তপোপ্রিয়
জন্মান্তরের কবিতা
একটি মানুষ কিভাবে তৈরি হয় ? নিজেকে দেখে বোঝার চেষ্টা করি। যেখানে আছি আমাকে দেখে আমারই কেমন ধাঁধা লাগে। এ কি সেই আমি যাকে খুঁজে পাই অন্য সব দিনগুলির মানচিত্রে ? আমাকে কখনো দেখি কোন এক আশ্চর্য পথে, সেই পথ নাগালে না থাকলেও জানি একদিন নিয়মিত হাঁটতাম ওখানে। আবার আমি আমাকে দেখি দাঁড়িয়ে আছি কোন একটি জলার ধারে, ডাকমা জলা, তার পুব আর উত্তর দিকটা ছবি—- জলা থেকে ঢালে উঠে যাওয়া উঁচু-নিচু জমির কাঁথায় ঝাঁকড়া-মাথা গাছগাছালি আর ধনুক-চালা কুঁড়েঘরের নকশা। অবাক লাগে আমি কখনো সেখানে ছিলাম যখন ভাবি। এই জীবনেই।
আজও আমি ওই পুকুর আর জলার ধারে গিয়ে দাঁড়াই, ভাবনায়, আর দাঁড়ালে দেখি আমার মাকে। মা আজ আমার কাছে স্মৃতি, আসবে এই দিনটা কোনদিন জানতাম। প্রস্তুত থাকলেও এখন যখন এলো কিছুতেই মানতে পারছি না। ধান বোনা আর ধান কাটার মরশুমগুলিতে মাকে দেখি হরদম ওই জলার ধারে, এছাড়াও সারাদিন যখন-তখন নানা কাজে যেত মা ওই পুকুরধারে, স্নান সারতে বা ঘাস তুলতে। মায়ের যে আমার কত কাজ ছিল সারাদিন জুড়ে, কাজ আর দুশ্চিন্তা। জমি-বাড়ি সবই এ দেশে এনে বাবা মারা গিয়েছিল, কার ভাগে কতটা কিছুই ঠিক নেই। যাদের সঙ্গী করে এনেছিল বাবা তারাই এখন সব ছিনিয়ে নিতে উদ্যত। তাদের সঙ্গে লড়াই মায়ের দিনরাত। তারা দলে ভারি, অনেক জনতার জোর তাদের, আশেপাশের লোকজনরাও সব ওদেরই পক্ষে। মায়ের আর কে আছে ? বড় মেয়েটির সতের-আঠেরো বছর, ষোল-সতেরোর বড় ছেলেটি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে, পাঁচ-ছ’ বছরের ছোট ছেলেটি আবার শারীরিকভাবে দুর্বল। মায়ের একা লড়াই, সঙ্গী শ্রীগোবিন্দ।
জমিতে আমাদের ধান হয় বছরে বড়জোর চল্লিশ মণ। একফসলী জমি, কেবল বোরো ধানের চাষ। ওই ধানের জমি ডাকমা জলায়। জলাজমি ছাড়া আছে টিলার উঁচু জমি, অধিকাংশটা জুড়ে আম-কাঁঠাল আর আনারসের বাগান আর জঙ্গল। ওখানে ফাঁকা মাঠও আছে, তাতে নামমাত্র ফসল হয়, নামমাত্রই। জলাজমির তুলনায় টিলা জমির আয় দশ ভাগের এক ভাগও নয়। এমনকি আম-কাঁঠাল আর আনারসের বাগান থেকেও বছরে খুব কমই টাকা আসে।
আনারস আর কাঁঠাল বাগানটা বেশ বড়, এমাথা ওমাথা ঘুরে আসতে এক-দু’ ঘন্টা লেগে যায়। অবশ্য ঘুরে আসাটা মুখের কথা নয়, বুনো ঝোঁপ আর জংলা গাছের এমন জঙ্গল যে প্রায়ই চলা দায়। ওই জঙ্গলে ঝাঁক ঝাঁক শেয়ালের বসবাস, এখানে ওখানে তাদের অজস্র গর্ত। রাত্তিরে তারা প্রহরে প্রহরে সমস্বরে ডাকে, দিনেও নির্ভয়ে সারা জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়। আর আছে বনবেড়াল, বাঘডাশ জাতীয় প্রাণী। সাপ রয়েছে প্রচুর, কিছু কিছু খুবই বিষাক্ত।
একবার এক কাণ্ড হয়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার দু’-এক বছর পরের ঘটনা হবে হয়তো, মায়ের তখনও মনের অবস্থা বড়ই বিষণ্ণ। কাজে-কর্মে মন বসাতে পারছে না, আবার না বসালেও নয় বুঝে অস্থির হয়ে থাকে। সে যে কী উভয়সংকট চলছিল মায়ের বোঝার কেউ ছিল না তখন। পরেও কি মা তার সেদিনের মর্মান্তিক মর্মবেদনার কথা বোঝাবার কোন উপযুক্ত সঙ্গী পেয়েছিল কখনও ?/ আমাকে বললে আমি শুনতাম এই যা। কতটা মায়ের সঙ্গী হতে পারতাম ? সেই যে মা বলত,
‘কেঁদে কেঁদে একদিন শেষে দেখি কী, ও মা, আমি যে চোখে কিছুই দেখতে পাই না ! কানা-মানা হয়ে যাব নাকি শেষে ? তাহলে আমার তপুর কী হবে ? ওকে কে দেখবে ? সেদিন থেকে ভাবলাম, দূর্, যে গেছে সে তো গেছেই। বসে বসে ঘরের মধ্যে কাঁদলে তো আর তাকে ফেরত পাবনা ? বরং যারা বেঁচে আছে তাদেরও প্রাণ যাবে।’
মাটির জগতে মায়ের সেই ফিরে আসা কতটা কঠিন ছিল আমি আজ কিছুটা কি বুঝতে শিখেছি ? যখন মগ্ন হই কোনকাজে, অন্তঃস্থলের কোন তাগিদে, আর আনন্দ পাওয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়, হঠাৎই কোত্থেকে একটা পিন সূক্ষ্ম খোঁচা মেরে জানায় আমি কী হারিয়েছি। ব্যাপক শূন্যতা তখনই সর্বগ্রাসী হাঁ-মুখে গিলে নিতে থাকে আর আমি ক্রমশ অবশ-আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। থেমে যেতে থাকে আমার সমস্ত কাজের উন্মাদনা। কেবলই আমার সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে বাজতে থাকে ‘মা নেই-মা নেই’ হা-হা রণন। অথচ আমাকে আনন্দে রাখার আয়োজনগুলিও তুলনায় কী প্রবল ! মায়ের সেই ফিরে আসার প্রক্রিয়াকে কোনভাবেই মেলাতে পারি না আমার সঙ্গে। আমি ফিরে আসতে পারছিনা এখনো অথচ মা ফিরে এসেছিল অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায়। মায়ের সেই ফিরে আসার দিনগুলিতে যতরকম ঘটনাবলী তার মধ্যে সেই কাণ্ড, আজও চোখে ভাসে।
হয়েছিল কী, একটা বাঘ এসে নাকি কোত্থেকে জুটেছিল আমাদের কাঁঠাল-আনারস বাগানে। সকালবেলাতেই লোকে-লোকারণ্য ওই জঙ্গলের লাগোয়া মাঠে। কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে দা—- যে যা পারে নিয়ে হাজির। কাছেই আমাদের টিলার কাঁঠাল গাছ, চেহারাটা ছোটখাটো, কাঁঠাল ধরলে মাটিতে লেগে যায় আর শেয়ালগুলির পোয়াবারো। মায়ের খুব হা-হুতাশ গাছটার বোকামি দেখে। সত্যিই কী বোকা গাছ ! ফল ফলাবি তো ফলা একটু ওপরদিকে যাতে কেউ নাগাল না পায়।চেহারায় ছোট হলে কী হবে কাঁঠাল ফলত গাছটা বিপুল পরিমাণে। অবশ্য কোয়াগুলি সব শক্ত-শক্ত, চলতি ভাষায় বলত সবাই, চাউল্লা কাঁঠাল ।
ওই অঞ্চলে ভাষাটা আমাদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ, ভাষার স্বকীয়তা বলতে কিছুই আর ছিল না। পূর্ববঙ্গ থেকে উৎখাত হয়ে যে লোকগুলি এসেছিল তাদের কেউ ঢাকার, কেউ চিটাগাং-এর, কেউ নোয়াখালির, কেউ কুমিল্লার। তারা ত্রিপুরায় এসে একপাত্রে ব্যঞ্জন, মিলেমিশে একাকার। ওই জঙ্গলে ছাওয়া পার্বত্য প্রদেশে এখন বেঁচে থাকার যুদ্ধটাই মুখ্য। কত যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের এভাবে অপমৃত্যু ঘটে গেল ! ভাষার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অহরহ লক্ষ করা যেত। মায়ের বাড়ি ছিল ঢাকায় আমরা কুমিল্লার। মা আর আমরা কাঁঠালকে কাঁঠাল বলতে অভ্যস্ত ছিলাম। অধিকাংশ লোকরা বলত, কাডল আর নোয়াখালীর লোকরা কান্ডল ।
কে যে প্রথম আবিষ্কার করেছিল ছোট মাঠটার ধারের ওই জঙ্গলে বাঘ এসে আশ্রয় নিয়েছে কে জানে ! সন্ত্রস্ত জনতার কোলাহলে আমরা টের পেয়েছিলাম। বাঘটা নাকি রুগ্ন আর কিছুটা অশক্ত। সমবেত জনমণ্ডলীর মধ্যে অনেকেই মাতব্বর। তাদের কত কত উপদেশ আর বিধান। মা আমার ঘরে আমাদের কাছে বলেছিল,
‘বাঘ না কচু ! ওরা কেউ জন্মে বাঘ দেখেছে ? বাঘ চেনেই না।’
ছোট মাঠটার একদিকে টিলার সেই কাঁঠাল গাছ, তার লাগোয়া অন্যদিকে বাঘাশ্রিত ওই জঙ্গল। তার পাশ দিয়ে টানা রাস্তা চলে গেছে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত, রাস্তার ওধারে আবার টানা মাঠ। ওই ছোট মাঠের অন্য পাশটায় চওড়া আলের পর আরেক মাঠ, সেই মাঠের ওধারে একটা বিশাল লিচু গাছ আর রাস্তার সঙ্গে যেখানে মাঠটা মিশেছে সেখানে আমবাগানের সূচনা। ওই লিচুতলার মাঠে দুই মাঠের মধ্যবর্তী ঘাসে ছাওয়া চওড়া আলের ধারে বসে এক বিকেলে আমি অতি দীর্ঘ এক কবিতার শেষাংশ লিখেছিলাম। লিখতে লিখতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। কাছেই আবার রাস্তাটার ঠিক গা ঘেঁষে এক দীর্ঘদেহী কুলগাছ। সেই একনিষ্ঠ কিশোর কবিটিকে এখনও আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। চোখ না বুজেও। তার চোখে তখন অজস্র স্বপ্ন। কত কিছু করে ফেলার প্রতিজ্ঞা বুকের খাঁচায়। তার দু’-দিন পরই ত্রিপুরা ছেড়ে কলকাতায় চলে আসার কথা আমাদের।
প্রায় ত্রিশ বছর আগে সেই সহজ কবিকে আমি ফেলে এসেছি তপস্যাস্নিগ্ধ এক ঘাসের মাঠে। তারপর ত্রিশ বছরের জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় তাকে হারিয়ে ফেলেছি। এখন তারা সবই আমার কাছে জন্মান্তরের ইতিহাস। আমার সেই শৈশবের বৃন্দাবনে এখনও ধবলী-শ্যামলীরা ঘুরে বেড়ায়। অথচ আমি জানি, তাদের আর ফিরে পাব না। পিছনে তাকালে কেবল কষ্ট বুকে ঘনীভূত হয়, নিশ্চল হয়ে আসে চেতনা। ওই মাঠের ধার ধরে আমি দেখি সন্ধে-লাগা লগ্নে মা আমার ধলী গাইটাকে রুগ্ন বাছুরসমেত ঘরের দিকে নিয়ে চলেছে। আমি তাকিয়ে থাকি তাকিয়ে থাকি, আচ্ছন্ন আর অবসন্ন চারদিক। নিরাকার, বোবা, বিবর্ণ।