সৌমিতা রায় চৌধুরী
লেখক পরিচিতি
(প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বড়িশা গার্লস হাইস্কুল (দ্বাদশ)-এ পড়াশোনা। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিবেকানন্দ কলেজ ফর উইমেনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে ভর্তি। সসম্মানে সেখান থেকে স্নাতক হয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী প্রাপ্ত হয়ে সাংবাদিকতা পাঠক্রমে প্রবেশ। সসম্মানে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা প্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা। আকাশবাণী কলকাতায় ক্রীড়া সাংবাদিকতা বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা। লেখিকা সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের ৩৫ তম বংশধর।)
গানের ঋতু বসন্তকাল। গানের প্রয়োজনেই প্রকৃতি যেন নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে। রাঙিয়ে তুলেছে নিজেকে।
নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল,
বসন্তে সৌরভের শিখা জাগল।।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরলিপিতে পরজ-বসন্ত রাগে, দাদরা তালে এই গানটিই যেন বসন্ত ঋতুর প্রকৃতির জানান দেয়।
বসন্তের ছোঁয়ায় শীতের খোলস ছেড়ে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বৃক্ষরাজি। শিমুল, পলাশ, পারুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আকাশের নীল দিগন্তে ফুলের আগুনের মতই বিরাজ করে।
১৯১৫ সালে ইন্দিরা দেবীর স্বরলিপিতে বসন্ত রাগে ত্রিতালে
ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে —
ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে।
বসন্তের প্রকৃতির রূপই যেন ফুঁটে উঠেছে।
মাটির কাছাকাছি গাঁদা ফুলে হলুদ বাসন্তী রং পথকে রঙিন রাখে। এমনকি শুকিয়ে যাওয়া জলাশয়েও কল্মির ফুল জানান দেয়…
বসন্ত এসে গেছে
প্রকৃতির স্বভাব মতই প্রজাপতিরা ফুলের কাছে ভিড় জমায়। আর কোকিল তো বসন্তেরই পাখি। কুহু তানে জানান দেয়
আহা আজি এই বসন্তে,
এত ফুল ফোটে,
এত পাখি গায়
বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে যেমন দোলা লাগে, তেমন দোলা লাগে মনেও। গান ভেসে আসে
মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে
মধুর মলয় সমীরে মধুর মিলন রটাতে।
প্রকৃতিতে যেমন বসন্তের সাজ সাজ রব, নারীও তেমন প্রকৃতির মতই। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরিহিতা তরুণী, কিশোরীর পদচারণায় মুখরিত হয় ধরণী। সঙ্গী হিসেবে তরুণ, কিশোর পাঞ্জাবি পাজামায় সজ্জিত হয়ে বসন্তের উৎসবে সামিল হয়। তারা ডাক দেয়
ওরে গৃহবাসী,
খোল দ্বার খোল
লাগলো যে দোল,
জলে স্থলে বনতলে
লাগলো যে দোল
দ্বার খোল, দ্বার খোল।
দোলযাত্রা হিন্দুদের একটি সনাতন উৎসব। ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপিনীদের সঙ্গে রঙের উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। সেই থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি। দোলযাত্রার দিন সকালে রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহে আবির দিয়ে দেবদোল শুরু হয় এবং রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহকে দোলায় চড়িয়ে কীর্তন সহযোগে নগর ভ্রমণ করানো হয়।
প্রবীণ কীর্তনীয়া সরস্বতী দাসের মতে, দোলের রং লুকিয়ে থাকে বসন্ত কীর্তনের সুরের মাঝে। তাই বৈষ্ণব ভজনকুটিরে দোলের গান ভাসে অন্যভাবে। দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় গঙ্গার তীর ঘেঁষা সরস্বতী দাসের ছোট ভজনকুটিরের নিকোনো উঠোনে প্রতি বছরই বসে বসন্ত কীর্তনের আসর। শুধু রসিক শ্রোতার আমন্ত্রণ থাকে সেখানে।
আড়বাঁশির সুরে মৃদঙ্গ বাজছে সেখানে ‘তিন চার তিন চার’। ছন্দের ‘দোঠুকি’ তালে। কীর্তন রসভারতী সরস্বতী দেবী গলা মেলালেন,
গাওত কত রস প্রসঙ্গ বাজত কত বীণা
মৃদঙ্গ থইয়া থইয়া মৃদঙ্গিয়া
তারপর আখর দিলেন
মৃদঙ্গ বাজছে তা তা থুইয়া
তা তা থুইয়া
পূর্ববঙ্গে ‘থুইয়া’ শব্দের অর্থ ‘রেখে দেওয়া’। কৃষ্ণ সেবায় অদরকারী যে সব জিনিস তা রেখে দিয়ে বা ত্যাগ করে হোলি খেলতে এসো। অন্তর-বাহির কৃষ্ণভক্তির পাকা রঙে রাঙিয়ে নাও। ভক্তের সঙ্গে ভগবানের এই নিরন্তর হোলিখেলা।
আসর ঢলে চাঁদ যখন শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, ঋদ্ধ কীর্তনীয়ার কণ্ঠে ভর করেছেন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্ম — রবীন্দ্রনাথ। চোখটি বুজে সরস্বতী গাইছেন
আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা
প্রিয় আমার ওগো প্রিয়
চরাচর ভেসে যাচ্ছে সুরের মূর্ছনায়।
হোলি সংক্রান্ত লোককথা গুলি মূলত দুই প্রকার। প্রথমটি দোলের আগেরদিন পালিত বহ্নি উৎসব হোলিকা দহন এবং দ্বিতীয়টি রাধাকৃষ্ণের ফাগু খেলা কেন্দ্রিক অমর প্রেম কাহিনি। অশুভ শক্তিকে হারিয়ে শুভ শক্তিকে জাগরিত করার কাহিনি। রঙই যার কেন্দ্রবিন্দু।
দোলের আগেরদিন খড়, বাঁশ, কাঠ ইত্যাদি জ্বালিয়ে বিশেষ বহ্নি উৎসবের আয়োজন হয়। বঙ্গে যা ‘ম্যাড়াপোড়া’ নামে পরিচিত। বহির্বঙ্গে এই উৎসব ‘হোলিকা দহন’ নামে পরিচিত। উৎসবটি প্রধানত হিন্দুদের হলেও বৌদ্ধ, জৈন, শিখ এবং নেপালীরাও এই উৎসব পালন করে। শিখ ধর্মে এই উৎসবকে ‘হোলা’ বলা হত। গুরু গোবিন্দ সিংহ হোলিকে তিনদিনের ‘হোলা মহল্লা’ উৎসবে পরিণত করেছিলেন। যার সাথে মার্শাল আর্টও যুক্ত হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম বিশ্বেও এই উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু ক্যারিবিয় এবং দক্ষিণ আমেরিকার ভারতীয় বংশদ্ভুত সম্প্রদায়েও এই উৎসব পালন করতে দেখা দেখা যায়। যেমন গায়না, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে এটি দেখা যায়। মরিশাসেও এই দিনটি পালন করা হয়।
দোলযাত্রা উৎসব শান্তিনিকেতনে ‘বসন্ত উৎসব’ নামে পরিচিত। দোল পূর্ণিমার আগেরদিন ‘বৈতালিক’ হয়। দোলের দিন সকালে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীরা হলুদ বসনে সজ্জিত হয়ে, ছাত্রীরা খোপায় পলাশ ফুল গুজে
ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল
গানটির মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। গানে, নাচে পথ পরিক্রমা চলতে থাকে। এরপর একে একে
ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে
বনে বনে
রাঙিয়ে দিয়ে যাও
যাও যাও গো এবার সবার আগে
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়
করেছি যে গান
এ কি লাবণ্যে পূণ্য প্রাণ
প্রাণেশ হে
আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে
হলুদ, সবুজ, গোলাপি আবিরে রঙিন করে দেওয়া হয় এলাকা। সন্ধ্যায় গৌর প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথের কোনো নাটক বা নৃত্যনাট্য পরিবেশন করা হয়। দেশবিদেশ থেকেও বহু পর্যটক শান্তিনিকেতনের এই বসন্ত উৎসব দেখতে আসেন।
শান্তিনিকেতন-বোলপুর এলাকা — আর লোকসংগীত থাকবে না, তা-ও কী সম্ভব! সে কারণেই কানে ভেসে আসে বাউল গানের সুরে
আজি প্রেমানন্দের হাট বসেছে
প্রেমিকের হৃদয়ে,
প্রেমানন্দে ভাসছে প্রেমিক,
আত্মহারা হয়ে।
আরও শোনা যায়
বসন্ত বাতাসে সই গো
বসন্ত আসিল সখী
হোলি খেলে রে হোলি
শ্যাম চিকন কালিয়া
সারা বাংলা মায় দেশবিদেশ জুড়ে এই দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন উৎসব পালন করা হয়। দোলযাত্রার সঙ্গে নবদ্বীপের বাড়তি আকর্ষণ চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি। এই দুই উৎসব মিলেমিশে একাকার হয় এখানে। পাশেই মায়াপুরে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা পালিত হয়। বৈষ্ণবদের কাছে রাধাকৃষ্ণের লীলা এবং তাদের মানসপুত্র চৈতন্যদেবের জন্মতিথি, এই দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। দোল উৎসবের দিনই কল্যাণীর ঘোষপাড়ায় অনুষ্ঠিত হয় সতী মায়ের উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় এবং বিরাট মেলা বসে।
শুরুতেই বলা হয়েছে বসন্তকালে প্রকৃতি যেন সেজে ওঠে গানেরই জন্য। বসন্ত উৎসবের রং মনেও গানের মূর্ছনা তৈরি করে। আধুনিক কালে দোলের দিনগুলোতে কয়েকটি গান সারাক্ষণই বেজে চলে।
খেলব হোলি রং দেব না
ও শ্যাম যখন তখন
আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে
এলো রে এলো রে হোলি এলো রে।
হিন্দি গানের মধ্যেও হোলির গানের ভরপুর মেজাজ পাওয়া যায়।
রঙ্গ বরসে ভিগে চুনরওয়ালি
বলম পিচকারি
হোলি কে দিন দিল মিল যাতে হ্যায়
আজ না ছোড়েঙ্গে
হোরি খেলে রঘুবীরা
দোল উৎসব আধ্যাত্মবাদ এবং মানবতাবাদের মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি করে। তাই প্রাচীন যুগ থেকে আজও এই বসন্তোৎসব প্রকৃতই এক প্রাণের উৎসব।