অরিত্রী দে

একাদশ পর্ব

প্রকৃতি’র প্রাণ তখন গানে, অনুভূতিতে

ক. “ভবণই গহন গম্ভীর বেগেঁ বাহী।

      দু আন্তে চিখিল মাঝেঁ ন থাহী।।”

      (৫ নং চর্যা)

খ. অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।

    খণহ ন ছাড়হ ভুসুকু অহেরী।। 

     (৬নং চর্যা)

গ. সোনে ভরিলী করুণা নাবী।

     রূপা থোই নহিকে ঠাবী।।

     বাহতু কামলি গঅণ উবেসেঁ।

     (৮ নং চর্যা)

এই তিনটি চর্যার দু’টিতে নদীপ্রধান বাংলার ছবি আছে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের নিদর্শন- চর্যাগীতিতে গৌড়বঙ্গের যে স্থানিক পট পাই, তা বৃহৎ বঙ্গের পট। গহন ভবনদী গম্ভীর বেগে বয়, দুই পারে তার কাদা আর মাঝে থৈ নেই। আবার ৮ নং চর্যায় সোনায় ভর্তি করুণা নৌকার আকাশের উদ্দেশ্যে বয়ে চলার কথা। অর্থাৎ চর্যায় চিত্রিত নদী নাব্য এবং বঙ্গের নাব্য এলাকা বলতে পূর্ববঙ্গ। হরিণ তার নিজের মাংসের কারণে নিজের কাছেই শত্রু, ভুসুকু তাকে ক্ষণিকের জন্যেও ছাড়েনা। জঙ্গলের চারপাশে বেড় দিয়ে এই হরিণ শিকারের গল্পই ৬ নং চর্যার মূল। “সহজ নলিনীবণ পইসি নিবিতা/ জিম জিম করিণা করিণিরে রিসঅ।” (৯ নং চর্যা)- এখানে মদমত্ত হাতির গল্প। বলতে গেলে উত্তরবঙ্গ ও আসামের গজ সম্পদ, পূর্ববঙ্গের কাউন-চিনা ও কাপাসের যে বর্ণনা পাই, তা চর্যার বহুবিস্তৃত ভৌগোলিক সীমা ছাড়া অসম্ভব। “তুলা ধুণি ধুণি আঁসু রে আঁসু।/ আঁসু ধুণি ধুণি ণিরবর সেসু।।”- তুলো ধুনে ধুনে আঁশ বের করা হল, আঁশ ধুনে ধুনে নিরবয়ব করা হল। এছাড়াও জলাশয়ে ভর্তি বাংলার পদ্ম বা কমল’কে মস্তিষ্কে অবস্থিত মহাসুখচক্র করে কমলরসকে মহাসুখরস হিসেবে পান করা, অবধূতীমার্গরূপী কমলমৃণালে বোধিচিত্তের জন্ম ও নির্বাণ লাভের গূঢ় তত্ত্বের গান গেয়েছেন বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যেরা।  

নদী, নৌকার ‘ইমেজারি’ আরো কয়েকটি চর্যায় মেলে, যেমন- ১৩, ১৪, ৩৮ ও ৪৯ নং চর্যায়। যথাক্রমে কায়-বাক-চিত্তকে নৌকা করে জলে ভাসানো, ডোমনী মেয়ের দ্বারা গঙ্গা-যমুনার মাঝে নৌকা বইয়ে নিয়ে অবলীলায় পার হয়ে যাওয়া, চিত্ত স্থির করে মনকে দাঁড় বানিয়ে ছোট নৌকার ভেসে যাওয়া ইত্যাদি৷ ৪৯ নং চর্যায় সরাসরি পদ্মাখালে বজ্র নৌবহর চলার কথা, জলদস্যুর কথা বলা আছে। যদিও এই জলদস্যুদের বঙ্গাল বলা হয়েছে। আর্যের দৃষ্টিতে বঙ্গাল তথা স্থানীয়রা দুর্ধর্ষ। চর্যার তত্ত্বানুযায়ী এই বঙ্গালদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া মানে দ্বৈতবোধের বিকল্প, মিথ্যা জ্ঞান থেকে মুক্ত হওয়া। বঙ্গাল আক্রমণ করে এসব বন্ধন হরণ করে। এখানে বাণিজ্য সম্প্রসারণার্থে নদী ও নৌকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৩২ নম্বর চর্যায় সোজা রাস্তার প্রসঙ্গে পথের দুধারে ডোবা আর খালের অস্তিত্ব সম্পর্কে উল্লেখ আছে। আমাদের গ্রামবাংলার রূপ এমনই। 

চর্যাগানে একটি আদি জনগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়- আদি অস্ট্রাল গোষ্ঠীর শবর শবরী। এরা স্পষ্টতই আর্য পূর্ব জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত, কাজেই তথাকথিত ‘সমাজ’ থেকে দূরে অরণ্যে-পর্বতে এদের বাস- “উঁচা উঁচা পাবত তহি বসই শবরী বালী” (২৮ নং চর্যা)। পাশেই তরু মুকুলিত হয়, কঙ্গুচিনা ফল পাকে। কৃষিতে শবর-শবরী নি:সন্দেহে দক্ষ। পুষ্প আভরণ, ময়ূর পুচ্ছ- এই সমস্ত প্রাকৃতিক উপাদানই তাদের অঙ্গসজ্জার প্রধান উপকরণ। প্রকৃতির মতো নিঃসংকোচ ও আদিম শবরীকে দেখে শবর পাগল হয়। প্রকৃতিলগ্ন এই জনগোষ্ঠীতে নারী-পুরুষ ভেদের ‘সোশ্যাল ডিসকোর্স’টি অনুপস্থিত। বরং শবর রমনীরা স্বাধীন- “একেলি শবরী এ বন হিন্ডই কর্ণকুন্ডলবজ্রধারী”। দৈনন্দ্যিন জীবনের একঘেয়েমি ব্যতিরেকে এদের জীবনের শৃঙ্গাররস যে অনুপস্থিত ছিল, এমত মনে হয়না। সম্ভোগ উপচার রূপে ব্যবহার করত তাম্বুল-কর্পূর আর বিহারের জন্য উঁচু পাহাড়ে জ্যোৎস্নাবাড়ি তৈরির প্রসঙ্গও আছে। নিসর্গের সঙ্গে জীবনের ওতপ্রোত যোগ এদের জীবন বোধ ও সৌন্দর্য বোধের নির্ণায়ক৷ 

পরবর্তী সাহিত্যিক নিদর্শন ১৯১৬ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ কর্তৃক বঙ্গীপ্রকাশিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য৷ এখানে রাধা কৃষ্ণ উভয়েই নদী-মাঠ-প্রাকৃতিক বাগান ও জঙ্গলময় গ্রাম্য পটভূমির। রাধা দধি দুধে পসার সাজিয়ে নেতবস্ত্রের আবরণ দিয়ে সখীদের সঙ্গে করে বড়ায়িকে নিয়ে প্রতিদিন মথুরায় যায় বনপথ দিয়ে। আর কৃষ্ণ পাচনি হাতে মাঠে গাই চরায়। কৃষ্ণ রাধাকে তার প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্রে নিতান্ত সুলভ প্রাকৃতিক সম্পদ- ফুল (চাপা, নাগকেশর), ফুলের মালা, কর্পূর মিশ্রিত পান ইত্যাদি নিবেদন করেছে। লক্ষণীয় যে রাধার রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনায় লতাপাতা, ফুল প্রভৃতির উপমা এসেছে- “কপোল যুগল তার মহুলের ফুল/ তিল ফুল জিণী নাসা কম্বু সম গলে/ কনকযূথিকা মালা বহু যুগলে।” রাধার চুল দেখে অরণ্যের তমাল কলিকা লজ্জায় মুখ লুকায়, তার কাজল শোভিত চোখ ও স্তনযুগল যথাক্রমে নীলপদ্ম এবং পাকা ডালিম ফলের মত। এমনকি কণ্ঠদেশ দেখে শঙ্খ লজ্জায় সমুদ্রের জলে গিয়ে প্রবেশ করে। কদম গাছের তলাতেই বসে রাধাকে যমুনার তীরে দানের ছলে হেনস্থা করার ঘোট পাকায় কৃষ্ণ। যমুনা নদীর বুকে একখানি ছোট নৌকাতেই কবি গোটা নৌকা খন্ডের ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন। আবার ছত্রখন্ডে মথুরা নগর থেকে দধি দুধ বেঁচে ঘরে ফেরার সময় রাধা ক্লান্ত হয়ে পড়লে শীতল বাতাস তাঁর প্রাণ রক্ষা করেছে। যদিও কৃষ্ণের ঐশ্বরিক মহিমাকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য দেখানো হয়েছে যে কৃষ্ণ রাধার পাশে আছেন বলেই অমন স্নিগ্ধ হাওয়া প্রবাহিত হয়েছে, তবু পটভূমি ও উপকরণ উপাচার সবই পরিবেশ প্রকৃতির। কালীদহের জল পান,স্নান সহ বিবিধ ব্যবহারের উপযোগী, অথচ তাতে বিশাল সাপের বাস। অতএব জল বিষমুক্ত করার জন্য কৃষ্ণ বিষাক্ত কালীয় নাগ দমন করলেন। বংশী খন্ডে এসে দেখব কৃষ্ণ রাধাকে এড়িয়ে অবস্থান করলে রাধা তাঁর সন্ধানের জন্য বড়ায়িকে পাঠাতে চায়৷ কিন্তু বড়ায়ির সাফাই- “যমুনা নদীতে মো কেমনে হৈবোঁ পার। ঘড়িয়াল কুম্ভীর তাহাত আপার।…বৃন্দাবন মাহা ঘোর ভয়ংকর। বাঘ ভালুক তাএ বসে বিথর।” স্পষ্টতই বৃন্দাবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ আদিম ও ভয়ানক। বাঁশির শব্দ শুনে রাধা জানায় তার মাটির ভিতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে হয় পাখি হয়ে উড়ে যেতে মন চায় এবং যেখানে যেখানে ফুল ফল প্রভূত পরিমাণে ফুটে আছে সেখানে কৃষ্ণকে অবশ্য করে খোঁজ করতে বলে দিয়েছে রাধা (বড়ায়িকে)। প্রকৃতি, তার উন্মুক্ত উদার প্রফুল্ল রূপের সঙ্গে ঈশ্বরের উপস্থিতিগত অনুভূতিকে মিলিয়ে নেওয়ার এই ভঙ্গি রাধার একার নয়, বাংলার আপামর ধর্মীয় জনের। বিরহেও প্রকৃতি রাধার সঙ্গী হয়েছে নানাভাবে- কদমতলে শুলে সাধারণত শীতল হওয়ার কথা, অথচ রাধার অন্তর পুড়তে থাকে, এমনকি সজল পদ্মদলে শয়ন করলেও রাধার দহন জ্বালা কমে না। চন্দ্রকিরণে তীব্র উষ্ণতা অনুভূত হয় ও চন্দনের প্রলেপ রাধার উপশম ঘটাতে পারেনা। বিরহের নায়িকা হিসেবে রাধার বারমাস্যা অর্থাৎ প্রকৃতির ছয় ঋতুর বারো মাসের দু:খ-পাঁচালি বিবৃত আছে। সংস্কৃত সাহিত্যের শকুন্তলা যেমন প্রকৃতির কন্যা ছিল, ‘nature’ বা প্রকৃতি তেমনি রাধার কাছে তাঁর জীবনানুভূতি ও আরো অনেক কিছুর সহায়ক এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ত্বরকও বটে। এজন্যই রসশাস্ত্রে রসের উদ্দীপন বিভাব রূপে পরিগণিত হয়েছে প্রকৃতি। 

প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেক আগে থেকেই সাহিত্যে এসেছে। কিন্তু অত্যাধুনিক জীবনের আধুনিক মানদণ্ডে সাহিত্যে প্রকৃতি-পরিবেশকে দেখা হল মূলত: ‘ইকো ক্রিটিসিজম’ এর হাত ধরে। খ্রিস্টিয় ১০০০ থেকে ১২০০ শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমি সভ্যতা ভৌত পরিবেশের (জৈব ও অজৈব) উপর জ্ঞানের আধিপত্য বিস্তারের কৌশলটি আয়ত্ত করে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে বিশ্ব-বিজ্ঞানে নেতৃত্ব দখল করে (ইউরোপ) এবং শিল্পবিপ্লবকে (১৭৫০) অনিবার্য করে তোলে। এই সময়পর্বে (১৭-১৮ শতক) যুক্তি ও বিজ্ঞানের শক্তি সর্বৈব বিস্তৃত হয়, কিন্তু ক্রমে যান্ত্রিক যৌক্তিকতাবাদ পুঁজিবাদের সহায়ক হয়ে উঠলে শুরু হয় প্রাকৃতিক ধনসম্বলের প্রক্রিয়াকরণ। স্পষ্টতই বিজ্ঞান নির্দেশিত পরিবেশ-সচেতনতাকে মানুষ অগ্রাহ্য করতে থাকে ধর্মীয়-সামাজিক-দার্শনিক প্রেরণায়। উনিশ শতকে নগরায়ণ-শিল্পায়নের প্রভাবগত ফলাফল, শ্বাসরোধকারী কুৎসিত পরিবেশ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা প্রসঙ্গে কার্লাইল ‘এনভায়রনমেন্ট’ শব্দটির সংজ্ঞায়ন করেন (১৮২৮) এবং আর্নেস্ট হেকেল ‘ইকোলজি’র ধারণা প্রচার করেন (১৮৬৬)। বস্তুত এই শতক যুগপৎ মানুষের বিনাশী কর্মকান্ড আর পরিবেশ সচেতনতার কাল। ১৮৯৫ সাল নাগাদ জোহানেস ইউজিন ওয়ার্মিং কর্তৃক ইউনিভার্সিটি পাঠক্রমে একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসেবে ‘ইকোলজি কোর্স’ চালু করেন। এরপর জটিল পরিবেশগত সমস্যা বিশ্লেষণের জন্য ১৯৫০ সালে স্ট্যানলি আর্বাচ ‘এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স’ বিভাগের প্রতিষ্ঠা করেন। মাঝে ওই শতকেরই তিনের দশকে (১৯৩৫) আরেকবার ‘ইকোলজি’কে ফিরে দেখার তাগিদে আর্থার ট্যান্সলে ‘ইকোসিস্টেমে’র কথা বলেন।

সাতের দশকে Eco-fiction anthologyLiterature and ecology, An experiment in eco-criticism গ্রন্থে ‘ইকোক্রিটিসিজম’ শব্দের ব্যবহার হলেও ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে গবেষক চেরিল গ্লটফেল্টি Ecocriticism reader গ্রন্থে ‘ইকোক্রিটিসিজম’কে একাডেমিক ডিসকোর্সে জনপ্রিয় করে তোলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *