তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি

(পঞ্চাশ বছরের ওপর সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা। অবশ্য সহস্রাধিক সুরারোপিত গানেরও রচয়িতা যেসব ইউটিউবার মেয়ে নিয়মিত আপলোডও করে চলেছে ইউটিউব  চ্যানেলে। কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়। প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। এই উপন্যাসও মূল রচনা ইংরেজিতে। বঙ্গানুবাদও লেখককৃত। পেশায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত একটি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক হলেও লেখকসত্ত্বাকে প্রথম পরিচয় বলে ভাবতে পছন্দ। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

অধ্যায় :পাঁচ 

কেউ চলেছে এদিকে, কেউ ওদিকে, আবার কেউ কেউ দুই বিপরীতমুখী ধারার উল্লম্ব দুদিকে, অথবা এভাবে তৈরি হওয়া চারটি তলের মিলনবিন্দু ভেদ করে কোণাকুণি নানাদিকে। সবাই এভাবে চলেছে যে যেদিকে পারে। বিভিন্নমুখী এমন নানাবিধ গমন চলছে সমস্ত মানুষের। দূরে কোন এক উচ্চস্থানে অবস্থানরত থেকে মনে হবে উদ্ভ্রান্তের মত সবার চলন, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের গতিপথকে কাটাকুটি করে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথায় কেন তার হিসেবে মাথায় না রেখে। অগোছালো, এলোমেলো চলছেই চলছে। মেলাতে এমনি চলমান লোকের ভিড়ে সে হারিয়ে গিয়েছিল ছোটবেলায়।                 

সে কারো সঙ্গে জুটে একবার এদিকে গেল আবার ওদিকে কিছুটা, তারপর যেকোন দিকে খানিকটা করে। গতিপথ ঘন ঘন পাল্টাতে পাল্টাতে দিগভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল একসময়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। কোন্ পথটা ঠিক, কেনই বা ঠিক, কোথায় গেলে কী হবে কিছুই তার মাথায় ছিল না। কী করা উচিত তাও বুঝতে পারল না। দাঁড়িয়েই রইল, কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানেও না। সম্বিৎ ফিরল একটা গলা শুনে,                                                       

‘তুই কি নতুন ? হারিয়ে গেছিস ?’                                                                                                                       

সে ফিরে তাকালো। বুদ্ধিদীপ্ত চোখের একটি ছেলে, সারা মুখাবয়ব আর শারীরিক ভাষায় সপ্রতিভতার ছাপ। ঋজু দেহকাঠামো দেখলে মনে হবে সোজা চলতেই অভ্যস্ত। বয়সে তার চেয়ে খানিকটা বড়ই হবে। সে তাকিয়েই রইল, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তার কথাও হারিয়ে গিয়েছিল, এমনই হয় সবার প্রথম প্রথম যারা মেলায় হারিয়ে যায়। তারা সবাই নতুন ভাষায় কথা বলতে শেখে মেলায় হারিয়ে যাওয়ার পর, যে ভাষা মেলার অন্যসব লোকেদের বোধগম্য। আসলে মেলার ভাষা আর চরিত্র একেবারেই অন্যরকম, থাকতে থাকতে এখানে শেখে সেসব মানুষজন।                        

‘আমার নাম কোটিকল্প। তোর মত আমিও মেলাতে হারিয়ে আছি। হারিয়ে গিয়েছিলাম কতদিন আগে নিজেও জানি না। আমারও অবস্থা হয়েছিল হারিয়ে যাওয়ার পর ঠিক তোরই মত। বুঝতে পারছিলাম না কী করব, কোথায় যাব, কোথায় থাকব। থাকতে থাকতে আর সবকিছু দেখতে দেখতে আমি এখন বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছি বলতে পারিস। এই মেলার নাড়ীনক্ষত্র আমার মত কে আর চেনে ?  আমার কাজটা আমি নিজেই ঠিক করে নিয়েছি। লোকজনকে দেখি, তাদের আচার-আচরণ, উদ্দেশ্য-বিধেয়, জীবনযাপন। দেখি আর নিজের মস্তিষ্কের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করি। মেলার সামগ্রিক চালচিত্র আর গতিধারা নজরে রাখি, কী বা কেমন হবে বোঝার চেষ্টা চালাই। বোঝাটা খুবই শক্ত যদিও, সবটা সবসময় বোঝাও যায় না, তবু আন্তরিক চেষ্টা থাকলে কিছু অন্তত আন্দাজ পাওয়া কারো পক্ষেই অসম্ভব হয় না। আর তোর মত যারা এখানে হারিয়ে যায় নতুন নতুন, তাদের হাত ধরে কিছুটা পথ এগিয়ে দিই, অন্তত যতক্ষণ না তাদের চোখমুখ খোলে। তারপর দেখি একদিন তারা নিজেরাই আমার হাত ছেড়ে দেয়, তাদের সবারই ডানা গজিয়ে যায়, কেউ আর আমার সঙ্গী হয়ে থাকে না। না থাকুক, আমার তাতে কোন দুঃখ বা কষ্ট হয় না। বরং মনে হয় কেউ ঘাড়ে চেপে ছিল এতদিন, বোঝাটা নামল আর স্বস্তি হল। নতুন যাদের এভাবে দু’দিন পর চোখ খোলে তারা তারপর দেখি এমন হয়ে গেছে যে চিনতেই পারি না, কোনদিন তারা আমারই হাত ধরে এই মেলাতে অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াত ভাবতেও তখন অবাক লাগে। এখানে যারা থাকে বা আসে তাদের সবারই চরিত্র একদিন এমন হতে বাধ্য। তোরও হবে, ভাবিস না। বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা ? ছবি তুলে রাখ্ তোর আজ, পনেরো-কুড়ি বছর পর মিলিয়ে দেখিস, কী বিপুল পাল্টে গেছে তোর চেহারা আর চরিত্র। চেহারা পাল্টায় বয়সের সঙ্গে সবাই জানে, চরিত্রও নিঃসন্দেহে, কিন্তু ওই পাল্টে যাওয়া আর আমি যে পাল্টে যাওয়ার কথা বলছি দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা। বোঝাতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়, বোঝাতে পারব কিনা বা তুই কতটা বুঝবি তাও একটা প্রশ্ন। তার চেয়ে ভালো হবে এখানে থাকতে থাকতে নিজেই যদি তা বুঝতে পারিস। ইচ্ছে থাকলে বুঝতে পারবি একশ’বার, সবাই পারেও। দুঃখ কোথায় জানিস, কী আমার পাল্টে গেল বা আমি কী ছিলাম আর কী হলাম এটা যাচাই করে দেখার ইচ্ছেটা করে না কেউ। মেলায় নতুন হারিয়ে যাওয়া অসহায় যাদের হাত ধরে আমি চলতে শেখাই, দু’দিন পর তারা সাবালক হলে তাদের বর্ণবিকাশ অন্যরকম হয়ে যায় যখন যদি তাদের বলতে যাই, ঘুরে দেখো, তুমি কেমন হলে বা দেখার ইচ্ছেটা মনে আনো একবার, তো তারা আমাকে হয়তো চাঁদা তুলে পেটাবে। আমি কাউকে কিছু বলতে যাই, পাগল ! কিচ্ছু বলি না, আমি কেবল দেখি, নিজের মনে ঘুরে বেড়াই, সব উপভোগ করি। আর নতুন যারা হারিয়ে যায় তাদের হাত ধরে চলতে শেখাই যতদিন না পাখনা গজায় তাদের। আয়, তোরও হাতটা ধরি।’                   

বহুক্ষণ কথা বলে হাত বাড়াল কোটিকল্প। সেও নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল অকূল সমুদ্রে কিছু একটা আশ্রয় হিসেবে পাওয়ার ভরসায়। হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত থেকে সে এমনই একটা ভরসা খুঁজে মরছিল। বড় অসহায় বড় একা মনে হচ্ছিল নিজেকে। হাতটা তাই ধরল শক্ত মুঠিতে, আর সঙ্গে সঙ্গে বুকে বল ফিরে পেল। যে নিঃসীম শূন্যতা তাকে ঘিরে রেখেছিল এতক্ষণ সে দেখল তা এখন ভরাট। এই মেলার ভিড়ে সে আর একা সঙ্গীহীন নয়। তার হাত ধরে তাকে নিয়ে এবার এগিয়ে যাবে স্বয়ং এমন একজন যে জানে এই মেলার ঘটনাপ্রবাহ কোন্ দিকে কিভাবে এগোয়। ওই একজন, যার নাম সে জানল কোটিকল্প, তার অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমার প্রক্রিয়ায়। সে কি এখন নিজেকে নিশ্চিন্ত ভাবতে পারে ? কোটিকল্প বলল আবার বলল,                                                                                                              

