প্রীতন্বিতা

ওজোনস্তরে গর্ত 

পরিবেশ ইদানীং আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা দিক থেকে .প্রকৃতিকে অক্ষুণ্ন রাখার চিন্তাটা নতুন কিছু নয়। প্রাচীন যুগ থেকেই একদল মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদগুলির সুরক্ষা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে এসেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিবেশ ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে অন্য কারণে। বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে মানুষ জানতে পেরেছে যে পৃথিবী ও প্রাণী জগতের প্রতিরক্ষা বলয়ে ফাটল দেখা দিয়েছে। যদি এই প্রতিরক্ষা বলয় ভেঙে যায় তো পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব মুছে যাবে। 

পৃথিবীর প্রতিরক্ষা বলয় টি কী ? কোথায় বা তার অবস্থান ? সামগ্রিকভাবে, পৃথিবীকে কম্বলের মত জড়িয়ে রাখা বায়ুমণ্ডল এই প্রতিরক্ষা বলয়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের সমস্তটাই প্রাণী জগতের রক্ষাকবচ নয়। খুব নির্দিষ্ট অর্থে, বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে অবস্থিত ওজোন গ্যাসের আস্তরণ হচ্ছে প্রাণীজগতের আসল রক্ষক।

মজার কথা হল এই যে পাংশু নীল রংয়ের ওজোন গ্যাস কিন্তু বিষাক্ত। অল্প পরিমাণ ওজোন গ্যাস জীবনের জন্য ক্ষতিকর। বৈদ্যুতিক ডিসচার্জ থেকে ওজোন পাওয়া যায় আর এর বিশ্রী গন্ধ রয়েছে। ভূস্তরের কাছাকাছি ওজোন গ্যাস কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে জন্ম নিতে পারে। রাসায়নিক শিল্পে এবং জল জীবাণুমুক্ত করতে ওজোনের ব্যবহার থাকলেও এই গ্যাসের সংশ্রব মানুষের জন্য একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে থাকলে ওজোন জীবনরক্ষার অপরিহার্য উপাদান। যে সূর্যকিরণ ছাড়া পৃথিবী অচল, তাতে রয়েছে ভয়ংকর অতিবেগুনি রশ্মি। এই রশ্মির সংস্পর্শে জীবনের অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়। পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ ঘটতে পেরেছে যেহেতু সূর্যের মারাত্মক অতিবেগুনি রশ্মি ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছায় না। বায়ুমণ্ডলের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অঞ্চলে থাকা ওজোন গ্যাসের আস্তরণ সূর্যকিরণ থেকে ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি শুষে নেয়। পৃথিবীতে প্রাণী জগতের প্রতিরক্ষা বলয় হিসেবে ওজোন গ্যাসের স্তর এভাবেই কাজ করে যার অভাবে এখানে প্রাণের কোন অস্তিত্ব দেখা যেত না। 

ওজোন গ্যাস কী ? ওজোন আসলে অক্সিজেনের এক বিশেষ রূপ। অক্সিজেনের একটি অণু গঠিত হয় দুটি পরমাণুর সমন্বয়ে, সেখানে ওজোনের একটি অণুতে থাকে তিনটি পরমাণু। জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য এই একটি মাত্র পরমাণুর। 

ওজোন স্তরের অবক্ষয়ের জন্য মূলত ক্লোরিনঘটিত রাসায়নিক ক্লোরোফ্লুরোকার্বনকে দায়ী করা হয়। সভ্য মানুষের শিল্পভিত্তিক কিছু উৎপাদন এই রাসায়নিকের জন্ম দেয়। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন মন্ডলের যে ফাটল দেখা দিয়েছে সেটা প্রথম জানা গিয়েছিল আজ থেকে প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগে, ১৯৮২ সালে। ১৯৫৬ সাল থেকে বিজ্ঞানীরা প্রত্যেক বছর বসন্তকালে উর্ধাকাশের ওজোন গ্যাসের পরিমাণ মাপা শুরু করেছিলেন। আন্টার্কটিকার হ্যালি বে নামে এক অঞ্চলকে এজন্য বাছাই করা হয়েছিল। পরিমাণ মাপা হত যে যন্ত্রে তার নাম স্পেকট্রোফটোমিটার। প্রায় ২৫ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ওজোন মাপার কাজটি রুটিন হিসেবে করে আসছিলেন। ১৯৮২ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা কাজটি করতে গিয়ে এক আজব ব্যাপার লক্ষ্ করলেন। তাঁরা দেখতে পেলেন যে আন্টার্কটিকার মাথার ওপরে অবস্থিত ওজোন স্তরে একটা বড়সড় গর্ত। এই গর্ত আসলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অনেকটা জায়গা জুড়ে ওজোনের পরিমাণ লক্ষণীয়ভাবে পাতলা হয়ে যাওয়া। প্রথমেই বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, ব্যাপারটা বোধহয় কোন যান্ত্রিক ত্রুটির ফল, কারণ যে স্পেকট্রোফটোমিটার যন্ত্র নিয়ে তাঁরা কাজ করছিলেন তা বেশ পুরনো। ইংল্যান্ড থেকে নতুন যন্ত্র এনে ব্যাপারটা ভালোভাবে পরীক্ষা না করে বিজ্ঞানীরা সবকিছু চেপে গেলেন। কিন্তু পরবর্তী দু’বছর নতুন যন্ত্রে টানা পরীক্ষা করে তাঁরা স্পষ্ট প্রমাণ পেলেন যে সত্যি প্রত্যেক বসন্তে আন্টার্কটিকায় ওজোন স্তরে গর্ত দেখা যায়। 

আবিষ্কারটা প্রকাশ পাওয়ার পর চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধান চালিয়ে গর্তটা সম্পর্কে নিঃসন্দেহে হতে পারল। নাসার পরীক্ষা থেকে গর্তটার আয়তন জানা গেল। বিশালত্বে এটি মার্কিন মুলকের সমান, আর গভীরতায় মাউন্ট এভারেস্টের মতো দীর্ঘ।। 

পরের কয়েক বছরে জোরদার পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে জানা গেল যে প্রত্যেক বসন্তে আন্টার্কটিকায় ওজোন স্তরে এই গর্ত আসলে ক্লোরিন ঘটিত। আরও স্পষ্টভাবে, ক্লোরিন মনোক্সাইড জাত। ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ভেঙেই এই ক্লোরিন বাতাসে মেশে। মজার কথা হল এটাই যে ক্লোরিনের এই ক্ষতিকর যৌগ আন্টার্কটিকা অঞ্চলে উৎপন্ন হয় না, কারণ সেখানে কল-কারখানা একেবারেই নেই। তবুও পৃথিবীর অন্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে এই যৌগ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে গিয়ে আটকে থাকে এবং মেরু অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে সেখানে গিয়ে শীতের পর বসন্তের সৌরকিরণে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

হিসেব করে দেখা গেছে যে ওজোন স্তরের ঘনত্ব প্রতিবছরই একটা নির্দিষ্ট হারে কমে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া যদি অব্যাহত থাকে তো অদূর ভবিষ্যতে সমগ্র স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অঞ্চলেই ওজোন মণ্ডল হালকা হয়ে যাবে এবং সূর্যের ভয়ানক অতিবেগুনি রশ্মি বিনা বাধায় সরাসরি ভূপৃষ্ঠে নেমে আসবে। পৃথিবীর বুক শ্মশান হয়ে যেতে তখন আর বেশি সময় লাগবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *