তাপস সরকার

লেখক পরিচিতি 

( সৃজনশীল সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত কিশোর  বয়স থেকেই। প্রথম পঠিত গ্রন্থ রামায়ণ, মহাভারত ও গীতা। গদ্যসাহিত্য ও উপন্যাসেই সাবলীল। যদিও শতাধিক গল্প ও দশ-বারোটি উপন্যাসের রচয়িতা কিন্তু সেসব হারিয়ে গেছে অপ্রীতিকর কারণে। প্রিয় বিষয় মহাকাশবিদ্যা। কল্পবিজ্ঞান ও কিশোর সাহিত্য প্রিয় লেখা।কিছু গল্প নব্বইয়ের দশকে বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। উন্মীলন নামে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকায় নিজের গল্প ও দুটি উপন্যাস ছাপা হলেও সেই উদ্যোগ থেমে যায়।প্রতিভাস সাহিত্য ম্যাগাজিন চলছে পনের বছর যা মায়ের নামে। সেখানে মায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত লেখা স্মৃতিচিত্রণ ও বেশ কিছু ছোটগল্প। নব্বইয়ের দশকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিছুদিন লিটল ম্যাগাজিন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে জেলায় জেলায় সাহিত্য আসরে ঘোরাঘুরি। বিশ্বকে নিজের ঘর বলে ভাবতে অভ্যস্ত। মায়ের মৃত্যুর পর অবসাদে দীর্ঘদিন লেখায় বিরত। তারপর আবার লেখা শুরু কিশোর সাহিত্য ‘গাছবাড়ির বাসিন্দা ‘ দিয়ে। পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় কোভিড পরিস্থিতিতে লেখা ইংরেজি ভাষায় ‘ইটস মাই আইল্যান্ড ‘ প্রকাশের অপেক্ষায়। স্বউদ্যোগে প্রকাশিত একমাত্র উপন্যাস ‘অন্তরালোকে ‘ নিজের জীবনের এক বিশেষ অধ্যায় ও মাকে নিয়ে লেখা। ভারতীয় প্রাচীন দর্শনের ওপর একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিরক্তি  ‘অনন্ত জীবন ‘ উপন্যাসের পাতায় পাতায় প্রতিফলিত। পেশায় অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক। ) 

মূলাংশ       

(মরজগতে মানুষ চলেছে অমরত্বের সন্ধানে। অনাদি অতীত থেকে তার এই যাত্রারম্ভ। অনন্ত জীবন তারই এক প্রকাশ। তাই অমৃতের অধিকার নিয়ে সুরাসুরে এত অশান্তি, কারণ অমৃত নাকি অমর করে। অমরত্বের ব্যাখ্যা আবার দ্বিধাবিভক্ত, দৈহিক অমরত্ব এবং আধ্যাত্মিক অমরত্ব। দানব ও সর্বসাধারণ বোঝে প্রথম মতবাদটিকেই। কোনটি সঠিক? সবাই ছোটবেলায় হারিয়ে যায় মানুষের মেলাতে, সেখানে সে বন্ধু খুঁজে পায় যাকে সে তাকে হাত বাড়িয়ে দেয়, বোঝাতে চায় মানুষ ও বিশ্বজগতের উদ্দেশ্যবিধেয়। যে তাকে চেনে সে বোঝে সব। শৈবাঙ্কন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতাকে অস্বীকার করে চলে যায় স্পিতি ভ্যালিতে। সেখানে সে আবিষ্কার করে সর্বজনীন ভাষা যাতে বাক্যালাপ চালাতো সনাতন মুনি-ঋষিরা কীটপতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, নদী-জঙ্গল, পাথর-প্রান্তর এবং অদৃশ্য দেবতাদের সঙ্গে। স্পিতি ভ্যালির পটভূমিকায় স্পিতি নদী ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ এবং মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে সে খুঁজতে থাকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ত্বের ব্যাখ্যা। কী পেল সে শেষ পর্যন্ত ? )

অবশেষে

বকপক্ষির উপাখ্যান

( ভবিতব্য )

শ্রীকৃষ্ণ তারপর পুস্পক রথ নামিয়ে নিয়ে এলেন পৃথিবীর আকাশে। তিনিই তো সঠিক সারথি এই রথের।

পুষ্পক রথের আসল মালিক কুবের, ধনসম্পদের দেবতা। সেই রথ ত্রেতাযুগে রাবণ দখল করে নিয়েছিল কুবেরকে যুদ্ধে হারিয়ে। যদিও সম্পর্কে কুবের তার বড় ভাই, কিন্তু রাবণ সেই সম্পর্কের কোন মর্যাদা দেয়নি। কেবল পুষ্পক রথ ছিনতাই করাই নয়, রাবণ দেবতা কুবেরের সম্পদশালী সাম্রাজ্যে লুঠপাট চালিয়েছিল। নারীদেরও হরণ করেছিল সেখান থেকে। কুবেরের সম্পদ দিয়ে সে বানিয়েছিল স্বর্ণলঙ্কা। তারপর শ্রীরাম রাবণকে মেরে সেই রথ ফিরিয়ে দিয়েছিল কুবেরকে। সেই রথে তারপর পুরো দ্বাপর যুগ ধরে অনেক নতুন বিষয় সংযোজন করা হল। কাটল কলিযুগের প্রথমার্ধ, আর এখন বলে সবাই কলির সবে সন্ধে। এতদিন ধরে সেই পুষ্পক রথকে অত্যাধুনিক মহাকাশযানে সাজিয়ে দিয়েছে বিশ্বকর্মা। সেই রথ এখন চলার সময় বস্তুপুঞ্জ থেকে শক্তিপুঞ্জে রূপান্তরিত হয়ে যায়, কয়েক সেকেন্ডে চলে যেতে পারে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব। আরও নতুনত্ব এসেছে সম্প্রতি, তাতে ওই রথ কালের গতিবেগে চলতে পারে। এখন সেই রথ চালাবার সর্বোত্তম সারথি শ্রীমধুসূদন।

পঞ্চপান্ডব সঙ্গে পাঞ্চালি স্বর্গারোহণ করেছিল আগে। আবার তাদের বিশেষ কারণে চলে আসতে হয়েছে ধরাধামে। কথা হচ্ছে, এবার তারা ওই অত্যাধুনিক রথে চেপে সুউন্নত সভ্যতার খোঁজে যাবে গ্রহান্তরে। কেন এই যাওয়া ? কারণ, অদ্যাবধি জানা গেল না এই মরজগতে মানুষ ব্যতীত আর কেউ রয়েছে কিনা গ্রহান্তরে। যুগ-যুগান্তের পরিক্রমা আর অন্বেষণ তো কোনও সুফল দেয়নি। পার্থিব আবাস ছেড়ে মহাকাশে ইতিমধ্যে বহু নিষ্ফল অনুসন্ধান সম্পাদিত হয়েছে। মানুষ শেষপর্যন্ত বুঝেছে, এই জটিল প্রক্রিয়া চালনা করতে পারে একমাত্র মহাকাব্যিক চরিত্ররা। বাস্তবে কিংবা পরাবাস্তবে। তাই পঞ্চপাণ্ডব সঙ্গে পাঞ্চালিকে ডেকে আনা। তাদের বিশেষ করে দায়িত্ব দেওয়া হবে দেবভূমি বলে সত্যিই কিছু আছে কিনা তা খুঁজে দেখা যেখানে দেবতাদের বসবাস। সত্যিই সেই বাসভূমির দেবতারা অনন্ত জীবনের অধিকারী কিনা। অন্যকথায়, তাদের অনুসন্ধানের মূল বিষয়বস্তু হবে অমরত্বের অন্বেষণ। আর তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব, ব্রহ্মলোকের ঠিকানা খোঁজা। তারা দেখবে, সৃষ্টিকর্তা পিতামহ ব্রহ্মাকে আবিষ্কার করা যায় কিনা।

এখানে এ প্রশ্ন স্বাভাবিক, স্বর্গারোহণের পর যারা স্বর্গেই ছিল তাদের আবার দেবলোকের খোঁজে নিষ্ক্রমণের এই আয়োজন অবান্তর ও লোকদেখানো হবে কি হবে না। প্রশ্নটি সঙ্গত বলে উত্তর তৈরি করা জরুরী। আসলে মহাকাব্যিক ওই চরিত্রগুলি স্বর্গে রয়েছে সূক্ষ্মদেহে, জীবদেহে আর নেই তারা। অমরত্ব, স্থূল এবং প্রচলিত অর্থে, যা একপক্ষীয় ধারণা, একান্তই জীবদেহের বিবেচ্য বিষয়, সূক্ষ্মদেহ বা আধ্যাত্মিকতাবাদ অথবা দিব্যধারণার অন্তর্গত নয়। সেই মতানুযায়ী, কেউ না কেউ তো ভবিষ্যতে এমন অন্বেষণে নিয়োজিত হবেই। সেখানে ওই মহাকাব্যিক চরিত্রগুলির আবার ভবিষ্যতে মানবদেহে ধরাধামে অবতীর্ণ হতে বাধা কোথায় ? প্রাচীন মতে, জন্মান্তরবাদ তো স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আর প্রাক্তন জীর্ণদেহ বর্জনের পর স্বর্গপুরীর প্রাপ্ত সূক্ষ্মদেহ ছেড়ে আবার মর্তলোকে নবজন্ম গ্রহণের পর ভূতপূর্ব কর্মকাণ্ড সবই তো বর্তমানে বিস্মৃতির অতলে। জানেন সমস্তকিছু কেবল দর্পহারী শ্রীমধুসূদন। কিন্তু তিনি তো কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে বিশ্বরূপ প্রদর্শনের প্রক্রিয়াতে বলেই রেখেছেন গীতার অমর শ্লোকে, তাঁর বাসনা যে জীবেরা কর্ম করুক নিষ্ক্রিয় বসে না থেকে। তিনি নিজে তাই সব জেনেও কাউকে কিছু জানাবেন না যাতে জীবেরা কর্মসম্পাদনের উৎসাহ এবং আগ্রহ না হারায়। এই সমস্ত কাজ এই কারণেই পঞ্চপাণ্ডব সঙ্গে পাঞ্চালি ছাড়া আর কেউ করার উপযুক্ত হতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ তাই পুষ্পক রথ চালিয়ে নেমে এসেছেন তাদের জন্য পার্থিব বায়ুমণ্ডলের ওপর।

এবার মহাভারত বিরচিত হবে মহাকাশে। তার জন্য ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র থাকবে ওই অসীমেরই কোনও এক পরিসরে। মহাকাব্যের ভাষ্যরচনার দায়িত্ব আবার নেবে মহর্ষি বেদব্যাস। আবার গণেশকে ধরতে হবে লেখনী। সে যাই হোক, সবই হবে যথাসময়ে। শ্রীকৃষ্ণ আপাতত হাজির পুষ্পক রথ নিয়ে।

রথের অবস্থান দেখে যুধিষ্ঠির চিন্তাকুল হয়ে পড়ল। অর্জুনকে ডেকে বলল,

‘কী বিপদ বলতো তৃতীয় পাণ্ডব ? অত উঁচুতে যাই কী করে ? ভ্রাতা, তুমি কি অস্ত্রবিদ্যার কোন কৌশল জান যাতে ওই রথে ওঠা যেতে পারে ?’