‘এখন থেকে যতদিন তুই আমার হাত ধরে চলবি দেখতে পাবি মেলার লোকজন কিভাবে কী উদ্দেশ্যে চলে। কী চায় এই লোকগুলি, কী ভাবনায় ব্যস্ত রাখে নিজেদের দিনক্ষণ স্পষ্ট হয়ে যাবে সব তোর কাছে। মানুষের কেমন চেহারা, কেমন চরিত্র, কী বৈশিষ্ট্য যত দেখবি তত অবাক হয়ে যাবি। একটি একটি মানুষ মানে একটি একটি পৃথিবী, সবই অন্তর্গত এই পৃথিবী নামক বাসস্থানের মানবসভ্যতায়। কত রহস্য, কত বৈচিত্র্য লুকিয়ে রয়েছে এখানে না দেখলে তোর বিশ্বাসই হবে না। যদি আমার হাত ধরে রাখার ধৈর্য থাকে তো দেখার চোখ পেয়ে যাবি। তখন তুই বুঝবি, যাদের যে পরিচয়ে দেখে যাচ্ছিস দিনরাত তারা আসলে মোটেই তা নয়। সবাই তারা অন্যরকম, কার্যকলাপে ও পরিচয়ে। এই চোখ তোর থেকে যাবে যতদিন আমার সঙ্গে আমার হাত ধরে আমি যেভাবে যেপথে চলছি অনবরত সেভাবে চলাচলের মানসিকতা থাকে তোর। যেদিন আমাকে ভুলে যাবি, আমার হাত ছেড়ে দিবি তোর এই ক্ষমতা চলে যাবে। তুইও তখন হয়ে যাবি মেলার আর দশজন লোকের মত। সবাই যা ভাবে তুইও তা ভাববি, যা করে করবি, যেভাবে চলে চলবি। তোর সঙ্গে অন্য লোকজনের আর কোন পার্থক্য থাকবে না।’                                                                                                      

কথাগুলি শোনাচ্ছিল কোটিকল্প হাত ধরে চলতে চলতে। তার চলার পথ একমুখী, থামে না বা পিছন ফিরে তাকায় না। কে চলল না-চলল তার ভ্রূক্ষেপ নেই, সে চলে নিজের ছন্দে নিজের খেয়ালে অবিরাম গতিতে। যে না চলে সে তাকে চলতে বলে না, যে চলে সে তাকে সঙ্গে রাখে, ফেলে এগিয়ে যায় না। চলুক বা না-চলুক সবাই বা সবকিছু তার চলাচলের ওপর নির্ভরশীল, এটা  বুঝেও কেউ বোঝে না। তাতে তার চলাচল আটকায় না। সে তার চলার পথে দেখে যায় কে কেমন, জানে সে জগৎ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় তার পথেই চলমান। কেন চলে সবাই তার সঙ্গে সেটা কি সেও জানে ? এমনকি সে নিজে কেন চলছে তার কোন ব্যাখ্যা বা যুক্তি সে সাজায় না। তার কোন সঙ্গী নেই, তাকে যারা আদর্শ ভেবে মর্যাদা রাখার চেষ্টা করে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও সে তাদের পুরষ্কৃত করে। সে হাতে ধরে দেয় না কাউকে কিছুই, পুরষ্কার যে পাওয়ার সে তবুও তা ঠিক ঠিক পেয়ে যায়।                                                                                                      

‘মেলার এই মানুষজন বড়োই বিচিত্র,’ হাত ধরে চলতে চলতে জানাচ্ছিল তাকে কোটিকল্প, ‘দ্যাখ্ না তাদের সাজগোজের ঘটা। গায়ে কতরকম পোশাক-আসাক। দেখতেও কেউ এক নয়, নানাবিধ চেহারা-চরিত্র। আবার দ্যাখ্, প্রত্যেকেই রঙের কারবারি। রকমারি রঙ দিয়ে সাজায় তাদের আজ-কাল-পরশু। তারা কখন হাসে কেন হাসে, কখন কাঁদে কেন কাঁদে বুঝতে গেলে থৈ পাবি না। আমি তাদের দেখি আর ভাবি, কেন এত রঙ মেখে সঙ সাজে সবাই। আমার চলন চলছেই, তারা কি তার খবর রাখে না ? আমার সঙ্গে কেন তারা চলতে পারে না ? কেন আমার হাত ধরতে চায় না ? আমি তো হাত বাড়িয়েই আছি। তারা ধরেও কেন ছেড়ে দেয় ? কেন আমাকে, আমার চলনকে দেখেও দেখতে পায় না ? আমি তো চলি আমার নিয়মে। থামি না, বসে থাকি না, এগিয়ে যাই। সবাই কিন্তু আমাকে চেনে, তবুও না চিনে থাকতে চায়। তারা কেউ মানতে চায় না আমার উপস্থিতি। এ এক আজব বিস্মরণ। কী  এক মোহ সবাইকে আচ্ছন্ন করে রাখে ! আমি সবাক হতে জানি না, নীরব থাকি, কিন্তু আমি প্রবলভাবে চলি আর চালাই। মানুষরা যারা মেলাতে আছে তারা সবাই মশগুল আনন্দে। আমি উহ্য হয়ে যাই।’                                                                                                                          

হাত ধরে তাকে চালাচ্ছিল কোটিকল্প, বলতে বলতে কথাগুলি। সে চুপ করে শুনতে থাকে। কী  বলবে বুঝতে পারে না। জনস্রোতের দিকে চোখ থাকে যদিও শুনতে কিছু ভুলে যায় না। সে যেমন কী বলবে বুঝতে পারে না তেমনি কিছু বলার সুযোগও পায় না। অপরপক্ষ তার কথা শোনার অপেক্ষা করে না, আপন খেয়ালে বলতেই থাকে,             

‘মেলা কিন্তু চিরকালই জমজমাট। হয়তো এখন যাদের দেখছিস তাদের আর কোনকালে দেখতে না-ও পারিস। দেখবি না কোনদিন, সেটাও কিন্তু জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। এমন লোকজনও দেখতে পাবি যারা বরাবর দলবদ্ধ হয়ে থেকে যায়, সেই দলে সব চেনামুখ। তবে তারা অনন্তকাল এভাবে থাকতে পারে না কোনক্রমেই। কোন না কোন একদিন আজ যে মুখগুলি মেলায় আছে তাদের জায়গায় অন্য মুখেরা চলে আসে। ব্যাপারটা এমনই নিঃশব্দ নিয়ম মেনে ঘটে যায় যে কোন একদিন সমস্ত মুখগুলি পাল্টে যাওয়া সত্বেও এতবড় পরিবর্তনটা কেউ টেরই পায় না। মেলার একটি প্রজন্ম এভাবে লোকচক্ষুর সামনে থেকে পুরোপুরি পাল্টে নীরব ছন্দে অন্য প্রজন্মে রূপান্তরিত হয়, হতেই থাকে, লোকজন দেখলেও তা নজরে আনে না। আমি আমার চলাচলের প্রক্রিয়ায় এমন রহস্য দেখেই আসছি, সমস্ত তথ্য আমার গোচরীভূত। মেলায় এত বিচিত্র জনসমাবেশ, এই বিপুল জনসমষ্টির সবাই চলছে মোহাচ্ছন্ন ভূতে পাওয়া অস্তিত্বের মত। অথচ প্রত্যেকেই অতিমাত্রায় সতর্ক, নিজের পাওনাগণ্ডা চুলচেরা হিসেবে বুঝে নিতে ওস্তাদ। এমনই বুদ্ধিমান এই জনরাশির প্রত্যেকটি সদস্য যে তুই তাদের তারা যা বোঝে তার অন্যকিছু বোঝাতে পারবি না। ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তিগত লাভক্ষতি সম্পর্কে কাউকে বোঝানোর কিছুই বাকি আছে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই জনরাশিকে ঠকাবে এমন সাধ্যি করোও নেই। নাহলে এমন সভ্যতা তারা গড়ে তুলতে পারে ? তারাইতো তাই শিল্পবিপ্লব ঘটিয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব এনেছে। এমনকি, জীবনকে কালোত্তীর্ণ করার অসম্ভবকেও হস্তগত করার প্রতিজ্ঞায় অটল থাকার দুঃসাহস সামনে রেখে সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা ও পরিচয় পাল্টে দিতে চলেছে। এই মেলার ভিড়ে সামিল এমনই সব মানুষরা। তাদের দেখে আপাতদৃষ্টিতে তোর মনে হবে চালচলনে সবাই বিশৃঙ্খল, সবাইকে এক এক করে দেখলে সেটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু এই জনতার সামগ্রিক চেহারাটা শৃঙ্খলাবদ্ধ। এতসব ইতিবাচক বিষয় থাকলেও গোড়ায় কিছু গলদ বর্তমান। মজা কী জানিস, এখানে যেভাবে যারা আছে তারা ভুলে যায় কিভাবে, কোথায়, কেন আছি। তারা ভাবে, যেখানে যেভাবে আছি সেটা সেভাবে আমার চিরকালীন বাসস্থান। তাই তারা সেই স্থানকে সর্বাধিক আরামপ্রদ বানাতে গিয়ে ন্যায়-অন্যায়, ভুলভ্রান্তির কালোত্তীর্ণ প্রচলিত সংজ্ঞা ও ধারণাগুলোকে ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মত করে নেয়। ব্যক্তিবিশেষের এই সংকট শেষপর্যন্ত আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক থাকে না, ব্যক্তিসমষ্টিও তাতে আক্রান্ত হয়ে যায়। সমাজ ও সভ্যতা তখন সামগ্রিকভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে, ভ্রান্ত মোহের বশবর্তী চলাচল তখনই দিশা হারিয়ে ফেলে। লক্ষ্য যা ছিল তা যদিওবা একই মনে হয়, সেখানে যাওয়ার পথ ও চলন দেখতে আপাতসহজ লাগলেও কিন্তু ভুল হয়ে যায়।’                                                                   

একটানা কথা শোনাতেই থাকে কোটিকল্প। তার শুনতে খুব যে বিরক্তি লাগে এমন নয় মোটেই। বরং সে যত শোনে তত বুঝতে শেখে চারপাশ। সে তো হারিয়েই যেতে বসেছিল মেলার মধ্যে জনপ্রবাহে, দৈবাৎ দেখা পেল এমন এক সূত্রধরের যে তাকে ভরসা জোগাল আর হাতটি ধরে এগিয়ে চলার পথ দেখাচ্ছে। সত্যিই সে চিনত না বুঝত না এই বিচিত্র জনস্রোতের চরিত্র, এই বিশেষ জনসমষ্টির মিলন ক্ষেত্রটিকে। যে তাকে এত যত্ন নিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তার কথা না শোনা তো বোকামি। এই অকূল ভিড়ে সঙ্গীহীন সে তো ছিল এমনই কোন সঙ্গীর আকুল অপেক্ষায়। যখন তেমন কাউকে পেল তাকে কেন অসহ মনে হবে ?                                                                                                                                          

দীর্ঘ সময় চলতে চলতে আর কথা বলতে বলতেও অক্লান্ত কোটিকল্পের হঠাৎ মনে হল, তার শ্রোতাটি প্রথম থেকেই নির্বাক ও নিরুত্তর। তার নিজের তো এমন থাকার কথা, কেবল এগিয়ে চলা ধর্ম যেহেতু। অথচ সে একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে, শ্রোতাটির কোনরকম প্রতিক্রিয়াই নেই। কেন ? সে কি বুঝতে পারছে তার কথা ? আদৌ শুনছে তো ? নাকি তার সমস্ত কথা অশ্রুত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ? এই সঙ্গত প্রশ্ন মনে জাগায় সে চুপ করল, যদিও চলা থামাল না। একটু সময় চুপ থেকে সে গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে প্রশ্ন করল,                                                                              

‘আচ্ছা, আমি কী বলে যাচ্ছি তুই কি শুনছিস ?’                                                                                                     

প্রশ্ন শুনে তার একটু অবাক লাগল। সরাসরি প্রশ্ন যখন কিছু তো এবার বলতেই হয়। এখানেই যত তার দ্বিধাদ্বন্দ, বলতে গিয়ে মুখে কথা ফোটে না। কেন, তা বোঝে না নিজেও।                                                                

‘কি রে, কিছু তো একটা বল্। এক তো আমিই বকে যাচ্ছি তখন থেকে। হারিয়ে গেছিস তা তো বুঝলাম। তার বৃত্তান্ত নাহয় পরে বলবি। কিন্তু এত যে কথা বলছি সেসব শুনছিস কিনা সেটা তো জানাবি ? কথাগুলি তোর পছন্দ কি অপছন্দ তা পরের কথা। শুনছিস তো ?’                                                                                                                           

এবার তো তাকে তাকে কিছু একটা উত্তর দিতেই হয়। তবুও যতক্ষণ মুখে শব্দ উচ্চারণ না করে পারা যায় এমন মনোভাবে আবদ্ধ থাকার বাসনায় সে ঘাড় কাৎ করে বোঝাল যে শুনছে। এভাবে উত্তর দিয়েই তার মনে হল প্রশ্নকর্তা কেবল একটানা চলনশীলই নয়, এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখাতেও উৎসাহী নয়। তার এই নির্বাক উত্তর সে তো দেখতে পেল না। অতএব মুখে কথা না বলে উপায় নেই। তাকে তাই বলতেই হল,                                                            

‘হ্যাঁ, শুনছি। বুঝতেও পারছি।’                                                                                                            

‘ভালোকথা। এবার তাহলে তুই বরং তোর কথা বলতে পারিস। তোর পরিচয়, তোর হারিয়ে যাওয়া, তোর ইচ্ছে-অনিচ্ছে যা তোর খুশি। আর নয় তো পরেও বলতে পারিস। যাকগে, ছেড়ে দে, পরেই নাহয় বলিস। আমি যে খুব জানতে চাই তাও নয়। কারণ তোর বিবরণ আমার জানা। তবুও বলতে বলছি এজন্য যাতে তুই কিছু বলার সুযোগ পাস্।’              

শুনে সে বেশ অবাক হল। কথা বলতে তার কোন দ্বিধাবোধ নেই এখন। সটান এবার প্রশ্ন করল,            

‘আমার কথা তুমি জানলে কী করে ?’                                                                                                            

‘সবার কথাই জানি আমি। না জেনে উপায় নেই। বলেছি তো তোকে, এখানে চলতে শেখে সবাই আমার হাত ধরে। সূচনা সেই হারিয়ে যাওয়া থেকে। কিভাবে হারায় সবাই দেখছি সবসময়। কারো ক্ষেত্রেই আলাদা কিছু হওয়ার জো নেই। তোর ক্ষেত্রেও হবে কেন ?’                                                                                                                                           

উত্তরটা কি পছন্দসই হল তেমন ? আপাতদৃষ্টিতে তেমন অবাস্তব মনে না হলেও একটু যেন কেমন-কেমন। তবুও মেনে নিতেই হল। তা সত্ত্বেও যা অপছন্দ সেটা জানবার জন্য উপযুক্ত জিজ্ঞাসা খুঁজে বেড়াতে লাগল। এই অবকাশে কোটিকল্প আবার বলল,                                                                                                                            

‘আমার হাত ধরে চলার একটা মুশকিল আছে। তোকে কেবলই চলতে হবে। থামতে পারবি না, বিশ্রামও পাবি না। কারণ আমি চলতেই থাকি, থেমে যাই না কখনো। একটানা চলনই আমার স্বভাব আমার ধর্ম।’                                            

এমন হয় কেউ ? সে মেলার চরিত্র বা লোকজন কী দেখবে ? তাকে দেখেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। যত দেখছে ততই অবাক হয়ে যাচ্ছে। কেন সে সবার সব তথ্য জানে ? কেন সে কেবলই চলে, কখনো থামে না বা বিশ্রাম নেয় না ? কেন সে মেলার ভিড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ? কেন যে হারায় এখানে তার হাত ধরে সে এগিয়ে নিয়ে যায় ? কেনই বা তার কথা সবাই ভুলে যায় একসময় ? একের পর এক এমন প্রশ্নগুলি মাথার মধ্যে আসতে লাগল ক্রমাগত। মেলার ভিড় দেখে এতক্ষণ সে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, এবার সে বিস্ময়াভিভূত হল তার কথা ভেবে। এই যে তার হাত ধরেছে, তার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে, তার কথা শুনছে, তাকে তো সে দেখছে না তাকিয়ে ! এবার সে চোখ ফেলল তার দিকে। মনে হল অনেক কালের চেনা কেউ। এমন কেউ যাকে সে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু কী মুশকিল, কিছুতেই মনে করতে পারল না কিভাবে তার সঙ্গে কবে কোথায় দেখা হয়েছিল। এত চেনা কেন মনে হচ্ছে ? হতভম্বের মত সে প্রশ্ন করল,                                    

‘তুমি কে বল তো ? কোথাও না কোথাও আগে নিশ্চয় দেখেছি।’                                                                             

তার প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসল কোটিকল্প, রহস্যজনক মেজাজে। সাবলীল ভঙ্গিতে জবাব দিল,                       

‘কোথায় কখন না দেখেছিস ? কেন যে মনে করতে পারছিস না ! তোর সঙ্গে আমার আজন্ম বন্ধুত্ব, আমৃত্যুও বলতে পারিস। ভুলে গেলি কী করে ? অরে ভাই, এটাই তো আমার দুর্ভাগ্য। তোর মত সবাই আমাকে ভুলে যায়। আর তাই হাতটা ছেড়েও দিতে পারে।’                                                                                                                               

কথাটা কি সত্যি ? সে বুঝে উঠতে পারল না। আবার নিশ্চিতভাবে মিথ্যে বলেও মনে হচ্ছে না, কারণ মুখটা বড়ই চেনা। অন্য আরও প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তেমনই একটি প্রশ্ন সে এবার মেলে ধরল ,                        

‘মেলার সমস্ত চরিত্র তুমি জানলে কী করে ? কেবল ঘুরে ঘুরে এতকিছু জানা যায় না। অন্য কোন ব্যাপার অবশ্যই আছে। আছে না কি ?’                                                                                                                                            

‘আছে তো !’ তার গলাতে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি নেই, ‘মেলাতে কেবল আমিই ঘুরে বেড়াই না, মেলাও চলে আমার সঙ্গে।ঘোরে সে আমি যেভাবে ঘুরে বেড়াই। আমি চলছি বলেই মেলা জমছে, বা বলতে পারিস, মেলা চলছে।’                                  

‘কিন্তু তুমি কে ?’                                                                                                                                               

আবারও হাসল কোটিকল্প। বলল,                                                                                                 

‘উত্তরটা জানিস, তবুও বুঝতে পারছিস না।’                                                                                                    

‘না, বুঝতে পারছি না। বলে দিলেই তো পারো।’  

‘সাময়িক ভুলে গেছিস, আবার ঠিক মনে পড়বে। নিজেই বুঝতে পারবি। ছেড়ে দে না, আমাকে নিয়ে পড়ে কোন লাভ নেই তোর। বন্ধু বলেই ভাব না, ল্যাঠা চুকে যাবে। হারিয়ে যাওয়া ভুলে যাওয়া কোন বন্ধু। থাকতেই তো পারে। সেসব বাদ দিয়ে এখন বরং মেলার লোকগুলিকেই দেখতে থাক। তারা আমার চেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক। তারা কী চায়, কী করে দেখলে তুই কূল পাবি না। সব একেকটি বিস্ময়ের খনি। তারা কিভাবে চলছে, কেন চলছে দেখতে চেষ্টা কর্, দ্যাখ্, বুঝতে পারিস কিনা। কী তারা বলতে ব্যস্ত তাও দেখার বিষয়। দ্যাখ্ না, একবার এদের দেখা শুরু করলে নেশা ধরে যাবে। তুই আর চোখ ফেরাতে পারবি না। রহস্য ঘনীভূত চরিত্র সব।’                

সে তাই এবার মেলার লোকগুলির দিকে পূর্ণচোখ  মেলে তাকালো।     

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *