তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

অধ্যায় : এক 

ইদানীং আমার কী যে হয়েছে আমি নিজেই জানিনা।

আমার কোনকিছুতেই মন বসে না।  ভালো লাগে না। কোন কাজ করতে ইচ্ছে করে না। কোন কাজে উৎসাহ খুঁজে পাই না।

ভুক্তভুগী না হলে আমার এই সংকট বুঝতে পারবে না কেউ। কোন কাজ ভাল না লাগলে বসে থাকতে পারি। বসে বসেই যদি জীবন কেটে যায় তো ক্ষতি কী? আসলে এখানেই যত গন্ডগোল। খানিকটা সময় কিছু না করে বসে থাকলেই মনে হতে থাকে, কিছুই তো করা হচ্ছে না, অথচ দিন কেটে যাচ্ছে। তখন আবার কিছু না করে বেকার বসে থাকার জন্য হা-হুতাশ করতে থাকি। এই হয়েছে আমার অবস্থা। কিছু করতে ভাল লাগে না, আবার কিছু না করলেও ভাল লাগে না। 

এইভাবেই চলছিল দিনগুলি, এইরকম বিপদের মধ্যে। বিপদ বলে বিপদ! আসল বিপদের কথা তো বলাই হয়নি। শুনলে সবাই বুঝবে কী যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটছে আমার। কিভাবে বলব বুঝতেও পারছি না। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা সন্দেহ আছে। এই ভয়েই এতদিন মুখ খুলিনি। দেখছিলাম, সবকিছু যদি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। পরিস্থিতি কিছুই পাল্টায়নি, বরং যত দিন যাচ্ছে সমস্যা যেন বেড়েই চলেছে। মুশকিলটা তো এখানেই, কোনকিছুই ঠিকঠাক বুঝতে পারি না। সমস্যা বেড়ে যাচ্চ্ছে নাকি একই আছে বুঝতেও গণ্ডগোল। তবে কমছে না নিঃসন্দেহে। সারাদিন মনে হয় ঘাড়ে একটা বোঝা চেপে আছে। সমস্যার বোঝা। এই বোঝাটা কিছুক্ষণের জন্য নামিয়ে রাখতে পারলে স্বস্তি পেতাম।অ্যাটলাসের ঘাড়ে গোটা পৃথিবী ! বোঝাটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারলে বেশ হত। কার ঘাড়ে চাপাব ? সেই লোকটাকে পাই কোথায় ?
এইরকম এক মনোবাঞ্ছা থেকে নিজেকে জানাবার এই প্রয়াস। যদি কোথাও একজন এমন লোক পাওয়া যায় যার কাঁধে আমার সব সমস্যার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যেত ! পাব কি ? ঝামেলা পাকিয়ে ফেললাম গোড়াতেই। অভিসন্ধিটা জানিয়ে দিলাম। এবার সবাই সতর্ক হয়ে যাবে। হয়তো কেউ আর পড়তেই চাইবে না কী বলছি। কিজানি বাবা, শুনতে গেলে যদি কোন ফ্যাসাদে পড়তে হয় ! বলেই তো ফেলেছি যে আমার ঘাড়ে যে সমস্যার বোঝা তা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে মুক্তি পেতে চাই। আসলে ওটা কথার কথা। যার বোঝা তারই, অন্যের হয় না। বড়জোর আমি বলতে পারি, আমার চুলটা পাকা, গায়ের রঙটা কালো। এই নিয়ে যদি কারো কাছে দুঃখ করি, আর সেই লোকটার গায়ের রঙ ফর্সা চুলের রঙ কালো হলে তা কি উল্টে যাবে ? সে আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারে, তাতে আমার চুল কালো আর গায়ের রঙ ফর্সা হয়ে যাবে না। তাই বলছি, আমার সমস্যা একান্ত আমারই। তা আমি অন্যকে দিয়ে দেব কোন্ কৌশলে ?
তাছাড়া সারা পৃথিবীর লোকেরা কম চালাক নয়। আমি আমার ঘাড়ের বোঝা লোককে ডেকে কায়দা করে দিয়ে দেব আর লোকেরা তা কিছু না বুঝেই ভালমানুষের মত নিয়ে নেবে এমনটা হয় নাকি ? আজ পর্যন্ত যত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি প্রত্যেককে মনে হয়েছে আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। পৃথিবীর কোন মানুষেরই আমি আজ অব্দি গোটাটা বুঝে উঠতে পারিনি। গোটা তো দূরের কথা, খানিকটাও কি বুঝতে পেরেছি ? এই পৃথিবীতে মানুষরাই আমার কাছে বেশি রহস্যজনক। আমি একজন লোকেরও চরিত্র বুঝতে পারি না।যাকে যেমন ভাবি পরে দেখি সে ঠিক তার উল্টো। মানুষকে যত দেখি তত আমি অবাক হই। মানুষের কাজকর্মের ধারাই বিচিত্র। তার সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন কিছুর হদিশ পাই নি জগতে। সাধে কি আর নিজেকেই নিজে সে বলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণি !
মানুষের চিন্তাভাবনার রকমসকমও বিস্ময়কর। প্রত্যেকেই মনে করে সে অন্যের চেয়ে বেশি জানে। বেশি জানুক বা কম জানুক, কাউকে ছোট করে বোকা বানানো যায় না। সারাজীবনই দেখেছি। অন্যের কথা জানিনা, আমি নিজে চিরকাল কাউকে বোকা বানাতে গিয়ে নিজেই বোকা বনে গেছি। অহরহ এমন ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ দিতে চাইছি না, তালিকাটা খুব লম্বা হয়ে যাবে। ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হয়েছে যে পৃথিবীতে আমিই একমাত্র বোকা। 
এসব কথা কেন বলছি ? আসলে সবাইকে বোঝাতে চাইছি যে আমার লেখা পড়লে ভয়ের কোন কারণ নেই। যারা আমার লেখা পড়বে আমি কোনদিক থেকেই তাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান নই। আমার মত এমন একজন উৎকৃষ্ট বোকা লোক লিখে এমন ফাঁদ পাতব যে কেউ বুঝতে না পেরে ফেঁসে যাবে এমন ভাবনা অবান্তর। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কিছু বলার উদ্দেশ্য নেই আমার। যা বলব সব সাদাসিধে। কোন লুকোন মতলব নেই। 
হ্যাঁ, নিজের সমস্যাগুলির কথা দশজনকে বলতে চাই। এই কারণে যে বলে যদি কিছুটা হালকা হওয়া যায়। তার মানে এই নয় যে আমি চাই অন্যেরাও আমার মত সমস্যায় পড়ুক। আমি কী ঝামেলায় পড়েছি তারই বিবরণ দিতে যাচ্ছি। কেউ ধৈর্য ধরে পড়লেই বর্তে যাব। সান্ত্বনা দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে তো কথাই নেই। আর আন্তরিকভাবে বলছি, আমি চাইনা অন্য কেউ আমার মত বিপদে পড়ুক। এই লেখা তৈরি করার এটাও একটা উদ্দেশ্য। যাতে আমার সমস্যাগুলির কথা জেনে সবাই সাবধান হতে পারে। 
বিপদ কার না হয় ? মানুষের বিপদের অন্ত নেই। সব বিপদের চরিত্র কি জানে সবাই ? আমি অন্তত জানি না। ইদানীং নিজে গুচ্ছ গুচ্ছ বেয়াক্কেলে সব বিপদের মুখোমুখি হয়ে বুঝতে পারছি বিপদ কত রকমের হয়। আবার মনে এই প্রশ্নও দেখা দিচ্ছে, আমার বিপদগুলির সঙ্গে অন্যদের বিপদের মিল আছে কিনা। অন্যরা কী কী বিপদে পড়ে ? আগে এসব নিয়ে ভাবিনি কখনও। তাই নিজের বিপদগুলি এত বিচিত্র মনে হচ্ছে। আসলে এই লেখাতে নিজের বিপদগুলির কথা বলে আমি জানতে চাই অন্য কেউ কখনো এসব বিপদের মোকাবিলা করেছে কিনা। 
ওপর-ওপর দেখে তো কিছুই বোঝা যায় না। কে যে কিভাবে আছে বা কী করছে। কেউ ঢাক পিটিয়ে বলতেও যায় না নিজের সব গোপন কথা। হ্যাঁ, ঢাক পেটায় অনেকেই নিজেকে জানাতে, তবে সেই ঢাক পেটানো সত্যিসত্যি যে যা তার উল্টোটাই প্রকাশ করে। চোর ঢাক পিটিয়ে জানায়, সে সাধু। সত্যিকারের সাধুরা ঢাক পেটায় কিনা জানা নেই। তবে আমি যতবার ঢাক পিটিয়ে কোন লোককে নিজের কথা ঘোষণা করতে শুনেছি ততবার খোঁজ নিয়ে দেখেছি, লোকটা আসলে যা ঢাক পিটিয়ে বলে মোটেই সে সেটা জানাতে চায় না। 
ওই যে বললাম, দেখে বোঝা মুশকিল কে কী বা কী করছে। রোজ রাস্তায় নামলে হাজার হাজার লোক দেখা যায়। এই লোকরা সবাই যেমন দেখছি তেমন কি ? প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু গোপন চেহারা আছে যেটা বাইরে প্রকাশ পায় না। দেখে যাকে মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না সে-ই হয়তো কোন এক সময় মাছটি ভেজে রেখেছে। এই যে হাজার হাজার লোকের সঙ্গে রোজ কর্মব্যস্ত সময়ে আমার দেখা হয় তাদের প্রত্যেকেরই একটা অন্য চেহারা আছে। একটা কেন, একাধিকও হতে পারে। রহস্য ঘিরে রেখেছে প্রত্যেকটি মানুষকে। কেউ আমরা টের পাই না। এই দুনিয়ায় এটাও সম্ভব, এই যে হাজার হাজার মানুষের দেখা পাচ্ছি রোজ, অনেকের সঙ্গেই কথাবার্তা বলছি আবার নানা কাজেকর্মে জড়িয়ে পড়ছি তারা সবাই হয়তো মানুষ নয়। মানুষের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আসল মানুষদের চোখে ধুলো দিয়ে। 
রিক্তর স্বভাব হল লোকের পিছু নেওয়া। না জানিয়ে। পথচলতি যে কোন লোককে সে বেছে নেয় আর গোপনে অনুসরণ করে। দেখে সারাদিন সেই লোকটা কী করে, কোথায় যায়, কোথায় থাকে। তার কাছেই আমার এই কথাটা শোনা। সে আমাকে একদিন বলেছিল, 
‘তুই যে মানুষগুলোকে রোজ দেখছিস তারা সবাই কিন্তু মানুষ নয়।’
আমি ভারী অবাক হয়ে চমকে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম,
‘মানুষ নয় তো কী ?’
‘কী সেটা তোকে ঠিক বোঝাতে পারব না। এটুকুই জেনে রাখ্ যে হাজার মানুষের ভিড়ে অনেকেই আছে যাদের দেখলে মনে হবে মানুষ, কিন্তু আসলে তারা অন্যকিছু। মানুষের চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ দেখে বুঝতেই পারবে না।’
রিক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছিল। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, 
‘তারা কি ভিনগ্রহী ?’
‘না, ঠিক ভীনগ্রহীও নয়। এই পৃথিবীই তাদের বাসস্থান। হলেও তারা ঠিক মানুষ নয়। সবার চোখের সামনে মানুষ সেজে থাকে। দেখে বোঝে সাধ্যি কার !’
কাকপক্ষিতেও টের পাবে না এই শর্তে রিক্ত একদিন রাস্তায় একটি মেয়েকে দেখিয়ে জানাল,
‘ওর কিছু রহস্য আছে। ও ছাড়া কেউ জানে না।’
মেয়েটির নাম স্বাদিতা সেন। বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে। দেখতে-শুনতে খারাপ নয়। একটা ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে চাকরি করে। এসব কথা রিক্তর কাছেই শুনলাম। তারপর আমাকে নিয়ে একদিন বিকেলের দিকে সে মেয়েটির অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে লাগল। অফিস ছুটির পর মেয়েটি ব্যস্ত রাস্তায় এসে দাঁড়াল। রিক্ত আমার কৌতূহলটা জাগিয়ে রাখতে বলল,
‘দ্যাখ্ না কী হয়।’
মেয়েটি অনলাইনে একটি ক্যাব ভাড়া করল। রিক্ত হাতের কাছে পেয়ে আমাকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। মেয়েটিকে অনুসরণ করে ঘন্টাখানেক পর আমরা একটা হাউজিং কমপ্লেক্সের সামনে এলাম। মেয়েটি, অর্থাৎ স্বাদিতা  ক্যাবের ভাড়া মিটিয়ে ভিতরে চলে গেল। সে এই কমপ্লেক্সের কোন এক বাড়ির কোন এক ফ্ল্যাটে থাকে। রিক্ত আমাকে নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। শহরে ইতিমধ্যে সন্ধে নেমে গেছে। এলাকাটা মোটামুটি নিরিবিলি হলেও লোক চলাচল মন্দ ছিল না। বাইক-রিকশা যাচ্ছিল একটু পর পর। আমরা অপেক্ষা করেই গেলাম। বিরক্তি ধরে গেল আমার একসময়। রিক্ত নির্বিকার। আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
‘কোন রহস্য জানতে হলে ধৈর্য ধরতে হয়। এত ছটফট করিস বলেই তোরা কিছু দেখিস না।’
সন্ধে পেরিয়ে রাত তখন আটটা। দু’ঘন্টার ওপর অপেক্ষা করা হয়ে গেছে ততক্ষণে। মনে মনে রিক্তর মুণ্ডুপাত করছি আর ভাবছি, রহস্য চুলোয় যাক। আর ঠিক তখনই দেখলাম, স্বাদিতা নামের মেয়েটি কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। আবার সে একটি ক্যাব ভাড়া করে তাতে চড়ে বসল। রিক্তও তৈরি ছিল। সে-ও একটা ক্যাব ডেকে নিয়ে এল। আমরা স্বাদিতাকে আবার অনুসরণ করতে লাগলাম। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট যাওয়ার পর শহরের প্রান্তে বাইপাসের ধারে জল থৈ-থৈ বিশাল ভেরিগুলির সামনে এলাম। স্বাদিতা তার ক্যাব ছেড়ে দিল। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি, গাড়িঘোড়া অনেক চলাচল করলেও পায়ে-হাঁটা লোকজন নেই-ই প্রায়। আলো থাকলেও একটা অন্ধকারাচ্ছন্নতা চেপে বসে আছে চারপাশে। রাট ন’টা বেজে গেছে। স্বাদিতা ভেরির জলের খানিকটা দূরে একটা বেঞ্চির ওপর গিয়ে বসল। চুপচাপ বসেই রইল।আলো কম থাকায় তাকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। কাছাকাছি আর কোন লোকের চিহ্ন নেই। আমরা একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে সব দেখছিলাম। সময় কেটে যাচ্ছিল। আমার ধৈর্যের বাঁধ আবার ভাঙ্গতে লাগল। ভেরির জলের কাছাকাছি বেঞ্চিতে স্বাদিতা বসে আছে তো বসেই আছে। কী তার মতলব বোঝা যাচ্ছিল না। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এলেও নাহয় কিছু বোঝা যেত। এভাবে অনন্তকাল অপেক্ষা করে যাওয়ার কোন মানে আছে ? রাস্তায় পুলিশের পেট্রল ভ্যান টহল দিচ্ছিল। তাদের নজরে পড়লে কী যে হবে ! কিন্তু রিক্ত আমাকে মৃদু ধমক দিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করে যেতে বলল। 
রাট তখন প্রায় এগারোটা। স্বাদিতা বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়াল। পায়ে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ভেরির জলের কাছাকাছি। তারপর সে ঝাঁপ দিল জলে। রাস্তা জুড়ে প্রচুর আলো, তবুও এলাকাটার সমস্ত অন্ধকার দূর হয়ে যায়নি। ভেরির জলকে আলোকিত করার কোন ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু যতটুকু আলো ছিল তাতেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়া স্বাদিতাকে দেখা যাচ্ছিল, অস্পষ্টতা থাকলেও। আমার চোখের সামনে মিনিটখানেকের মধ্যেই সে একটা প্রকাণ্ড মাছে পরিণত হয়ে গেল আর মনের আনন্দে সাঁতার কাটতে কাটতে চলে গেল অনেক দূরে, জলের অনেক গভীরে। 
তারপর আমাদের বাড়ি ফিরে আসা উচিত ছিল। কিন্তু রিক্ত আমাকে সারারাত ওখানেই বসিয়ে রাখল। খুব ভোরে, রাতের অন্ধকার পুরো কাটেনি তখনও, দেখলাম একটা বিশাল মাছ জলের গভীর থেকে পারের কাছে এগিয়ে আসছে। ওখানেই সে ঘোরাফেরা করতে লাগল ঘন্টাখানেক সময় ধরে। অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হতে লাগল, আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল। ওই বিরাট মাছটা এবার জল থেকে এক লাফ মেরে ডাঙায় উঠে এল। এক মিনিটের মধ্যেই মাছটা আবার স্বাদিতা হয়ে গেল, ঠিক কাল রাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তাকে যেমন দেখেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনলাইনে আবার একটা ক্যাব ভাড়া করে নিজের হাউজিং কমপ্লেক্সে ফিরে গেল। বেলা দশটার সময় তাকে দেখলাম অফিসের দিকে রওনা দিচ্ছে, মোবাইল ফোনে কারোও সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে বলতে। 
তারপর আমি রিক্তর চ্যালা হয়ে গেলাম। বলতে গেলে তাই বলতে হয়। অন্তত কিছুদিনের জন্য তো অবশ্যই। তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বিচিত্র সব মানুষের সন্ধান পেলাম। তারা সবাই মানুষ হলেও ঠিক মানুষ নয়। তাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু রহস্য আছে। রাস্তার ভিড় থেকে একজন লোক বেছে নিয়ে তাকে অনুসরণ করে যাওয়া। কারো পিছনে দিনের পর দিন লেগে থাকতে হত। কাউকে আবার কিছুক্ষণ নজরে রাখলেই তার গোপন রহস্যটা বোঝা যেত। 
কতরকম বিচিত্র ব্যাপার রয়েছে লোকজনের। আগে এসব সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। মানুষকে দেখলে ভাবি আমরা সে মানুষই। সে যে অন্যকিছু হতে পারে ভাবি কি কেউ ? রিক্ত আমার সামনে একটা অজানা জগতের দরজা খুলে দিল। আমি জানতে পারলাম, মানুষরা সব মানুষ নয়। তারা অন্যকিছু হলেও হতে পারে। 
গদাধর পাকড়াশির কথাই ধরা যাক। দুই ছেলেমেয়ের বাবা এই ভদ্রলোক সকালে বাজার করে খেয়েদেয়ে অফিসে যান। সারাদিন মন দিয়ে অফিসের কাজকর্ম করেন, সহকর্মীদের সঙ্গে সময় পেলে আড্ডা মারেন, মিটিং-মিছিলেও যান দরকার হলে। রোজ সন্ধেবেলা নিয়ম মেনে বাড়ি ফেরেন। তাঁর কী গোপন রহস্য থাকতে পারে ? একমাত্র রিক্ত জানত সেটা। দিন তিনেক তাঁর পিছনে আমাকে নিয়ে লেগে রইল ব্যাপারটা দেখাবার জন্য। একদিন অফিস ছুটির পর গদাধরবাবু বাড়িতে যাওয়ার বাস না ধরে ময়দানের দিকে হাঁটা দিলেন। আমরাও লুকিয়ে তাঁর পিছু নিলাম। খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে তিনি এমন একটা জায়গায় গেলেন যেখানে বেশ কিছু গাছপালা, ঝোপঝাড় রয়েছে। পারতে কেউ আসে না এখানে, আবার এই সময়ে, বিকেল ফুরিয়ে যখন সন্ধে আসতে চলেছে। এই নির্জন এলাকাতে এসে গদাধরবাবু ঘাসের ওপর বাবু হয়ে বসে পড়লেন। তারপর নাক দিয়ে সশব্দে শ্বাস গ্রহণ করতে লাগলেন। তাঁর শরীরটা ক্রমশ ফুলে উঠছিল। ফুলতে ফুলতে ভদ্রলোক একটা গোল বস্তুতে পরিণত হয়ে গেলেন। তাঁকে আর আলাদা করে মানুষ বলে চেনা যাচ্ছিল না। তখনও তিনি শ্বাস নিচ্ছিলেন আর কেবলই ফুলছিলেন। তারপর একসময় ফটাস করে ফেটে গেলেন। ফেটে যাওয়ায় শরীরের মধ্যে থেকে একটা খোলা ছাতার মত বস্তু তীব্রবেগে সাঁ-সাঁ করে উঠে গেল আকাশের দিকে। অনেকটা ওপরে ওঠার পর বস্তুটা হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে লাগল। তখন দেখলাম, ছাতাটার বাঁট ধরে ঝুলছে লেজওয়ালা একটা প্রাণি। ওটা যে কী প্রাণি বুঝতে পারলাম না। 
কতটা সময় ছাতাটা আকাশে ভাসমান ছিল ? আধঘন্টা ? হলেও হতে পারে। তারপর সেটা নিচে নেমে আসতে লাগল। সঙ্গে ওই উদ্ভট প্রানিটাও ছিল। সেটা যে কী চেনা গেল না। একসময় ছাতা নেমে এল মাটিতে ঘাসের ওপর। ঠিক সেখানটায় যেখানে গদাধরবাবু বসেছিলেন। খাড়া দাঁড়িয়ে রইল মিনিটখানেক। অদ্ভুত প্রাণিটা ছাতার বাঁট বুকে আগলে জড়িয়ে রেখেছিল। ছাতা তারপর গুটিয়ে যেতে লাগল এবং গুটিয়ে গেল ওই প্রাণিটাকে নিজের ভিতরে রেখে। সঙ্গে সঙ্গেই আবার গদাধরবাবুর আবির্ভাব। স্বমূর্তিতে নয়, বিকট ফোলা চেহারায়। এবার তিনি নাক দিয়ে ক্রমাগত শ্বাস ছাড়তে লাগলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আবার সেই অবিকল আগের মত গদাধরবাবু ফিরে এলেন। চটপট উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটা দিলেন বাসরাস্তার দিকে। তারপর রোজদিনের মত বাড়ি ফেরার বাস ধরলেন। 
আমি রিক্তকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এই মানুষগুলি কি সত্যি মানুষ ?’ 
সে আমার প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘সত্যি মানুষ বলতে তুই কী বুঝিস ?’
আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। ভেবেচিন্তে বললাম,
সত্যি মানুষ বলতে বুঝি যারা সবসময় মানুষই থেকে যাবে। কখনও কোন অবস্থাতে স্বাদিতা বা গদাধর পাকড়াশির মত অন্য কিছু হয়ে যাবে না।’
‘তুই তাহলে কিছুই বুঝিস নি। গোড়াতেই গণ্ডগোল। তোর মত সবারই এই একই অবস্থা। সবাই তোর মতোই ভাবে। তোর মতোই দেখে।’
আমি রিক্তর দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম।   

(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *