দীপান্বিতা

ন্যুট হ্যামসুন

আসল নাম ন্যুট পেটডেরসন। জন্ম নরওয়ের লম অঞ্চলে ১৮৫৯ সালে। বাবা বেডের পেডেরসন ছিলেন একজন দর্জি। 

এক বিতর্কিত চরিত্র। গুণ্টার গ্রাসের সঙ্গে নাৎসী বাহিনীর যোগাযোগ নিয়ে যেমন নিন্দে-মন্দ হয়েছিল তেমনি তাঁর সম্পর্কেও এ ব্যাপারে আশ্চর্য মিল। নোবেলজয়ী এই দু’জন সাহিত্যিকেরই জীবনের শেষ ভাগ হিটলার বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় আলোড়িত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই হ্যামসুন জার্মানদের পক্ষে ছিলেন। তাঁর দেশ নরওয়ে ও সেখানকার লোকরা কিন্তু জার্মানিকে সমর্থন করত না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হ্যামসুন সরাসরি হিটলার ও নাৎসী দলের হয়ে রীতিমত প্রচার শুরু করেন। নাৎসী বাহিনী নরওয়ে অধিকার করে তাণ্ডব চালালেও হ্যামসুনের মোহ ভাঙ্গে না। উল্টে তিনি নাৎসীদের সমর্থন করে একের পর এক রচনা কাগজে-পত্রে লিখতে থাকেন। এমনকি তিনি হিটলার এবং তাঁর প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবলের সঙ্গে দেখাও করেন। তাঁর নোবেল পুরস্কারটি তিনি গোয়েবেলকে স্তুতি জানাতে উৎসর্গ করেছিলেন। 

হ্যামসুন-এর এই হিটলার প্রীতির পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল ১৮৯৪ সালে যখন তিনি প্যান বইটি লেখেন। এ সময় তিনি ফ্রেডেরিখ নিৎসের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। পরে হিটলারকেও দেখা গেছে নিৎসের আদর্শ অনুসরণ করতে। হ্যামসুন তাঁর প্যান বইটিতে নাগরিক সভ্যতা থেকে পালিয়ে প্রাকৃতিক বন্যতার মধ্যে চলে যাওয়ার ওপর জোর দেন আর এখানেই দেখা যায় নিৎসের প্রভাব। 

হিটলার ও নাৎসী বাহিনীর পক্ষ নেওয়ায় হ্যামসুনকে কম মূল্য দিতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নরওয়ে সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে প্রথমেই মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৯৪৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। গোটা মামলায় হ্যামসুন আগাগোড়া হিটলারকে সমর্থন করে যান। আদালত তাঁকে মোটা অংকের জরিমানা করে। চারদিকে সবার মুখে শুরু হয় তাঁর নিন্দা। তাঁর বইপত্রের বিক্রিও কমে যায়। অবশ্য ১৯৪৯ সালে তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বই প্রকাশ করেন। নরওয়েতে সে বই খুবই জনপ্রিয় হয়। 

রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক না কেন ন্যুট হ্যামসুনের অমর সাহিত্য কীর্তিকে অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই। তাঁর উপন্যাসগুলি রচনাশৈলী ও প্রকরণগত দিক দিয়ে একেবারেই ব্যতিক্রমী। ব্যক্তির সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কটাই তাঁর সমস্ত উপন্যাসের মূল বিষয়। কাহিনী নির্ভর উপন্যাসের একটা নিজস্ব ভাষা হ্যামসুন আবিষ্কার করেছিলেন যেখান থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রায় সমস্ত উপন্যাস তাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছে। এসব কারণে অনেক সমালোচক হ্যামসুনকে আধুনিক সাহিত্য ও উপন্যাসের জন্মদাতাও বলে থাকেন। এসব ছাড়াও হ্যামসুন নরওয়ের সংস্কৃতি ও জীবনযুদ্ধকে সারা বিশ্বে তাঁর লেখার মাধ্যমে পরিচিত করে তোলেন। 

ন্যুট হ্যামসুনের সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপন্যাসটির নাম মার্কিন ্স গ্রোডি, ইংরেজিতে দা গ্রোথ অফ দা সয়েল। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মাত্র তিন বছর আগে ১৯১৭ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। নরওয়ে ছাড়াও জার্মানিতে বইটি খুবই জনপ্রিয়তা পায়। এমনিতেও জার্মানরা গোড়া থেকেই হ্যামসুনের বিশেষ ভক্ত হয়ে উঠেছিল। সরল ও আদিম প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতায় জীবন এগিয়ে যাওয়ার আশ্চর্য কাহিনী দা গ্রোথ অফ দ্য সয়েল যেখানে আইজ্যাক নামের এক সাধারন মানুষ নিজের জীবনকে খুঁজে পায় অনাড়ম্বর গ্রামীণ প্রকৃতির সুষমায়। নরওয়ের সংস্কৃতির পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বিষয়গুলির আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছে এই উপন্যাসে। নিজের জীবন ও দর্শনেরও যেন এক প্রতিফলন ফুটে উঠেছে এখানে। ১৯১১ সাল থেকেই তিনি নরওয়ের একটি ছোট খামারবাড়িতে বসবাস করতে থাকেন আর বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দেন। সারাদিন কেবল লিখতেন আর খামারের কাজকর্ম করতেন। 

অধিকাংশ সমালোচকই অবশ্য এ বিষয়ে একমত যে হ্যামসুনের হাতে সেরা লেখাগুলি এসেছে বিংশ শতাব্দীর শুরু হওয়ার আগে। ১৮৯৪ সালে লেখা প্যানের কথা আগেই উল্লেখিত হয়েছে যা তিনি লিখেছিলেন প্যারিসে বসবাসের সময়। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত মিস্ট্রিজ ছাড়াও রয়েছে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হাঙ্গার আর এই হাঙ্গার উপন্যাসটি হ্যামসুনকে প্রথম খ্যাতির শিখরে তুলে দেয়। এখানে অসলো শহরের এক খেতে না পাওয়া লেখকের জীবনকাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। এই উপন্যাসে হ্যামসুন এক অভাবনীয় বর্ণনাভঙ্গির উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন। কখনো কথা বলেছে উত্তম পুরুষ কখনো বা তৃতীয় পুরুষ। বিংশ শতাব্দীতে এই ধারা সাহিত্যে ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়েছে। 

ন্যুট হ্যামসুনের ব্যক্তিগত জীবন আরও অনেক কারণেই বেশ আকর্ষণীয়। কোন কলেজের কোন শিক্ষা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি কোনদিন। বাবা পেডের পেডেরসন তাঁর শ্যালক হেনস ওলসেনের খামারবাড়িতে কাজ করতে চলে যান। ওলসেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ায় নিজে কাজকর্ম করতে পারতেন না। বোনের বরের হাতে খামারের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। পরে ওলসেন দাবি করেন যে তিনি পেডেরসনের কাছে অনেক টাকা পান আর বাবার ঋণ শোধ করতে বাচ্চা বয়স থেকে হ্যামসুনকে মামার পোস্ট অফিসের হিসেব দেখা, কাঠ কাটা, গ্রামের ছোট লাইব্রেরী চালানো ইত্যাদি অনেক কাজ করতে হয়। তাঁর বাবাই তাকে লিখতে-পড়তে শেখান। বছরে কয়েক সপ্তাহ গ্রামে যে ভ্রাম্যমান স্কুল আসত সেখানে খানিকটা পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। গ্রামের লাইব্রেরীর বইগুলো অবশ্য সময় পেলেই পড়তেন। শৈশব-কৈশোর জীবনের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর লেখায়। 

১৮৭৭ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে হ্যামসুন তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশ করার সুযোগ পান। উপন্যাস মোটেই সাড়া ফেলেনি। ওই বছরই এক ছোট শহরে স্কুল টিচারের চাকরি হয় তাঁর। পরের বছর আবার আরেকটি ব্যর্থ উপন্যাস প্রকাশ পায়। সাহিত্যের নেশা তাঁর মধ্যে স্থায়ীভাবে চেপে বসে আর তিনি চলে আসেন রাজধানী অসলো শহরে। প্রচন্ড দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটতে থাকে তাঁর। কিছু রোজগার হতো রাস্তা তৈরির শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। অভাবের তাড়নায় হ্যামসুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। ছ’-বছর সেখানে থেকে খামারবাড়ির ভৃত্য আর গাড়ির খালাসি হিসেবেও কাজ করেছেন। জীবনের এসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যে অভিনব গদ্যরীতির উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *