মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
চতুর্দশ পর্ব
কোনো কোনো মেঘলা দিন, কোনো কোনো প্রথম পাখির ডাক, কোনো বিশেষ ছিদ্র দিয়ে আসা সূর্যের কিরণ এক একটা মুহূর্তকে মহিমান্বিত করে। আর কিছুতেই সেই একই জায়গায় একই কুশীলবের উপস্হিতি সে মহিমা ফেরাতে পারে না। আমার জীবনের সে সব হারিয়ে ফেলা উজ্জ্বল সময় যেমন ফিরবে না, তেমনি ফিরবে না সেই সব মুহূর্তেরাও যাদের নিজেই দূরে ঠেলতে চেয়েছি। তবু যদি থেকে যেত সেই সব চেনা মানুষেরা, চেনা পরিবেশ – মনের মধ্যে কোনো একটা আশ্রয় থাকতো বুঝি। কিন্তু যতই বড় হচ্ছি, ততই সেই চেনা গণ্ডী ভেঙে যাচ্ছে।
আমাদের বাড়িটা কত পুরোনো ছিল জানি না, অন্তত শ’ খানেক বয়স বোধ হয় হয়েছিল তার। সে বাড়ির মালিক আমার বাবা ছিল না, আমার বাবার পালিত বাবাও ছিলেন না। সে বাড়ি ছিল সিংহ রায়দের। আমি তাকে বহু দিন অন্যের বাড়ি বলে জানতামও না। আমার দাদু ডাক্তার গিরীন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্ত সেই বাড়ির একতলায় তার ডিসপেনসারি সাজিয়ে দোতলায় তার দুই পালিতকে নিয়ে থাকতেন। সে সব সেই কবেকার কথা। বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো পাশের বাড়িটার সে ভাই। এক্কেবারে যমজ ভাই না হলেও যেমন ভাই ভাই, বা বোন বোনের একটা মুখের আদল থাকে না, ঠিক তেমনি। তেমনি উঁচু রোয়াক, রোয়াকে সামনের দরজা আর গলি পথে খিড়কি দরজা। আর গলিটা যেন কমন, একটা এক মানুষ উঁচু পাঁচিল দিয়ে আলাদা করা। ভেতরে কুয়ো, উঠোন। উঠোনের ওধারে আর একটা দু কামরার মহল। মহল বলতে নিজেরই হাসি পেল। কিন্তু এখন যারা জন সংখ্যার চাপে ছোট পরিসরের ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়, তাদের কাছে ভাড়ায় এত বড় বাড়ি পেলে এমন দু মহলা তিন মহলা বাড়ির কথাই মনে হবে।
এই বাড়িতেই আমার বাবা ও জেঠু তাদের ছাত্র জীবন অতিবাহিত করেছেন চিকিৎসক দাদুর তত্বাবধানে। দুই ভাই নিজের পিতা মাতা থাকা সত্ত্বেও কেমন করে এই দরদী চিকিৎসকের সান্নিধ্য লাভ করেন ও জীবনব্যাপী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সে জট আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আজও খুলতে পারি নি। কিন্তু আজও যখনই আশ্রয়ের কথা এবং প্রশ্রয়ের কথা ভাবি তখনই দাদুর মুখটাই স্মরণ করি।
এই দোতলা ভাড়া বাড়িটা ছিল একজন অকৃতদার স্বাধীনতা সংগ্রামী চিকিৎসকের স্নেহের স্পর্শে গড়ে তোলা সংসারের ঠিকানা। দুজন কিশোর, একজন রাঁধুনি এবং গণ্ডা কয়েক কুকুর বেড়াল ছিল এই সংসারের মানুষজন। বাবার বিয়ে এবং আমার ভাইয়ের জন্ম, মাঝের বছর পাঁচেক বাবা এই বাড়ি ছেড়ে সামনের ভাদুড়িদের বাড়িতে যান সম্ভবত স্থানাভাবে। পরে আমার জেঠু, অমর চট্টোপাধ্যায় অন্যত্র চলে গেলে আবার পুরোনো বাড়িতে ফেরত আসেন। আমি তো দুই বাড়িতেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে বড় হচ্ছিলাম। দাদুর কোলে, দাদুর বিছানায় মুড়ি খুঁটে খেয়ে ভালোই ছিলাম। পাকাপাকি ভাবে এই বাড়িতে এসে বর্তে গেলাম।
ছোট থেকেই বেশ ঘর ভরা মানুষ জন দেখে এসেছি। একতলার সামনের অংশে ডিসপেনশরি আর পেছনের অংশে আমাদের রান্নাঘর হওয়ায় লোকজনের হাত এড়ানোর উপায় ছিল না। মাঝে শুধু একটা ছোট উঠোন। পাশে কুয়ো আর দোতলার সিঁড়ি লাগোয়া স্নানঘর। মাঝে কোনো এক সময় ওই উঠোনের মাঝে বেড়া তুলে বসত অংশে আব্রুর ব্যবস্হা হয়েছিল কিন্তু সে দড়মা বেড়া ভাঙতেও বেশি সময় লাগেনি।
এই বাড়িতে নিত্য যাদের যাতায়াত ছিল তারা কেউ আত্মীয়, কেউ আত্মীয়সম হয়ে উঠেছিলেন।
তাদের একজনের কথাই আজ বলি। সেই মানুষটির পোশাকি নাম ছিল পূর্ণিমা। নামটা আমাদের ভাই বোনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ছিল মানুষটি। তাকে আমরা দিদা বলে ডাকতাম। দুনিয়ার লোকের কাছে তার অনেক নাম ছিল – হেমনির মা, পানুয়ার মা, নাপিত বুড়ি আরও কত কি। পানুয়া বা পান্নালাল ঠাকুরের সেলুন সাহু সরকার মোড়ে এখনও আছে। এখন অবশ্য সেই দোকানের দায়িত্ব পানুয়াজেঠার নাতি নিয়েছে।
ভাই তখন ছোট্টটি। ঠিক কবে থেকে ভাইকে তেল মাখানো চান করানোর দায়িত্ব নিয়ে দিদা আমাদের ঘরে এসেছিলো মনে নেই। কিন্তু সেই নিয়মিত আসা যাওয়া আমাদের স্কুল কলেজের গণ্ডি পার হওয়া পর্যন্ত বজায় ছিল। সেই সময় বাড়ির সধবা নারীদের মধ্যে নাপিত বৌদের হাতে নখ কাটা, আলতা পরার চল ছিল। বিধবা মানুষটি পেশা হিসেবে এই কাজ বেছে নিয়েছিলেন। আর ছিল তেল মালিশ করা, চুলের পরিচর্চার কাজ। আগে যখন পার্লারে পেডিকিওর , ম্যানিকিওর ও বডি ম্যাসেজের কোনো সম্ভাবনাও বাংলার বুকে তৈরি হয় নি তখন এই ভাবেই বাঙালি নারী নিজেদের যত্ন নিতে। নিজের ও আগের পক্ষের ছেলেপুলে নাতি নাতনি, গাই বাছুর নিয়ে তার ভরা সংসার ছিল। কিন্তু বরাবর নিজের কাজ করে সম্মান বোধ করত।
দিদা কি ভাবে তারপর ওতপ্রোত ভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে জড়িয়ে গেল জানি না। বেলায় নিজের অন্য কাজকর্ম সেরে আমাদের বাড়ি আসতো। কাচাকুচি, মশলা করা, এটা ওটা রোদে দেওয়া এই সব নানা খুঁটিনাটি ঘরের কাজকর্ম করেই চলতো। আমরা ভাই বোন নানা ভাবে তাকে উত্যক্ত করতাম। কখনও আমাদের খেলায় যোগ দিত, কখনও গল্প শোনাতো। আর সব থেকে বড় কথা দাদুর পর যে আমাদের বাবার লাঠি থেকে বাঁচাতে তৎপর হতো সে এই দিদাই। কতদিন দেখেছি রেগে আগুন বাবা আর বদমাশি করে কেঁচো হওয়া ভাই বা আমির মাঝে পড়ে দিদা ঘা খেতে খেতে বেঁচেছে, আর আমাদের বাঁচিয়েছে।
বিকেলে নিজের মালিশ ইত্যাদি কাজ সেরে সন্ধ্যে বেলায় আবার তার দেখা মিলত। মায়ের মাথায় তেল দিয়ে কি সুন্দর চুল বেঁধে দিত।
দিদার কথায় ছোটরা খুব মজা পেতাম। কারণ কোনো কোনো শব্দ কিছুতেই ঠিক করে বলতে পারত না। যেমন এস ডি পি ওকে সব সময়ই এস পি ও ডি বলত। এই রকম আরও নানা কথা নিয়ে আমরা খুব মজা করতাম। তাহলেই দিদা খুব রেগে যেত।
দিদার বাড়ি এক ছুটের রাস্তায় ছিল। এখন যেখানে মিলনী ক্লাব- রক্ষাকালী পুজোর মণ্ডপ সেই গলিতেই তার মাটির বাড়ি ছিল। পরে অবশ্য পাকা হয়। কি সুন্দর দড়ির খাটিয়ায় আমরা বসতাম। দিদার মেয়ে হেমনীর বিয়ে হয়েছিল বর্ধমানে। সেখান থেকে দিদার চার নাতনি এলে আমাদের খেলার সীমা থাকতো না। দিদা প্রতি বছর ছট পুজো করত। ছট পুজো বড় কঠিন নিয়ম নিষ্ঠার পুজো। প্রধানত বিহারীদের মধ্যেই এই পুজোর প্রচলন ছিল। একটু খরচ সাপেক্ষও ছিল এই পুজো। দিদা কিন্তু ঘর দোর নিকিয়ে ঝেড়ে মুছে নিরামিষ খেয়ে প্রতিবার ছটের ব্রত পালন করত। পুজোর মজায় মাততে ভালোই লাগতো। আর অবশ্যই ভালো লাগতো কিছু দিন ধরে ঠেকুয়া খেতে।
আমরা অনেকে বড় হয়ে গেলে দিদা আর প্রতিদিন আমাদের বাড়ি আসত না। কিন্তু নিয়মিত আসত, খোঁজ খবর নিত। আমার বিয়েতে খুব খুশি হয়ে আমাকে একটা রূপোর কোমর চাবি দিয়েছিল। আমি খুব একটা সাজতে পারি না বলে ওটা বেশি ব্যবহার করি নি। কিন্তু ওটা আমার কাছে সম্পদের মতো রাখা আছে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)