শরদিন্দু সাহা

বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই  বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।

(যা কিছু দেখি, তাই কি বাস্তব, নাকি যা কিছু অন্তরালে থাকে সেই আপাত অদেখা জীবনেই লুকিয়ে আছে বাস্তবের সারাৎসার। আমরা যদি কোন জাদুবলে সেই অদেখা জীবনকে জীবন্ত করে তুলতে পারি, গোটা সমাজজীবন আর তার চারপাশের চেনা জগৎটাই হয়ত একদিন পাল্টে যাবে, কিংবা অবাক হয়ে ভাবতে থাকবে, যাকে বাসভূমি বলে জেনে এসেছি এতকাল, আদপেই তা নয়, আসলে চোখে পট্টি পরানো সম্পূর্ণটাই এক ধাঁধার জগৎ। লেখক এই উপন্যাসে তার খোলস ছাড়িয়ে আসল জগৎ ও ঘুমন্ত মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন অন্য মোড়কে, যা আসলে স্বপ্নভঙ্গ নয়, কোন এক সুন্দর সকালে দেখে ফেলা আলো ঝলমলে জগতের বাহিরে ভিন্ন এক ভূমি, লড়াকু মানুষের জীবন, পশুদের চিৎকার, পাখিদের কলরব, পরম্পরায় মাখা  নোনা ঘামের কলেবর। উপন্যাসে বিচরণ করুন আর সেই কুশীলবদের নতুন করে আবিষ্কার করুন, চিনে নিন অচেনা, অপরাজিত, অপরিচিত নতুন এক বাস্তবতা, লেখকের সৃষ্ট জগতের  অপরনাম ‘অমরাবতী’ )

পঞ্চম অধ্যায় 

মেদিনীকে চঞ্চল দেখেছে কী! এমন একটা জীবনের আঁতিপাতি খুঁজে বেড়ানো চক্ষুলোভ না গোপন আকাঙ্খায় মশগুল থাকা কেউ কি জানে? সে নিজেও কি জানে? গুটিয়ে রেখেছিল নিজের মতো করে। সে তো দেখতে পায়নি মেঘেদের আনাগোনা, শুনতে পায় নি তো নীল আকাশের ডাক। সে খালি দিনরাত কাঁদে,  বুকের কোনে ওর আগুন জ্বলে। ওর কাচ্চাবাচ্চারা এখনও ঘরে ফেরে নি। কনে সাজায় বটে, নিজে কি আর তেমন করে সাজে। সময়ের ঝঞ্জাটে নিজের কথা নিজেই শোনে সাত সতেরো কথা। কে আর কার কথা শোনে। এর মুখের কথা ও কাড়ে, ওর মুখের কথা ও কাড়ে, এর শিকড়ের জ্বালা ও বোঝে না, ওর শিকড়ের জ্বালা ও বোঝে না। জ্বালা কি আর কম, জুড়ায় না যে সহজে। এর ঘরে  উলুধ্বনি দেয় তো, ওর ঘরে ঘন্টা বাজে, তার ঘরে কাঁসর বাজে।  ঘরে ঠাকুর শয়ান দেয় তো, মেঝেতে শ্বশুর শাশুড়ির মাঝে পর্দার আড়ালে সঙ্গম করে। জমিন আর ফসলের জন্ম দেয়। বর বর বর্বর তুবড়ি বানাতে গিয়ে সেই যে ক্লাবঘরে প্রাণ গেল, কত লোক তো উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল দর্মার ঘরের ফাঁকফোকরে। পড়তি যৌবন ও মেদিনী যে কাটাল, কম খেসারত তো দিতে হয়নি। শেষে মালতির বুদ্ধিটা কাজে লাগিয়ে দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটল। কালসিটে দাগ পড়েছে ওদের কনুইয়ে, হাঁটুর গোড়ায় সদ্য বোলতা কামড়িয়ে ফিরে গেছে নিজের ঘরে, ওরা তো ঘরে ফেরে নি। কত তো ছড়া কাটে –  তুলসি তুলসী তুলসী, ও তুলসী/তুলসী তলায় ঘর/তুলসী তুলি কৃষ্ণ বরাবর।  না, একটুও উঠোনের মাটিও তো নেই, কখন কাঁদবে পা ছড়িয়ে। করাত কলে খ্যাঁচ খ্যাঁচ শব্দ করে চিরে চিরে একসার হয়ে গেল। এল আর গেল এপাশ ওপাশ। কেউ বলে ওরা জ্যান্ত নেই, মুখ গুঁজে ধাঁতানি সইতে সইতে দেখে সব গুঁড়িগুলো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কাটা আঙুলটা নিয়ে ফসল কান্নাটা চড়াতেই থাকে। চারপাশের বাতাসকে ভারী করে দেয়। পথচারীরা উঁকি দিয়ে যায়। মেদিনী নিজের মতো করে চড়া সুরে উৎকন্ঠায় বলে দিল ‘আমি আর পারছিনা। আমি যদি কোনভাবে আমার মৃত্যুর দিনটা জেনে নিতে পারতাম!’ মেদিনীর সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যেতে পারত। হারিয়ে ফেলাটা জীবন থেকে নতুন কথা নয়। মরা মানুষের মুখ দেখেনি তাও তো নয়। মর্গে শরীরের জ্যান্ত হওয়ার আশায় দিনরাত অপেক্ষার দিনগুলো ভয়ঙ্কর, ধুকধুক করেনি এমন তো নয়। ফসল ঘরে ফিরবে, জমিন ওকে পথ দেখাবে। দেখাবে তো বটেই। রক্তাক্ত আঙুলের যন্ত্রণা ফসল হজম করছে, জমিনকেও চালান করছে নীরবে নিভৃতে। এগিয়ে এলো কেউ কেউ। জড়িয়ে ধরে আহা উঁহু কত কী শব্দ করল, উচ্চারণে কত কি ছিল, আসল কথা ছিল না। যে চারাগাছটার পাতাগুলো ধূলোর ভারে নুইয়ে পড়েছে, ওরা আরও ঢলে পড়ল, এমনটা হয় কিনা কেউ দেখে না, রোজ হয়ে চলেছে তো একটু একটু করে। ফসলের কাটা আঙুলটা জমিন ছুঁয়ে থাকল আরো কিছুক্ষণ। উল্টোদিকে একটা গলি ছিল, জন্তু তো থাকে না, মানুষ থাকে। গজ আনলো, ব্যান্ডেজ করল, আঙুলটা যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল। করাত কলটা সামনে পেছনে চলতেই থাকল। করাতের রঙটা কালো কেন বলা, কালচে হলে মন্দ হয় না শুনতে, রক্তের দাগটা শুকনো, ঘা হয়ে চোখটা বড় বড় করে আছে। ওরা লরিতে বোঝাই করবে বলে বলেই বেড়াচ্ছে ‘তড়িঘড়ি কর বাবা, আগাম বরাত দিয়েছে,না হয় মাথা কাটা যাবে।’ মুখে চওড়া হাসি, এতগুলো টাকা, গুনে গুনে দেখে। গজের টুকরোটা লোকটার দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। কত মানুষ যায় আর আসে, ওরাও দেখে এক কোনে বসে বুড়িটা কাঁদছে। কেন যে কাঁদছে? এই কান্না কি ক্ষিধের ? ব্যথা থেকেও তো কান্নার জন্ম হয়। জীবনের কাছ থেকে কিছু না পাওয়ারও তো কান্না হয়।  জীবনকে কিছু না ফিরিয়ে দেওয়ার রোদন কিনা কে জানে। বঞ্চনা আর বঞ্চিতের কোলাহলে জন্মে গেছে কোথায় যেন, নাড়ি কেটেছিল কোন বাঁশের ছিলায়, সেও তো হুড়মুড় করা শব্দের গুঞ্জন, উচ্ছন্নে গিয়েছিল সময়ে অসময়ে। করাতের চলাচল কি আর থামে। ফসলের যন্ত্রণার শব্দগুলো ভেঙেচুরে যায়। জমিন ভাইয়ের আঙুলটা নিজের শরীরে জড়িয়ে নেয়। কাঠের বদলে শুইয়ে দেয় লাশ যেমন অচৈতন্য হয়ে থাকে। দেয়ালে দেয়ালে কথার জঞ্জাল থাবা বসায়। বাসি বাসি গন্ধ। মলমূত্র যোগ হয়ে মশামাছিগুলো বনবন শব্দে ওড়ে। জমিন পথের নিশানা মেপেই চলে। মোড়টা এমন বিদঘুটে ভাবে চলে একটুখানি জায়গা ছাড়ল তো মহাভারত অশুদ্ধ হবে, রক্তারক্তি কিলঘুষিতে ভাঙা পিচের টুকরোয় দাপাদাপি শুরু হয়। ‘আঙুলকাটা বাচ্চা ছেলেটার জন্য মায়া হয় না বুঝি।’ ‘ দরদ উথলে উঠছে বুঝি, আগে ছোট হাতি যাবে, পরে যাবে ওই ভ্যান। মরতে গেছিল কেন করাত কলে। পেটে দানা পড়েনি তো আর কোন কাজ ছিল না।’ জমিন ফসলকে আগলে রেখে দু’গুদাম ছেড়ে আর একটু পথ এগোয়। ওরা কেউ কেউ পিল পিল করে বের হয়, কালিঝুলি গায়ে গায়ে মাখা। একটা ঠোঙা থেকেই দু’চারটে করে পাখির খানার মতো টপাটপ মুখে পোরে। ‘কী সর্বনাশ, বেটা মালিকের চামচা, দুধের ছানাটা মরতে বসেছে, ছোট হাতির গুমোর হয়েছে বেশি।’ গাড়ির চাকাটা ভ্যানগাড়িটা ঘষে দিয়ে চলে যায়। ভ্যানগাড়িটা থেকে থেকে চিঁ চিঁ আওয়াজ আসে, ‘ঘর যাব, দুটি ভাত খাব, বড্ড খিদে পেয়েছে।’ ‘আহারে দুধের ছানাকে কাজে পাঠিয়েছে, একটুখানি মায়া মমতা নেই গো। পাষানি গো পাষানি’ দল থেকে এক মেয়েছেলে বলাকওয়া করে, ‘আরে এটা তো মেদেনীর ছাওয়াল, জম্মাতে দেখেছি। আহা গো! জন্মের মতো আঙুলটা গেল।’ হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ। ওরা নেচে নেচে কোমর দুলিয়ে গান ধরে। ‘পথের ধুলো পথে মরে, যে যাবার যাবে চলে। দোষ‌ আবার দেবে কাদের, ধুলোয় ধুলোয় মরণ মোদের।’

চঞ্চল ভেবে নেয় পথটাকে আগলে রাখবে। ওর বিচরণক্ষেত্র দ্রুত পাল্টে যাবে কোনাকুনি না সোজাসুজি। অধরা দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত হবে এমন ইচ্ছে ও পোষণ করে না। মেদেনীর খোঁজ ওর চোখের আড়ালে চলে যায়। প্রথমেই ও চিনে নেয় কোন বিন্দু থেকে কত দ্রুত হাঁটলে ও অনেকটা পথ চিনে ফেলবে। এমন যে মানুষের আনাগোনা ও ফসল আর জমিনের ভ্যানগাড়িটাকে অনুসরণ করে চিনিয়ে দেবে কোন এক চেনা রাস্তা থেকে অন্য আর এক অচেনা অন্দরমহল । চঞ্চল জমিনকে চিনিয়ে দেবে শক্তপোক্ত মনোভূমিকে। শক্তির বহরটা গতিটাকে উল্টোপথে ঘোরাবে। ফসলের পঙ্গুত্ব ওর অন্তরকে নতুন করে প্রশ্ন করে বলবে, ‘ তোমার এই গমন নিজের মতো করে সহজ করে নাও।’ ফসল চমকে উঠে বলতে পারে ‘এটাই কী নতুন এক প্রতিবাদের ভাষা,ঘৃণা নয়, রাঙা চোখের আলো নয়, নিজেকে প্রকাশ করে, সন্ধানের পথটাকে খোলা রেখে দাও।’ চঞ্চল ভারাক্রান্ত হয়ে, কোন পথটা সহজ আর সাবলীল, আক্রান্তই শিক্ষক নাকি প্রদর্শক, যে ও নিজে সেজেগুজে বসে আছে ওর ইচ্ছেটাই জমিন আর ফসলকে বাঁচার আর কোন নতুন রাস্তা খুলে দেবে। রাস্তাটাও তো কম সংগীন নয়, লোকগুলো যারা পলক ফেলছে না ডেকে বলবে, ‘ এটা নয় গো, ভুল, গোটাটাই ভুল, ওই তো নতুন রাস্তা দেখেও দেখে না, নতুন আর এক সূত্রের আলো এসেছে, সেই মায়াবী আলোয় প্রদক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে আর এক নতুন পৃথিবী।’ মেদিনী সন্তানকে আগলে রাখতে পারে গোপন গভীরে।  দুনিয়া সেই কথাটা বলবে বলেই আড়ালে আবডালে সাজাচ্ছিল নিজের ঘর দূয়ার। কে এই দুনিয়া? চঞ্চল জানতে চেয়েছিল দুনিয়ার হাল হকিকত। দাঁড়াতে চেয়েছিল সীমানাটা ভেঙেচুরে দিয়ে নতুন সীমানা গড়তে। ভেবেছিল এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে চলে যাবে। জনে জনে সংবাদ নিয়ে নিজেকে হাজির করবে আমদরবারে। তাদের উচ্চারণে উঠে এসেছিল বারবার,  ‘ চঞ্চলের আত্মীয়তা পাতানোর নরম আকাঙ্খায় দেখা দিয়েছিল, প্রমাণ করে দিতে চেয়েছিল তা কিন্তু সত্য নয়, যা ভাবনার গণ্ডীতে ফেলে‌ নিজের সৃষ্টি বলে চালান করতে চাইছে তাও কিন্তু সত্য নয়। অংশত সত্য চঞ্চলকে দুনিয়াকে কখনও চেনাবে না। জমিন ফসলকে নিয়ে মাঝপথে আটকে যাবেই। দুনিয়ার কী এমন সাধ্য চঞ্চলকে সঙ্গে করে মেদিনীর সান্নিধ্যে নিয়ে যায়। দুনিয়া নিজেই যে মাঝপথে বারবার হোঁচট খাচ্ছে। মনের আন্দোলনে আন্দোলিত হতে হতে ওর দৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করছে এমন সব অভাবিত অঞ্চল মনে হচ্ছে শূন্যতার মাঝে পূর্ণতার জন্মভূমি। হে জন্মভূমি কোথায় রেখেছো তুমি জমিনকে আর কোথায় বা রেখেছো ফসলের ঝরা ঘামের ক্লান্ত মুখ। আজ আঙুল গেছে, কাল যদি গোটা হাতটাই চলে যায় পরশু যদি হৃদয়টা বন্ধ হয়ে যায়, জমিন কি পারবে ফসলকে আগলে রাখতে বুকের পাঁজরে মিশিয়ে নিতে, হয়তো না। দুনিয়ার চাওয়া-পাওয়ার গোপন কথোপকথন ওদের চলনকে দিতে পারবে তো গতি, সে প্রশ্ন প্রথমে ও নিজের কাছেই রাখে। তাইতো এতটা নীরব নিঝুম নিরালায় নিজের বৃত্তে নিজেই ঘোরাফেরা করে। উদ্দেশ্যবিহীন যাত্রা নয়, কোন এক জীবনের মাত্রাহীন সন্ধান। মেদেনী আকাশ তো ছুঁতে চায়, সঙ্গে নিতে চায় চঞ্চলকে, জুড়বে বলে ইতিউতি মানুষের শয়নকক্ষ, জমিনও আছে, ফসলও আছে, ওরা ইচ্ছে অনিচ্ছের হিসেব কষে না, এই কথা কেউ তো বলে নি, প্রশ্নোত্তরের হিসেব চায়নি, এই কথাই বা কে বলেছে। কাকটা আজও ওর পিছু ছাড়েনি, চোখ দুটো মেলে মেলে এডাল থেকে ওডালে গিয়ে ডালে ডালে মুখ ঘষে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়িয়েছে। শ্বাস আরও শ্বাস, মধ্যিখানে উড়ে গিয়ে তৃষ্ণার্ত কাক দেখেছে জমিন ফসলের আঙুলটায় চুমু খেয়ে টেনে নিয়ে চলেছে ওর গোটা শরীর। কঠিন প্রহরায় চোখ বুলোচ্ছে চঞ্চল, কাকের সঙ্গে আত্মীয়তায় ওর কোন খামতি নেই। কোন ফাঁকে যে মেদিনী উড়ে এসে জুড়ে বসবে কে জানত। আসলে ও যে প্রস্তুতি পর্ব সারবে বলে কত কিছুই না খুঁটে খুঁটে দেখে নিয়েছে, মাটি আঁচড়ে আঁচড়ে পোড়া কলসির কানা জড় করেছে, কে আর জানত। ওর ভাঙা টেবিলটার পায়া টের পেয়েছিল, কেমন করে পৃষ্ঠাগুলো অক্ষরের মায়ায় প্রদক্ষিণ করছে গোটা ঘর। মেদিনীর চোখের পাতায় একী আলো, একী রঙ, কত রঙের মেলা ওকে যে ঘিরে রেখেছে, ফসলকে না চেনার কোনো কারণ তো ছিল না। কিন্তু রঙটাকে ওকে যে চিনতেই হবে। ফসলের ধারা থেকে যে রক্তের ধারা বইছে তার ওজন মাপা তো সহজ কথা নয়। ফোঁটাফোঁটা রক্ত রাঙিয়ে দিচ্ছে ওর গোটা শরীর। চঞ্চল নিরুত্তর জবাব নিয়ে হাজির হয়ে যায় মেদিনীর আয়োজনে। ভ্যানগাড়ীটার সিগন্যাল সবুজ যে হয় না সকল পথে। কারা যেন বলে ‘চল যাই সব রঙের মেলায়, নিজের মতো করে বেছে নিই।’ আর এক দল বলে, ‘চোখ গেল, মন গেল, রইল বাকি কী?’ এই উত্তরের আশায় মেদিনী হাঁটতে  গিয়ে হোঁচট খেল। কত মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। ডেকে নিল কত দুঃখী দুঃখী ভাব করে করুণ স্বরে। ‘সব কী শেষ হয়ে গেল! মিছিল আর মিছিল রইল না। ঘাত প্রতিঘাতে কথাগুলো ভাব হারাল, দমটা রইল ষোল আনা। সমস্বরে চিল্লিয়ে বোঝাতে চাইল কত জানে ওরা। ফসলের আঙুলটা তখন জমিনের পাঁজরের ছোঁয়া ছেড়ে দু’আঙুলের ফাঁকে এসে ঝুলছে।

মেদিনী কনেকে রাঙিয়ে দিয়ে নিজের রুপকে মুছে নেয়। যে দাগগুলো সহজে উঠে যায়, আর যে দাগগুলো অবিচল থেকে বলে, ‘আরো সময়ের ধাক্কা সামলে তবে তো পথ চলা।’ ও জানে আজ আর সেই সময় নয়, অনেক গানে মাতিয়ে দেবে, অনেক প্রাণের সাড়া জাগবে। সংবাদটা এসেই গেল ‘,ওরা আসছে, অনেকটা পথের বাঁক কেটে কেটে ওরা ঘরে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টায় পথ হারাচ্ছে। আবার খুঁজে মরছে। বুড়িটা দরজার খুঁটি ধরে বলে, ‘ঘরে ফেরা কী এতই সোজা!’ কেউবা আবার খিলখিল করে হাসে, ‘এই বুড়ি, এই তুমি কী বললে?’ ‘ঘর কাকে বলে জানিস? পুরুষ মানুষের গোঁফ গজানো দেখিছিস! এই কাটে, এই আসে, এই আছে, এই নেই। মোদের ঘর এরকমটা লা, এই তাণ্ডবে ওলটপালট হবে, কেউ এসে ঠেসেঠুসে দেবে। এই মাইয়াটা দুনিয়া পড়ানেখা শিখছে না, তাই তো ওর সব কেমন আবোল তাবোল লাগে। সুরে সুরে মিলতে চায় না রে। ভালা করে শুনতে লাগে যে।’ দূনিয়া এসে তো বলেই ফেলে, ‘কত মেয়েকে সাজাও গো, আস না, আমি তোমার চুল বেঁধে দি, না হয় এমন উকুন বাসা বাঁধবে, চুলে জট ধরবে, গা বেয়ে বেয়ে পা সমান গড়াবে, নেচে কুঁদে পার পাবে না।’ দুনিয়ার আকন্ঠ অনুসন্ধিৎসা ওকে জানিয়ে দেয় পূর্ণাঙ্গ নিবাসের হদিস, আগুনের ফুলকি উঠবে ও জানে বলেই ও জানতে পারে ফসলরা পথ অতিক্রম করে আসবে, চলে আসবে ওই অন্ধকার বৃক্ষের মূল যে পথ অবরূদ্ধ হয়েছে রাতারাতি, যে গর্ত বুজে গেছে আপনা আপনি, কোন নির্দেশের অপেক্ষাই করেনি,  ভাবেনি মা পুষ্ট হয়েছে নিজেরই প্রয়োজনে। দুনিয়া বলেছিল, ‘আসুন, আলিঙ্গন করি। কেউ যদি নিন্দেমন্দ করতে চায় করুক, তাতে কীইবা যায় আর আসে। ফসলের যায় আসে, সে যে রক্তাক্ত পথটা ভালো করে দেখে নিতে চায়। রক্তশূন্য পথটা অপেক্ষা নিয়ে দণ্ডায়মান। সে যে মনে মনে ভেবেছে মৃত্যুর স্বাদ নেবে, জীবনকে ধরবে বলেই না ওর আমরণ লড়াই। জমিনের মনটা জলে জলাকার হয়। ও যে ভূমিটা দেখেছিল বড় নড়বড়ে। ভেবেছিল কাউকে বেঁকে বলবে, ‘একটুখানি জায়গা দাও।’ 

ঘরে ফিরেই দেখল, ভিন্ন এক সন্ধ্যায় মূহ্যমান বাড়িঘরগুলো উচ্ছলতাহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে জমিনকে অনেক গল্প শোনাবে বলে। রোজকার ভাবনাগুলো জমা হচ্ছিল স্তূপ হয়ে। জমিনের নজরটা ঘুরেই গেছিল অনন্ত অবলম্বনে। সূর্যের প্রথম আলো যখন জীবন ছুঁয়ে যায়, ওয়েল্ডিং মেশিনের আওয়াজ ওকে কী সত্যিই টানে, নাকি কোন এক জীবনের খোঁজে পায়ের ভাজে ভাজে পৌঁছে যায় সেই আলোর বৃত্তে, স্ফূরণ ঘটছে নতুনের এক শিহরণে, শরীরটা দোলায় বটে, চিন্তার দেয়ালটা টুকরো টুকরো হয়ে যায় বটে, কি জানি কখন কোন বজ্রাঘাত এসে দানা বাঁধে। জমিন একটু আধটু কথা বলার জের টানে, কত রসের মেলা সেই স্ফূরণে। মন তো চায় নিজেকে ঢেকেঢুকে রাখতে, বলবে বলে যে কত ঘটনার জন্ম হয়, কী হয় কখন, শব্দ বের করে আনার আকুলি বিকুলে অজানা আঘাতে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। প্রশ্ন তো করতেই পারে, প্রয়োজন শব্দটা আসলে কী? কত তার দৌড়, এই জিজ্ঞাসার উৎপত্তিই বা কোথা থেকে শুরু। জমিন তাই মনের কোনে উথাল পাথাল করলেই এক এক করে জিজ্ঞাসার নিঃশেষ করে না ‘কে তোরা?’ আত্মম্ভরিতা বড় বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়। আগুনটা উৎপাত করে না কে বলল। সে তো গ্ৰাস করতে চায়। ‘কত তার দাম বললেন না তো, তাহলে তো আপন করে নিতাম, চেখে অনন্ত দেখতাম, না হলে যে সবকিছু কেমন অধরা থেকে যেত। একেবারেই ছোঁয়া অছোঁয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। চলে যাবে না তো, সময় হয় নি তো, কেন যাবে? ফাটা ফাটা বুকে অজানার রেশ টেনে এইভাবে পাওয়া যায়? এটাও কি মনে হয় না, এটা প্রশ্ন নয়, এটাই আশ্চর্য হওয়া। হ্যাঁ, একা একা ও দাঁড়িয়ে আছে তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছিল, ‘এটা চাই, ওটা চাই’। ঘরের মাঝখানে বন্দী হয়ে বলছে কত কী চাই ওর, সেটাও তো কোন ভুবনে, কাছে গেলেই সবকিছু ফুস। সব মিথ্যা, আবার সব সত্য। একসময় জানাতে গিয়ে বলে, ‘আমি সব জানি’। ওয়েল্ডিং মেশিনটা চলতেই থাকে।‌ আগুনের ফুলকি নিজের মতো করেই নাচে। কালো কাঁচের আড়ালে চলছে কত তো তরঙ্গ। চলতেই থাকে, সবকিছু চলতেই থাকে। খালি এক মৃত মানুষের গন্ধ। ওর শরীর থেকেই জন্ম নিচ্ছে। কত কী জন্ম নিচ্ছ? একেই কি জীবন্ত বলে? ‘ আরে হ্যাঁ তাই তো বলে।’ শ্রান্ত শরীরের রূপ পাল্টাতে পাল্টাতে একদিন আসে, জমিন এরকমই হয়ে যায়। মায়ের গর্ভের উপরে কিংবা কাছাকাছি কোথাও ফসলের জন্মের বীজ তৈরি হয়েছে। ওর আঙুলটা হয়েছে রক্তাক্ত। কাল রক্তে ওর বুকটাও ভেসে যাবে। ঘরের পাশের মায়ের গর্ভে আরও রক্তপিণ্ড দলা পাকাবে, আর একদিন ওর শরীরটা আধাআধি হতে থাকলে বলতে থাকবে, ‘ আমি বাঁচতে তো চাই, একটু তো দোয়া কর। ‘ইনশাআল্লাহ সব একদিন মনের মতো হবে।’ মজিদ ও তাই বলেছিল। হাত দুটো টেনে নিয়ে বলেছিল, ‘ আস্তে চালা মজিদ ভাই, এই সংসারের কথা তো কিছু বলা যায় না।’ দু’জনের আনন্দের ভাগটা পাল্টাপাল্টি হয়ে কেমন যেন হয়ে গেল।’ আজকাল মজিদ অনুকরণ শব্দটা খুব শিখেছে, ভালো কি মন্দ জানে না, কিন্তু শিখেছে। ওয়েল্ডিং মেশিনটা চলতে থাকলে ও কথাগুলো ধার করতে পারে না। এই এক ভারি বিপদ! সব কথা থেমে যায়, সব গল্প শেষ হয়ে যায়। উৎপত্তি যে হয় না, এই কথা কেউ বলে। গল্পের জন্ম যে কখন হয়, এটা কেই বা বলতে পারে, ও তো কোন ছার! জন্ম ওর কোন হাসপাতালে সেই খবর নাইবা রাখল। কিন্তু কতবারই তো ওর জন্ম হয়েছে, ও টের পেয়েছিল, মস্তিষ্কটা সচল হয়েছিল বলেই না। মাঝে মাঝে অনেক গোলমালও টের পায়। অগুণতি মানুষের গোপন গল্পগুলো গুমড়েই মরে যায়, দিনরাত জন্ম হচ্ছে নিজের মতো করে, চাবিটা বন্ধ করছে আর খুলছে, সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি জিয়ন কাঠি হয়ে জ্বলছে আর নিভছে। একথা সেকথায় হালকা হয়ে আসল নকল গুলিয়ে যায়। মানুষের মেলায় অন্য এক পৃথিবী, ওরা নিজেদের সাজিয়েছে নিজেরই মতো, মেঠো গন্ধে কত না গাছ গাছালির বাঁক, স্বপ্নিল সুন্দরী গরান, ওদের বাতাস-গায়ের গন্ধ এই অজানা বিভুঁইয়ে ছড়িয়েছে নিজেদের আমেজে। ওদের বৃত্তে এমন খানাপিনা, নিজেদের ঘরটাকে কেমন খুঁজেপেতে নিয়ে আসে। যারা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, ভ্রূ কুঁচকে দেখছে বটে, গল্পগাথা উদ্ধার করবে,তেমন দৃষ্টি আর বাচন কোথায়। সুখদুঃখে নিজেদের গন্তব্যের আস্বাদ আর তিক্ততাকে ওদের সামনেই আছাড় মেরে বলে, ‘তরকারিতে মশলাপাতি আর একটু কম হলে মন্দ হতো না। কেমন তেতো তেতো লাগে। কথাটা না বললেই নয়। জিহ্বাটা কম কি লাগে। কোন ব্যামো হয় নি তো, চল তো ঘরবাড়িটার খুঁটিনাটি খোলসা করে দেখি। দেবতা অসুরের লড়াইটা জমে উঠছে উঠুক, মন্থনে অমৃত নাই বা উঠল, বিষের ভাণ্ডারটা গিলতে হয় গিলুক। বাকি যেটুকু থাকবে ভাগবাটোয়ারা করে খেয়ে ফেলা যাবে।’ 

পথ কাটিয়ে আশপাশে যায় বটে, যাবার বলায় হাসি মস্কারা চলে বটে, নতুন ঘরবাড়ি, নতুন আদলে নতুন মানুষের কথা ছোঁড়াছুঁড়ি। ওরা ওদের পাত্তা দেয় কি দেয় না, গ্ৰাহ্যি করে কি করে না, এই কথা কে আর ভাবে। ওরা হেঁটে হেঁটে চলে যায়, কতদূর যাবে, লোহালক্করের গায়ে নাটবল্টু জুড়ে কত কি যে বানিয়ে এই শহরের বাবুদের বলবে, ‘ নাও না গো বাবু, ওপরওয়ালা তোমাদের মঙ্গল করবে, দুধেভাতে রাখবে। ওরা দু-চার পয়সা রোজগারপাতি করে ঘরে ফিরবে। এ ওর পিঠে ধাক্কা মেরে বলবে, ‘মালিক কী বলল রে?’ ‘বলল, রোজের টাকা, অমনি অমনি বাড়াব, গায়ে-গতরে খেটেখুটে পুষিয়ে দিতে হবে না। না হয় কোন চুলোয় যাবি যা। না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরলে তোদের কোন বাপ দেখবে, আমিও দেখব।’ ‘বল দেখিনি বাড়তি কাজের অর্ডার পেয়ে কত কামাবি বেটা তুই, মোদের করা দেখাবি।’ ‘কী করা যায় বল তো? কোন ঝান্ডার তলায় মাথা ঝুঁকিয়ে মরি।’ ‘বেঁফাস কথা মুখে আনবি নি। ভাবতেছি আর একটা পথের খোঁজে যাব।’ ‘পাগলটার কথা শুনতেছিস, না খেতি পেয়ে কোমর বেঁকে যেতিছে, সে নাকি বানাবে ঝান্ডা।’ ‘পাগলা বউবাচ্চার পরনে কাপড় জোটাতে পারিস না, ঝান্ডা বানাবি। ঠেলা সামলা, ওই সত্তরে বুড়োটা ঘুরে ঘুরে হকের টাকা পেলো নি, শেষে ঘুরে ঘুরে স্টোক হয়ে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায়। কেউ খোঁজ রাখল নি। আমরাও কি রাখি?’ ওরা তালে তাল রেখে পা ফেলে। যাবে তো অনেকদূর, সোজাসুজি, কোনাকুনি, মতে অমতে, পথে পথে কত জোর মিলান্তি, চোখে চোখ রাখা, ভালো মন্দের হিসেব কষা, জবাবটা তো দিতেই হবে, কত তো চিহ্ন, গায়ে পিঠে হাতে গলায় মুখে, তাই দেখে তো মুখ চেনা চিনি। যাবার বেলায় ফুটের দোকান দেখে ঠোঙায় ঠোঙায় মশলা মুড়ি, ভাজাভুজি, চিমসে পেট, ঠেলে বেরনো ভুরিওয়ালা পেটটা বেশ লাগে, আগে আগে পেট যায়, পিঠটা যায় পেছন পেছন, সে এক মজার কাণ্ড, এরকম কত মজার কাণ্ডই ঘটে বটে। কারো মুখ চিনতে চাইলে বলেই ফেলল ‘ওটা ইন, ওটা আউট।’ শব্দটা ইংরাজি বটে, একটু উল্টেপাল্টে নিলে অর্থ যে এভাবে পাল্টে যায় কে জানত। তাই তো ডেকেডুকে আত্মীয়তা পাতানো। ‘বৈঠিয়ে না দাদা, বিক্রিবাট্টা হয়নি গো, তুমহার হাতে পেথ্থম বউনি হল। খেত লাগ, খেতে লাগ, মিলেগা নেহি, খোদ মুল্লুক থেকে আনা।’ ‘সময় নি গো, সময় নি। সেকরার ঠুকঠাক কামারের  এক ঘা, এমন যন্তনা, সারা রাত ঘুমোতে দেবে নি, ছটফট ছটফট, এত বেদনা নিয়ে কেমন করে টিকে থাকা যায়, বল তো।’ ‘এট্টুখন দাঁড়িয়ে যাও না, ওই ভবঘুরেটাও আছে দেখছি। দু’জনের হাতখানা পরখ করে দি।’ চঞ্চলের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে। ‘ ভাগ্যটা কেমন করে পাল্টানো যায়, এই কথাটা বল দেখি। তাবিজ, পাথর কিছুই তো দেখিনা।’ ‘আহা, ওসব কি আমি বলতে পারি, তোমার কি হতে চলেছে, এখন কেমন কাটছে, শুধু ওইটুকুই জানি।’ ‘আচ্ছা, আমার ভাগ্যের কথা আমার মাথায় থাক।‌ এই দিনখাটুরের হাত দেখে বলল দেখিনি, ভবিষ্যত কিছু দেখতে পাও কিনা। ‘জন্মসাল, জন্মক্ষণ বল’ ‘ব্যাস ওইটুকু বললেই হবে, রাশি, নক্ষত্র এসব কিচ্ছু লাগবে না!’ বেজার মুখ, মালগাড়ির কয়লার মতো চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আঁধার, শুধুই আঁধার। শুধুই কি আঁধার, ঘুটঘুটে আঁধার।’ ‘আশু কোন সমাধান নেই!’ চঞ্চল হাত বাড়িয়ে ডাকে, ‘ও ভাই শোন, হাত দেখিয়ছ কখনও’ ‘হাত! সে আবার কোথায়!’ ‘দেখাও না একবার, জানতে তো পারবে, এই শহরে বাংলোবাড়ি হবে কিনা। কাড়িকাড়ি টাকাপয়সা হবে কিনা, সোনাদানা হবে কিনা, ঘর থেকে লুটপাট বন্ধ হবে কিনা।’ ‘কত্তদিন এমনি হাসিনি। আপকা লিয়ে হাসি আপনাআপনি এসে গেল। হামার হাত দেখেছেন বাপু। এই দেখুন ঠেলা ঠেলতে ঠেলতে সবি হাতের রেখাগুলা গায়েব হয়ে গেছে। এই বাবু হামার ভাগ্যের কথা বলতে পারবেন নাই। পরের জন্মে এই ঠেলাওয়ালার সাথে আপলোগদের যদি কখনও দেখা হয়, তবে হামার ভাগ্যের কথা পুছে নেব।’ চঞ্চল শব্দহীন হয়ে যায়। নিঃস্তব্ধ নিরালাপে হস্তরেখাবিদের পাশে দাঁড়িয়ে সময়টাকে ঘেঁটেঘুটে বুঝতে চায় এই নীল আকাশের নিচের পৃথিবীর এক শহরের এক কোনের ঠেলাওয়ালার কথার অর্থ কী, ওকে কী ও শিক্ষকের আসনে বসিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে অনুরোধ জানাবে ‘আমি আপনার ছাত্র হলে খুব কী দোষের হবে? নতমস্তকে আর একটা প্রশ্নও করে বসলেন, ‘আপনি কি নালন্দা কিম্বা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন? ঠেলাওয়ালা বড়জোড় ‘বিশ্বভারতী’ আর ‘রবীন্দ্রভারতী’ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলেও শুনতে পারেন। ‘রবিঠাকুরের নাম শুনেছি বাবু। জোঁড়াসাকোর পাশ দিয়ে ঠেলায় করে কত তো বই  টেইনে নিয়ে গেছি বাবু। এসব নাম তো কভি শুনি নি।’

‘তোমার নাম যেন কী বললে? ‘তুলসীরাম। এতো বাত পুছতেছেন কেন বাবু? হামার কোন গলতি হয়েছে কী?’ থানাটা কাছেই ছিল, খানিকটা ভয় পেয়ে তুলসীরাম বলল, ‘ বাবু, গরীব মানুষ, থানায় ঢোকাবেন না, রামপুর টিভি কোম্পানির বারান্দায় শুয়ে থাকি, কোন কসুর হামার হলে মাফ করে দেবেন। তাড়িয়ে দিলে কুথায় আর যাব।’ তুলসীরাম ভয় পেয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে । ‘না না তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ ও খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে চঞ্চলের দিকে চেয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, ‘পুলিশের লোক নয় তো! পুলিশে ছুঁলে আবার আঠারো ঘা। তবে কি ওই দোকানি বাবু নালিশ করেছে থানায়।’ কত লোকেই তো বাজারের দোকানে শুয়ে থাকে, ওর বেলায় যত দোষ। কেউ কি পিছনে লেগেছে? এরকমই হাজার কথা ভাবতে ভাবতে তুলসীরাম একবার সামনে দেখে আর একবার চঞ্চলের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যা দিনকাল পড়েছে যা কিছু হতে পারে কিছুতেই যেন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না।

অটল নির্ধারিত সময়ের আগেই ওর চিন্তাকে ছড়িয়ে দিয়ে হয়তো ভাবতে চাইল যে মানুষগুলোর জীবনকে চঞ্চল ছুঁতে চাইছে আসলে ওরা কারা? ওরা কী ঘুমিয়ে পড়েছে না জেগে আছে। বইয়ের পাতা ওল্টাতে গিয়ে ভাবে এইভাবেও ধরা যায় না জানাবোঝার নির্দিষ্ট একটা মাধ্যম আছে। কোনটা পাটিগণিত, কোনটা বীজগণিত, কোনটা ত্রিকোণমিতি। গাণিতিক সূত্র দিয়ে জীবনকে কি উপলব্ধি করা যায়, এই কথার উত্তর ও নিজেও তো খুঁজতে থাকে। ওই যে লোকটা, কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছে, আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে তার কি কোন দৃষ্টিকোণ থাকতে পারে না! কি জানি কেন ওর উপলব্ধির মাত্রা বলে, চঞ্চলের চোখটা ওর নিজের করে নিতে সংকোচ হয়। তাই তো ও কিন্তু কিন্তু  করেও একবার ওর মুণ্ডটাকে ঘুরিয়ে দেয়। দেখে চুলের ভাঁজটা উল্টোদিকে ঘুরে গেছে। ওর মাথায় আলাদা এক সুগন্ধি তেলের গন্ধ। হাতে কেমন অতি সহজে মুঠো করে ধরে আছে এক বনৌষধি। ওর ঠোঁটটা দুদিকে ঝুলে আছে। চঞ্চল জানে না ও কি খেয়ে কেমন করে কোন বিদ্যায় শরীরটাকে মুড়িয়ে রেখেছে। ও ইচ্ছে করলেই ওর একটা নাম দিয়ে দিতে পারে। ওই নাম দিলেই মানুষটাকে চেনা যাবে। আলোর খেলাগুলো তো থেমে যায় নি। এতক্ষণ আলোটা ডান দিক থেকেই ওর শরীরটাকে চিনিয়ে দিচ্ছিল, চমকেই উঠেছিল অটল। আবার ও যখন বাঁদিকে ঘুরে ওর শরীরটাকে মনে হল একটু আগেই ওর বইয়ের তিনশ নম্বর পাতায় যে ছবিটা দেখেছিল তার সঙ্গে নব্বই ভাগ মিল। ও ওর শরীরটাকে ছেড়ে ঘরে ফিরে আসবে যেই না ভাবছিল, ও শুনতে পাচ্ছিল একটা মানুষ কানফোনে, স্মার্টফোন নয়, অনর্গল বয়ে যাচ্ছিল, সেই কথায় শব্দ ব্যবহারে এমন দু’একটা নাম ব্যবহার করছিল, না শুনতে পারলেই উচিত কাজ হতো, কিন্তু তা হল না। আর বলার গল্পে যে ভাবে ওই ঔষধের দোকানের কর্মচারীর কথা উঠে আসছিল, যে চিন্তার স্রোতটা বয়ে আসছিল, দুপুরের ব্যবহার করা উচিত অনুচিতের সঙ্গে কতই না মিল। ওই মানুষটাকে বাকি লোকগুলো অনিমেষ বলে সম্বোধন করছিল। ও এই আঁধারে অনিমেষ একা একা কথা বলে যায়, শব্দগুলো হুবুহু মিলে যায়, ও যে ভাবে বাঁচার কথা বলে, তাও যেন সমান সারিতে চলে আসে। অটল ভাবল পাঁচশত বছর ধরে নেওয়া যাক। সময়টাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এমনভাবে আগলে রাখা যাক, কথার স্বরটা পাল্টে গেলেও ‘নিমন্ত্রণ’ শব্দটা ‘নিয়ন্ত্রন’ হলেও ওর চিন্তার শর্তগুলোকে অমান্য করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে না। অটল ওই নামধারী মানুষটাকে চিনবে বলেই একটা দামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। অনিমেষ কেন একটুও পাল্টাচ্ছে না, এতটাই ভিন্ন সময়ের ভিন্ন রঙ, ওপারের ব্যক্তিটি ও নয়, তাহলে ওর দেখাটাই ভুল, দুপুরের মুহূর্ত আর গল্পটাই আবার পুণ:প্রচার হচ্ছে।

অটলের দর্শন যে বিপরীত মেরুর চঞ্চল পলে পলে অনুভব করে। সম্পর্কটা চির ধরার কোনো প্রশ্নই আসে না। দ্বন্দ্ব এখানে মোটেই নেই মানুষের চলার পথটা সুগম নয়। পথটা রুদ্ধ হয়ে যাবে এই ধারণা অকল্পনীয়। তেজোদ্বীপ্ত রোদ চঞ্চল মাথায় করে বয়ে বেড়াতে পারে অনায়াসে। অটল ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গাঙের জলে ঝুপ করে ডুব দেয়, প্রয়োজনে একটু সাঁতার কেটেও নেয়। ভেজা কাপড়ে ফেরার পথে ওই লোকটাকে ডাক দিয়ে বসে – ভাঙলো ঘুম? ওঠো নিজের মতো করে ওঠো, কম্বলটা ভাজ করে পিলারটার এক কোনে গুঁজে রাখে, পায়খানা প্রস্রাব সারবে বলে কর্পোরেশনের শৌচালয়ে ছোটে পেটটা চেপে ধরে, জলাধারে হাতমুখ ধুয়ে স্নান সেরে সেই যে দৌড়য়, আর ফেরে না। অটল কত করে চেয়ে থাকে আর দেখতেই পায় না। ওর ঘর থেকে কুড়ি বাইশ ঘর দূরের চায়ের দোকানের সুধন ওর সঙ্গী হয়ে যায়। দশ টাকার আধাভাঙা টালির ঘর থেকেই ও আধা মাইল দূর থেকে ছুটতে ছুটতেই চলে আসে। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝোলানো থাকে, সেটা এমন করে মুঠো করে ধরে, মাটির সঙ্গে ঝুলেই থাকে, ও টের পেল কি পেল না, তাতে কিইবা আসে যায়, লক্ষ্য তো ওই কাউন্টারটাই। কাঠের বাক্সগুলো এক এক করে নামায়, সাজিয়ে গুছিয়ে গুঁড়ো চা, পাতা চা, দুটোরই মেশামেশি, নিজের মুখে ‘ইসপেশাল’ শব্দটা বসিয়ে দেয়। মুখস্ত চা বাগানের নামগুলো নিয়ে ওর গর্বের শেষ নেই। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ‘এতবার নামগুলো আওড়াও কেন?’ অটল জানে, এতে ওর কিছু হয়তো আসে যায় আসে না, কিন্তু অদ্ভুত আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার অধিকার তো নেই। তাই বলে স্ত্রী পুত্র তখন ওকে ওগো,বাবাগো বলে দুপুর বিকেলে ডাক দিয়ে যায়, কেমন করে ওঠে তো ভেতরটা, বাক্সগুলো নাড়াচাড়া করার সময়ও করে। চঞ্চলেরও করে। নাড়ানাড়ি হলে মনটা কেমন করবে না! সুধন আপনমনেই চেয়ারটা টেনে নিয়ে পায়ের উপর পা তোলে, প্রয়োজনে চেয়ারটা দোলায়। মালিক সাজতে যাবে ঠিক অমনি সময় দু-তিনবার গলা খাকারি দিয়ে কাঁশি তুলে খরিদ্দারটা কফ তুললে আর ফেললে ঘেন্না হয়, ‘বুড়ো থুরথুরে বলে বেঁচে গেলেন। বয়সের বুদ্ধিটার তো কদর করবেন। কী জমানা এলো ছেলে বুড়ো এক হলো।’ আবার থেমে গেল মহাশ্মশানের ঘাটের দিকে চলে যাওয়া মরা মানুষটি দেখে। এই জীবন কেন এই প্রশ্নটা এলো না নাকি, স্বাভাবিক জীবনের তাড়নায় মনেই তো পড়ে গেল, দরমার বেড়াটায় বড্ড উইপোকা ধরেছে, ঘুণে ধরেছে বাঁশে, ঘুঁটে আর কয়লা কিনতে হবে না। গরুটা রেল লাইনের ধারে বেঁধে রাখে খুঁটিতে, কম কথা তো শোনায় না কেউ। চঞ্চল দু-এক কলম লেখে বটে, তাতে কি আর মন ভরে! বইয়ের পাতা যখন নাড়াচাড়া করে, ডুব দিয়ে তো দিয়ে যায়, তাকিয়ে থাকে সুধনের দিকে, পলক ফেলে না। সুধন কেন জন্মালো খুব যে মাথাব্যথা আছে এই নিয়ে, তা কিন্তু নয়, এমন করে জন্মানোর আদৌ কোন দরকার ছিল কিনা এই প্রশ্ন ও রাখলে যে দোষের কিছু নয়, অটল আরও বেশি করে ওর কাছাকছি যায়, ওকে ব্যতিব্যস্ত করে। ‘ যান তো যান, কেটে পড়ুন, নিজের জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরি, জ্বালাতন করার লোক জুটেছে। মানুষের এক বেলা খানা জোটে।গরুটার খাবার ঘাস নেই,খড় নেই, খোল নেই, চোখ দিয়ে জল গড়ায়, সইতে পারিনি গো অটলদা। বাবু আমার ছেড়ে কথা বলবে না যে, বিকরিবাট্টা শিকেয় উঠেছে, বাবুর গালমন্দ তো আর তুমি সইবে না গো, যতো দোষের ভাগ তো আমার ঘাড়ে চাপবে, বুঝবে কি আর তুমি। এই শহরের মরা গুনতেই তোমার দিন কাটে, তা-ও আবার আবার আমাদের মতো গরীবের মরা। এই ছোটলোক মরারা নাকি শহরের কাছে হাত বাটায় নি, টাকার কুমিরদের ভাবনার আগামাথা নেই।’ সত্যি হয়তো অটল মরা মানুষের মাথাগুলো গুনে চলে রাতদিন, আত্মার খোঁজ করে কিনা। হয়তো শুনতে চায় না, দাঁড়াতেও চায়না, জানতেও চায় না, ওর কিচ্ছু যায়ও আসে না, শুধু বাঁচাতে চায়, রোজ জ্যান্ত মানুষগুলোর মাথা গুনে যাওয়া ওর রোজের কাজের ডায়েরিতে ধরা পড়ে। হয়তো কতকিছুই বিশ্বাসও করেনা আবার করেও। দ্বন্দ্বটা সাময়িক কিনা কিংবা মাথার কোন গোলমাল কিনা সেটা চঞ্চল অটলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল বটে কিন্তু অটল মাথায় নেয়নি, শরীরেও জায়গা দেয়নি, মনেও ধারণ করে নি। অটল ঘরে ফেরে না কত রাতেই না, সে রাত অন্ধকার নয়, ফুটফুটে আলোর মধ্যে যে অন্ধকার লুকিয়ে থাকে তারই আরেক রাতের রঙ। সুধন এক অনন্য মানুষ হয়ে যায় ওর কাছে তখন আর চা দোকানের কর্মচারী থাকে না।  ও বলেই ফেলে,’সুধন তুমি ধন্য, ধন্য তোমার এ-জীবন।’ সুধন চঞ্চলের কথার কোন অর্থই খুঁজে পেল না। জোরে জোরে হেসে উঠে বলল, ‘দাদা, মরে বাঁচার পথটা একটু বাতলে দিতে পারেন তো, একবার চেখে দেখে নি। সারাজীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব, এই কথা হলফ করে বলতে পারি।’ অটল ভাবে, ‘লোকটা বলে কীরে!’

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *