মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
ত্রয়োদশ পর্ব
ঝরা পাতারা নিরুদ্দেশে যেতে পারে হাওয়ায় হাওয়ায় কিন্তু স্মৃতির পাতারা ঝরে পড়ে হৃদয়ে, হারানো হৃদয়গুলো ছুঁয়ে দেখতে চায়। সেই পুরোনো ছবিগুলো হাতছানি দেয় ‘আয়’ ‘আয়’ বলে।
আঁকাতে কখনও ভীষণ ভালো কিছু করে দেখাতে পারি নি কিন্তু আঁকার আনন্দ থেকে বঞ্চিতও হইনি বালিকা বয়সে। নিজে নিজে আঁকিবুঁকি টানতে টানতে একদিন কবে যেন পড়লাম বাবলাকাকার হাতে। বাবলাকাকা, মানে কালনার স্বনামধন্য শিল্পী সুমিত গোস্বামী তখন মিউনিসিপ্যাল রোডের ওপর ভাড়াবাড়িতে আঁকা শেখাতেন। বড়ঘড়ির কাছে যে কুমার বাড়ি তার পাশ দিয়ে যেতে হতো বাবলাকাকার কাছে। এখন সেই অংশটার অস্তিত্ব আছে কি না মনে পড়ছে না একেবারেই।
তবে রবিবারের অনেক সকাল আমার কেটেছে বাবলাকাকার কাছে। প্রথম প্রথম ১ ২ ৩ ইত্যাদির সাহায্যে পশু পাখি ইত্যাদি আঁকা শিখে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, সেই প্রথম আনন্দানুভূতি আজও দারুণ ভাবে টাটকা।
কোনো কারণবশতঃ খুব বেশি দিন আমার আঁকা শেখার এই প্রাথমিক পর্ব গড়ালো না। তার বেশ পরে আবারও আঁকার ক্লাসে ফিরেছিলাম গোপালবাড়িতে, পিনাকী মেমোরিয়ালের উদ্যোগে চলা অঙ্কনশিক্ষা কেন্দ্রে। তবে এই যে বললাম, এই ব্যাপারে সরস্বতীর সাথে আমার বোঝাপড়া খুব একটা ভালো ছিল না। তবুও রঙ তুলি নিয়ে ইচ্ছে মতো হাত চালাতে সকলেই নিশ্চয়ই আনন্দ পায়। আমিও পেতাম। আর বড় কথা, ইস্কুলের প্র্যাকটিক্যাল খাতার আঁকাগুলো বেশ উৎরে যেত। তবে আমার ভাইয়ের আঁকার প্রতি টান ছিল। ও প্রথমে আমার সাথে গোপালবাড়িতে ক্লাস করলেও পরে আমি আঁকা শেখার ছেড়ে দিতে বাবলা কাকার কাছে রঙের পাঠ নিতে শুরু করে।
অনেক পরে যখন তাজা প্রাণেরা ‘ব্যারিকেড’ করেছিলাম তখন আবার বাবলা কাকাকে দলে পেয়েছিলাম। নাটকের মঞ্চসজ্জা, পোশাক সব এঁকে ফেলতো বাবলাকাকা। প্রয়োজনমতো তৈরি হতো মুকুট, পাখা আরও কত কি!
মনে আছে আমাদের পাড়ায় তখন সরস্বতী পুজোর ধুম ছিল জুপিটার আর ভেনাস ক্লাবের মধ্যে। টাউন ক্লাব তখন সাময়িক সমাধিতে পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখছে। সেইসব ছিমছাম কাপড়ের প্যান্ডেল, কঞ্চির হালকা ঘেরের মধ্যে ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকার টব, হয়ত কিছু চুণের আল্পনা থিমের পুজোর রাজত্বে কোথায় হারিয়ে গেল!
