শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ’ উপন্যাস।)
হায় হায় রে কী গজব লাইগল
রাহু আই চন্দ্র সূর্যের টুটি চিপল
ইউসুফ আলী মণ্ডল প্রাইমারী ইস্কুলে হড়ায়। চাইর গ্ৰামের মানুষ সম্মান করে। সত্যনারায়নের হুজায় না ডাইকতেই চলি আয়ে। এই লই দুই-চার কথা হুইনতেও হয়। হেতেনে এসকল কতা এককান দিই হোনে, এককান দিই বার করি দেয়। এই লই টিটকারী মারি ছাড়া কতা কয় না – ধম্ম ধম্ম করি তোমরা মর, আঁর যিয়ানে ইচ্ছা হয়, আঁই যাইয়ুম। আঁর হরান যা চায়, তাই তো করুম। কিল্লাই যে এত টান ইউসুফ মাষ্টার নিজেও তো জানে না। আব্বার কাছে হুইনছিল কত হুরুষ আগে ওরা নাকি হিন্দু ছিল। হরে হরে পির দরবেশের কতায় সন্তুষ্ট হই মুসলমান হয়। আব্বাও আঁর বাঁচি নাই, কতাগাইনও আর স্মরনে নাই। অনেক কিছুই মিলাইত হারে না। মনের গতি এমন গতি কে আর টের হায়। আঁরে কয়, ভাবী এইডা কইত হারেন নি, আমনেগো লগে আমরা মিলতে হারি না ক্যান, আমনেগো চিন্তা, হাবভাব, ডাকখোঁজ বেগ্গাইনের লগে ষোল আনা না হোক বারো আনা মিল তো আছে আঁঙ্গ। বেবাকের সমাজই হড়ি আছে, কারা আগাই আছে, আর কারা হিচাই আছে। হেইডা লই, দেয়েন তো রোজের কাজে, চইলতে ফিরতে, এত অশান্তি কিল্লাই? এক হত দিই তো হাডি, আমনেরাও তো আঙ্গ মাজারে যাই দোয়া মাঙ্গেন, তাহইলে এত কতা উডে ক্যান।
মাষ্টারের মনের ভাবখানা হালাই দিবার মতো না, মনের মধ্যে থাই থাই খোঁচা মারে। কারা ঢাইলছে এত বিষ মাইনষের মনে, এই হশ্নখানের উত্তর দিবার লাই কেউ কি আছে, কেউ নাই। ইউসুফ মাষ্টাররা যা চায়, আঁঙ্গ সমাজের অন্য লোকরা কি তা চায়? মাষ্টার দূরের তুন এক কোনায় গাছের গোড়ায় বই থায় হূজা দেয়। কোনো কতা কয় না, মুখের ভাবখানা হাল্টি যায়। কয়, সত্যনারায়নের হস্যাদ হামু নি ভাবী। আঁর চোয়ের জল আই যায়। হেতেনেরে কী আর কমু, আঁর মুয়ের তুন একটা বাইক্য সরে না। দুঃখ তো লাগে যন হুনি আঁঙ্গ বাড়ির তুন দূরে কোন গ্ৰামে মারামারি কাটাকাটি হর, মুসলমান ভাইরা হিন্দু মাষ্টারের গলা কাডি হানা হুইরে ডুবাই দিছে, মরা মাইনষের গন্ধ বার হর হয়, চোখ ঠিকরাই বার হই আইছে, কেউ একটুও হিরেও চায় না, ভাবেও না, এই মানুষটা হেতাগো গ্ৰামের ইসকুলে হড়াইত, সন্তানের মতো দেইখত হেথাগো ঘরের হোলামাইয়াদের। একটুও চোয়ের চামড়া নাই। মানুষ কেমনে এত বেইমান হয় ধম্মের দোহাই দিই, না অন্য কোনও কারণ আছে, ভাবায় তো আঁরে। মাষ্টার কতা হুনি মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ঠাঁডা মাইরা রোদের মধ্যে দিই হাডি চলি যায়।
ইগাইন হেতারা ইচ্ছা করি করে, না অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে? হক্কল কামের পিছনে একটা শয়তানি বুদ্ধি আছে। আজ যেটা দেয়ের তার ফলটা ভোগ কইরব অনেক হরে। বুঝি না মাইনষে কেন ছুটছে, না-বুঝি ছুইটছে কিনা, হরে বুঝা যাইব। এইডা বুইঝতাম হারিয়ের কেউ না কেউ মানুষগুনের মাথা খার, চিবাই খার। না হয় গরীব চাষা মোতালেব মিঞার মাথাটা ঘুরি গেল কেমন করি। আঁই অনেক চিন্তা কইরলাম, কোনো কুল কিনারা খুঁজি হাইলাম না। তবে একদিন না একদিন এই হালটানো হাওয়ার গন্ধটা আই শ্বাসের লগে ঢুইকবই ঢুইকব। মোতালেবের মাথাটা কারা খাইছে, কিল্লাই এত বদ মতলব হের ঠিকানা খুঁইজত গেলে কাইল্যা কী ঘটনা ঘইটছে এইটা ভাইবলে চইলত ন, মাইনষের মনের ভেতরে গোপনে যে কব্জা কইরবার ফন্দি চিড়বিড় করের হারাক্ষণ হেইডা লই টান দিত হইব। পাঁচ গণ্ডা জমির মালিক আর ভাগে জমি চাষ করি চাইর চারইটা হোলামাইয়া লই দিন কাডায়। মাইয়ারে বিয়া দিছিল সোনামুখীতে। জামাই কাজকারবার কিচ্ছু করে না, হান্ডাগুলি মারে, মারধর করি তালাক দিই দিছে। মাইয়া কাঁইদতে কাঁইদতে আই জম্মভিটাতে উইঠছে। হুনি আঁর মনটা খারাপ হই গেছে। এই মাইয়ারে আঁই কত ছোড দেইখছি। বাপের লগে আই আঁঙ্গ আমবাগানে আম কুড়াইত, আঁই কত তিলের লাড়ু খাইতে দিতাম। কোনদিন ভাইবতামও হারি ন, মোতালেব মিঞার মনে আঙ্গ লাই এত বিতৃষ্ণা জম্মাইব। এইডাই বোধহয় বিধির বিধান। হেতে কি একা, সঙ্গে জুটাইছে কত শাগরেদ। আইজ আঙ্গ গাছের নাইরকল হাড়ি লই যার তো কাইল জমি তুন ফসল কাডি লই যার। কারে কইয়ুম, কার কাছেই বা নালিশ জানাইয়ুম, কে কার কথা হুইনব। বইলতে গেলে রে রে করি তাড়াই আইব। এইদিকে আঁঙ্গ বাড়িঘরদোর ভাগ হই যাওনে আর এক বিপত্তি। ভাইয়ে ভাইয়ে মিলমিশ না থাইকলে যা হয় আর কি। ঘরের শত্রুর বিভীষণ, ওরা আই উসকায়, জমি সম্পত্তি হাতাই লইবার কারসাজি করে। আঁর এক দেয়রের কান ভাঙায়। হেথে তো কোনো রোজগারপাতি করে না, চাইর গ্ৰাম ঘোরে। হেতের কথার মধ্যে আর এক শাগরেদ মজিদ আলির কথার মিল খুঁজি হাই আঁই তো চমকাই উডি। ব্যাপারখানা কি, হেরা কি বাবদাদার কালের সম্পর্কটার কতাটাই ভুলি গেছে। আজব দ্যাশের গজব কথা, যা বাপের জম্মে হুনি নি, আইজ হেগুনে আই আঁঙ্গরে হোনার। কত কতাই না চাপা হড়ি থায়, সময়ের ধাক্কায় হুঁড়ি বার হয়। হেগুনে আঁর দেয়রেরে হুসলার সম্পত্তি কেন্নে হাতান যায়। এই বুদ্ধি আঁঙ্গ গ্ৰামের মোতালেব মিঞাদের মাথা তুন বার হয় ন। অনেক দূর দ্যাশের মাথা কলকাঠি নাড়ের, তারা হেতাগো মাথাগাইন খার। মোতালেব মিঞা সেদিন কইল, আমনেরা এত জমির মালিক হইলেন কেন্নে, টিনের চালের বড় বড় ঘরে থান, আর আমরা চাষাভুষা মাইনষেরা সনের চালের ঘরে গরমকালে বর্ষাকালে আধপেটা খাই দিন কাডাই। কতাগাইন যে একদম উড়াই দেওন যায় না। কিন্তু হেতেনের কতার মধ্যে কেমন যেন শত্রুতামির গন্ধ হাইলাম। আমরাই নাকি ওদের দুঃখ কষ্টগাইন কোনদিন বুঝি ন, নিন্দামন্দ কইরছি, অচ্ছুত করি রাইখছি, অন ওরা প্রতিশোধ নিত চায়।
ব্যাপারটা লই ভাইবতে হয়, এমন করি কোনদিন তো ভাবি ন। পাপ যদি পূর্বহুরুষেরা করি থায়, হের প্রায়শ্চিত্ত করুম কেন্নে। খালি ইয়েল্লাই এত ঘৃণা, এইডা ভাইবতে গেলে আঁর কষ্ট হয়। কই আমরা তো হেথাগরে কম ভালোবাসি ন। তাইলে কী অন্য জায়গার হিংসাহিংসি আঁঙ্গ গ্ৰামে আই বাসা বাঁধের। আঁই ঠিক দেইখছিতো, আঁই ঠিক বুইঝঝিতো, বোঝনের দরকারই-বা কি আছে। কত মানুষ কত কিছু জানে, আঁই তো কিছুই জানিনা। যদি জাইনতাম ঠিক, কাউকে চিনতাম হারি ন ক্যান। কত মাইনষেরে তো আমরা চিনতাম হারি না, তাতে দোষের কী আছে! দোষ গুন কজনেই-বা বিচার করে, হক্কলে তো নিজের মতোই চলে, সেইমতো জীবন দেয়ে, ভিতরে ভিতরে ডুব দেয়, ফের সামনে চলি আয় কয়, আমারে দেয়ো, আঁরে এতকাল যেইভাবে দেইখছ সেইভাবে নয়, নতুন করে দেয়ো। সত্যিই এই পৃথিবীর কত রূপ, কত গয়নাগাটি হরি আছে, আরও গয়নাগাটি হইরব বলে হক্কলেরে নিজের মতো বানাইতে চায়, অন্যরা যে ভিন্ন মানুষ এই কথা স্বীকারই কইরত চায় না। হোড়াইতে হইলে হোড়াইব, গলা কাইটত চাইলে গলা কাইটব, হোলামাইয়ার সামনে উলঙ্গ করি মাইয়া মানুষের শরীল দেইখতে চাইলে তাও দেইখব। কী জ্বালা! কী জ্বালা! এমন জ্বালায় কেইবা জ্বলি হুড়ি মইরছে। হরেক জাতের মানুষ আর নানা ঢঙের সংসার। চিনন কী যায়! কন যে কন মুই যাইত চায় কে জানে। এই তো হেইদিন মাচার তুন একটা কুমড়া লতার তুন ছিঁড়ি আনার সময় ধপাস করি হাত তুন মাটিতে হড়ি গেলে সে কী দশা! পিলপিল করি কত রাজ্যের হোকা আঁর চাইরপাশে ঘিরি ধইরল, ভাইবতামও কী হাইরছিলাম নি, এমনটা হইব, গা-টা ঘিনঘিনই তো কইরছে। আঁর গা-টা এরমই ঘিনঘিন করে। কন করে, যন দেই হোলা কাঁদে, মাইয়া কাঁদে, মাটিতে আঁছড়াই হড়ি কাঁদে।
তো ভাইবলাম এমন করি কেন্নে চইলত হারে, এর একটা বিহিত কইরতেই হইব, যেমন করি হোক। দুনিয়া চলে দুনিয়ার মতো করি, আমরা কেন্নে চলুম। রাতারাতি তো ভোল হালটানো যায় না। এইডা তো ঠিক এমন মেঘ তো দেই না, টুকরো টাকরা ছড়াই ছিটাই আছে, তেমন হইলে একখান কতা ছিল, ওমা এই দেখি, যতদূর চোখ যায় কালা জমাট বাঁধি আছে, রাতের বেলায় আঁধার নাইমলে যেমনটা হয়, এই আছে, এই নাই। খবর আইছে চুপি চুপি, হরে প্রমাণটা বোঝা গেল যন বোঝকা-বুঝকি লই আঁর বড় ননদের মেঝ হোলা আই হাজির হইল, বেজার মুখে দুঃখ করি কইল, আঙ্গ হিয়ানে যা শুরু কইরছে এক দল লোক হেথারা নাকি পশ্চিমাদের চর, গোপনে গোপনে শলা-পরামর্শ করের কেন্নে আঙ্গ বাড়িঘর দখল কইরব। মামী কি কইরতাম কন, কনডাই যামু। অত চিন্তা করচের কিয়ের লাই, আমরা আছি তো, আঙ্গ গ্ৰামের হাওয়া অনও অত গরম হয় ন। হেগুনের জুলুম বেশিদূর আগাইত ন, রেডিওতে যা হুইনতেছি, বঙ্গবন্ধু হুঁশিয়ারি দিছে ইয়াহিয়া খানকে, এইদ্যাশে গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা কইরলে মাইনষে চুপ করি থাইকত ন, তবে কিনা বেগ্গাইন হাঁচা কথা কর না মিছা কথা, কে কইব। তবে অনও এত ভয় হাওনের কিছু হয় ন। চন্ড-সূয্য মাথার উপর আছে, এত বেইমানি সহ্য হইত ন। ভগবানরে মন-হরান দিই ডাক, একখান ব্যবস্থা ঠিকই হইব। আমরা বাপদাদার কাল তুন এই দ্যাশে আছি, আঙ্গরে বাড়িছাড়া কইরব, এত সোজা কথা নি। তুই চুপ করি বয় তো, হাত মুখ ধুই ল, কিছু একখান মুয়ে দে। হেতে কি আর আঁর কথা হোনে, বাড়িতে মা-বোইনরে হালাই আইছে, চোয়ের কোনায় জল গড়ায়।
যত দিন যার ধুয়া ধুয়া লাগে, মাইনষের মনের মধ্যে কী একটা রোগ আই বাসা বাঁধের, আঁই কইতাম হারিয়েন না। আঙ্গ শরীলে ক্রিমি কামরাইলে যেমন মোচড় দেয়, থাই থাই মাথার মধ্যে কিলবিল করে কত রকমের দুশ্চিন্তা – কিছু একটা তো ঘইটব, কন হইব, কেন্নে হইব কেউ জানে না। এইডা বুঝিয়ের যন হইব, ঝড়ের বেগে আই উলটি হালাই দিব, হলাইবার হত খুঁজি হাইত ন কেউ। মোতালেব মিঞা, মজিদ আলি হক্কলের মনে বিষ ঢালের। সেই বিষ হতেঘাটে মাঠেঘাটে বদইলাদের জেলে মাঝিদেরও মন বিষাই দের। বিষ ঢাইলবার লাই ওরা হাগলা কুত্তার মতো লালা ঝরার। সুযুগ হাইলেই কামরাই ছোলাই ধইরব। ভালামন্দ বিচার কইরবার সময় কনডাই। আঁর হোলা শহরের তুন বাড়ি আইছে। হোলারে দেই ভালা যেমন লাইগল, চিন্তাও বাইড়ল। হোলা মন খারাপ করি বই থায়, কিছু কয়ও না, হেডভরি খানাও খায় না। হেতেরে বুঝাই হারি না। কই, হ্যাঁরে কছ না, কী হইছে। হেথে কয়, আমনে ইগাইন বুইঝবেন না। বুঝাই কইলেই বুঝুম। তোর মারে তুই এত মূর্খ ভাবছ ক্যামনে। হোলা আঁর কাঁদি হালায়। ইনায় বিনায় কত কথা কয়, অদ্ধেক বুঝি, অদ্ধেক বুইঝতাম হারি না। আসলে চোয়ের জলের নাকের জলে হইলে যেইডা হয়। মনের কষ্ট কইমলে বুঝন যায়, হেতের বাপেরে শয়তান গোছের লোকজন মুয়ের সামনে যা নয় তাই বলে গাইল দেয়, হেতেনের পেশার নাম ধরি ভেঙায়। ঘরের মধ্যে ঢিল ছোড়ে। কেন্নে হেগুনের ইতরামি সহ্য কইরব। নালিশ জানাইলে কী ফল হইব, হেতেনে জানে বিধায় চুপ মারি থায়। কারা ইন্ধন যোগায়, হিগাইন না জানার কতা নয়। মুসলিম লীগের মাতব্বররা চায় হিন্দুগো ঘরছাড়া করি দখল করি লইব, তাই গুণ্ডা মস্তানদের লালাই দিছে উত্তক্ত্য কইরবার লাই। এহেন দুষ্কর্ম শহরের হিন্দুদের ঘরে ঘরে শুরু হইছে। কেউ কেউ ঠিকও করি হালাইছে আর থাইকত ন। আঁর যিগুনে হেগুনের কথায় সায় দিই চলে আর যেতাগো কোমরের জোর আছে, হেথাগরে অনও কিছু কয় না। তাই বলি আইজ কিছু কয় না বলি, কাইল কিছু কইত ন, হেইডা ভাইববার কারণ নাই। হোলা কয় আর শহরে বাপের কাছে যাইত ন। আঁর স্বামীরে কইলাম, আমনের মত কী। হেতেনে ত কতাখান হাসিই উড়াই দেয়। ঠিক কইল না বেঠিক কইল, কিছুই বুইঝলাম না, না আঁরে বুইঝতে দিল না, কে কইব।
ইউসুফ মাষ্টার সময়টা তো বড় গোলমালে লাইগতেছে। ব্যাপারখানা বুঝাই কন দেখি হাঁচা হাঁচা এই দ্যাশটা উচ্ছন্নে চলি যাইব না তো! কাগো হাতে রক্ষা হাইব? আমরা কেমন করি বাঁচুম? আঁর কতা হুনি হেতেনে মুখ নাড়াইল না, মাথার চুল মুঠা করি ডাইনে বাঁয়ে কইরল। কিছুক্ষণের লাগি এবার এমন করি মুখ নাড়াইল যেন তাস খেলার চাল দের – ইয়াহিয়া খান না শেখ মুজিব। মুজিবরের কথা আইয়ের কত্তুন, হেথেনে তো অনও ক্ষমতাই হায় ন, দ্যাশ চালাইব কেমনে? হবে তো জেল তুন বার হইছে। মাইনছি লোকে বঙ্গবন্ধু কয়। কিন্তু ছড়িখান তো ঘুরাইতে আছে অনও পশ্চিমারা।
ঠিক পয়েন্টে তো আমনে ক্যাচ করছেন। বেডারা তো খেলাটা খেইলতে আছে। ছিল তো পূর্ববঙ্গ, অন নাম হইছে পূর্ব পাকিস্তান, হেথারা দ্যাশ উপর উপর কইলেও আসলে ভাবে মধু খাইবার বাসা, আঙ্গরে ভাবে মৌমাছি, আগুন দিই মারি হালাইত হাইরলে হুরা সম্পদের মালিক।
কন কী! এত শয়তান ওরা?
আস্তে কন ভাবী, কে কন্নাই ঘাপটি মারি আছে, হুইনত হাইরলে দফা রফা করি দিব। দিনকাল ভালা না।
আমনে কইতে আছেন হিয়েল্লাই কিছু মাইনষেরে কুমন্তর দিই ধম্মে ধম্মে গোলামি লাগাই ফায়দা লুইটত চায়।
দেয়েন তো কেমন সুন্দর আমনে হশ্নও কইরলেন, উত্তরটাও হাই গেলেন।
হায় ভগবান হেতেনের মতো যদি দেশগাঁয়ে আরও কজন মানুষ থাইকত, গাঁ গঞ্জের চেহারাখানই হাল্টি যাইত। কবে যে আঙ্গ দ্যাশে শান্তি আইব, কে জানে। আঁর হোলাডার কথা যত ভাবি, মনটা তত খারাপ হই যায়। এমন একটা দ্যাশে এগুনের ভবিষ্যৎ কী! কেন্নে আঁই কই, ভয় হাস না, দিন আইব, যেদিন তোর বাপেরে কেউ আর হিন্দু বলি ঘেন্না কইরত ন।
কদ্দিন হর হোলা চলি গেল শহরে। যাইবার সময় সদর দরজা হার হই গেলে হিরি হিরি চায়। ওর ভেতরে ভয়টা জাপটাই ধইরছে। এট্টুখানি হোলা, যা দেয় হক্কলটা গিলি লয়। আঙ্গ উঠানের এক কোনায় কলাগাছ মাথা তুলি দাঁড়াই আছে। আঁর হোলাটা বাড়ি থাইকলে কলার কাঁদির দিকে চাই থায়। কী যে ভাবে ওই জানে। হেতে ভাবে এইডা ওর নিজের বাড়ি, নিজের ঘর, নিজের মাডি। আঁরে দুঃখ করি কয়, মা আইজকাল বেক কিছু আঁর হর হর লাগে ক্যান। এই কথার উত্তর আঁই ক্যামন করি দিমু। আঁর হৌড়ি কয়, হোলাটারে বউ তুই জোর করি শহরে হাডাইলি। কত চোয়ের জল হালাইছে, তোর এট্টুখানি মায়াদয়া হয়নি? আঁর হৌড়ি খালি আঁরে দোষ দেয়। মায়ের মন বোঝে না। আরে বাবা হক্কল কিছুর লগে যুজি বাঁইচতে শিখতে হইব। মনে সাহস আইনতে হইব, না হইলে চইলব ক্যামনে! অবস্থাটা যে ভালা নয়, জানি। কী করার আছে, লেয়াহড়া বন্ধ করি বাড়ি বই থাইকলে জাইনব কী করে চাইরদিক দিন দিন ক্যামন হাল্টাই যার। হেতেরে তো শিখত হইব এই দ্যাশটার নাম পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিমাদের হাতের পুতুল, যতই বঙ্গবন্ধু বাংলা বাংলা করুক, হিন্দুদের দ্যাশভাগের আগের সম্মান হিরাই দিতে হাইরব? যারা ভারতে চলি গেছে না থাইকত হারি হেগোরে তো আমরা হিরাই আইনতাম হাইরতাম ন। যারা এত অত্যাচার সহ্য করিও মাডি কামড়াই হড়ি আছে, কী দশা হইব আঙ্গ? মুসলিম লীগ তো কয় এই দ্যাশ হেতাগো দ্যাশ, হিন্দুদের জায়গা হইত না ইয়ানে, আইজ না হয় কাইল চলি যাইতই হইব। কীসের ভরসায় আমরা থাইয়ুম। আঁই কী বুঝি না, আঁর হোলা কিয়ের লাই চোয়ের জল হালায়। ওর লগে কীরম ব্যবহারটা হয় হিন্দুর হোলা বলি। মা, আমার মনে আছে সব, আঁর বাপের দ্যাশের হরিচরণ কাকার মাইয়ারে তুলি লই যাই রাতারাতি মুসলমান করি বুড়া হুজুরের লগে বিয়া দিল, জয়িতা হই গেল আমিনা বেগম। আঁর মাইয়ার লাই চিন্তা হয়, আঁই জানি না দিন হাল্টাইব কিনা, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্নে আঙ্গ জায়গা কন্নাই হইব ভগবান জানে।
রেডিওর সাউন্ডটা বাড়াই দিলে হুরা বাড়িটা গমগম করে। ইয়াহিয়া খান আঙ্গ দ্যাশের মিটিং মিছিল লই কত কতাই না বইলল, আঁর মাথায় ওগো কতা কিছুই ঢুইকল না, খালি শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানী এই দুইঢা নাম ঘুরিফিরি আইল। বুইঝলাম কতার মধ্যে কোনও ছিরিছাদ যাগো নাই তারা কেন্নে আঙ্গ দ্যাশ শাসন কইরব, আঁঙ্গ মনের কতা বুইঝবার হেথাগো সাধ্য আছে নি। ইয়াকুব খান এই দ্যাশের হর্তাকর্তা, ওরা কয় পাকবাংলার গভর্নর। এই খান সাবরে লই কত কতা হুনি। হেতেনের নাকি বাঙালিদের লাই কত দরদ, বাংলা বলা শিখছে, আঙ্গ দ্যাশের সুখ দুঃখের কতা পশ্চিমাদের জানাইলেও কোনো কামে আয় ন। ইউসুফ মাষ্টার কইছে হেথেনে নাকি এও বিশ্বাস করে শুধু ধম্ম দিই বিচার কইরলে পূব আর পশ্চিমাদের লগে সম্পর্ক টিকি থাইকত ন, আরও ভিতরে ঢুকি দেখার দরকার আছে, না হইলে পাকবাংলা শাসন করা মুশকিল হই যাইব। চোরা না হোনে ধম্মের কাহিনী, যা হবার তা হর। ইউসুফ মাষ্টারের উপরে খড়্গ নামি আইছে। হিন্দু মুসলমানরে এক চোয়ে দেইখলে হেথাগো অসুবিধা হর, হোনা যার মাষ্টারের চাকরি চলি যাইত হারে। বেডারা ইস্কুলডার লাই এক হয়সাও খরচা করে না, নতুন কোনও মাষ্টারও দেয় না। ইসকুলডার দেয়াল ভাঙ্গি হরের। মুরুক্ষু বানাই ধনে হরানে কাঙাল করি আধমরা করি ছাইড়ব। দ্যাশভাগের হরে বিহারী মুসলমানরা যারা এই দ্যাশে আইছে, হেগুনরে উর্দু মাষ্টার বানাই চাকরি দের, ইউসুফ মাষ্টারের মতো বাংলা হড়ানোর মাষ্টার আর কোন কামে আইব।
ভাবী বঙ্গবন্ধু হেই কারণেই এই দ্যাশে স্বশাসন
দাবি কইরছে।
হেইডা আবার কী?
আমাগো দ্যাশ, মানে হল গিয়া বাঙালিদের দ্যাশ বাঙালিরাই শাসন কইরব।
মাষ্টার, আমনে কী ভাইবছেন, এত সহজে হেথারা আঙ্গরে এই অধিকার দিব। এইটা খুব মুশকিলের কাম।
পশ্চিমারা বাহান্ন সালে হেতাগো উর্দু ভাষাখান আঁঙ্গ বাঙালিদের মুয়ে বসাইতে চাইছিল, সফল হয় ন, অন ভাতে মাইরতে চায়। এমন করি কি চলে, মানুষ আইজ না হয় কাইল গর্জি উইঠবই উইঠব।
আমাগো হোলামাইয়াগুলার শিক্ষাদীক্ষা নাই, চাকরি নাই বাকরি নাই, না খাই মরার জোগাড়, আনাজপাতির দাম মাঙ্গা, চাইল, ডাইল, ঢুল্লার শাগ, মাইরার শাগেরও আকাল, আর পশ্চিমারা সিংহাসনে বই হা দোলার। কারে কাছে দুঃখের কতা কই হরান জুড়াইয়ুম কন চাই মাষ্টার। দেইখতে দেইখতে ভাইঙতে ভাইঙতে সোনার দ্যাশটা ক্যামন ঠুণ্ডা হই গেল। আঁঙ্গ দ্যাশের পশ্চিমাদের দোসররা এই সার কথাখান বুইঝত হারেন না, হেতারা আঙ্গ দ্যাশের ধন সম্পত্তি লুডি লই হেতাগো দ্যাশের সিন্দুক ভর্তি করের। অন না বুইঝলে আর কবে বুইঝব। হিন্দু মুসলমান করি করি আঙ্গ দ্যাশটা একবারে উচ্ছন্নে গেল, আর বাকি হরিচয়খান ধুলায় মিশাই দিল। এই জাতটারে কে বাঁচাইব, বেঘোরে মইরব। ইঁংরাজরা যাইবার কালে মারি দি চলি গেছে, পশ্চিমারাও হেই কামাই করের।
এরম করি কইয়েন না ভাবী, বুয়ের ভিতরে চিন চিন করে। তবে আমনের ভাবনার প্রশংসা না করি হাইরতাম ন। এত বোঝেন ক্যামনে কন দেখি।
বুঝি মাষ্টার বুঝি, কত কতাই বুঝি, খালি হোনাইবার লোক হাই না।
ওমা, এরা যায় কনডাই, তাইলে একটা সুরাহা হইল। মাইনষের মনে দ্যাশের লাই হরান কাঁইদল। ভালা লক্ষণ কইতেই হয়। কোনমুই যামু। কুরবান আলী, আকবর, প্রতাপ, অমূল্য, মনসুর আহমদরা জোরে জোরে হা চালায়। হেগুনরে যে চিল্লাই জিগাইয়ুম হেই সুযোগ নাই। চাষের কাম ছাড়ি, বদইলার কাম ছাড়ি, দোয়ান বন্ধ করি, ইস্কুলের হড়া বন্ধ করি গলা হাডাই কত কী দাবির কথা হোনাইতে হোনাইতে ওরা চলি যার। কারে হোনার আর কেই বা হোনের হেসবের তোয়াক্কা করের না। ওরা নাড়া মাড়াই যার, বৈশাখ মাসের চড়া রোদ খাইতে খাইতে যার, উদোম গায়ে একজন অন্যজনের হাতের উপরে হাত রাখি যার, বাঁইচব কি মইরব এই কতা আর কারই বা জানা। হাঁইটত হইব, মাইলের পর মাইল হাঁইটত হইব, কোনো এক ডাক হেগুনরে চুম্বকের মতো টানি লই যার। হতের কথা হুইনত না তো কার কতা হুইনব। এত অন্যায়, এত অবিচার, এত ব্যাভিচার নামি আইছে অন যদি গলা না মিলায়, তবে আর কবে মিলাইব।
আঁর স্বামীর চিন্তা বাড়ছে, হোলাডারে আর ধরি রাইখত হারেন না। হেতে লুকাই লুকাই মিছিলে মিছিলে হা মেলার, শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে বক্তিমা করের। হুনিয়ের আওয়ামী লীগে নাকি নাম লেখাইছে। চিন্তায় চিন্তায় আঁর ঘুম আইয়ে না, বড় হোলা কইলকাতায়, হেতে বাস্তুহারা আন্দোলনের নেতা হইছে। আঁঙ্গ দ্যাশে এই হোলা বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছুডি যার। কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক মিলাইতাম হারিয়েন না। যে মুসলমানের হোলাগুন ওর বাবারে গাইল দেয়, কতায় কতায় মালাওন বলে,মুসলমানের দ্যাশ বলি গলা উঁচা করি ঘোরে, হেগুনের মুয়ের উপর জবাব দিবার লাই কি বঙ্গবন্ধুর দল ওর এত হচন্দ। যে হোলা কোনদিন রা কাইরত না, হেই হোলা ক্যামনে এত কতার জবাব দেয়, বঙ্গবন্ধুর এলেম আছে কইতে হয়। এট্টুখানি নাতির কথা ভাবি ভাবি আঁর হৌড়ি খানাদানা ছাড়ি দিছে, শরীলখান হুয়াই আমসি হই গেছে, আঁই তাকাইতাম হারি না, কত তোষামোদ করিও তালে আইনতাম হারিয়েন না। আর এক চিন্তা আই মাথার উপর চাপি আই বইছে। বাড়ির হোলাগুনও তাঁতি উঠছে। ইসকুল তুন আইবার সময় কত কতা হোনে আর হিগাইন কলম দোয়াত লই হিষ্টা ছিঁড়ি ছিঁড়ি লেয়। আঁর তো মাথায় হাত। মোল্লা হাড়ার হোলাগুনও আই হেগুনের কানে ফিসফিস করি কানে ফুসমন্তর দেয়। হেগুনের বাপেরা বলা কওয়া করে – আঙ্গ যে ঘর গেরস্থালি ভালা ন, দুবেলা হেঢে ভাত হড়ে না, হিগাইনের লাই পশ্চিমারা দায়ি, জোচ্চুরি করি লই যার বেগ্গাইন, অধিকার ছিনাই লইত হইব, হক্কলে প্রস্তুত হ। বঙ্গবন্ধু হক্কল বাঙালিদের এক হইবার লাই কইছে।
বুইঝতাম হারিয়ের আর একখান ঢেউ আইয়ের, হক্কলে এক জোট হনের লাই কোমর বাঁধের।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)