তুষার বরণ হালদার
লেখক পরিচিতি
(তুষার বরণ হালদার নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রাম থেকে স্কুল শিক্ষা শেষ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি পান নদীয়া জেলার অসংগঠিত শিল্প ও শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে । গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে দুটি বই এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ও জার্নালে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ কর্তৃক প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের জন্য তিন বার পুরস্কৃত হন। এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য। বর্তমানে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত দক্ষিণবঙ্গের একটি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক।)
ইতিহাসাচার্য স্যার যদুনাথ সরকার (১৮৭০ – ১৯৫৮)
( প্রাককথন: ভারতবিদ্যাচর্চা কলামে আজ যার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হবে তিনি পুরোনো দিনের একজন শুধু ভারতখ্যাত নয়, বিশ্বেও তাঁর কীর্তি সমাদৃত। বর্তমানের স্কুল কলেজে ইতিহাস পড়ুয়া ছাত্র -ছাত্রীরা এই আদর্শনিষ্ঠ ও পন্ডিত ঐতিহাসিকের সারস্বতসাধনা সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। অথচ তাঁর সামগ্রিক জীবন সম্পর্কে যদি অবহিত হয় তাহলে আমাদের পড়তে পড়তে বিষ্ময় জাগাবে। একজন ইতিহাসের সাধরণ ছাত্র ও মাষ্টারমশাই হিসাবে তাঁর সম্পর্কে একটি দীর্ঘ আলোচনা করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। তাই কিছু কিছু করে কয়েকটি পর্বে স্যার যদুনাথ সর্ম্পকে লিখব।)
শেষ পর্ব
এই পর্বে স্যার যদুনাথের প্রধান গ্রন্থগুলির পরিচয় দেওয়া যেতে পারে। ১৯০১ সালে প্রকাশিত India of Aurangzib নামক গ্রন্থে তিনি মুখ্যত মুঘল শাসনাধীনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বিবরণ, রাজস্ব সংক্রান্ত তথ্যাবলী, পথঘাট ইত্যাদি সর্ম্পকে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন। এই ব্যাপারে তাঁর প্রধান সহায়ক উপাদান ছিল, ফার্সি রচনা। যদুনাথ খুব ভালো ফার্সি ও উর্দু জানতেন। যার ফলে তিনি মূলে গিয়ে কোনো বিষয়ের সত্য আহরণে সক্ষম হয়েছিলেন।কারণ মধ্যযুগের ইতিহাস নির্মাণে উর্দু বা ফার্সি জানা একান্ত প্রয়োজন ছিল। আকবর ও ঔরঙ্গজেবের তুলনামূলক আলোচনাও এ গ্রন্থের অন্যতম উপজীব্য। মোঘল যুগ সর্ম্পকে গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর পরবর্তী সুবিখ্যাত গ্রন্থ History of Aurangzib এ। পাঁচ খন্ডে এই গ্রন্থ সমাপ্ত হয়েছে। মুঘল ইতিহাসের উপর এ এক আকরগ্রন্থ। প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ডে ঔরঙ্গজেবের জন্ম অর্থাৎ ১৬১৮ থেকে তাঁর রাজ্যভিষেকের কাল ১৬৫৯ সাল পর্যন্ত ভারত ইতিহাসের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। ঔরঙ্গজেবের পুরো রাজত্বকালের আলোচনা পরবর্তী তিন খন্ডের বিষয়বস্তু। মুঘল ইতিহাসের এই মহাগ্রন্থ রচনার সময় তিনি মোঘল যুগের রাজভাষা, ফার্সিতে রচিত সমসাময়িক সরকারি ও বেসরকারি ইতিবৃত্ত, ফরমান, চিঠিপত্র, দলিল – দস্তাবেজ ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করেছিলেন।এজন্য ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু পরিশ্রমে এই সমূহ আকর উপাদান সংগ্রহ করতে হয়েছিল।
মোঘল আমলের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে যদুনাথের দৃষ্টি মারাঠা জাতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলো। মোঘল – মারাঠা দ্বন্দ্বের মধ্যেই মারাঠা রাষ্ট্রের বিকাশ ও শিবাজীর উত্থান। বিপুল মারাঠা উপাদান সংগ্রহ করে রচনা করলেন Shivaji and His Times। এ জন্য তাঁকে সমসাময়িক ফার্সি ইতিবৃত্ত, মারাঠি বখর, শকাবলী ও কাগজপত্র, ডিঙ্গল (প্রাচীন রাজস্থানী কাগজ পত্র), সংস্কৃত ও হিন্দি কাব্যাদি, ইংরেজী এবং পর্তুগিজ ভাষায় রক্ষিত উপকরণের চর্চা করতে হয়েছিল। এও এক প্রামাণ্য গ্রন্থ।
তাঁর আরেকটি অতীব মূল্যবান গবেষণা নাদির শাহের ভারত ত্যাগের কাল থেকে ১৮০৩ সাল পর্যন্ত মোঘল শাসনের অবলুপ্তির ইতিহাস Fall of the Mughal Empire শীর্ষক চার খন্ডে বিরাট গ্রন্থ রচনা। মোঘল ইতিহাসের এও আরেক মহাগ্রন্থ। এই গ্রন্থটিকে অনেক ঐতিহাসিক বিখ্যাত ইউরোপীয় ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গীবনের Decline and Fall of the Roman Empire এর সমগোত্রীয় বলে মনে করেন। মোঘল ও মারাঠা ইতিহাস চর্চায় স্যার যদুনাথকে বাদ দিয়ে কখনোই কোনো লেখা বা পাঠ করা সম্ভব নয়।
মোঘল যুগের শেষ দুশো বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস ব্যতীত তিনি আরো বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। রচনা করেছেন অজস্র প্রবন্ধ। সবই যে ইতিহাস ভিত্তিক তা নয়। সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন বিষয়ক বহু রচনা লিখেছেন। তিনি ‘চৈতন্যচরিতামৃত ‘ এর ইংরেজি ভাবানুবাদ chaitanya’s Life and Teachings প্রণয়ন করেন। চৈতন্য চর্চায় এই গ্রন্থটির মূল্য অসীম। এছাড়াও আওরঙ্গজেবের সমসাময়িক হামিদউদ্দিন খাঁ লিখিত ফার্সি গ্রন্থ ‘ আহখম – ই – আলমগিরি ‘ – র ইংরাজী অনুবাদ Anecdotes of Aurangzib রচনা করেছিলেন। অর্থাৎ একজন মানুষ কতো বিচিত্র দিকে তাঁর প্রতিভাকে উদ্ভাসিত করেছিলেন। তাঁর এই কর্মদ্যম এর মধ্যে অভিব্যক্ত হয়েছিল ভারতবিদ্যাচর্চার নানা দিগন্ত। বাংলাতেও তিনি কলম ধরেছিলেন, সেখানেও বিষয় বৈচিত্র ছিল বিচিত্র। দীর্ঘ জীবনের অধিকারী এই মানুষটি আজীবন কাজ করেছিলেন ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটনের জন্য।