্দের বিষয় মূলত কথাসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতি। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ থেকেই তিনি কিন্নর রায়ের উপন্যাসে পরিবেশ ভাবনা নিয়ে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.ফিল ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে রচনা করেন ‘কিন্নর রায়ের কথাসাহিত্যে পরিবেশ প্রসঙ্গ’ নামক নিজস্ব গ্রন্থ। এর আগে যুগ্ম-সম্পাদনায় ‘বাংলা ছোটগল্প : বিষয় ও নির্মাণ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘প্রাজক্তা’ সহ নানা পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। তিনি বর্তমানে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণারত।
বিষয় পরিচিতি
( পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য বর্তমানে রীতিমত নানা আন্দোলন যেমন হচ্ছে তেমনি পরিবেশ রক্ষার জন্য সমস্ত দেশের বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণাও করে চলেছেন। এ বিষয়ে পরিবেশবিদরা বর্তমানে ভীষণভাবেই চিন্তিত। এই মর্মেই নানারকম প্রবন্ধ নিবন্ধন প্রকাশিত হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়। পিছিয়ে নেই সাহিত্যও। তাইতো বর্তমানে পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য রচিত হচ্ছে। কবি সাহিত্যিকরা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশ করছেন পরিবেশ সম্পর্কে তাদের ভাবনা-চিন্তা। পাঠককে সচেতন করতে সমসাময়িক পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যাকে সাহিত্যের বিষয় করে তুলেছেন তাই তাঁরা। এই ধরনের সাহিত্য পরিবেশ সচেতন সাহিত্য, পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা পরিবেশবাদী সাহিত্য নামে পরিচিত। এই ধরনের সাহিত্যের সাহিত্যমূলক ছাড়াও একটি পরিবেশগত বা পরিবেশবাদী মূল্য আছে। সাহিত্য সমালোচনায়, সাহিত্য পাঠের তাই নতুন এক প্রস্থান তৈরি হয়েছে পরিবেশবাদী সাহিত্য সমালোচনা বা ইকোক্রিটিসিজম। এই আলোচনায় মূলত বাংলা সাহিত্যের পরিবেশবাদী গল্প নিয়ে আলোচনা করা হবে, দেখার চেষ্টা করা হবে গল্পগুলি কীভাবে ইকো টেক্সট হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের লেখকরা কীভাবে তাঁদের গল্পের মধ্যে পরিবেশ ভাবনা সম্পৃক্ত করে পরিবেশবাদী সাহিত্য রচনা করে চলেছেন এবং পাঠককে পরিবেশ ভাবনায় মগ্ন করে পরিবেশকেন্দ্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য সচেতন করে চলেছেন সেই দিক নির্দেশ করার চেষ্টা করা হবে মূলত এই আলোচনায়। )
সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে পরিবেশ চেতনা
একজন সার্থক শিল্পী তাঁর সাহিত্যে মনোরঞ্জনের পরিবর্তে মননধর্মিতার চর্চায় বেশি মনোযোগী হন। কথাশিল্পী সাধন চট্টোপাধ্যায় (১৯৪৪) এই মননধর্মিতার কথা বলেই বাংলা কথাসাহিত্যে দায়বদ্ধ শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সাহিত্যিক নয়, বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই বিজ্ঞানচর্চা এবং বিজ্ঞান চেতনা তাঁর গল্প উপন্যাসেও বিস্তর প্রভাব ফেলেছে। একইসঙ্গে তাঁর লেখায় রয়েছে পরিমিতি বোধ এবং এক বিশ্লেষণী জিজ্ঞাসা। তাঁর টেক্সটে ধরা থাকে সময় এবং আগামী সময়ের ভাষ্য। এপ্রসঙ্গে উপন্যাস সম্পর্কে বলতে গিয়ে তপোধীর বাবু বলেছেন–“সার্থক উপন্যাস তাকেই বলব যেখানে বয়নের সংকটময় সন্ধি মুহূর্ত ও আবর্তন বিন্দু ব্যক্ত হয় সময়ের বিভিন্ন চিহ্নায়কের মধ্য দিয়ে।”১ ঠিক একইভাবে ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। আমরা দেখি কথাকার সাধনবাবু তাঁর ছোটগল্পগুলির মধ্যদিয়ে একইভাবে সময়ের কথা বয়ন করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন, সামাজিক চাহিদা, বিশ্ব রাজনীতি প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন করে দেয়। সেই প্রকৃতি পরিবেশের বিনষ্ট হওয়ার চিত্র সময় ও সমাজ সচেতন কথাকার সাধন চট্টোপাধ্যায়ের দৃষ্টি এড়ায়নি। তাঁর গল্পের সংখ্যা যেমন বহুল তাই তাঁর বিষয়বৈচিত্র্য নানা রূপে রসে ভরা। এই বহুল বিষয়বৈচিত্র্যের মধ্যেই তাঁর গল্পের অন্যতম একটি বিষয় হয়ে উঠেছে প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতনতা। তাঁর পরিবেশ সচেতনামূলক গল্পগুলি হল- ‘একটি চুম্বনের জন্ম’ (পরিচয়, ১৯৮৭), ‘মহাপ্রাণের ঋণ’ (নির্মাণ, শারদীয়, ১৯৯৫), ‘ভুঁই জোনাকি’ (প্রমা, শারদীয়, ১৯৯৫)প্রভৃতি। গল্পগুলি আলোচনা করে দেখব লেখকের সচেতনতার গুণে কীভাবে গল্পগুলি পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা ইকো-টেক্সট হয়ে উঠেছে।
ভূমন্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ সাধারণত নিরপেক্ষ হলেও মূলত ইদানিংকালে উষ্ণতা বৃদ্ধিকেই নির্দেশ করা হয় এবং এটি মানুষের কার্যকর্মের প্রভাবে ঘটছে। গত এক দশকে প্রায় প্রতিবছর বিশ্বের গড় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আগের রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। এই ক্রমবদ্ধমান বিশ্ব উষ্ণায়ন বর্তমানে বিশ্ববাসীর কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধন চট্টোপাধ্যায় এই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রেক্ষাপটে আজ থেকে ৩৬ বছর আগে লিখেছেন ‘একটি চুম্বনের জন্ম’(১৯৮৭) গল্পটি। প্রচন্ড গরমে পুড়ছে চারপাশ। এই গল্পে ক্ষিতিমোহন স্কুল টিচার এবং একজন অসফল লেখক। তিনি গরমে পিস রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ভাবেন কালকের কাগজের হেডলাইন হবে-‘কোনদিন এদেশে বৃষ্টি হবে না? এই কর্কটক্রান্তীয় মহাদেশে শুধু ঘাস জ্বলবে, মাটিতে কাঁকর ফুটে উঠবে, তামার বর্ণ আকাশের নিচে কালো মানুষরা ঝিমিয়ে বোধির ক্রীতদাস হয়ে থাকবে?’ তীব্র গরমে ক্লান্ত ক্ষিতিমোহন, সে অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হয়েছে–‘সমস্ত দেহ নিংড়ে নাকের ডগা, থুতনি এবং কানের পাশ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা লবণাক্ত সাদা রক্ত পড়তে থাকে সে যেন পীড়নের উল্লাসে চারদিকে কাঁচা কয়লার কুণ্ডলী জ্বালিয়েছে।’ দিন দিন দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে কল-কারখানা এই কল-কারখানা বৃদ্ধির ফলে তা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে। আধুনিক জীবন যাপনে বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা তা থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে, শুধু তাই নয় মানবজাতি যত ভোগবাদী হয়ে উঠছে ততই প্রকৃতির উপর অত্যাচার করছে। শহর বাড়ছে, গ্রাম কমছে, হ্রাস পাচ্ছে গাছপালা ফলস্বরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন। এই যে প্রতিনিয়ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে কিন্নর রায় তাঁর ‘প্রকৃতি পাঠ’ উপন্যাসে বলেছেন-“যেন আইখম্যানের গ্যাস চেম্বারে সবাই একসঙ্গে বসবাস করছে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর প্রতীক্ষায়।”২
গল্পে আমরা দেখতে পাই গাছপালার হ্রাসের ফলে তাপও প্রবাহ বৃদ্ধির চিত্র। বর্তমানে প্রকৃতির ঠান্ডা হওয়া নেই মানুষ এ.সি আর ফ্যানের মতো যন্ত্রের উপর নির্ভরশীল। যন্ত্রের হাওয়ায় ক্লান্তি মুক্তি হয় না। তাই লেখক আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছেন–‘ফ্যানটা ঘুরছে। বিয়ে বাড়ির বাসি ফুলের মতো, যন্ত্রের বাতাসে কোন আকর্ষণ নেই।’ যন্ত্র সভ্যতার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বনভূমি হ্রাস প্রকৃতি পরিবেশকে ধ্বংস করছে ফলে ঋতুচক্র বিঘ্নিত হচ্ছে। সেই চিত্র গল্পকার গল্পে তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্ব ভাষায়–‘বাধ্য হলে, দু একটা কথা বলে মানুষ। যার বিষয় হল অসহ্য তাপ।
— বৃষ্টি হবে না।
—একটানা দু’মাস ধরে।
— মরে যাবে মানুষ।’
পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন এতই বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তাপে মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। শুধু মানুষ নয় জগতের সমস্ত প্রাণীকুল আজ ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি। তাইতো হিট স্টকে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক দশকে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্র আমরা কিন্নর রায়ের ‘ব্রহ্মকমল’ উপন্যাসেও দেখতে পাই–“অসহ্য গরম জুন মাসের আকাশে মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। পুড়ে যায় গা-হাত। পা-মুখ। প্রায় সত্তর ছোঁয়া রাঘবেন্দ্র সান্যাল কিছুতেই গরম সহ্য করতে পারেন না।”৩ এভাবেই বিশ্ব উষ্ণায়ন পৃথিবীর যে ঋতুচক্র তা বিঘ্নিত করছে এবং জীবকুলের ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স বিনষ্ট করছে।
গল্পে দেখি প্রবল গরমের মধ্যেও ক্ষিতিমোহন চল্লিশ মিনিট সাইকেল চালিয়ে লাইব্রেরী যান। লাইব্রেরীর মধ্যে মগ্ন হয়ে থাকেন তাই বাইরে যে কখন বৃষ্টি শুরু হয়ে ঠান্ডা বাতাস বইছে তা তিনি বুঝতে পারেন না। তাই নিজের অজান্তেই এই বৃষ্টিতে ভিজেছেন তিনি–‘ফোঁটা ফোঁটা জলের স্পর্শে শীতল বায়ু প্রবাহে ক্ষিতিমোহন নিজেকে বিস্মিত হল। কে যেন তাকে চুম্বন করছে। ব্যক্তি পরিচয় হারিয়ে, অপ্রত্যাশিত চুম্বনে সে গলতে শুরু করল। কী ঘন আনন্দের শিহরণ! মানুষ হাঁটছে বৃষ্টি মাথায়। কিন্তু জীবনের এই গোপন চুম্বন কোথায় ছিল? কে দিয়ে গেল? কিসের বিনিময়ে?’ তপ্ত পৃথিবীর বুকে নেমে আসা হঠাৎ বৃষ্টির ছোঁয়া ক্ষিতিমোহনের কাছে নারীর চুম্বনের তৃপ্তি বলে মনে হয়।
গল্পের শেষ লাইনে লেখক বলেছেন–‘রাস্তায় লুটিয়ে আছে দুর্বল ঝরা পাতা, ভাঙ্গা ডাল-পালা, কিছু বৃক্ষ, চালা, লোনাধরা ইট-কাঠ, পুরনো পাখির বাসা-কিছু অপরিহার্য ক্ষয়-ক্ষতি।’ বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে এবং বিভিন্ন সময় নানা স্থানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ঝড়ঝঞ্ঝার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতিতে এই ঝড়ঝঞ্ঝার ফলে প্রাকৃতিক কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। কারণ ঝড়ের প্রভাবে যেমন অনেক গাছপালা ভেঙে পড়ে তেমনি মারা যায় নানা পশু পাখি যা ইকোলজিকাল ব্যালেন্স নষ্ট করে। লেখক গল্প জুড়ে বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণ যেমন বর্ণনা করেছেন সেই সঙ্গে এই বিশ্ব উষ্ণায়ন কীভাবে ক্ষতি করছে সেই চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন। আজকের এই বিশ্ব উষ্ণায়নের ভয়ংকর পরিণতির অনেক বছর আগেই এই আখ্যানের মধ্যে দিয়ে লেখক পাঠককে সচেতন করতে চেয়েছেন।
১৯৭৪ সালে ৫-ই জুন প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। এটি পরিবেশ রক্ষার সচেতনতা এবং নতুন পদক্ষেপকে উৎসাহিত করতে রাষ্ট্রসংঘ পালন করে থাকে। ১৯৭৪ সালে এই বিশেষ দিনটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছে সামুদ্রিক দূষণ, মানব জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, বন্যপ্রাণের মতো পরিবেশগত বিষয়ের সচেতনতা বৃদ্ধির একটি স্বার্থে। আর ২০২১ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম ছিল ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা’। এই থিমের মধ্যদিয়েই বোঝা যায় যে আমাদের বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হয়ে গেছে। এই বাস্তুতান্ত্রিক সংকটের কথাই সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘মহাপ্রাণের ঋণ’(১৯৯৫) গল্পে আজ থেকে বহু বছর আগে বলেছেন। দূষণ যত বাড়ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থলজ এবং জলজ প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। জীব বৈচিত্রের আতুড়ঘর তাই ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। গল্পের শুরুতেই দেখি একটা বৃষ্টি ভেজা কেজি দেড়েকের ব্যাঙ পিচের রাস্তায় লাফিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে জানে না এই পৃথিবী তার বাস যোগ্যতা হারিয়েছে। দূষণ এবং যন্ত্র সভ্যতার আগ্রাসনে সে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন। প্রসব যন্ত্রণায় ব্যাকুল ব্যাঙটি প্রসব করার মতন সামান্য আশ্রয়টুকু পাচ্ছে না-‘ন্যাতানো মাংসল পা দুটোর আশ্রয়ে ব্যাঙটা হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলেছে একটি গর্ভ পেট, থকথকে ডিমরাশির একটি পিণ্ড। এক্ষুনি ঠেলে বেরিয়ে পড়বে সব। ঘাড়হীনমাথায় একজোড়া চোখ কেমন বোকাবোকা। ব্যথায় কেমন ঘোরঘোর। ব্যাঙটা আড়াল পেলেই বিয়োবে।’ তাইতো ব্যাঙটা একটু আড়াল খুঁজছিল। যেখানে সে প্রসব কাজটি সারতে পারে কিন্তু রাস্তায় গাড়ির ভিড়, ব্যাঙটা চেষ্টা করেও রাস্তা পেরোতে পারে না। শিবু এগিয়ে গিয়ে ব্যাঙটার পাছায় জুতোর ডগাটি দিয়ে আলতো একটা টুসকি দেয়। আর তাতেই উড়ে গিয়ে থপাস করে পড়ে কাঁদার ফুটপাথে। চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। শিবুর মনে হয় ব্যাঙটা মরে গেছে-‘শিবু নিজেকে বোঝাতে পারে না, এক-পেট-ডিমরাশি-প্রাণের কোটি কোটি অনু, যা একটু পরেই ফুটে বেরুত মাটির পৃথিবীতে, ফুলকা ও ব্যাঙ্গাচি পর্বের পর চুলবুলিয়ে ঘাসের আড়ালে মহাপ্রাণচক্রের কুশীলবের ভূমিকা পালন করত–অযথা শেষ করে দিয়ে কোথাও দায়ি রয়ে গেল নাতো?’ জীবের প্রধান বৈশিষ্ট্য বংশবিস্তার করা। সেই বংশবিস্তার করার জন্য যে সুস্থ স্বাভাবিক জায়গার প্রয়োজন সেই জায়গার আজ বড়ই অভাব, তাই মানবেতর প্রাণীকুলের বেঁচে থাকা আজ দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। তাইতো এই সমস্ত প্রাণী দিন দিন পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স। তাইতো বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ‘বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার’ থিম করে ঘটা করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
গল্পে লেখক ব্যাঙ্গের ছলে এক অতিপ্রাচীন সংস্কারের উল্লেখ করেছেন–‘…উল্টে রাখুন। নইলে সাত দিনেও আকাশ ধরবে না।’ এই কথার মধ্যদিয়ে লেখক ঋতু বৈচিত্রের বৈষম্যের কথাই তুলে ধরেছেন। প্রাণীকুল তার স্বাভাবিক বাসস্থানের অভাবে ক্রমশ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ বনভূমি যেমন হ্রাস পেয়েছে তেমনি জল, স্থল সবই আজ দূষিত। তাই বনভূমি হ্রাস এবং প্রাণের বিনাশ সার্বিকভাবে ইকোলজিকাল ব্যালেন্স নষ্ট করে দিয়েছে। ফলস্বরূপ দেখা দিয়েছে অনাবৃষ্টি এবং অতিবৃষ্টি। নষ্ট হয়ে গেছে ঋতুবৈচিত্র্য।
রাতে শিবু স্বপ্ন দেখে ব্যাঙের দৃষ্টিতে মানুষের মতো স্বস্তির হাসি। চোখের কোন থেকে এক ফোটা রক্ত গড়াচ্ছে। আর সে ক্রমে পরিণত হচ্ছে ব্যাঙে। সে স্বপ্নে দেখে–‘মস্ত থলথলে একটা গর্ভ, পেছনের দুই ঠ্যাংয়ে আড়াল দিয়ে রাস্তার পাশে হাঁসফাঁস করছে। রাস্তাটুকু পেরুবে। এত ব্যস্ততা কখনো দেখেনি রাস্তায়। ধোঁয়াধুলো, চাকা, হর্ন, কার্বন-মনোক্সাইড এবং নিষ্ঠুর উদাসীনতায় টায়ারগুলো ছুটছে স্যাটস্যাট। এত দ্রুত ছুটছে সব, ছিটোনো পেট্রলের ফোঁটাগুলো পর্যন্ত, শিবু ব্যাঙটিকে গাঢ় প্রলেপ দিচ্ছে। দম নিতে পারছে না। অসহ্য যন্ত্রণায় থলথলে গর্ভটিসহ শরীর ফাটিয়ে অপেক্ষা করছে। কিছুতেই এক টুকরো অবসর বা মুহূর্তের সুযোগ তাকে দেওয়া হচ্ছে না রাস্তাটা পেরিয়ে নির্জন একাকিত্বে মহাপ্রাণের কাছে আপন ঋণটুকু শোধ করতে পারে যাতে।’ বনভূমি হ্রাস পেয়েছে, কলকারখানার বৃদ্ধির ফলে বায়ু দূষণ যেমন বেড়েছে, তেমনি কলকারখানার দূষিত জল জলজ প্রাণীর বাসস্থানকেও ধ্বংস করেছে।ফলে কীট, পতঙ্গ এবং মানবেতর প্রাণীকুল তাদের জীবন ধারণের পরিবেশ হারিয়ে ফেলেছে। ফলে পৃথিবীর কাছে প্রাণীর প্রধান যে ঋণ বংশগতি রক্ষা করা সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য যে জায়গার দরকার সেই জায়গাটুকু আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন ভাঙ্গে শিবুর কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না–‘পৃথিবী নামক অতি পরিচিত গ্রহটির আকাশ ফুটো হয়ে রুদ্র-আলোককণা হর্ন, হেডলাইট এবং টায়ারের গতির লক্ষগুণ বেগে ছুটে আসছে এবং সেই পথের দুধারে কয়েক বিলিয়ন ব্যাঙ অপেক্ষা করছে কীভাবে পারাপার করবে লাফিয়ে লাফিয়ে।’ ওজন স্তর ভেদ করে ছুটে আসা ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি এবং প্রতিদিন যানবাহন থেকে উগরে দেওয়া কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড জনিত তীব্র দূষণে একাকার হয়ে গেছে প্রাণীর বাসরত পৃথিবী। এর প্রভাব পড়েছে বাস্তুতন্ত্রে, শিবুর মতো মানুষদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে। মানুষ তো একা বাঁচতে পারেনা, সে প্রত্যক্ষভাবে পরিবেশের একটি অংশ এবং বাস্তুতন্ত্রের এক অঙ্গ। তাই বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে শরিক হয়েই মানুষও বেঁচে থাকে। পরিবেশের পরিবর্তন এবং বাস্তুতন্ত্রের ভাঙ্গন মানুষের বেঁচে থাকাকেও কঠিন করে তুলেছে। বিপন্ন পরিবেশ মানুষের অন্তর্জগতেও ঘা দিয়ে যাচ্ছে। তাইতো জীবন ছন্দ আজ বিপন্ন।
বিশ্ব উষ্ণায়নে শেষ হয়ে যাচ্ছে কত প্রাণী। নষ্ট হচ্ছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য। বর্তমান অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে অতীতকে ফেরানো সম্ভব নয় ঠিকই কিন্তু আমরা গাছ লাগাতে পারি, জল দূষণ রোধ করতে পারি, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আর সমস্ত রকম দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণী ও উদ্ভিদ কূলের বাসযোগ্য করে তুলতে পারি আমাদের স্বর্গভূমি পৃথিবীকে। তাইতো আজ থেকে বহু বছর আগে লেখা সাধনবাবুর এই গল্পের প্রাসঙ্গিকতা এতোটুকুও কমেনি বরং আগের থেকে অনেক অনেক গুণ বেড়েছে। এভাবেই পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্যগুলি পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে।
‘ভুঁই জোনাকি’(১৯৯৫) গল্পে সাধনবাবু গাছপালা হ্রাসের ফলে পরিবেশ দূষণের চিত্র তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যানবাহনের বৃদ্ধির ফলস্বরূপ শব্দ ও বায়ু আজ দূষিত। তাইতো স্বর্গের অমৃত পান করা জোনাকি আজ নিশ্চিহ্ন। শব্দ আর বায়ুদূষণের বাড়াবাড়ির জন্যই মধুও শহরে না গিয়ে গ্রামেই পড়ে রয়েছেন শুধুমাত্র সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে বসবাস করার তাগিদে। তাছাড়া গল্পে বর্ণিত হয়েছে কীভাবে পতিত জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে এবং শহরগুলি কীভাবে গ্রামগুলিকে গ্রাস করে ফেলছে তার চিত্র। দিন দিন সমস্ত জায়গায় ঘর-বাড়ি অট্টালিকায় ভরে যাচ্ছে। জমির দাম যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি ফাঁকা জমির পরিমাণ প্রতিনিয়তই কমছে। লেখক বলেছেন–‘দু’বছর আগে সোজা তাকালে দেখতে পাওয়া যেত যখন, ঘরখানাকে মনে হতো জলকাছারি। এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে যত আশ্রয় গড়ে উঠছে, ততই বিষন্ন বোধ হয়। ৮০০ টাকা কাটা কিনেছিল এখন সাড়ে পাঁচ হাজার। তাও জমি কই? এভাবেই ফাঁকা জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে সমস্ত জায়গা বড় বড় অট্টালিকা এবং শপিংমলে গ্রাস করছে। লেখক কিন্নর রায় তাঁর ‘প্রকৃতি পাঠ’ উপন্যাসে গ্রামগুলিকে কীভাবে গ্রাস করে করে শহরের বিস্তার ঘটছে সেই বর্ণনা দিয়েছেন–“কলকাতা উত্তরে আর দক্ষিণে কতটা ছড়িয়েছে তার হিসেব ঠিক ঠিক বলে দেয়া বেশ মুশকিলের ব্যাপার। দক্ষিণে হরিনভি, শিবরামপুর, হরিদেবপুর, বোড়াল, ব্রহ্মপুর, জোকা, সোনারপুর, সুভাষগ্রাম, সবই বলতে গেলে কলকাতার কাছেই। আর উত্তরে দমদম, বাগুইহাটি, সল্টলেক, লেক টাউন পূবে ইস্টার্ন বাইপাস। কলকাতা এভাবেই মফ:স্বলকে গ্রাস করতে করতে হাত পা ছড়াচ্ছে।”৪ শহর, গ্রাম এবং গ্রাম্য প্রকৃতিকে গ্রাস করার ফলে কীটপতঙ্গ এবং পশু পাখি কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এবং ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ সেই চিত্রই বর্ণিত হয়েছে এই ‘ভুঁই জোনাকি’ গল্পে।
সাধন চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে পাঠকের জন্য নানা অভিমুখ থাকে। একমুখী বিষয় ভাবনা তাঁর গল্পের আঙ্গিক নয়। একই গল্প পাঠ করে পাঠক নানা দৃষ্টি কোন থেকে বিচার বিশ্লেষণ করতে পারেন। তবে এই প্রবন্ধে আলোচিত তাঁর গল্প তিনটি মূলত প্রকৃতি ও পরিবেশ চেতনা নির্ভর গল্প বলা যেতেই পারে। এই গল্প তিনটি পড়তে পড়তে আমরা যদি মুলের বিষয়ের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখব গল্পের আদ্যোপান্ত জুড়ে রয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণের কারণ এবং তা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা। লেখক বহুদিন আগে গল্পগুলি রচনা করলেও বর্তমান সময়ে গল্পগুলি আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে এখানেই পরিবেশকেন্দ্রিক সাহিত্য বা ইকো-টেক্সটগুলির অন্য ধরনের বিশিষ্টতা রয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১.ভট্টাচার্য, তপোধীর: উপন্যাসের সময়, এবং মুশায়েরা, জানুয়ারি-১৯৯৯, কলকাতা-৭৩, পৃ-২৮
২.রায়, কিন্নর: প্রকৃতি পাঠ, দে’জ, দ্বিতীয় সংস্করণ: নভেম্বর ২০০২, কলকাতা-৭৩, পৃ-৫৭
৩.রায়, কিন্নর: ব্রহ্মকমল, দে’জ, প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি-২০০৯,কলকাতা-৭৩, পৃ-৯
৪.রায়, কিন্নর: প্রকৃতি পাঠ, দে’জ, দ্বিতীয় সংস্করণ: নভেম্বর ২০০২, কলকাতা-৭৩, পৃ-৩৪