তপোপ্রিয়
চোখে ভাসে
কোন নিস্তব্ধ প্রদেশের স্বপ্ন দেখি। মাটির আনাচে-কানাচে ক্লান্ত আলোর অলস চলাচল। সেখানে আমি আমাকে খুঁজে পাই নিস্পন্দ তাকিয়ে থাকা কোন পাথরের মূর্তি যেমন। বসে থাকি একেবারেই একা আর আমাকে ঘিরে ফেলে আসা দিনগুলি যাতায়াত করে। আমার কৈশোরের দিনগুলি, যারা অনাদরে হারিয়ে গেছে।
তখন বুঝিনি তারা আমার এত প্রিয়। আজ সেই প্রদেশ ফেলে আসার পর উপলব্ধি করতে পারছি আমার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাসবায়ু ছিল ওখানেই। আসলে এমনই হয়। নাগালে যে রয়েছে তার কথা তেমন ভেবে দেখি না, যা অধরা তাকে পেতে মাথা খুঁড়ে মরি। এই করে করে হাতের পাঁচ হারিয়ে গেলে তখন বুঝি কী তার গুরুত্ব আর হায়-হায় করি। সেই ছোটবেলা থেকে মাকে বলতে শুনতাম চালু একটা কথা। বলত মা যখন তখন নানা প্রসঙ্গে, ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম না বুঝলে হয় !’
জীবনে এসে যেখানে দাঁড়িয়েছি দাঁতগুলো কিছুই নেই। পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, ছিল সেগুলি যখন মর্ম বুঝতে পারিনি। আমার কেবলই চোখে ভাসছে সেই দিনটি যেদিন মাকে নিয়ে ত্রিপুরা ছেড়ে চলে এসেছিলাম। গন্তব্য ছিল কলকাতা যার স্বপ্নে মশগুল ছিলাম এতদিন। জীবনের প্রথম অধ্যায় ত্রিপুরাতে থাকার মেয়াদ আমার শৈশব আর কৈশোর, সেখানেই ফেলে রেখে এসেছি তাদের। এমনই মাতাল ছিলাম ওই শখের নেশায় যে মনে হত পাহাড়-জঙ্গলের এই অখাদ্য দেশটা ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচি।
রওনা দিয়েছিলাম সকাল সকাল, সাতটা বা আটটা হবেই। কলকাতার প্লেনটা বোধহয় ছাড়ার কথা ছিল বেলা দু’টো বা তিনটে নাগাদ। বিমানবন্দর আগরতলা শহর, আমাদের বাড়ি থেকে যার দূরত্ব কম করেও সত্তর-আশি কিলোমিটার। এতদিনের বাসস্থান ছেড়ে যাচ্ছি বরাবরের মতো, উদ্বেগ আর উত্তেজনা চলছিল কদিন ধরে। বোধহয় তা বেড়ে চূড়ান্ত হয়েছিল আগের দিন। রাতে কি ঘুমাতে পেরেছিলাম ? ভাবতে গিয়ে আজ দেখছি স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে। দেখাগুলি এতই অস্পষ্ট যে পড়তে পারছি না। তবুও আবছাভাবে দেখছি মায়ের চলাফেরা। মা চিরকালই শীর্ণকায়া, খুব একটা লম্বাও নয়। বছরের পর বছর খাটুনি আর খাটুনি মায়ের শরীর আরো ভেঙে দিয়েছে। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বয়স তখন, তার ওপর শুরু হয়েছে অসুখ-বিসুখের আক্রমণ। তবুও মা কাজ করতে পারে একটানা। কাজ করতে করতে শরীরটা কুঁজো হয়ে যায়, কাজ থামেনা। চোখে ভাসে, গায়ে আটোআটো সাদা ব্লাউজ, সায়ার ওপর কালো পাড়ের সাদা কাপড়টা কয়েক পাকে জড়িয়ে কোমরে মোটা করে গোজা শেষপ্রান্ত কোনো রকমে বুকে জড়িয়ে পিঠ দিয়ে এনে আবার কোমরে গুজে রাখা। চুল কখনো খোলা থাকে না মায়ের। যদিও কম তবুও মাথার পিছনে সব সময় গুটুলি খোঁপা। গোছগাছ করছিল মা ক’দিন ধরেই। কত যে জিনিসপত্র ! গুছিয়ে মা কুলিয়ে উঠতে পারেনা। এটা গোছায় ওটা গোছায় আর অনর্গল কথা বলে,
‘রাজ্যের জিনিস রে বাবা। কত আর নেওয়া যায় ? বোঝাও তো কম নয়। সারা জীবন আমার গোছাতে গোছাতেই গেল। একবার এই দেশ ছেড়ে ওই দেশে যাও, আবার সেই দেশে। আর পারি না রে বাবা।’
বড়ই দুশ্চিন্তা আগের দিন। সঙ্গে আছে দুটো-তিনটে ব্যাগ আর ঝোলা, দুটো-তিনটে বড় ট্রাঙ্ক আর শতরঞ্চি দিয়ে মুড়িয়ে দড়ি দিয়ে যথাসম্ভব টাইপ করে বাঁধা লম্বা পেটমোটা একটা বেডিং। এত দূরের রাস্তা এত মালপত্র নিয়ে কিভাবে যে যাওয়া যাবে ? অন্তত তিনবার গাড়ি পাল্টাতে হবে। সম্ভব ? মায়ের রোগা-রোগা মুখটা দুশ্চিন্তায় আরও শুকনো হয়ে ওঠে।
‘প্লেনটা ধরতে পারবো তো রে বাবা ? যদি শেষে মিস করি ? তাহলে আর উপায় নেই।’
বারবার আমার কাছে এসে দুশ্চিন্তা জানায় মা। আমি উড়িয়ে দিই, একেবারেই পাত্তা দিই না এত দুর্ভাবনা। ভিতরে ভিতরে নিজেও কিছু উদ্বেগে ভুগি, মাকে বুঝতে দিই না। বুঝলে মা যে আরও কাতর হয়ে পড়বে।
সকালে উঠেই জামাকাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে আমি গাড়ি ঠিক করতে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ ভেবেচিন্তে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেললাম। চুক্তি হলো একেবারে এয়ারপোর্ট অব্দি পৌঁছে দেবে। ত্রিপুরার পাহাড়ি রাস্তায় ভাড়ার ট্যাক্সি চলে না। ট্যাক্সিরা সব শেয়ারে চলে, পেটে ন’-দশ জন যাত্রী বোঝাই করে। বড়ই দুঃসাহস দেখিয়েছিলাম আমি ওভাবে ট্যাক্সি রিজার্ভ করে। ভাড়াটা হিসেবের চেয়ে অনেক বেশি লেগেছিল। মা শুনে প্রথমটায় শিউরে উঠেছিল, পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিল যে একটু বেশি ভাড়া লাগলেও কাজটা আমি ঠিকই করেছিলাম।
হুবহু না হলেও যাত্রাপথটা আমার চোখে ভাসে। ট্যাক্সিচালক ছিল অল্পবয়সী একটা ছেলে। ছোটখাটো রোগা চেহারা, শান্ত স্বভাব। অতটা রাস্তা ধীরেসুস্থে চালিয়ে নিয়ে গেল সে। বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম বেলা বারোটার মধ্যেই। রিক্সার ঝাঁকুনি আর দীর্ঘ জার্নি মায়ের চিরকাল অপছন্দ। অথচ সেই ট্যাক্সিযাত্রায় মা ততটা কাবু হয়নি। সারা রাস্তা পিছনে হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে বসেছিল। আমার সঙ্গে অনেক কথা বলছিল, আবার ট্যাক্সিচালক ছেলেটির সঙ্গেও কিছু কিছু কথা হচ্ছিল। আজ সে সবকিছুই আর মনে করতে পারছি না। কেবল দেখতে পাচ্ছি, বিছানা আর ট্রাঙ্কগুলি পিছনের ডালায় রাখার পর ঢাকনা পুরোপুরি বন্ধ হল না। রাস্তায় না আবার কিছু পড়ে যায় এই নিয়ে মায়ের খুব দুশ্চিন্তা। ট্যাক্সিচালক ছেলেটা অভয় দিল। মালপত্র সে একা হাতে গুছিয়ে রেখে দড়ি দিয়ে ডালার ঢাকনা ভালোমতো বেঁধে রাখল। দু’-একটা বোঁচকা মা কিছুতেই কাজ ছাড়া করবে না, নিজের কাছেই নিয়ে বসল। এই নিয়ে আমার সঙ্গে খানিকটা অশান্তি। বোঁচকাগুলি থাকায় বসতে একটু অসুবিধেই হচ্ছিল।
উদয়পুর থেকে গোমতী নদী পেরিয়ে আগরতলা যাওয়ার দীর্ঘ পথের মনোরম শোভা কী স্পষ্ট চোখে ভাসে ! কখনো পাহাড় কখনো জঙ্গল, কখনো দু’পাশে ঢেউখেলানো দিগন্তছোঁয়া প্রান্তর। পথ কোথাও সর্পিল কোথাও সমতল, কোথাও অগুনতি চড়াই-উৎরাই দিয়ে সাজানো। অসংখ্য সেতু, কাঠের বা কংক্রিটের। ওই রাস্তা ধরে যেতে যেতে কতবার আমি ভেবেছি সেগুলির মোট সংখ্যা গুনে রাখব। কিন্তু যাত্রা শুরুতে মনে থাকে নি কোনদিন। সংখ্যাটা আর গোনাও হয়ে ওঠেনি।
এত আগে এয়ারপোর্টে পৌঁছে আমার আর মায়ের সময় কাটে না। আমি এদিক-সেদিক ঘুরে ঘুরে দেখি। নিজেকে মনে হচ্ছিল বেশ সাবালক। মা জিনিসপত্র আগলে লাউঞ্জে বসে থাকে। একটু-আধটু ঘোরাঘুরির ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারেনা। আমি বেশিক্ষণ চোখের আড়ালে থাকলে আবার দুশ্চিন্তায় ভোগে কোথায় গেলাম ভেবে। কাছে এলেই বলে,
‘বোসো বাবা। আর কোথাও যেওনা। আমার কাছে থাকো।’
নিজেই আবার বিরক্তি প্রকাশ করে একটু পর পর,
‘বাবারে বাবা, বসে থাকতে থাকতে পিত্তি মজে গেল।’
এয়ারপোর্ট-এর রেস্তোরাঁতে হয়তো মাকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। কী যে খেয়েছিলাম মনে নেই, তবে খাওয়াটা বিশেষ সুখের হয়নি। মা হয়তো খায়নি কিছুই। আশায় ছিলাম প্লেনে কিছু খাবার-দাবার দেবে নিশ্চয়ই।
সেই প্লেন এলো ঠিক সময়েই। শুরু হল বিমানবন্দরে কর্মব্যস্ততা, হৈ-চৈ। এতক্ষণ এলাকাটা ছিল শুনশান, পরিত্যক্ত অঞ্চলের মতো। মনে হচ্ছিল জন্মে কেউ আসে না এখানে। আর এখন চিত্র একেবারেই অন্যরকম। মাকে নিয়ে প্লেনে চড়ে বসলাম আমি। দু’জনের আসন, মাকে বসতে দিলাম জানালার পাশে। যদিও মা আগে অনেকবারই প্লেনে চেপেছে, তবুও আমি জানলাটা মাকে ছেড়ে না দিয়ে পারলাম না। মায়ের যে খুব প্রিয় ওই জায়গাটা।
তারপর একটা মিহি আওয়াজ শুনতে পেলাম, প্লেনের ইঞ্জিন চালু হল। প্রপেলার ঘুরতে লাগল, আওয়াজ বেড়ে গিয়ে কানে তালা ধরিয়ে দিল। প্লেনের সারা দেহে কম্পন। তারপর সেটা অলস গতিতে চলতে চলতে রান ওয়ের মুখে এসে দাঁড়ালো, শুরু হলো চূড়ান্ত দৌড়। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাটি ছাড়লো প্লেন।মা বিষণ্ণ সুরে আমাকে বলল,
‘বুকটা কেমন পাড় দিয়ে ওঠে, সব জন্মের মত ছেড়ে যাচ্ছি।’
বাংলাদেশের ওপরে ভাসছে তখন প্লেন। তলায় এক বিশাল ক্যানভাসে বাড়িঘর, গাছপালা, নদী-জলাভূমি আঁকা। মা জানলার কাছে মাথা ঠেকিয়ে দেখছে আবার একটু পরপর আমি দেখতে পাচ্ছি কিনা জানতে চাইছে। মুগ্ধ গলায় কখনো বা বলছে,
‘চমৎকার সিনারি। পুতুলের মত লাগছে সব।’
এখন আর কোন উদ্বেগ নেই, উত্তেজনাও নেই। এবার আমার মনে পড়ছিল কী ছেড়ে এলাম। কিজানি কেন বুকের কোন্ গভীর অতলে এই প্রথম ক্ষীণ একটা বিষণ্ণ সুর অনুভব করলাম। আর তখন মা জানলা থেকে মাথা তুলে নিস্প্রভ গলায় বলল,
‘মনটা বড় খারাপ লাগছে রে বাবা। টুসিটাকে ফেলে এলাম।’
টুসি আমার দিদির ডাকনাম। কাছাকাছি বাড়িতেই থাকত দিদি ও তার পরিবার, প্রায় একসঙ্গেই থাকা। সবসময় আমারও তখন মনে পড়ছিল দিদি আর তার ছেলে মেয়েগুলির কথা। চলে আসার সময় তাদের অশ্রুসজল মুখগুলি। বুকের তলায় কী যেন পাক দিয়ে উঠছিল। আর কি কোনদিন ওভাবে কাছাকাছি থাকতে পারব আবার ? আর চোখে তাকিয়ে দেখি, মায়েরও সমস্ত মুখ জুড়ে কান্নার রং। সেই বিষণ্ণ কাতর মুখের ছবি আমার কী যে স্পষ্ট চোখে ভাসে ! জানালায় চোখ পড়তে দেখি মেঘের সাম্রাজ্যে ভাসছে প্লেন। নিচের দৃশ্য সবই মেঘে ঢাকা।