অর্জুনের বিমর্ষ মুখ। গাণ্ডীব টংকারে মেদিনী ঝংকৃত হয় যদিও তাতে পুষ্পক রথ অবতরণ করতে পারে না। স্বয়ং মধুসূদনই মুশকিল আসান করতে পারেন। রথকে নামিয়ে আনতেই হবে ভূপৃষ্ঠে। হেলিকপ্টারে চেপে পাণ্ডুপুত্রগণের পুষ্পক মহাকাশযানে যাওয়াটা বড়োই দৃষ্টিকটু।

এদিকে বেদব্যাস আর গণেশের মধ্যে আবার খিটিমিটি বেঁধে গেছে। গণেশ আগের মতোই জানাল যে তাকে বসিয়ে রাখা যাবে না। মহাভারতের শ্লোকসমূহ একনাগাড়ে বলে যেতে হবে ব্যাসদেবকে। সত্যবতী নন্দন তাতে সম্মতি জানাল এই শর্তে যে গণেশও কিছু না বুঝে লিখতে পারবে না। এই শর্তে আগের মত আবারও রাজি হয়ে গেল গণেশ।

শ্রীকৃষ্ণ বুঝলেন, পুষ্পকযান ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি নিয়ে যেতেই হবে। তাতে ঝামেলা একটাই যে অতবড় প্রাসাদোপম স্টারশিপ যদি ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করে তো তাতে যে আন্দোলন দেখা দেবে তা ভূকম্পের অনুরূপ। নামাতে হবে কোন মরুভুমি বা সমতলপ্রদেশে, লোকালয়ের অনেক দূরে। তিনি তেমনই বার্তা পাঠালেন পঞ্চপাণ্ডবকে। জানালেন যে স্টারশিপ নিয়ে তিনি যাচ্ছেন মঙ্গোলিয়ায়, রুক্ষ গোবি মরুভূমিতে।

গোবি এক ভয়ানক মরুভুমি। ঠাণ্ডা আর উষ্ণতা সেখানে চরম ভাবাপন্ন। মোঙ্গলরা এই প্রতিকূলতার মোকাবিলায় অভ্যস্ত হলেও ভারতীয়দের সেই পরিবেশে বড়োই বিব্রত হতে হবে। মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন উষ্ণ গলায় বলল,

‘কেন, শ্রীকৃষ্ণ তো থর মরুভূমিতেও যেতে পারত ? সেটা চেনাশোনা পরিবেশ।’

যুধিষ্ঠির বুঝিয়ে বলল,

‘শোন ভাই, শ্রীকৃষ্ণের সমালোচনা করবে না। উনি যা করেন পাণ্ডবদের হিতার্থেই করে থাকেন। গোবি মরুভূমিতে যাওয়ারও কোন বিশেষ উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে তাঁর। গোবিন্দ হেন কূটনীতিকের থৈ পাওয়া তোমার সাধ্যাতীত। চল, গোবি মরুভূমিতে যাওয়ার আয়োজন কর।’

বীর বৃকোদরের বিরক্তি তবুও কাটে না। সে বলল,

‘মুশকিল হল চীনকে নিয়ে। সে যদি না অনুমতি দেয় যাব কিভাবে ?’

যুধিষ্ঠির বোঝালেন,

‘শোন, চীনের কী সাধ্য আছে স্থিতিরক্ষক কূটনীতি বিশেষজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণের তল পাওয়া ? তুমি কি ভাব দর্পহারী শ্রীমধুসূদন চীনের কথা ভাবেননি ? দেখ না, চৈনিক প্রেসিডেন্ট কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারবেই না।’

সহদেব জানাল, শ্রীকৃষ্ণ বার্তা পাঠাচ্ছেন। চৈনিক প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। তাদের ব্যবস্থাপনাতেই পাণ্ডুপুত্ররা মঙ্গোলিয়া যাত্রা করবে। এমনকি পাসপোর্ট আর ভিসাও লাগবে না। একেবারেই ভি আই পি স্তরের ব্যবস্থা। প্রোটোকলের হাঙ্গামা সমাধান হয়ে গেছে। অতএব, যাত্রা কর চীনের ব্যবস্থাপনায় মঙ্গোলিয়াতে। গোবি মরুভূমিতে রয়েছে স্টারশিপ পুষ্পকযান।

শ্রীকৃষ্ণের সবল বার্তা এখন কেবল সর্বজ্ঞ সহদেবেরই মানসলোকে উদ্ভাসিত নয়, অন্যসব পাণ্ডুপুত্রগণ এবং যাজ্ঞসেনীর মনোজগতেও প্রখর সূর্যকিরণের ছটায় প্রেরিত হতে লাগল। পঞ্চপাণ্ডব সঙ্গে দ্রৌপদী, স্বর্গারোহনের পর সূক্ষ্মদেহে যারা স্বর্গেই ছিল, আবার মরদেহে ধরাধামে আগমনের পর এখন সমস্তকিছুই তাদের বিস্মৃতির অতলে। তারা আবার কর্মসম্পাদনের অধিকারপ্রাপ্ত, এই নব্য প্রজন্মে এই গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত। শ্রীকৃষ্ণ কী যে মায়াজাল রচনা করলেন, চীনদেশ হয়ে গেল বন্ধুভাবাপন্ন আর পঞ্চপাণ্ডব সঙ্গে দ্রৌপদী স্ব স্ব অস্তিত্বে পরিণত হল একেকটি জ্যোতির্বলয়ে এবং বাহ্যিক কোনপ্রকার যানবাহনের সাহায্য গ্রহণ না করেই নিজেদের আবার আপন আপন জীবদেহে আবিষ্কার করল গোবি মরুভুমিস্থিত পুষ্পকযানে। শ্রীকৃষ্ণ বললেন,

‘প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির স্বীকৃতির স্বার্থে আমি গোবি মরুভূমিকে নির্বাচন করেছি মঙ্গোলিয়াতে, যেহেতু এখান থেকেই শাসকবর্গ সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিল ভারতবর্ষে। এবার তাই ভারতীয় পৌরাণিক চরিত্ররা এখান থেকেই নতুন মহাকাব্যের সূচনা ঘটাবে। এখানে চীনদেশকেও এই আগামী মহাকাব্যে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হল।’

যুধিষ্ঠির কৃতাঞ্জলিপুটে বলল,

‘হে গোবিন্দ, সবই তোমার ইচ্ছে।’

শ্রীকৃষ্ণ জানালেন,

‘শোন রাজা, যে কর্মের জন্য আবার ধরাতলে তোমাদের আগমন ঘটা অনিবার্য হয়ে পড়ল, এখন তোমরা সুচারুরূপে সেই কর্মসম্পাদনে প্রবৃত্ত হও। জাগতিক স্বার্থে মানবকুলের কিছু বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। আমি সমস্তকিছু জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোন কথাই জানাতে ইচ্ছাপ্রকাশ করি না, সেক্ষেত্রে মানবসমাজ কর্মে অনাগ্রহী হবে। যেহেতু আমাকে সকলেই বাঞ্ছাকল্পতরু ভাবে, অতএব আমার এইরূপ অভিলাষ যে অজানিত রহস্যসমূহের তোমরাই প্রত্যক্ষভাবে দ্বারোদ্ঘাটন ঘটাও। তাতে পার্থিব জগৎবাসী উৎসাহিত হবে।’

যুধিষ্ঠির আনত মস্তকে প্রশ্ন করল,

‘হে সখা, এক্ষেত্রে তুমি কী করবে ?’

শ্রীকৃষ্ণ সহাস্যলোচনে জানালেন,

‘আমি এক্ষনে গোলোকধামে প্রস্থান করব। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, তেমন পরিস্থিতির উদয় হলে আমি স্মরণমাত্রেই উপস্থিত হব। যদি আবার কুরুক্ষেত্র হয় কোনকালে কোন ভিন্ন স্থানে তো আমি আবার পার্থসখার রথের সারথি হয়ে দেখা দেব। ভক্তিপাশে আমি পাণ্ডবদের কাছে আজীবন বাঁধা হয়ে আছি। অতএব তোমার কোন চিন্তা নেই।’

যুধিষ্ঠির আবার জিজ্ঞেস করল,

‘তুমি তো আমাদের পুষ্পকযান দিয়ে দিলে। তুমি নিজে গোলোকধামে যাবে কী প্রকারে ?’

শ্রীকৃষ্ণ তিলমাত্র বিড়ম্বিত না হয়ে উত্তর দিলেন,

‘আমার নিজস্ব ব্যবস্থা আছে। দেখতে পাবে এখনই।’

কথা শেষ করে শ্রীকৃষ্ণ দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্টি ও তর্জনী মর্দনান্তে বিচিত্র শব্দের উৎপত্তি ঘটালেন। সেই শব্দরাজি তীব্রবেগে ধাবিত হল ঊর্ধগগনের অনন্ত তমসাচ্ছন্নতায়। কোন আশ্রয় বা অবলম্বন ব্যতীত কী কৌশলে বিন্দুবৎ শব্দকণিকাগুচ্ছ ধাবিত হল, চক্রধারীর সেই মায়া বোঝে কার ক্ষমতা ! অল্প সময়ের ব্যবধানেই দেখা গেল অলৌকিক কাণ্ড। অনন্ত মহাশূন্যের জঠর ভেদ করে আগমন ঘটল পক্ষিসদৃশ বিশালকায় একটি জীবের। তার সমগ্র দেহ দ্যুতিময়, বর্ণচ্ছটায় উদ্ভাসিত তার অপরূপ উপস্থিতি। পাণ্ডবরা জানে, এজনই হল স্বর্গীয় পক্ষি গরুড়, শ্রীকৃষ্ণের উপযুক্ত বাহন। সেই অপার্থিব পক্ষি যুক্তকরে সম্মুখে দণ্ডায়মান হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাতে আরোহণ করলেন। পাখিটি তার স্বর্গীয় অতিকায় ডানাদুটির আন্দোলন তুলে অন্তর্হিত হল পলকমাত্রে।

শ্রীকৃষ্ণ চলে যাওয়ার পর যুধিষ্ঠির যথেষ্ট ব্যথাতুর কণ্ঠে ভ্রাতাদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল,

‘চল ভাই, আমরা আপন আপন প্রকোষ্ঠে গমন করি। এই অলৌকিক যান তো স্বয়ংচালিত। তার গতিপথ পূর্বনির্ধারিত। আমাদের এক্ষনে অপেক্ষা ব্যতীত আর করণীয় নেই কোনকিছুই।’

ওদিকে যমপুরীতে বসে ধর্মরাজ যম সমস্তকিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন। দ্বাপর যুগে বনভূমিতে অজ্ঞাতবাসের সময় তিনি একদা পাণ্ডুপুত্রগণের পরীক্ষা নিয়েছিলেন। বিশেষ করে, তাঁর প্রসাদে জন্মপ্রাপ্ত স্বীয়পুত্র জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের। সে ধরাতলে ন্যায়ের ধ্বজাধারী ধর্মানুসারী হিসেবে বিশেষ সুবিদিত। সেই পাণ্ডুপুত্ররা আবার ধরাধামে পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হয়েছে কলিযুগের দ্বিতীয়ার্ধে। তিনি ভাবলেন, ‘আমার পুত্র যুধিষ্ঠির কি অদ্যবধি তদ্রূপ ধর্মপালনে তৎপর ? তার আবার একটি পরীক্ষা নেওয়া যাক। যে কর্মে সে বর্তমানে নিযুক্ত হতে চলেছে তাতে যথাযথ ধর্মপালন অতীব জরুরী। স্বধর্ম বিচ্যুতি ঘটলে কর্মসম্পাদন দুষ্কর। আমি আবার একই উপায় অবলম্বন করি। মনে হয় অবশ্যই বিগত জন্মের সেই পরীক্ষার কাহিনী এজন্মে বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে। আমার কর্মসম্পাদনে তাই বিঘ্ন ঘটার কোন আশংকা নেই।’

এতদূর ভেবে ধর্মরাজ পুনরায় বকপক্ষির ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। পার্থক্য এই যে এখানে অনন্ত মহাকাশ, আর মায়াসরোবর সৃজনের অবকাশ নেই। এক্ষনে বকপক্ষি আসলে বিশালকায় এক অত্যাধুনিক মহাকাশযান এবং সে অবস্থান করল পুষ্পকযান গতিরুদ্ধ করে। পুষ্পক মহাকাশযান স্বয়ংচালিত, যদি কোন বিঘ্ন উপস্থিত হয় তাহলে সে আপন উদ্যোগে বিকল্প পথে ধাবিত হবে। এস্থলে বিপদ হল এরূপ যে বিকল্প পথ যাই সে নির্বাচন করে না কেন তা রুদ্ধ করে অবস্থানরত থাকে বকপক্ষিযান। বাধ্যতাবশত পুষ্পকযান নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

পুষ্পকযান যে থেমে গেছে যুধিষ্ঠিরের তা বোধগম্য হল। সে সাতিশয় দুশ্চিন্তা বিজড়িত কণ্ঠে সহোদর ভ্রাতা ভীমকে বলল,

‘শোন ভ্রাতা মধ্যমপাণ্ডব, হেন অনাসৃষ্টি কাণ্ড তো ঘটার কথা ছিল না। পুষ্পকযান থামে কেন ? তুমি যাও ভাই, সত্বর কারণ অনুসন্ধান করে এস।’

পুষ্পকযানের অভ্যন্তর সুবিশাল প্রাসাদপুরী, তুলনীয় বর্তমানকালের কোন দুর্মূল্য হাউজিং কমপ্লেক্সের সঙ্গে। সেখানে আছে ভিতরস্থ যাতায়াতের জন্য শাটলযান, যার মাধ্যমে বহির্ভাগেও যাতায়াত সম্ভব। ভীম তদ্রূপ এক শাটলযানে চেপে গদাহস্তে পুষ্পকযানের মূল দরজা খুলে অনন্ত মহাশূন্যে বেরিয়ে গেল।

অচিরেই সে দেখতে পেল বকপক্ষিযানকে, সে গতিপথে অবস্থানরত আছে গতিরুদ্ধ করে। ভীম ভাবল, ‘এ আবার কোন্ আপদ ?’ সে গদা তুলে গর্জন করে বলল,

‘হটে যাও সামনে থেকে। যে আছ পক্ষিযানের অভ্যন্তরে তাকে বলছি, রাস্তা থেকে দূর হটো। নয়তো গদাঘাতে এখনই সব চূর্ণবিচূর্ণ করে দেব।’

পক্ষিযানের ভিতর থেকে ধর্মরাজ দৈবকণ্ঠে জবাব দিলেন,

‘শোন মধ্যম পাণ্ডব বীর বৃকোদর, বৃথা দর্প পরিত্যাগ কর। আমি অবশ্যই পথ ছেড়ে দেব। কিন্তু তার আগে আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দাও। বলছি শোন।’

অতঃপর ধর্মরাজ তার প্রশ্নরাজির স্তবক জানালেন,

‘কী বা বার্তা কী আশ্চর্য পথ বলি কারে

কোন্ জন সুখী এই জগৎ সংসারে ?

পাণ্ডুপুত্র আমার যে এই প্রশ্ন চারি

উত্তর করিয়া তবে দাও শূন্যে পাড়ি।’

ভীম এমনিতেই রগচটা, এসব প্রশ্নটশ্ন শুনে সে আরও চটে গেল। তর্জনগর্জন করে বলল,

‘শোন, এইসব বেকার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় বা ধৈর্য কোনটাই আমার নেই। তুমি আগে রাস্তা ছাড়, তারপর দেখা যাবে তোমার প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া সম্ভব কিনা।’

ধর্ম হতাশ কণ্ঠে বললেন,

‘শোন মধ্যম পাণ্ডব, আমার প্রশ্নসমূহের উত্তর না প্রদানের ন্যায় অধর্মাচরণ করবে না। তাতে তোমার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।’

ভীম গদা উদ্যত করে পক্ষিযানে আঘাত হানতে গেলে ধর্ম পুনরায় সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বললেন,

‘শোন ভীম, এই পক্ষিযান স্পর্শ করামাত্র তোমার মৃত্যু সুনিশ্চিত।সাবধান !’

ভীম তাতে কর্ণপাত না করে পক্ষিযানে গদাঘাত হানল। ভীমের গদা আটকে গেল কোন অদৃশ্য বর্মে এবং ভীম তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হল। তার মৃতদেহ শাটল্ যানের বাইরে মহাশূন্যে ভাসমান রইল পক্ষিযানের চারিপাশে আবর্তনশীল অবস্থায়।

এদিকে ভীমের বিলম্ব দেখে যুধিষ্ঠির অতিশয় ব্যস্ত হয়ে অর্জুনকে ডেকে বলল,

‘যাও ভাই তৃতীয় পাণ্ডব, দেখ গিয়ে ভীম কোথায় কী করছে। তার তো এত দেরি করার কোন কারণ দেখি না। সে কি কোন বিপদে পড়ল ? এদিকে পুস্পকযান কেন থেমে গেল তাও তো বোধগম্য হচ্ছে না। তুমি যাও, গিয়ে সমস্ত কিছুর কারণ অনুসন্ধান করে শীঘ্র ভীমকে নিয়ে ফিরে এস।’

জ্যেষ্ঠভ্রাতার আজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়ে অর্জুন হাতে গাণ্ডীব ধনুক তুলে নিল এবং বেছে বেছে তীর ভরল পৃষ্ঠদেশের তূণে। তারপর অন্য আরেক শাটল্ যান নিয়ে চলল ভীমান্বেষণে।যথারীতি সে দর্শন পেল পক্ষিযানের এবং ভাসমান দেখল ভীমের মৃতদেহ। সে অতীব শোকাকুল চিত্তে ভাবল, ‘এসব এই পক্ষিযানের কারসাজি। অতএব শরাঘাতে একে ছিন্নভিন্ন করাই বিধেয়।’ এতদূর ভেবে অর্জুন গাণ্ডীবে শরযোজনা করলে পর পক্ষিযানাভ্যরন্তরস্থ ধর্মরাজ তাকে এইরূপ কর্মে নিবৃত্ত হতে বললেন। পরিবর্তে তিনি অর্জুনসমীপে তাঁর প্রশ্নসমূহ উত্থাপন করে উত্তরদান চাইলেন। ভীমের মত অর্জুনও তা গ্রাহ্য না করে পক্ষিযানকে শরাঘাতে প্রবৃত্ত হয়ে অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হল।

অতঃপর যুধিষ্ঠিরের আদেশক্রমে দুই মাদ্রিসুত নকুল এবং সহদেবও অপরাপর ভ্রাতাদের অন্বেষণে গিয়ে ধর্মরাজের বাক্য অমান্য করে পূর্বোক্ত উপায়ে মৃত্যুবরণ করল। রাজা যুধিষ্ঠির অবশেষে দ্রৌপদীকে বলল গিয়ে সমস্তকিছু দেখে আসার জন্য।পতিআজ্ঞা অবজ্ঞা করা দ্রৌপদীর নিকট অপরাধতুল্য বলে অন্তরে আপত্তি থাকা সত্বেও সে যেতে বাধ্য হল এবং অন্য অন্য পাণ্ডবদের মত ধর্মরাজের বাক্য অমান্য করে তারও অকালমৃত্যু ঘটল।

পুষ্পকযানে যুধিষ্ঠির অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ল। আর সে কাকে পাঠাবে অনুসন্ধানে ? অনন্যোপায় হয়ে তখন নিজেই নিষ্ক্রান্ত হল ভিন্ন এক শাটল্ যান নিয়ে। যথাসময়ে সে উপনীত হল বকপক্ষিযানের সম্মুখে। সে দেখতে পেল দ্রৌপদী ও অপরাপর ভ্রাতাগণের ভাসমান মৃতদেহ, পক্ষিযানকে ঘিরে আবর্তনশীল। তার যা মানসিক অবস্থা হল তা আর কহতব্য নয়। প্রথমত, সে মূর্চ্ছা গেল। অনতিবিলম্বে অবশ্য সে চেতনাপ্রাপ্ত হল এবং উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করতে করতে পুনরায় চেতনালুপ্ত হল। আবারও চেতনা ফিরে পেয়ে সে শোকদুঃখে কাতর হয়ে আত্মঘাতী হওয়ার বাসনা নিয়ে শাটল্ যান থেকে শূন্যে অবতরণ করল। তখনই ধর্মরাজ পক্ষিযান থেকে তাকে সম্বোধন করে বললেন,

‘শোন রাজা, তুমি সংসারে সুবিদিত ধর্মাত্মা বলে। তুমি আত্মহননের ন্যায় মহাপাতকী ভাবনা কর কী প্রকারে ? তোমারও তো পরকাল আছে ? যদি ওইরূপ কুকর্ম কর তাহলে ইহকালে সংসারে তো তোমার অপযশ হবেই অধর্মাচারী বলে, পরকালেও তুমি নরকবাসী হবে। অতএব তুমি বাতুলতা বর্জন কর। আমার কতিপয় জিজ্ঞাসা আছে। তুমি বরং সেসবের উত্তর দাও। তোমার ভ্রাতাগণ এবং দ্রৌপদী আমার কথা অমান্য করে প্রশ্নসমূহের উত্তরদান না করে গর্হিত আচরণ করার ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। তুমি তেমন আচরণ করতে যাবে না। তাতে তোমারও মৃত্যু ঘটবে এবং তুমি ধর্মচ্যূত হবে।’

যুধিষ্ঠির শোকতপ্ত নির্ভিক কণ্ঠে বলতে লাগল,

‘আমাকে বৃথাই তুমি মৃত্যুভয় দেখাও। ও ভয়ে আমি ভীত নই। তবে ধর্মচ্যূত হওয়া আমার ক্ষেত্রে অসহনীয়। ধর্মরক্ষার্থে আমি সমস্তকিছু বর্জনেও বদ্ধপরিকর। সাংসারিক মায়াবন্ধন ও জীবন তো তুলনায় তুচ্ছ। আমি তোমার প্রশ্নের উত্তরদানে সম্মত আছি, যেহেতু তা হবে জ্ঞানীব্যক্তির ধর্ম। শুনি, কী তোমার প্রশ্ন ?’

তখন ছদ্মবেশী ধর্মরাজ পক্ষিযানের অভ্যন্তর থেকে দৈববাণী সদৃশ ঘোষণায় জানালেন,

‘কী বা বার্তা কী আশ্চর্য পথ বলি কারে

কোন্ জন সুখী এই জগৎসংসারে

পাণ্ডুপুত্র আমার যে এই প্রশ্ন চারি

উত্তর করিয়া তবে দাও শূন্যে পাড়ি।’

প্রশ্নসমূহ শ্রবণান্তে উত্তরদান করতে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে তেমন বিব্রত হতে দেখা গেল না। সে সাবলীল কণ্ঠে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একে একে প্রশ্নসমূহের যথাযথ উত্তরদান করতে লাগল। প্রথম প্রশ্ন ‘কিবা বার্তা’-র উত্তরে সে জানাল,

‘জীব ও জড়ের সমন্বয়ে গঠিত এই যে পার্থিব মরলোক সে যেমন কালের চক্রব্যূহে পতিত থেকে অজ্ঞ, আপন ইচ্ছাধীন নয় তার কোনকিছুই, সেইরূপ মহাকালের চক্রজালে বেষ্টিত থেকে আবর্তনশীল মহাশূন্যের অপরাপর জীবলোক ও জড়লোকসমূহ, পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে এবং সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত দেবলোক, পাতাল, ব্রহ্মলোক, এমনকি স্বয়ং গোলক পর্যন্ত আর এসমস্ত কিছু বেষ্টন করে রেখেছে মহাকাল অপরিমেয় ব্রহ্মস্বরূপ ডিম্বাকৃতি জ্ঞানভাণ্ডারকে এবং মহাকালের সেই বেষ্টনীজালের অন্তর্গত নয় যা সেখানে দিব্যজ্ঞানও অচল, এক স্তম্ভিত প্রতীক্ষা সর্বব্যাপী বিন্দুবৎ বিরাজমান।’

এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন ‘কী আশ্চর্য’ প্রসঙ্গ। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যুধিষ্ঠির বলল,

‘তত্ত্বগর্বী গুণী নিত্য পৃথিবীর ঘরে

নিজ নিজ তত্ত্বদানে ব্রহ্মাণ্ডকে গড়ে

ভাবে স্বীয় তত্ত্ব হবে অজর অক্ষয়

অতঃপর কী আশ্চর্য কহ মহাশয় ?’

যুধিষ্ঠির এইরূপে যে ভাষ্য ব্যক্ত করেছিল তার সারমর্ম এইরকম,

‘যুগে যুগে মানবসভ্যতার জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ তাঁদের বিশ্বাস ও ধারণা অনুসারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি সম্পর্কে নিজেদের মত তত্ত্বপ্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সমকালীন মানবসম্প্রদায় তাঁদের প্রদত্ত তত্ত্বানুসারেই ব্রহ্মাণ্ডের ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছে। কোন কোন মতবাদ শতাব্দীপ্রাচীন। সেইসব তত্ত্বপ্রদানকারীরা এতটাই আপন ধারণা ও বিশ্বাসে মুগ্ধ এবং অটল ছিলেন যে অন্যরকমকিছু ভাবতেই পারতেন না। পরবর্তী সময়ে আবার কোন তত্ত্বজ্ঞানী সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করেছেন নতুনভাবে, তখন জগৎবাসী দেখেছে যে ব্রহ্মাণ্ড অন্যরকম নিয়মাবলীর ওপরে প্রতিষ্ঠিত। এভাবে যুগে যুগে ব্রহ্মাণ্ডকে সংজ্ঞায়িত করেছেন নতুন নতুন তত্ত্বজ্ঞানীরা নতুন নতুন অনুমান ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে। সমকালীন মানুষ সর্বদা অন্ধের মত ভেবে নিয়েছে যে ব্রহ্মাণ্ড চলছে সেইসব মতবাদ অনুযায়ী সেইসব ধারণা ও অনুমানসর্বস্ব হয়ে। আসলে কেউ ভেবে দেখছে না কখনো যে ব্রহ্মাণ্ড চলছে তার নিজের নিয়মে, কোন মতবাদের অনুমাননির্ভর হয়ে নয়। ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্রতম এক কণিকাতে অবস্থানরত ততোধিক ক্ষুদ্র মানব সমূহের ব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করার মত মতবাদ দান এক স্পর্ধা ও মূর্খের আস্ফালনসদৃশ এবং এটাই সর্বাধিক আশ্চর্যের বিষয়।’

তৃতীয় প্রশ্ন ‘পথ বলি কারে’ বিষয়ে বলতে গিয়ে যুধিষ্ঠির জানাল,

‘যে পথে বিশ্বজগৎ ধাবিত সেটাই হবে চলার পথ। বিশ্বজগৎ প্রসারণশীল, বিন্দু থেকে উৎপাদিত সিন্ধুসদৃশ, যদিও স্থিতিশীলতা তার স্বাভাবিক ধর্ম। বিন্দু থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর বিন্দুজাত জ্ঞানও ক্রমপ্রসারণশীল, অতএব উক্ত প্রসারণশীল মহাবিশ্ব ও দিব্যজ্ঞানের পথই হবে উত্তম গমনপথ। তবে এই চলার পথে সর্বদা খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয় যেন ঘটনাসীমান্তে না হারিয়ে যায় চলন, কারণ সেই অজ্ঞাত প্রদেশে যেহেতু ঘটনাবলী অনুপস্থিত তাই কালের প্রবাহ অনির্ণীত এবং জীবন ও জড় কালপ্রবাহ অথবা ঘটনাবর্জিত না হওয়াই কাম্য।’

সর্বশেষ চতুর্থ প্রশ্ন ‘কোন্ জন সুখী এই জগৎসংসারে’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে যুধিষ্ঠির সবিস্তারে বলতে লাগল,

‘যে ব্যক্তি আপন ইচ্ছায় অপরের শান্তি বিঘ্নিত না করে চলতে সক্ষম এবং যাকে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থেকে জীবনপাত করতে হয় না সেই ব্যক্তিই যথার্থ সুখী বিবেচ্য হওয়া উচিত, তথাপি কিঞ্চিৎ বাকি থাকে। বাস্তবজগতে দেখা যায় এরূপ ব্যক্তিও শেষপর্যন্ত নিজেকে সুখী বলে ভাবতে পারে না। প্রকৃত সুখী হতে পারে না জীব এই জগতে। মানুষের মনে থাকে অনন্য প্রত্যাশা, তা পূরণ হওয়া সম্ভব নয় এক জীবনে আর তাই প্রতিটি ব্যক্তির চিত্তে রয়েছে অনন্ত জীবন প্রাপ্তির লোভ। এই অনন্ত জীবনই অন্য অর্থে হল অমরত্ব এবং তা না পাওয়াই মানুষকে অতৃপ্ত রাখে। সে সুখী হতে পারে না, তার অনন্ত চাহিদা তাকে সুখী থাকতে দেয় না। এইরূপ পরিস্থিতিতে কোন মানুষই কোনোদিন জগৎসংসারে সুখী হতে পারবে না। অনন্ত চাহিদা থেকে মুক্তি ঘটত যদি সে অনন্ত জীবন পেত, কিন্তু সেই অনন্ত জীবন বা অমরত্ব মানুষের করায়ত্ত হতে পারছে না। সে সুখী হবে কী করে ?এখানেই অনিবার্য হয়ে ওঠে অন্য প্রশ্ন,অনন্ত জীবন কি সত্যিই অধরা, নাকি তাকেও পাওয়া সম্ভব কোনপ্রকারে যা শেষপর্যন্ত হতে পারে সুখী হওয়ার চাবিকাঠি ?’

যুধিষ্ঠির এখানে কথা থামাল। ছদ্মবেশী ধর্ম মনোযোগ সহকারে তার সমস্ত যুক্তি শুনছিলেন।সে চুপ করে যাওয়ার পর তিনি তার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘থামলে কেন ? বল, আমি শুনছি।’

যুধিষ্ঠির ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলতে লাগল,

‘এখানে তাহলে আমাকে অতীব জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করতে হয় যা প্রকৃতপক্ষে আমারও আয়ত্তাধীন নয়। অনন্ত জীবনের মূল অর্থ বা রহস্য কী ? এর উত্তর যুগ যুগ ধরে সবাই সন্ধানে ব্যস্ত, উত্তর জানে না কেউ এখনও। আমি কী বলি ? তবে আমি জানি দু’টি ধারা বা মতবাদের কথা, অনন্তকাল ধরে অন্তত পার্থিব মানুষ যে দু’টি পথে অমরত্বকে ভাবতে অভ্যস্ত। একটি মতবাদে বলা হয়, দৈহিক অমরত্বের কথা যেখানে শারীরিকভাবে জীবের কখনও মৃত্যু ঘটবে না, অন্য কথায় তার জীবনকাল হবে অনন্ত। এইরূপ অমরত্বের জন্যই প্রাচীনকালে তপস্যা করে বর চাইত দৈত্যদানব, অসুর, রাক্ষসরা সৃষ্টিপিতা ব্রহ্মার কাছে। এই ধারারই অনুসারি আধুনিক মানবসমাজ বা তথাকথিত সভ্যমানুষ ও চিকিৎসাবিজ্ঞান। তারা আসুরিক ভাবনা অনুযায়ী ভাবে দৈহিক স্থায়িত্ব দীর্ঘকাল থাকা মানেই অমরত্ব, অনন্ত হবে কোন মানুষের জীবনকাল, তার দেহ বিনষ্ট হবে না, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অজর-অক্ষয় থাকবে চিরকাল, তার মৃত্যু হবে না কোনদিন। অন্যদিকে অনন্ত জীবন বা অমরত্ব নিয়ে অন্য একটি বিকল্প মতবাদও আছে। সেই অমরত্ব দেহগত বিষয়কে বোঝায় না, বোঝায় অসীমকে সীমার মধ্যে উপলব্ধি করা। সেই অমরত্বের সন্ধানেই সনাতন ভারতবর্ষে হিমালয়ের গুহায় মুনিঋষিরা তপস্যামগ্ন থাকতেন, তাঁদেরও ছিল অনন্ত জীবনের সন্ধান, যা ছিল মূলত দিব্যজ্ঞানের অন্বেষণ। তাঁরা ভাবতেন, আমার মধ্যে থেকেই, আমার ক্ষুদ্র দৈহিক কাঠামোর পরিসরে আমার ক্ষুদ্র জীবনকালে আমি অমরত্বকে অনুভব করতে পারব যদি আমি ভাবনার স্বাধীনতা পাই, অসীমকে উপলব্ধি করতে শিখি। অপরিমেয় মহাবিশ্বকে যদি সীমিত আমার মধ্যে বুঝতে পারি ও খুঁজে পাই তাহলেই আমি যথার্থভাবে অমরত্বের বা অনন্ত জীবনের সন্ধান পাব। অনন্ত জীবন তাই এই ভিন্ন বা বিকল্প মতবাদে অসীম জ্ঞানভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া সীমিত আধারের সীমিত জীবনকালের মধ্যে। এই বিকল্প মতানুযায়ী, মানুষ একটি এমন অস্তিত্ব যে সময়ের প্রতিটি ক্ষণে নিজের জীবনের পুনর্নবীকরণ ঘটাতে পারবে। মানুষ অমর হতে পারে মরণকে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে। মৃত্যুকে অস্বীকার করা মানে কোন মানুষ তার অমরত্বের সুবর্ণ সুযোগকে হাতছাড়া করল।ওইসব দিব্যজ্ঞানী মুনিঋষিরা ভাবতেন, অমরত্ব মানে হচ্ছে জীবন একটি ঘিরে রাখা অঞ্চলের মধ্যে স্বাধীনভাবে যথেচ্ছ বিহার করতে পারবে। অর্থাৎ জীবন মুক্তভাবে চলাচল করবে একটি আবদ্ধ সীমানার মধ্যে যার দু’টি প্রান্ত হবে দু’টি চরম বিন্দু জন্ম ও মৃত্যু। এভাবেই প্রাচীনকাল থেকে অমরত্বের সন্ধান দ্বিধাবিভক্ত। একটি মতবাদে দৈত্যদানব-অসুররা শারীরিক অমরত্বের কথাই কেবল বুঝত এবং আধুনিক সাধারণ মানুষও তার জাগতিক বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে এই পথেই চলছে এবং উন্নয়নও ঘটছে এই মতবাদকে মূলধন করে। অন্যদিকে দেবতা এবং দেবপ্রিয়রা অমরত্ব বলতে মোক্ষলাভ ঘটাকে ভাবতেন যা মানসিক বিকাশের মাধ্যমে অনন্ত জ্ঞানভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া। এখন তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, কোন্ জন সুখী এই জগতে। কেউ যদি দৈহিক অমরত্ব পেতে চায় তো সে কবে সুখী হবে বলা দুষ্কর, আর যদি কেউ দিব্যজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অসীমকে সীমায়িত দৈহিক কাঠামোর আধারে নির্দিষ্ট জীবনকালের মধ্যে উপলব্ধি করতে চায় তাহলে সে একজীবনেই সুখী হবে, তাকে আর জন্মজন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী হতে হবে না সুখী হওয়ার বাসনায়।’

অতঃপর আবার সেই পুনরাবৃত্তি। ছদ্মবেশী বকরূপী ধর্মরাজ উত্তরশ্রবণে অতিশয় সন্তুষ্টচিত্তে যুধিষ্ঠিরকে বললেন যে একজনের প্রাণ ফিরিয়ে নিতে। যুধিষ্ঠির আবার কনিষ্ঠভ্রাতা মাদ্রিপুত্র সহদেবের প্রাণভিক্ষা চাইল। ধর্মরাজের শত প্রলোভনেও সে ধর্মচ্যুত হলনা। তখন ছদ্মবেশী ধর্ম আত্মপরিচয় দিলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে বকপক্ষিযানে এনে বক্ষলগ্ন করে বললেন,

‘সাধু, সাধু ! এমনই তোমার ধর্মে মতি থাকুক চিরকাল।’

ধর্মরাজ অতঃপর দ্রৌপদীসহ অপরাপর পাণ্ডুপুত্রগণের প্রাণদান করলেন।

অনন্তর পুষ্পক মহাকাশযানের আরোহী দ্রৌপদীসহ পাণ্ডুপুত্ররা চলল মহাকাশে মহাকালকে সঙ্গী করে মহাভারতের নতুন অধ্যায় রচনার উদ্দেশ্যে যেখানে অবশ্যম্ভাবী হবে অনন্ত জীবনের অন্বেষণ, অথবা অমরালোকের আবিষ্কার, যা থাকবে মহাজাগতিক কাঠামোরই মধ্যে।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *