অমিত বসাক
লেখক পরিচিতি
(লেখক ২২ বছর ধরে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন অন্য কলেজে। সমবায় ব্যাঙ্ক ও অকৃষি সমবায় সমিতির ওপর গবেষণাধর্মী তার দুটি বই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা নতুন আঙ্গিকের একটি বই আমি মলে ঘুচিবে জজ্ঞাল। ভ্রমণ ও সমবায় বিষয়ক কিছু লেখা আজকাল ও গণশক্তি পত্রিকাতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্বার এ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণে পাহাড়প্রেমী লেখক বারবারই ছুটে গেছেন হিমালয়ে:কেদারনাথ,তুঙ্গনা্থ,রূপকুন্ড,বৈজনাথ,যজ্ঞেশ্বর,হর কি দুন, পিন্ডারী, কাফনি, মুন্সিয়ারি, প্যাংগং, সান্দাকফু এবং এরকম আরো অনেক জায়গায়।)
(প্রতি বছর ভাদ্র মাসের নন্দাষ্টমী তিথিতে উৎসবের সাঁজে সেঁজে ওঠে বৈদিনী। কুমায়ুন গাড়োয়ালের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা দর্গম কান্তার পেরিয়ে আসেন এই বুগিয়ালে।বৈদিনী কুন্ডে ডুব দিয়ে তারা পবিত্র হয়। পুণ্যার্জনের আশায় পূজো দেয় নন্দাদেবী মন্দিরের অধিষ্ঠাতা নন্দা মাকে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় উৎসব হল বড়িনন্দজাত। ঠিক প্রত্যেক ১২ বছর অন্তর এই অঞ্চলের কোথাও না কোথাও একটি চার শিঙা ভেড়ার জন্ম হয়। শেষে পাহাড় থেকে পাহাড়,গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এই খবর লোকমুখে পৌঁছে যায়। প্রত্যেকেই প্রস্তুত হয় উৎসব পালনের জন্য;নির্দিষ্ট দিনে দলে দলে পুণ্যার্থী এগিয়ে চলে শোভাযাাত্রা সহকারে। সামনে থাকে সুসজ্জিত সেই চার শিঙাবিশিষ্ট ভেড়া। এইভাবে শত সহশ্রাধিক মানব -মানবী এগিয়ে চলেন ওয়ান-বৈদিনী-পাতরনাচুনি-বগুয়াবাসা-রূপকুন্ড হয়ে হোমকুন্ডে। আশ্চর্যের বিষয় হল চার শিঙাওয়ালা ভেড়াটিকে পরবর্তীকালে আর কেহই দেখতে পায় না। সেই যে বড়া হোমকুন্ডে ছেড়ে দেওয়া হয় তারপর নাকি সে নিজ পথে এগিয়ে চলে তার লক্ষ্যে। এই সব মনকাড়া স্বপ্নের অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে শুরু হল এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় লেখকের নতুন ধারাবাহিক ভ্রমন কাহিনী “হিমালয়ের ডাইরীর” অংশ হিসেবে “রহস্যেঘেরা রূপকুন্ডের পথে ”)
প্রথম পর্ব
পাহাড়ে যখন উঠি তখন প্রতিবারই মনে হয় এটাই বুঝি শেষ,আর আসবো না। কি দরকার এত কষ্ট করার? কিন্তু নিচে আসলেই আর মন মানে না। আবার শুরু হয় পরের পরিকল্পনা পাহাড়ে যাবার-তুষারমৌলি হিমালয় আবার ডাকে-বেরিয়ে পড়ি। এ নেশা ড্রাগের নেশার থেকেও ভয়ঙ্কর-ঠিক টেনে নিয়ে যাবেই যাবে। এবার আমরাা চলেছি কোলকাতার CLIFF & CLARK ক্লাবের তত্ত্বাবধানে ১২ সদস্যের একটি দল দুর্গম গাড়োয়াল হিমালয়ের ১৭,৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত রন্টি স্যাাডলের উদ্দেশ্যে। আমরা যাব রূপকুন্ড হয়ে রন্টি স্যাডল। স্যাডল হল দুই পর্বতের সংযোগস্থলে ঘোড়ার জিনের মত একটা জায়গা। বাঁ-দিকে উঠে গেছে নন্দাঘুন্টি(২০,০০০ ফুট) এবং ডানদিক থেকে এসে মিলেছে ২৩,৩৬০ ফুট উঁচু ত্রিশূলের গিরিশিরা। ১৭,৭০০ ফুট উঁচুতে দুই পর্বতের এই মিলনভূমিই হল বিখ্যাত রন্টি স্যাডল। সামনে রন্টি হিমবাহ আর কাছেই ঋষিগঙ্গার গিরিখাত। অন্যদিকে চানোনিয়াকোট পাহাড়ের কোলে ১৬,৩০০ ফুট উচ্চতায় রূপকুন্ড একটি ছোট্ট প্রাকৃতিক হ্রদ। জিউরাঁগলি গিরিপথ থেকে নেমে আসা হিমিবাহ রূপকুন্ডকে ঢেকে রাখে প্রায় সারাটা বছর।
১৬ই অক্টোবর হাওড়া থেকে রওনা দিলাম হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে। ১৮ তারিখ সকাল ঠিক পাঁচটায় হরিদ্বারে ট্রেন থেকে নামতেই সামনে পেলাম সদা হাস্যময় পর্বতপ্রেমী সেই মানুষটিকে-সকলের প্রিয় রবীনদা (রবীন ব্যানার্জী);সঙ্গে গাইড কাম পোর্টার লাল সিং ও রাজীন্দ্রর সিং। সকাল সাতটায় বাস ছাড়লো-গন্তব্য লোহাজঙ্গ। একে একে পথে পড়ল ঋষিকেশ-দেবপ্রয়াগ-শ্রীনগর-রুদ্রপ্রয়াাগ-গোচর-কর্ণপ্রয়াগ-থরালীী-দেবল। প্রকৃতপক্ষে কর্ণপ্রয়াগের পর থেকে পিন্ডারের পাড় ধরেই গাড়ীর রাস্তা চলে গেছে। দেবল ফরেষ্ট বাংলোর নিচে গাড়োয়ালের কোয়েল ঝাঁপিয়ে পড়েছে কুমাঁউ এর পিন্ডারের বুকে। দেবল থেকে রাস্তাটি এঁকে বেঁকে ক্রমশঃ চলে গেছে বগরিগড়,মান্দোলী হয়ে লোহাজঙ্গ (৯,০০০ ফুট) পর্যন্ত। লোহাজঙ্গ পৌঁছালাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। বাংলো আগেই বুক করা ছিল।
১৯ তারিখ;বাংলোর বাইরে মন ভরে গেল-চোখের সামনে উত্তর দিকে নন্দাঘুন্টি-সাদা তুষার শৃঙ্গ। বাংলোর লনের দক্ষিণপ্রান্তে দাঁড়ালে নিচে দেখা যাচ্ছে বগরিগড়,পূর্ব আর পশ্চিমে সবুজ পাহাড়-মাঝে উপত্যকা-নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অনেকটা দূরে কোয়েল গঙ্গা। এ যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি-অপূর্ব সুন্দর। বাংলোর পিছনে দক্ষিণে দূরে দেখা যাচ্ছে গোয়ালদাম। অগ্নিকোণে লোহাজং এর সর্বোচ্চ বিন্দু-সবুজ ঘাসে ঢাকা সমতল পর্বতশীর্ষ আজিনটপ (১০,৫০০ ফুট)। পশ্চিমে ঘন অরণ্যে ঢাকা ১০-১২ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের ঢেউ। আকাশ রেখায় তারই দক্ষিণ বাহুটি দেবল হয়ে চলে গেছে থারালি। উত্তরের বাহুটি বিগুনতাল,ব্রহ্মতাল হয়ে প্রসারিত ওয়ানের দিকে । পাহাড়ের উচ্চতা,আবহাওয়া ইত্যাদির সাথে মানিয়ে নেবার জন্য (যাকে পরিভাষায় বলে Acclimatization) ১৯ তারিখ আমরা লোহাজং ই থেকে গেলাম। সকালে জলখাবার খেয়ে বাংলোর ঠিক পিছনে নন্দাদেবীর মন্দিরের পাশ দিয়ে আড়াআড়িভাবে রাস্তা চলে গেছে আজিন টপে। সামনে একটি ছোট্ট মন্দির। প্রায়ান্ধকার গর্ভগৃহের মাঝখানে চকচক করছে একটি শিবলিঙ্গ।
দ্বিতীয় পর্ব
পরদিন ২০ তারিখ সকাল সাতটায় খচ্চরের পিঠে মালমত্র চাপিয়ে রওনা দিলাম ৮ কিমি দূরের দিদনা (৯,০০০ ফুট) গ্রামের উদ্দেশ্যে। লোহাজং বাংলোর সামনে দিয়ে উত্তর পশ্চিম দিক দিয়ে রাস্তা এঁকে বেঁকে ক্রমশঃ নিচে নেমে গেছে। প্রায় দেড় কিমি যাবার পর একটা লোহার ব্রীজ পেলাম। আরও কিছুটা যাবার পর সামনে পড়লো কুলীন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর ডানপাশ দিয়ে ঝুড়ো পাথরের রাস্তা ক্রমশঃ নিচের দিকে নেমে গেছে। চির-পাইন-ওক গাছের ছায়াঘেরা পথ। আরও কিছুটা যাবার পর রাস্তাটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটা উপরের দিকে উঠে ক্রমশঃ ওয়ানের দিকে চলে গেছে। অপর পথটি ক্রমশঃ নিচের দিকে নীলগঙ্গার দিকে নেমে গেছে। এরপর একটা লোহার সাঁকো পেরিয়ে রাস্তা ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠে গেছে দিদনা গ্রামের দিকে। দেখলাম পাহাড়ের ঢালে রামদানার চাষ হয়েছে-চারদিক লালে লাল হয়ে আছে। আমরা গিয়ে উঠলাম গ্রামের স্কুলে। গ্রামটি দেখতে যেন অনেকটা বাটির মতো-মাঝখানে গ্রামটি আর চারদিকে একে ঘিরে রেখেছে পাহাড়ের সারি।
২১ তারিখ ভোর পাঁচটায় “সাব বেড টি রেডী ”,পোর্টার রাজীন্দ্ররের এই ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। ব্রেকফাস্ট সরে সকাল আটটা নাগাদ আমাদের দ্বিতীয় দিনের ট্রেক শুরু হল। আজ আমরা যাব আলি বুগিয়াল হয়ে বৈদিনী বুগিয়াল;প্রায় ১২ কিমি পথ। পৌছতে পৌছতে বিকাল হয়ে যাবে;তাই প্রত্যেকে প্যাক লাঞ্চ নিয়ে নিলাম। দিদনা গ্রামের স্কুল বাড়িটির পিছন দিক দিয়ে সরু পাহাড়ী রাস্তা এঁকে বেঁকে ক্রমশঃ উপরে উঠে গেছে। পথে শুরুতেই একটা ঝরণা পড়লো। আমরা চলেছি উত্তরমুখো-চির পাইন রডোডেনড্রনের ছায়াঘেরা পথ দিয়ে। প্রায় দুই ঘন্টা পর একটা সবুজ মাঠের মতো জায়গায় এসে পৌছালাম। চারদিকে বড় বড় গাছ;আর সামনে বেশ কয়েকটা পাথর দিয়ে তৈরী ঘর। পাহাড়ের ধার (Ridge)বরাবর ক্রমশঃ উত্তরদিকে যেতে লাগলাম। গাছপালার গভীরতা ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো-গাছের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূল ঝকঝক করছে। এইভাবে যেতে যেতে প্রায় একটা নাগাদ এসে পৌঁছালাম এক সবুজ প্রান্তরে-গাছপালার রাজত্ব প্রায় শেষ-শুধু ঘাস আর গুল্ম। যেদিকে তাকাই শুধু ঢেউ খেলানো সবুজ প্রান্তর। এক কথায় অপূর্ব। বুঝতে পারি আমরা চলে এসেছি গাড়োয়াল হিমালয়ের এক নম্বর বুগিয়াল আলি বুগিয়ালে। মাঝে একটা পাথরের ঘরে আমরা লাঞ্চ করলাম। প্রায় আধ ঘন্টা পর আবার হাঁটা শুরু হল। আলি বুগিয়াল দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ পাহাড়ের গা দিয়ে চলে গেছে ৩ কিমি দূরের বৈদিনীর দিকে। এইভাবে বেশ কয়েকটা বাঁক ঘুরতেই সামনে ঘন খয়েরি রঙ্গের উষর পর্বত চোখে পড়লো। তার নীচ পর্যন্ত প্রসারিত সমুদ্রতরঙ্গের মত সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ। পিছনে উত্তর দিকে নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূলের তুষার ধবল শৃঙ্গ। বৈদিনী ক্রমশঃ ঢালু হয়ে পশ্চিম দিকে নেমে গেছে;অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে বৈদিনী গঙ্গা-ওপারের পাহাড়ে ঘন জঙ্গল। বুগিয়ালে দেখলাম তিনটি পাথরের ঘর;সম্ভবত ওখানে ভেড়াওয়ালারা থাকে। রবীনদার নির্দেশমতো পর পর চারটি ট্রেন্ট খাটানো হল। ইতিমধ্যে কফি রেডী;সঙ্গে বিস্কুট চানাাচুর। পশ্চিম দিকে সূর্য ডুবে যাচ্ছে;আর তার লাল রঙ রাঙিয়ে দিচ্ছে একে একে নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূলের মাথাকে। রাতের ডিনার খিচুরি,ঘী আর ডিমভাজা খেয়ে তাড়াতাড়ি তাঁবুর মধ্যে ডুকে পড়লাম। রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে।
২২ তারিখ। অরূপমদার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে তাবুর বাইরে এসে আনন্দে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। এ কোথায় এসে পড়লাম-এই কি স্বর্গ। আস্তে আস্তে চারদিক আলোর বন্যায় ভেসে যেতে লাগলো-তুষার হিমালয়ের অঙ্গনে ঢুকে পড়েছে সূর্যের সোনার রথ। আর সেই আলোয় এক এক করে উদ্ভাসিত হতে লাগলো সব তুষার শৃঙ্গ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তরে এক এক করে বন্দরপুঞ্ছ,চৌখাম্বা,হাতিপর্বত,নীলকন্ঠ,নন্দাঘুন্টি,ত্রিশূল। আজ আমাদের ট্রেকিং এর বিরতি। এখানে এসে জানা গেল এ’বছর আগষ্টের পরে কোনো দলই রন্টি তো দূরের কথা রূপকুন্ডই যেতে পারে নি;সামনে একেবারে বরফের সমুদ্র। রবীনদার নির্দেশানুসারে অরূপমদা লাল সিংকে নিয়ে ফেরী করতে গেল। ঠিক হলো অরূপমদারা ফিরে আসলে আগামী কালের পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হবে। অন্যদিকে আমরা সবাই বৈদিনীর আশে-পাশে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম। বুগিয়ালের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের পিছনে দেখলাম একটি কুন্ড-বৈদিনী কুন্ড। কুন্ডের উত্তর পূর্ব দিকে নন্দাদেবীর মন্দির। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের নন্দাষ্টমী তিথিতে উৎসবের সাজে সেজে ওঠে বৈদিনী। কুমায়ুন গাড়োয়ালের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা দর্গম কান্তার পেরিয়ে আসেন এই বুগিয়ালে।বৈদিনী কুন্ডে ডুব দিয়ে তারা পবিত্র হয়। পুণ্যার্জনের আশায় পূজো দেয় নন্দাদেবী মন্দিরের অধিষ্ঠাতা নন্দা মাকে।।গাড়োয়াল কুমায়ুনের সবচেয়ে বড় উৎসব হল বড়িনন্দজাত। ঠিক প্রত্যেক ১২ বছর অন্তর এই অঞ্চলের কোথাও না কোথাও একটি চার শিঙা ভেড়ার জন্ম হয়। শেষে পাহাড় থেকে পাহাড়,গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এই খবর লোকমুখে পৌঁছে যায়। প্র্রত্যেকেই প্রস্তুত হয় উৎসব পালনের জন্য। নির্দিষ্ট দিনে দলে দলে শত সহস্র পুণ্যার্থী শোভাযাত্রা সহকারে এগিয়ে চলে-সামনে থাকে সুসজ্জিত সেই অলৌকিক চার শিঙা ভেড়া। এইভাবে দলে দলে অসংখ্য নর নারী এগিয়ে চলেন ওয়ান,বৈদিনী,পাতরনাচুনি,কৈলুবিনায়ক,বগুয়াবাসা,রূপকুন্ড হয়ে হোমকুন্ডে। আশ্চর্যের কথা হল চার শিঙাবিশিষ্ট ভেড়াটিকে পরবর্তীকালে আর দেখতে পাওয়া যায় না। সেই যে বড়াহোমকুন্ডে ছেড়ে দেওয়া হয় তারপর সেই দেবীর মানতের ভেড়া নিজ পথে এগিয়ে চলে তার লক্ষ্যে।
দুপুর ২টা নাগাদ দেখলাম দূরে পাহাড়ের গা দিয়ে ছয় সাতজন মানুষ এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা আমাদের তাঁবুর কাছে চলে আসলো। শুনলাম ওরা বগুয়াবাসার পর আর এগোতে পারে নি। কৈলুবিনায়কের পর শুধুই বরফ আর বরফ। পথ বলে কিছুই নেই। এরপর এগোতে হলে রোপ,আইস-এ্যাক্স ইত্যাদি সরঞ্জাম প্রয়োজন। ইতিমধ্যে অরূপমদারাও ফিরে এল। ওদের কাছে সামনের পথের বিস্তরিত সব শুনে ঠিক হলো আগামীকাল অরূপমদা,রঞ্জনদা,উত্তমদা,তাপসদা ও আমি রূপকুন্ডের পথে এগিয়ে যাব। বাদবাকী সবাই বৈদিনীতেই থেকে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি প্রথমে আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আর রাজী হচ্ছিলাম না। মাথায় শুধুই ঘুরপাঁক খাচ্ছিল সামনের পথের ভয়াবহতা ও দুর্গমতার কথা। কিন্তু রবীনদাই দিলেন মনের জোর-অনুপ্রেরণা। দেখা যাক কি হয়? রাজীও হয়ে গেলাম আগামীকাল নতুন উদ্যমে অরূপমদাদের সাথে পথে নামতে-রূপকুন্ডের দিকে এগিয়ে যেতে।
তৃতীয় পর্ব
পাহাড়ে যখন উঠি তখন প্রতিবারই মনে হয় এটাই বুঝি শেষ,আর আসবো না। কি দরকার এত কষ্ট করার? কিন্তু নিচে আসলেই আর মন মানে না। আবার শুরু হয় পরের পরিকল্পনা পাহাড়ে যাবার-তুষারমৌলি হিমালয় আবার ডাকে-বেরিয়ে পড়ি। এ নেশা ড্রাগের নেশার থেকেও ভয়ঙ্কর-ঠিক টেনে নিয়ে যাবেই যাবে।
এবায় আমরাা চলেছি কোলকাতার CLIFF & CLARK ক্লাবের তত্ত্বাবধানে ১২ সদস্যের একটি দল দুর্গম গাড়োয়াল হিমালয়ের ১৭,৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত রন্টি স্যাাডলের উদ্দেশ্যে। আমরা যাব রূপকুন্ড হয়ে রন্টি স্যাডল। স্যাডল হল দুই পর্বতের সংযোগস্থলে ঘোড়ার জিনের মত একটা জায়গা। বাঁ-দিকে উঠে গেছে নন্দাঘুন্টি(২০,০০০ ফুট) এবং ডানদিক থেকে এসে মিলেছে ২৩,৩৬০ ফুট উঁচু ত্রিশূলের গিরিশিরা। ১৭,৭০০ ফুট উঁচুতে দুই পর্বতের এই মিলনভূমিই হল বিখ্যাত রন্টি স্যাডল। সামনে রন্টি হিমবাহ আর কাছেই ঋষিগঙ্গার গিরিখাত। অন্যদিকে চানোনিয়াকোট পাহাড়ের কোলে ১৬,৩০০ ফুট উচ্চতায় রূপকুন্ড একটি ছোট্ট প্রাকৃতিক হ্রদ। জিউরাঁগলি গিরিপথ থেকে নেমে আসা হিমিবাহ রূপকুন্ডকে ঢেকে রাখে প্রায় সারাটা বছর।
১৬ই অক্টোবর হাওড়া থেকে রওনা দিলাম হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে। ১৮ তারিখ সকাল ঠিক পাঁচটায় হরিদ্বারে ট্রেন থেকে নামতেই সামনে পেলাম সদা হাস্যময় পর্বতপ্রেমী সেই মানুষটিকে-সকলের প্রিয় রবীনদা (রবীন ব্যানার্জী);সঙ্গে গাইড কাম পোর্টার লাল সিং ও রাজীন্দ্রর সিং। সকাল সাতটায় বাস ছাড়লো-গন্তব্য লোহাজঙ্গ। একে একে পথে পড়ল ঋষিকেশ-দেবপ্রয়াগ-শ্রীনগর-রুদ্রপ্রয়াগ-গোচর-কর্ণপ্রয়াগ-থরালীী-দেবল। প্রকৃতপক্ষে কর্ণপ্রয়াগের পর থেকে পিন্ডারের পাড় ধরেই গাড়ীর রাস্তা চলে গেছে। দেবল ফরেষ্ট বাংলোর নিচে গাড়োয়ালের কোয়েল ঝাঁপিয়ে পড়েছে কুমাঁউ এর পিন্ডারের বুকে। দেবল থেকে রাস্তাটি এঁকে বেঁকে ক্রমশঃ চলে গেছে বগরিগড়,মান্দোলী হয়ে লোহাজঙ্গ (৯,০০০ ফুট) পর্যন্ত। লোহাজঙ্গ পৌঁছালাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। বাংলো আগেই বুক করা ছিল।
১৯ তারিখ;বাংলোর বাইরে মন ভরে গেল-চোখের সামনে উত্তর দিকে নন্দাঘুন্টি-সাদা তুষার শৃঙ্গ। বাংলোর লনের দক্ষিণপ্রান্তে দাঁড়ালে নিচে দেখা যাচ্ছে বগরিগড়,পূর্ব আর পশ্চিমে সবুজ পাহাড়-মাঝে উপত্যকা-নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অনেকটা দূরে কোয়েল গঙ্গা। এ যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি-অপূর্ব সুন্দর। বাংলোর পিছনে দক্ষিণে দূরে দেখা যাচ্ছে গোয়ালদাম। অগ্নিকোণে লোহাজং এর সর্বোচ্চ বিন্দু-সবুজ ঘাসে ঢাকা সমতল পর্বতশীর্ষ আজিনটপ (১০,৫০০ ফুট)। পশ্চিমে ঘন অরণ্যে ঢাকা ১০-১২ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের ঢেউ। আকাশ রেখায় তারই দক্ষিণ বাহুটি দেবল হয়ে চলে গেছে থারালি। উত্তরের বাহুটি বিগুনতাল,ব্রহ্মতাল হয়ে প্রসারিত ওয়ানের দিকে। পাহাড়ের উচ্চতা,আবহাওয়া ইত্যাদির সাথে মানিয়ে নেবার জন্য (যাকে পরিভাষায় বলে Acclimatization) ১৯ তারিখ আমরা লোহাজং ই থেকে গেলাম। সকালে জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।বাংলোর ঠিক পিছনে নন্দাদেবীর মন্দিরের পাশ দিয়ে আড়াআড়িভাবে রাস্তা চলে গেছে আজিন টপে। সামনে একটি ছোট্ট মন্দির। প্রায়ান্ধকার গর্ভগৃহের মাঝখানে চকচক করছে একটি শিবলিঙ্গ।
পরদিন ২০ তারিখ সকাল সাতটায় খচ্চরের পিঠে মালমত্র চাপিয়ে রওনা দিলাম ৮ কিমি দূরের দিদনা (৯,০০০ ফুট) গ্রামের উদ্দেশ্যে। লোহাজং বাংলোর সামনে দিয়ে উত্তর পশ্চিম দিক দিয়ে রাস্তা এঁকে বেঁকে ক্রমশঃ নিচে নেমে গেছে। প্রায় দেড় কিমি যাবার পর একটা লোহার ব্রীজ পেলাম। আরও কিছুটা যাবার পর সামনে পড়লো কুলীন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর ডানপাশ দিয়ে ঝুড়ো পাথরের রাস্তা ক্রমশঃ নিচের দিকে নেমে গেছে। চির-পাইন-ওক গাছের ছায়াঘেরা পথ। আরও কছুটা যাবার পর রাস্তাটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটা উপরের দিকে উঠে ক্রমশঃ ওয়ানের দকে চলে গেছে। অপর পথটি ক্রমশঃ নিচের দিকে নীলগঙ্গার দিকে নেমে গেছে। এরপর একটা লোহার সাঁকো পেরিয়ে রাস্তা ক্রমশঃ উপরের দিকে উঠে গেছে দিদনা গ্রামের দিকে। দেখলাম পাহাড়ের ঢালে রামদানার চাষ হয়েছে-চারদিক লালে লাল হয়ে আছে। আমরা গিয়ে উঠলাম গ্রামের স্কুলে। গ্রামটি দেখতে যেন অনেকটা বাটির মতো-মাঝখানে গ্রামটি আর চারদিকে একে ঘিরে রেখেছে পাহাড়ের সাড়ি।
২১ তারিখ ভোর পাঁচটায় “সাব বেড টি রেডী ”,পোর্টার রাজীন্দ্ররের এই ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। ব্রেকফাস্ট সেরে সকাল আটটা নাগাদ আমাদের দ্বিতীয় দিনের ট্রেক শুরু হল। আজ আমরা যাব আলি বুগিয়াল হয়ে বৈদিনী বুগিয়াল;প্রায় ১২ কিমি পথ। পৌছাতে পৌছাতে বিকাল হয়ে যাবে;তাই প্রত্যেকে প্যাক লাঞ্চ নিয়ে নিলাম। দিদনা গ্রামের স্কুল বাড়িটির পিছন দিক দিয়ে সরু পাহাড়ী রাস্তা এঁকে বেঁকে ক্রমশঃ উপরে উঠে গেছে। পথে শুরুতেই একটা ঝরণা পড়লো। আমরা চলেছি উত্তরমুখো-চির পাইন রোডোড্রেনডেনের ছায়াঘেরা পথ দিয়ে। প্রায় দুই ঘন্টা পর একটা সবুজ মাঠের মতো জায়গায় এসে পৌছালাম। চারদিকে বড় বড় গাছ;আর সামনে বেশ কয়েকটা পাথর দিয়ে তৈরী ঘর। পাহাড়ের ধার (Ridge)বরাবর ক্রমশঃ উত্তরদিকে যেতে লাগলাম। গাছপালার গভীরতা ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো-গাছের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূল ।।এইভাবে যেতে যেতে প্রায় একটা নাগাদ এসে পৌছালাম এক সবুজ প্রান্তরে-গাছপালার রাজত্ব প্রায় শেষ-শুধু ঘাস আর গুল্ম। যেদিকে তাকাই শুধুই ঢেউ খেলানো প্রান্তর-অপূর্ব। বুঝতে পারি আমরা চলে এসেছি গাড়োয়াল হিমালয়ের এক নম্বর বুগিয়াল আলি বুগিয়ালে। হিমালয়ে গিয়ে বুগিয়াল দেখা নতুন কিছু নয়। পঞ্চকেদারের (কেদারনাথ,তুঙ্গনাথ,রুদ্রনাথ,কল্পেশ্বর,মদমহেশ্বর) অন্যতম তুঙ্গনাথে যাবার সৌভাগ্য আমার তিনবার হয়েছে। তুঙ্গনাথের পথেও দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ বুগিয়াল দেখেছি। কিন্তু আলি বুগিয়ালের সৌন্দর্য অসাধারণ;শুধুই সবুজ-দিগন্ত বিস্তৃত- যেদিকেই তাকাই শুধুই সবুজের ঢেউ। মাঝে একটা পাথরের ঘরে লাঞ্চ করলাম। এই পাথরের ঘরগুলি ভেরাপালকদের থাকবার জন্যই মূলত ব্যবহৃত হয়। প্রায় আধঘন্টা পর আবার হাঁটা শুরু করলাম। আলি বুগিয়াল দিয়ে সরু পথ পাহাড়ের গা দিয়ে চলে গেছে ৩ কিমি দূরের বৈদিনীর দিকে। এইভাবে বেশ কয়েকটা বাঁক ঘুরতেই সামনে ঘন খয়েরি রঙ্গের উষর পর্বত চোখে পড়লো। তার নিচ পর্যন্ত প্রসারিত সমুদ্রতরঙ্গের মত সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ। পিছনে উত্তর দিকে নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূলের তুষার ধবল শৃঙ্গ ঝকঝক করছে। বৈদিনী ক্রমশঃ ঢালু হয়ে পশ্চিমদিকে নেমে গেছে-অনেক নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে বৈদিনী গঙ্গা;ওপারের পাহাড়ে ঘন জঙ্গল। বুগিয়ালে দেখলাম তিনটি পাথরের ঘর-সম্ভবত ওখানে ভেড়াওয়ালারা থাকে। যাহোক রবীনদার নির্দেশমতো পরপর চারটি ট্রেন্ট খাটানো হল। ইতিমধ্যে কফি রেডী;সঙ্গে বিস্কুট চানাচূর। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ডুবে যাচ্ছে;আর তার লাল রঙ রাঙ্গিয়ে দিচ্ছে একে একে নন্দাঘুন্টি ও ত্রিশূলের মাথাকে। রাতের ডিনার খিচুরি,ঘী আর ডিমভাজা খেয়ে তাড়াতাড়ি তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়লাম। রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে।
২২ তারিখ-অরূপমদার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে তাঁবুর বাইরে এসে আনন্দে পাগল হয়ে যাবার উপক্রম। এ কোথায় এসে পড়লাম-এই কি স্বর্গ। আস্তে আস্তে চারদিক আআলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে-তুষার হিমালয়ের অঙ্গনে ঢুকে পড়েছে সূর্যের সোনার রথ। আর সেই আলোয় এক এক করে উদ্ভাসিত হতে লাগলো সব তুষারশৃঙ্গ-পশ্চিম দিক থেকে উত্তরে এক এক করে বন্দরপুঞ্ছ,চৌখাম্বা,হাতিপর্বত,নীলকন্ঠ,নন্দাঘুন্টি,ত্রিশূল। আজ আমাদের ট্রেকিং এর বিরতি। এখানে এসে জানা গেল এ বছর আগষ্টের পরে কোনো টীমই রন্টি স্যাডল তো দূরের কথা রূপকুন্ডই যেতে পারেনি-সামনে একেবারে বরফের সমুদ্র। রবীনদার নির্দেশানুসারে অরূপমদা লাল সিং কে নিয়ে বগুয়াবাসার দিকে ফেরী করতে গেল। ঠিক হলো ওরা ফিরে আসার পর আগামীকালের পরকল্পনা ঠিক হবে। আমরা বৈদিনীর আশে-পাশে ঘুরতে লাগলাম। বুগিয়ালের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের পিছনেই দেখলাম একটা কুন্ড রয়েছে-বৈদিনী কুন্ড। কুন্ডের উত্তর-পূর্ব দিকে নন্দাদেবীর মন্দির। প্রতিবছর ভাদ্র্র মাসের নন্দাষ্টমী তিথিতে উৎসবের সাজে সেজে ওঠে বৈদিনী। কুমায়ুন গাড়োয়ালের ধর্মপ্রাণ মাানুষেরা দুর্গম কান্তার পেরিয়ে আসে এই বুগিয়ালে। বৈদিনী কুন্ডে ডুব দিয়ে তাারা পবিত্র হয়। পুণ্য কামনার জন্য তারা নন্দা মাকে পূজা দেয়। কুমায়ুন-গাড়োয়ালের সবচেয়ে বড় উৎসব হল বড়িনন্দজাত। ঠিক প্রত্যেক ১২ বছর অন্তর এই অঙ্কলের কোথাও-না-কোথাও একটি চার শিঙা ভেড়ার জন্ম হয়। শেষে পাহাড় থেকে পাহাড়,গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে এই খবর লোকমুখে পৌঁছে যায়। প্রত্যেকেই প্রস্তুত হয় উৎসব পালনের জন্য। নির্দিষ্ট দিনে দলে দলে পুণ্যার্থী শোভাযাত্রা সহকারে পাহাড়ের পথ বেয়ে এগিয়ে চলে-সামনে থাকে সুসজ্জিত সেই অলৌকিক চার শিঙার ভেড়া। এইভাবে শত সহস্র মানব মানবী এগিয়ে চলেন ওয়ান-বৈদিনী-পাতরনাচুনি-বগুয়াবাসা-রূপকুন্ড হয়ে হোমকুন্ডে। আশ্চর্যের বিষয় হল সেই চার শিঙাওয়ালা ভেড়াটাকে পরবর্তীকালে আর কেহউ দেখতে পায় না। সেই যে বড়াহোমকুন্ডে ছেড়ে দেওয়া হয় তারপর নাকি সে নিজ পথে এগিয়ে চলে তার লক্ষে।
দুপুর ২টা নাগাদ দেখলাম দূরে পাহাড়ের গা দিয়ে ছয়-সাতজন মানুষ এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আমাদের তাঁবুর কাছে চলে আসলো। ওরা বগুয়াবাসার পর আর এগোতে পারে নি। কৈলু বিনায়কের পর শুধুই বরফ আর বরফ। পথ বলে আর কিছুই নেই। এরপর এগোতে হলে রোপ,আইস এ্যাক্স ইত্যাদি সরঞ্জাম প্রয়োজন। ইতিমধ্যে অরূপমদারাও ফিরে আসলো। তার কাছে বিস্তারিত সব শুনে রবীনদার নির্দেশানুসারে ঠিক হল আগামীকাল আমি,রঞ্জনদা,উত্তমদা,তাপসদা,অরূপমদা রূপকুন্ডের পথে এগিয়ে যাব। বাদবাকী সবাই বৈদিনীতে থেকে যাবে।
শেষ পর্ব
লাল সিং বরফ গলিয়ে চা তৈরী করলো। আস্তে আস্তে সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা অদ্ভুত রহস্যময় অপার্থিব পরিবেশ চারদিককে ঢেকে দিল। রাতের খাবার খিচুড়ি খেয়ে তাড়াতাড়ি Sleeping Bag এর ভিতর ঢুকে পড়ি। আমরা এখন প্রায় সাড়েচোদ্দ হাজার ফুট উপরে। এত উচ্চতায় অক্সিজেন স্বল্পতা আর প্রচন্ড ঠান্ডায় কি আর ঘুম আসে ? এপাশ ওপাশ করতে করতে আচ্ছন্নের মত সময় কাটে। হঠাৎ একটা গুম গুম শব্দ। হয়তো পাহাড় থেকে বিশাল বরফের চাই নেমে আসছে-হিমানী সম্প্র্রপাত-Avalanche । বাড়ির কথা আপনজনদের কথা শুধুই মনের আনাচে কানাচে ভেসে উঠছে। আগামীকালের পথ-রূপকুন্ডের পথ যে আরো ভয়ঙ্কর হবে,সেকথা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
চারদিকে সব সুউচ্চ পর্বতরাজির মধ্যে ছোট্ট অপরূপ হ্রদটি হল রূপকুন্ড। আর একে নিয়ে সব রহস্য। এর পাড়ে ছড়িয়ে থাকা মানুষের হাড় গোড়। ১৯৪২ সালের আগে হিমালয়ের এত ভিতরে অবস্থিত এই হ্রদটিকৈ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় নি। সেই বছর হরিকৃষ্ণ মাধোয়াল নামে এক ফরেষ্ট অফিসার চলেছিলেন ত্রিশূল পর্বতের দিকে যোগিপাদশা নামে এক বিরল প্রজাতির পাহাড়ী গাছের সন্ধানে। জিউরাঁগলি পৌঁছে তার নজর পড়ে এক অপূর্ব সুন্দর হ্রদের উপর। হ্রদের কাছে নেমে আসতেই চমকে উঠলেন তিনি। হ্রদের ধারে পড়ে আছে অসংখ্য নর কঙ্কাল। ১৯৫৫ সালে সরকারী সাহায্যে এই অঞ্চলে তিনি দ্বিতীয়বার অভিজান করেন। এরপর ১৯৫৬ সালে লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডঃ মজুমদারের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় দুটি অভিজান। অভিযাত্রীরা বরফের নীচ থেকে অনুসন্ধান করে নিয়ে আসেন মানুষের হাড়গোড়,পোষাক-পরিচ্ছদ,অলঙ্কার ইত্যাদি। সেগুলির রেডিও কার্বন টেষ্টের মাধ্যমে জানা যায় প্রায় ৫০০ থেকে ৮০০ বছর আগে ঘটেছিল এই ঘটনা। মৃতদেহগুলি কোন প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায় নিহত কোন তীর্থযাত্রীদের। অনেকের ধারণা কনৌজরাজ যশোদয়াল রাণী বল্লভাকে নিয়ে যাওয়ার পথে মর্মান্তিক দুর্যোগের শিকার হয়েছিলেন জিউরাঁগলি কলে।
২৪ তারিখ সকাল আটটায় বেড়িয়ে পড়া গেল রূপকুন্ডের উদ্দেশ্যে। প্রায় ৪ কিমি হাটতে হবে। পথ বলতে কিছুই নেই-চারদিক শুধুই সাদা আর সাদা-বরফের চাদরে মোড়া। হুনিয়াথর পর্যন্ত আস্তে আস্তে চড়াই বেয়ে উপরে উঠা। লাল সিং ও রাজীন্দ্ররের হাতে রোপ,আইস অ্যাক্স। অরূপমদা সবার আগে Route Open করে সামনের দিকে চলেছে;আর ওর পিছনে এক এক করে পথরেখা বরাবর জুতোর ছাচে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলা। কোন কোন জায়গায় শরীরের ভরসাম্য বজায় রাখা যাচ্ছে না;পা বরফে হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছে। অসাবধান হলেই খাড়া পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে হবে। ওদিকে পাল্লা দিয়ে হাওয়ার গতিও বাড়ছে। পথ ক্রমশঃ দুর্গম থেকে দুর্গমতর হতে লাগলো। অরূপমদার নির্দেশ মতো সবার কোমরে রোপ পড়ানো হল। লাল সিং আইস আ্যাক্স দিয়ে পথ করতে লাগলো;আর সেই বরফের সিঁড়ি ধরে কেবলই এগিয়ে চলা। শরীর যেন আর চলছে না। প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ চানোনিয়াকোটের তলায় পৌঁছান গেল। জিউরাঁগলির মাথা তখন সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। লাল সিং দেখায় ওই জিউরাঁগলির বাঁদিকে চানোনিয়াকোটের খাঁজের মধ্য্ লুকিয়ে আছে রূপকুন্ড। আর খুব বেশী হলে ৩০০-৪০০ ফুট যেতে পারলেই সেই স্বপ্নের রূপকুন্ডে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু উপরের দিকে তাকালে বুক শুকিয়ে যাবার উপক্রম। ভীষণ খাড়া শক্ত বরফে ঢাকা পাহাড়ের গা। ডানদিকে কচ্ছপের পিঠের মত শক্ত বরফের ঢাল। পা ফসকালেই অবধারিত মৃত্যু-বরফসমাধি। কোন দিকে তাকানোর অবকাশ নেই। জীবন মৃত্যুর সূক্ষ্ম সুতোর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। অবশেষে সাড়ে বারটা নাগাদ রূপকুন্ডে পৌঁছান গেল। ৫০/৬০ ফুট নিচে ঈষৎ নীলাভ বরফের পাতলা চাদরে ঢাকা ছোট্ট হ্রদ। হ্রদের জলটাকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই। উত্তরদিকে এই ভয়ঙ্কর সুন্দর কুন্ডের উপর ঝুকে আছে চানোনিয়াকোটের ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ওভারহ্যাঙ।
একথা ভাবলেই অবাক লাগছে যে তুষারে মৃত্যুর ছোঁয়া এড়িয়ে এই চরম লক্ষ্যে অবশেষে পৌঁছান যাবে। সেপ্টেম্বর থেকে সমগ্র পশ্চিম হিমালয়ে যে দুর্যোগ চলেছে তাতে রূপকুন্ড-রন্টি স্যাডল তো দূরের কথা বৈদিনী বুগিয়াল থেকেই আমাদের ফিরতে হত। যেকোন এ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় পাহাড়প্রেমী ট্রেকারের কাছে রপকুন্ড তো স্বপ্ন;রহস্যেভেরা সে জায়গা তো চিরকাঙ্খিত। হিমালয়ের অপার করুণা-পরমেশ্বরের অশেষ কৃপা রূপকুন্ডে অরূপমদা-লাল সিং-রাজীন্দ্ররের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পৌঁছান গেছে। রন্টির পথে সাফল্যের অন্তত একটি প্রস্তর ফলক কোলকাতার CLIFF & CLARK স্পর্শ করতে পেরেছে।