এই চত্বরে তখন শেঠদের অন্নপূর্ণা বস্ত্রালয় রমরম করে চলছে, ফাইভ স্টার তখন মহিলাদের রেডিমেডের বদলে তৈরি করা ফিটিংস্ ব্লাউজের প্রলোভন দেখাচ্ছে। ঘড়ির দোকানের মতো রেডিও বিক্রি ও সারাইয়ের দোকানগুলেতে লেগে আছে লোকের আনাগোনা। তবে হ্যাঁ, আলোর চাকচিক্য নেই রাস্তায়। লো টেনশন তারে সংযুক্ত খাটো খাটো ল্যাম্পপোস্টে ঝুলতো ঘুম ঘুম ডুম।
এমন কিছু সন্ধ্যেতে হঠাৎ হঠাৎ আসতো রামযাত্রার দল। কারা কোথা থেকে আসতো তা বুঝতাম না। কিন্তু খবর পেলেই দেখতে ছুটতাম। হয়ত অভিনয় হচ্ছে বর্মণদের কালীবাড়ির পাশের গলিতে। সীতাকে খুঁজতে হনুমান সাগর পার হবার জন্য কুটুস করে লাফ দিয়ে সরু ড্রেনের ওদিকে গিয়ে পড়ল। আহা! কি চমৎকার। কিন্তু সেসব অমূল্য সংলাপ এখন আমার একটুও মনে পড়ে না।
এই গলির শেষ হতো সমাজবাড়ির চণ্ডীচরণ প্রাইমারি স্কুলে। ওই গলি শেষে আমার বেশ কয়েক বছর নিবীড় যাতায়াত ছিল নাগ বাড়িতে।
ক্লাস ফাইভে যখন পড়ি তখন প্রীতিপিসি অর্থাৎ প্রীতিকণা নাগের সংস্পর্শে এলাম। পিসি আমার পড়া দেখিয়ে দিতেন। নিয়মিত আমাদের বাড়িতে আসতেন, আবার মাঝে মাঝে আমাকে ডাকতেন নিজের বাড়িতে।
পিসির বাড়িতে দাদু ঠাকুমাসহ সকলেরই যথেষ্ট স্নেহ পেয়েছি।
প্রীতিপিসির পড়ানোর প্রেমে পড়ে আছি আজও। কি নিষ্ঠার সাথে নানা স্কুলের নানা ক্লাসের নানা বিষয়ের প্রশ্নপত্র জোগাড় করে সেলাই করে গেঁথে রাখতেন, যাতে পড়ুয়ারা পুরোনো প্রশ্ন লিখে অভ্যাস করতে পারে। সেসময় প্রশ্ন বিচিত্রা বা কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্কের রমরমা ছিল না। ইউ টিউব সার্চ করলে কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার কোনো অপশন ছিল না। একমাত্র নানা বইয়ের সংগ্রহ এবং পাঠই ছিল জ্ঞান বাড়ানোর উপায়। পিসি আমাদের জন্য কতটা পরিশ্রম করতেন তা এখন বুঝতে পারি। ক্লাস সেভেন এইটের জন্যও কয়েকটা বই ঘেঁটে
উত্তর লিখে দিতেন। শেখাতেন পড়া মনে রাখার নানান সূত্র।
পিসির কাছেই শিখেছি রচনা লেখার জন্য ডায়েরিতে ভালো ভালো কবিতার লাইন সংগ্রহ করে লিখে রাখতে হয়, যাকে আমরা বলতাম ‘কোটেশন’। আর রোজকার কাগজ থেকে ভালো লাগলে নানা তথ্যও টুকে রাখতে হয়।
একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল। কোনো একটা সাবান কোম্পানির বিজ্ঞাপন ছিল পেপারে, সম্ভবত পামোলিভের। সঙ্গে এক চিমটে আঠায় আটকানো এক টুকরো টিস্যু পেপার। পাঠকের ত্বক তৈলাক্ত কি না পরখ করার জন্য। আমি তো পেপারটা দেখামাত্রই তুলে নিয়ে ঝট করে গালে লাগিয়েছি। পিসি বকা দিয়েছিলেন কারণ ওটা বহু জায়গা ঘুরে এসেছে তাই অপরিষ্কার নিশ্চয়ই। ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। এই রকম ছোটখাটো কত কথা মনে আসে।
একদিন পিসি বিয়ে হয়ে অনেক দূরে চলে গেলন।
কিন্তু থেকে গেল একটা অপূর্ব সুন্দর সম্পর্ক। এই সুশিক্ষিত সংস্কৃতিপ্রেমী পরিবারের সদস্যরা আজ পেশার তাগিদে নানান জায়গায় ছড়িয়ে আছেন। সেই ফ্রকপরা আব্দার করা আমিটারও বয়স বেড়েছে। তবু আজও নাগ পরিবারের নানা পারিবারিক অনুষ্ঠানের আনন্দ মুহূর্তগুলো যখন মনে পড়ে ভারি মধুর অনুভুতি হয় মনে। আর মাঝে মাঝে একলা থাকার ক্ষণে মনে হয় কোনো সকালে বা সন্ধ্যায় পিসির সাথে পড়তে বসার টুকরো ছবি। কত পুরোনো কথা, তবু ক্লাস ফাইভের লাল সাদা ছবি দেওয়া বই থেকে “Boats sail on the river, And ship sail on the sea” পড়ার কথা মনে পড়ে বড় রাস্তার দিকের বারান্দায় বসে। কখনও মনে হয় ঘড়ি দেখছি, কখন সন্ধ্যায় পিসির পড়ানো শেষ হলে মা টিভি চালালে দুজনে মিলে দেখবে চিত্রহার বা চিত্রমালা। আমি একটু ছুটি পাবো।
এই সব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন আবার একটা ছোট্ট মেয়ে হয়ে যাই আর দৌড়ে বেড়াই আমার চেনা পাড়া জুড়ে।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)