তুষার বরণ হালদার

লেখক পরিচিতি 

(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা  সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং  বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।) 

ভূদেব মুখোপাধ্যায়

এই ধারাবাহিক কলামে উনিশ শতকে বাঙালী ভারততত্ত্ববিদদের স্বপ্নের একটি রূপরেখা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এবার আলোচনা করা হবে এই স্বপ্নের আনুষঙ্গিক বাঙালীর ভারতবিদ্যাচর্চা। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন সে যুগের স্বপ্নদর্শীদের পথ প্রদর্শক। তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৮২৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায়। পিতা বিশ্বনাথ তর্কভুষণ ছিলেন সেকালের এক খাতিমান পন্ডিত। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। আর তেরো বছরে ভর্তি হয়েছিলেন হিন্দু কলেজে সপ্তম শ্রেণীতে।। আর এইখানেই তার সাথে পরিচয় ঘটেছিল মধুসূদন দত্তের সাথে এবং সে পরিচয় পরবর্তী কালেও বজায় ছিল। 
   হিন্দু কলেজে একবার এক প্রতিযোগিতা হয়েছিল যে ইংরাজি ভাষায় স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লিখতে পারবে এমন দুই জন কে স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক দিয়ে  পুরষ্কৃত করা হবে। প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিলেন মধু কবি এবং দ্বিতীয় পুরষ্কার লাভ করেছিলেন ভূদেব। কর্ম জীবনের প্রথম দিকে তিনি কলকাতা মাদ্রাসাতে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। এরপর টানা ৩৫ বছর তিনি সরকারি শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজের কর্ম দক্ষতায় উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করেছিলেন। 
   এ ইউরোপীয় সাহিত্যে গদ্যকে বলা হয় যুক্তির ভাষা, যা বঙ্গ সাহিত্যে প্রায় বিরল। যে সামান্য সংখ্যক সেই কর্মসাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন ভূদেব তাদের মধ্যে অন্যতম। ভূদেব মুখোপাধ্যায় এর ভারতবিদ্যাচর্চায় অন্যতম অবদান ১৮৭৫  সালে প্রকাশিত ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস’, যেখানে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মহারাষ্ট্রশক্তির বিজয়ী হলে ভারতবর্ষের পরবর্তী ইতিহাস কি রকম হতে পারত তারই এক কাল্পনিক চিত্রকল্প। এই গ্রন্থে তিনি মহারাষ্ট্রশক্তির নেতৃত্বে ভারতরাষ্ট্রের ঐক্য ও পুনরুত্থানের চিত্র এঁকেছেন। ভূদেব কল্পনা করেছেন যে শিবাজীর বংশধরের নেতৃত্বে পেশোয়ার পরিচালনায় ভারতবর্ষ সংঘবদ্ধ হয়ে এক ও অখণ্ড সাম্রাজ্যে পরিণত হতো। মারাঠাদের রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে ভূদেবের ধারণা অবাস্তব সন্ধেহ নেই, কিন্তু, কিন্তু তাঁদের কার্যাবলীর বিবরণ ভূদেব যেভাবে দিয়েছেন সেভাবে না ঘটলেও ভূদেবর আঁকা ছবি নিঃসন্দেহে আদর্শনিষ্ঠ ও ভাববাদী – এক উচ্চতর হিন্দু সভ্যতার ভাবনা।
   ভূদেবের ভারতদর্শী কল্পনার ভারত শুধু হিন্দু ভারত নয়, মুসলমান সমাজকেও এই ঐক্যবোধের মধ্যে গ্রথিত করে দিয়েছেন। হিন্দু আচারের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা তাঁকে গোঁড়া ও ধর্মান্ধ করে তোলেনি, তাঁকে উদার ও পরমতসহিষ্ণু করেছে। প্রদেশে প্রদেশে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, প্রদেশ নির্বিশেষে হিন্দুর মধ্যে, এবং সর্বোপরি হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে যাতে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়, ভারতীয় প্রজাপুঞ্জের মধ্যে ভারতীয় ঐক্য বৃদ্ধি ও সংহতিবোধ যাতে সকলের মনে জাগ্রত হয় – সেই লক্ষ্যে তিনি লেখনী ধারণ করেছিলেন। ভূদেব কল্পিত নতুন সাম্রাজ্যে ” একজন ব্রাহ্মণ একজন মুসলমানকে বলিতেছেন, ‘ যে রাম সেই রহিম, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়’ …।”
   ভূদেব ছিলেন প্রাচীন ব্রাহ্মণ, তাঁর স্বপ্নের পিছনে ইতিহাসের চেয়ে বেশি কাজ করেছিল পুরাণ ও পৌরণিক উপকথা। অন্যদিকে ‘ পুষ্পাঞ্জলি ‘ (১৮৭৬) গ্রন্থের পরিচয় দিতে গিয়ে গ্যেটের দুটি ছত্রের ইংরেজী অনুবাদ মুদ্রিত হয়েছে – “Ordinary history is traditional, higher history mythical, and highest mystical.” এই উদ্ধৃতি দিয়ে ভূদেব বলতে চান যে, তিনি traditional history লিখতে আগ্রহী নন। তিনি ইতিহাসের mythical রূপকে অবলম্বন করে mystical রূপ আঁকতে বসেছেন। এই গ্রন্থে তিনি ভারতের তীর্থ ভ্রমণ উপলক্ষ্যে ভারতবোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। সেই সঙ্গে ভারতের হিন্দু সাধনার ইতিহাসও বিবৃত হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের আন্তর বাহ্যমূর্তি একদেহে প্রকট করে তোলা হয়েছে। সম্ভবত তিনিই বাংলা সাহিত্যে ভারতভূমিকে দেবী রূপে কল্পনা করেছেন। আবার বঙ্কিম প্রণীত ‘আনন্দমঠ ‘ এও দেবীমূর্তি ভারতবর্ষ। দুই গ্রন্থেই দেবীমূর্তির ব্যাখ্যাস্থলে মাতৃভূমির ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
   পরিশেষে বলা যায়, ভূদেব ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে ঘটনাদির বিচার করে সত্যিকারের ইতিহাস লেখেননি, তিনি লিখেছিলেন ঐতিহাসিক নীতিগত রূপক কাহিনী। এ কথা সত্য, যে ভূদেব কথিত নূতন হিন্দু সভ্যতার সবগুলি উপাদানই তিনি গ্রহণ করেছিলেন প্রাচীন ভারতের সভ্যতা থেকে। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল গৌরোজ্জ্বল অতীত ভারতীয় সভ্যতার মর্মবাণী বর্তমান ও ভবিষ্যতের দৃষ্টি পথে তুলে ধরা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *