অরিত্রী দে
দ্বাদশ পর্ব
‘ইকোক্রিটিসিজম’- একটি ‘গ্রিন’ পরিভাষা কিংবা আরো কিছু
Joseph W. Meeker প্রথম ‘Literary ecology’ শব্দবন্ধ চালু করেন। পরে ১৯৯৬ সালে William Rueckert ব্যবহার করেন ‘Eco-criticism’ কথাটি। ‘Eco-criticism’ বলতে আমরা আমাদের কৃষ্টিগত/সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে (সংস্কারের ফসল) যেভাবে, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেকার সম্পর্ককে কল্পনা করা হয়, চিত্রিত করা হয়- তাকে বোঝায়। এটি আধুনিক পরিবেশ আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত। Greg Garrard তাঁর ‘Ecocriticism’ বইতে একবিংশ শতাব্দীর বিশেষত গত ত্রিশ দশক ধরে মানব-প্রকৃতি সম্পর্ক অধ্যয়নে যে যে পরিবর্তনগুলি দেখা দিয়েছে সেগুলি নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য (account) দিয়েছে। পরিবেশ যেখানে গাছ-পালা, লতাপাতা ও অজস্র সবুজ নিয়ে বর্তমান- সেটা দেখা মানেই কিন্তু cco-criticism না। বরং সবুজের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গ্রাফ যখন সাহিত্যের অধ্যয়নে চর্চিত হয়, তখন সেটা উক্ত ধরনের ক্রিটিসিজমের অন্তর্গত হয়। মানুষ-পরিবেশ সম্পর্কের বুননক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে সেই সম্পর্কের প্রেক্ষণবিন্দু থেকে
প্রকৃতিকে দেখা, তার মধ্যেকার উপাদানগুলির ভারসাম্যাবস্থা ও ভারসাম্য-হীনতা দুই’ই সাহিত্যে (literature) পর্যবেক্ষণ করাটা ecocriticism-এর অন্তর্গত। এই পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের ফলে প্রকৃতি ও চরাচরের প্রতি (পরিবেশ-প্রতিবেশ) মানুষের সচেতনতা, সংরক্ষণশীলতার প্রসঙ্গ আসে। অর্থাৎ মানব- প্রকৃতি সম্পর্কের বিন্যাস, পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা যখন সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় (ecocriticism) পরিবেশ সমালোচকরা তাদের সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণগুলি স্পষ্টতই এক সবুজ নৈতিকতা ও রাজনৈতিক বিষয়সূচি বা আলোচ্য সূচিতে বেঁধে রাখেন। ১৯৯০ এর সময়ে ‘Ecocriticism’-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি কাজের উদাহরণ হল – ওয়ার্ডস ওয়ার্থ ও শেলি’র সাহিত্য পর্যালোচনা। এই ক্রিটিসিজমের পরিধি যত বেড়েছে তত পরিবেশ সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন ও সমস্যা, এমনকি চিন্তাভাবনার দিক উন্মোচিত হয়েছে। ইকোক্রিটিক’রা পরিবেশগত ধারণা ও পরিবেশগত প্রকাশের সেই দিকগুলি খুঁজে পেতে চায় যা বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আলোচনা-সমালোচনার পরিসর তৈরিতে সক্ষম। তাঁদের প্রধান কাজই হল যতদূর সম্ভব পরিবেশ সাক্ষরতা তৈরি করা
আধুনিক পরিবেশবাদ শুরু হয় র্যাচেল কারসনের ‘Silent Spring’ (১৯৬২) গ্রন্থটি থেকে। বইটির প্রথম অধ্যায় ‘A fable for Tomorrow’তে দেখানো হয়েছে প্রাচীন আমেরিকার সেই প্রাচীন সময়কে, যখন প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে ঐক্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই বইটির বর্ণিত রূপকথা গল্প চারণভূমি ও মেষপালক সংক্রান্ত ‘প্যাসটোরাল’ ঐতিহ্যকে বহন করে, যেখানে আছে ‘সমৃদ্ধ খামার’, ‘সবুজ ক্ষেত্র’, পাহাড়ি শেয়াল, নীরব হরিণ, ফার্ন ইত্যাদি। কিন্তু এদের পারস্পরিক শান্তি, জালিক সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ‘Malady’ বা ব্যাধি ও ‘spell’ তথা জাদুমন্ত্র, বলা ভালো কু-জাদুমন্ত্রের দ্বারা। গ্রামীণ জীবনের প্রতিমা, প্রতীক গুলির প্রতিটি উপাদান ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে পরিবর্তনের প্রতিনিধি দ্বারা। এবং এই পরিবর্তনের রহস্য ক্রমিক ব্যবহারবিধির মাধ্যমে কেবলই বেড়েছে। ‘Silent Spring’ রূপকথার গল্পের মাধ্যমে দেখায় যে পৌরাণিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাহিনীটি অতিপ্রাকৃত হলেও তা মানুষের কৃতকর্মের ফল। আবার John Keats রচিত ‘La belle Dame Sans Merci’তে সুন্দরী একজন মহিলার জাদু দন্ডের রহস্যময় অশুভ প্রভাবে গাছপালা সহ প্রকৃতির বিভিন্ন অঙ্গ-উপাঙ্গে রোগ উপস্থিত হলেও আসলে আর কেউ নয়, মানুষই এর জন্য দায়ী- “No whichcraft no enemy action had silenced to the rebirth of new life in this stricken world. The people had done it themselves.” ‘Silent Spring’ দেখায় যে এরকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় গোটা আমেরিকায় শুরু হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে।
একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে
‘Association for Study of literature & the environment’ (ASLE) প্রথম ‘Ecocriticism’ নিয়ে চর্চা শুরু করে। আমেরিকায় প্রথম এর চর্চা শুরু হয়। ক্রমে ব্রিটেনে, জাপানে এই অ্যাসোসিয়েশনের শাখাগুলি চালু হয়। ১৯৯৮ সালে ISLE বা Interdisciplinary studies in literature and Environment শুরু হয় ব্রিটেনে৷ এমনকি বর্তমানে আয়ারল্যান্ডেও চালু হয়েছে। এর অফিসিয়াল জার্নাল ‘Green letters’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ‘Ecocriticism reader’, ইকোক্রিটিকাল প্রবন্ধের প্রাথমিক সংগ্রহের ভূমিকায়, শেরিল গ্লটফেল্টি সেই সময়ে বিদ্যমান পরিবেশগত সমালোচনার অভাবকে নির্দেশ করেছেন-
“If your knowledge of the outside world were limited to what you could infer from the major publications of the literary profession, you would quickly discern that race, class, and gender were the hot topics of the late twentieth century, but you would never suspect that the earth’s life support systems were under stress. Indeed you would never know that there was an earth at all.” (xvi)
জাতি, শ্রেণী এবং লিঙ্গগত বিষয় বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের আলোচিত বিষয় হয়ে থেকেছে। কিন্তু আপাতত আমরা সন্দেহ করিনি যে পৃথিবীর জীবন ব্যবস্থা ভয়ানক সমস্যার মধ্যে আছে। প্রকৃতপক্ষে কখনও হয়তো আমরা ভেবেও দেখিনি যে আমরা, আমাদের চারপাশ- সবটা নিয়েই গোটা একটা পৃথিবী। এই ধীর অগ্রগতির প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে পরিবেশগত বিজ্ঞানের ডোমেইনে ‘বৈজ্ঞানিক’ সমস্যা হিসাবে যা সাধারণত বিবেচিত হয়, তার সাথে নিজেকে জড়িত করতে পারার মানসিকতার অভাব। ব্রিটেনের শিক্ষাবিদ পাপ্পা মারল্যান্ডের (Pappa Marland, University of Worcester, institute of humanities and creative arts-UK) মতে- “Another issue was the difficulty of speaking of the earth itself.”
তত্ত্বের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলি ১৯৭০-এর দিকে চলমান ছিল, যেমন ‘নারীবাদ’ এবং ‘উত্তর-ঔপনিবেশিকতা’। উভয়েই মূল ধারা থেকে ‘অপর’ (other) করে দেওয়ার রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবগুলির সমালোচনা করেছিল। এবং আধিপত্যবাদী মতাদর্শ দ্বারা স্তব্ধ কণ্ঠস্বরগুলিকে সনাক্ত করার, তাদের জায়গা করে দেওয়ার উপায় নির্দেশের জন্য তত্ত্বগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু, বিশেষ করে ইকোক্রিটিকদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে এই অনুভূতির জন্ম হয়েছিল যে কোনো ‘ক্রিটিকাল থিয়োরি’, ‘লাইফ সিস্টেম’ পৃথিবীর হয়ে তাদের ওকালতির প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়। জন পারহাম (John Parham) যথার্থই প্রথম তরঙ্গ ইকোক্রিটিসিজম-এর তত্ত্বের প্রতি একটি ‘প্রতিকূল ও আক্রমণাত্মক’ মনোভাব পোষণ করেছেন। নতুন ইতিহাসবাদের প্রেক্ষাপটে অ্যালান লিউ (Alan Liu) দাবি করেন যে মানুষের পৃথিবীতে মানব সৃষ্ট সরকার দ্বারা প্রযুক্ত রাজনৈতিক সংজ্ঞার বাইরে পরিবেশ-প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা যায়না। তিনি ‘Nature’ বলতে অন্তস্থ ধ্যানের সম্পদকে মনে করেছিলেন, যা শব্দাতীত। কিন্তু টেরি গিফর্ড (Terry Gifford) এই বক্তব্য ও মনোভাবের প্রতিক্রিয়ায় লেখেন-
“While Liu is right to identify the word ‘nature’ as a ‘meditation’, the general physical presence that is one side of that meditation.” (Green voice, 15)
উত্তর ঔপনিবেশিকতায় একদিকে পরিবেশ-প্রকৃতির ব্যাখ্যাতীত উপস্থিতি, অন্যদিকে এর যতটুকু চোখে দেখা যায় সেই ‘physical appearance’কে ধরে থিয়োরির বৈশ্বিক চর্চা শুরু হয়। প্রকৃতির বাহ্যিক উপস্থিতির চর্চায় মানুষের ‘ভোগী’ সত্তা এবং ভোগের স্বভাব, ভোগের অধিকারের অসম বৈশ্বিক বন্টন নিয়ে আওয়াজ উঠল। এল পরিবর্তনের আকাঙ্খার কথা।