পাঠক মিত্র
সেলটু মহম্মদের কোবরেজি
‘সেলটু মহম্মদের কোবরেজি’ গল্প সংকলনটি ন’টি গল্পের শরীর দিয়ে তৈরি করেছেন কথাশিল্পী দীপক মন্ডল । কথা-শিল্পের স্পর্শে পাঠককে মুগ্ধ করার যে শৈল্পিক নিপুণতা প্রয়োজন তার প্রতিটি উপকরণ কথাকারের সৃষ্টিশীলতাকে ধারণ করে । দীপক মন্ডলের এই সংকলনটি তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন বলা যেতে পারে । মূলত কিশোর পাঠকের জন্য তাঁর সৃষ্টিশীলতার মাঠ সেজে ওঠে । তবুও এ সংকলনের সজ্জিত মাঠে শুধু কিশোর পাঠক নয়, সব শ্রেণীর পাঠকই মুগ্ধ হবেন । কিশোরদের জন্য গল্প মানেই সচরাচর রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা হিসেবে আমাদের চেনা । আবার কখনো কল্পবিজ্ঞানের স্পর্শে কিশোর মনকে আন্দোলিত করে তাঁর অলীক ভাবনার ঢেউয়ে । এই সংকলনে তার কোনটাই সেভাবে নেয় । এখানে গল্পকারের প্রতিটি গল্প শুধু নিছক গল্প বলে পাঠকের মনে হবে না । গল্পগুলির কাহিনীবিন্যাস এমনই যে পাঠক কখন সেই বিন্যাসে জড়িয়ে পড়েছেন তা বোঝার আগেই কাহিনীর শেষ দ্বারে ততক্ষণ তিনি পৌঁছে যাবেন । গল্পগুলোর অংশবিশেষে পাঠকের চেনা মাঠে কোথাও না কোথাও খুঁজে পাবেন। তাছাড়া প্রতিটি গল্পে মজার ছলে সমাজের দুর্বল চিত্র ধরা পড়েছে, তা আলাদা এক সংকেত প্রকাশ করে ।
সংকলনটির নামকরণের গল্পটি ‘সেলটু’ চরিত্রের মত কবিরাজ বা ডাক্তার গ্রাম বাংলায় এখন আর নেই সে কথা বলা যায় না । যথাযথ বিদ্যা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই কোন যুবকের এমন কর্মসংস্থান সুদূর গ্রামবাংলায় আজও বর্তমান । তাঁরাই গ্রামের ভরসা । প্রকৃত শিক্ষার অভাব যেমন এমন ডাক্তারের থাকে না, তেমনই গ্রামীণ সাধারণ মানুষজনেরও সেই সচেতনতা নেই। এর উদাহরণ সুদূর গ্রামে গেলেই চোখে পড়ে । তবে এখন তা অনেক ক্ষেত্রেই বাহ্যিক চকচকে পোশাকে ঢেকে থাকে । গল্পটির সেই দিক নির্দেশকে পাঠকের কাছে হাজির করে । এমনই নির্দেশ রয়েছে ‘গণনা’, ‘গোয়েন্দা গুলু’ গল্প দুটিতে । ‘গণনা’ গল্পের হরিলালের চরিত্র শুধু কোর্ট চত্বরে নয়, এ চরিত্র শহর ও শহরতলির ব্যস্ত রাস্তায় চোখে পড়ে না এমন নয় । সমাজের অলিতে-গলিতে নানা মোড়কে হরিলালের মত গণৎকারের সংখ্যা কম নয় । যুক্তিনির্ভর শিক্ষার অভাবে মানুষের কুসংস্কার থেকে সচেতনতার যে অভাবের মাঠ তৈরি হয়ে আছে, সেই মাঠে হরিলালেরা বিকল্প কর্মসংস্থানের নামে খেলা করে । হরিলালের চরিত্র দিয়ে কথাকার সমাজের এই অন্ধকার দিকটায় অত্যন্ত মজার ছলে এমনভাবে আলোকপাত করেছেন যা কিশোর পাঠকের মন অবশ্যই যুক্তিনির্ভর হয়ে উঠতে পারে । আর ‘গোয়েন্দা গুলু’ গল্পে গৃহস্থের বাড়িতে চুরির ঘটনা থেকে কাহিনীর বিন্যাসে রহস্যের রসে জারিত করে যেভাবে চোর দুটি উদ্ধার হয়েছে তা সত্যিই মজাদার । কিন্তু মজার আড়ালে চির-বুভুক্ষ চোর দুটির বর্ণনা সমাজের কর্মহীন মানুষের জীবনের অন্ধকারকে দেখিয়ে দেয়, যা গল্পটি আর নিছক গল্প হয়ে ওঠেনি ।
‘পনেরো হাজারের চেয়ার’, ‘কবিরাজি কাটলেট’, ‘বৃষ্টির পর’, ‘বন্ধু’ গল্পগুলি বেশ সুখপাঠ্য । প্রতিটি গল্প আলাদা মাত্রার । তবে গল্পগুলির মুখ্য চরিত্রদের স্মৃতি বিন্যাসে গল্পগুলি অন্য মাত্রা পেয়েছে । ‘বন্ধু’ গল্পে দেশভাগে অন্য দেশের মেঠো হাওয়ায় ছেলেবেলার বন্ধুত্বের স্মৃতি খুঁজে ফেরাকে গল্পকার আলাদা মুন্সিয়ানায় হাজির করেছে । শুধু দেশভাগে নয়, জন্মভূমি থেকে ছিন্ন মানুষদের ছেলেবেলার বন্ধুত্বের যে কোন স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলবে ।
‘সুদ কষার অংক’ আর ‘আঙ্কিক’ গল্প দুটি বিশেষ অর্থ বহন করে । সমাজে একশ্রেণী থাকে যারা সহজ সরল মানুষদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ঠকিয়ে যায় । এমন সরল মানুষদের চোখ খুলে দেওয়ার গল্পই হল ‘সুদ কষার অংক’ । সরল মানুষদের ঠকানোর ফিকির আজ কম নয় । তাদের সজাগ করে তোলার জন্য শুধু সুদ কষার অংক নয়, তাদের জীবনে চলার অংকের প্রয়োজনের এই একটি দিক নয়, প্রতিটি দিকেরই এমন সংকেত প্রয়োজন আছে । গল্পকারের এই ইঙ্গিত পাঠককে মুগ্ধ করবে অবশ্যই। আর ‘আঙ্কিক’ গল্পটি আজকে ছেলেমেয়েদের জীবনে ইঁদুর দৌড়ের পথে তাদের অভিভাবকদের কাছে এক ‘লাইট হাউস’ হয়ে দেখা দিতে পারে । অভিভাবকদের ইচ্ছার প্রাধান্যে ছেলেমেয়েদের আসল প্রতিভা অনেকক্ষেত্রেই চাপা পড়ে যায়, তা থেকে মুক্তির দিক দেখিয়েছে এই গল্প । এই গল্প তাই শুধু মান্নাবাড়ির গল্প হয়ে ওঠেনি । গল্পটি আজ প্রতিটি ঘরের গল্প । তাই হয়তো গল্পটির মুখ্য চরিত্রের মান্নাবাড়ির ছেলেটির নাম ছাড়াই কাহিনীর বিন্যাসে এক অনবদ্য চরিত্র হয়ে উঠেছে ।
আবার বলতে হয়, এই সংকলনের প্রতিটি গল্পের শরীরে সহজ সরল ভাষার বুননে এমনই সাবলীল ছন্দ তৈরি করেছেন গল্পকার যে সেই ছন্দে দুলতে দুলতে পাঠক শুধু মুগ্ধ হবেন না, পাঠকের ভাবনাকেও অন্যমাত্রায় বিস্তার করবে ।
‘সেলটু মহম্মদের কোবরেজি’
–দীপক মন্ডল,
উড়ান, মালদহ