প্রীতন্বিতা
রহস্যময় প্রতিবস্তু
সৌরমণ্ডলের সীমানা পার হল টিউলিয়াস। সঙ্গে সঙ্গেই সূচনা হলো মহাকাশ যাত্রার এক নতুন অধ্যায়। মানুষ অভিযাত্রী নিয়ে আর কোন মহাকাশযান আগে কখনো সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে এতদূর পাড়ি জমায়নি।
নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে অভিযাত্রী দলের নেতা রন্ কোল বিশাল পর্দায় মহাকাশযাত্রার মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করছিল। এমন সময় তার কাছে একটি বার্তা এল। প্রেরক বেতার বিশেষজ্ঞ-আরিগাতো: ‘সামনেই একটা অদ্ভুত উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে’।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টিউলিয়াসের নিয়ন্ত্রণকক্ষে সমবেত হল অভিযানের সমস্ত সদস্য। খুবই জরুরি আলোচনা। ‘অদ্ভুত উপস্থিতি’টি কোন গ্রহ নয়, উল্কা বা ধুমকেতুও নয়, নয় মহাকাশের কোন প্রাকৃতিক বস্তু। নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর বোঝা গেল ‘অদ্ভুত উপস্থিতি’টি আসলে একটি মহাকাশযান। এ এক অভাবনীয় আবিষ্কার। কারণ মানুষ ছাড়া অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব সম্পর্কে এটি হলো জ্বলন্ত প্রমাণ।
টিউলিয়াস থেকে একটি ছোট ফেরিযান পাঠানো হলো ওই রহস্যযানের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরিযান অজানা মহাকাশযানের একেবারে কাছে চলে গেল। তারপর দুটি যানের স্পর্শ ঘটলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রবল বিস্ফোরণ। চোখ ধাঁধিয়ে গেল বীভৎস আলোকবন্যায়। দীর্ঘ সময় পর সব শান্ত হলে ফেরিযান বা অজানা মহাকাশযানের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেল না। সব কোথায় হারিয়ে গেছে! আসলে অজানা মহাকাশযানটি ছিল প্রতিবস্তু দিয়ে তৈরি।
কল্পবিজ্ঞান কাহিনী লেখকদের কাছে প্রতিবস্তু এমনই এক জনপ্রিয় বিষয়। মনে করা হয়, এই মহাবিশ্বের কোথাও এমন অঞ্চল আছে যেখানে সমস্ত কিছুই প্রতিবস্তু দিয়ে গড়া। যদি পরিভ্রমণ কালে কখনো আমাদের গ্যালাক্সি ওই প্রতিবস্তু অঞ্চলে গিয়ে ঢোকে তো মুহূর্তের মধ্যে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটবে আর সমস্ত কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে।
এবার তাহলে দেখা যাক, প্রতিবস্তু ব্যাপারটা কী। প্রতিবস্তু বা অ্যান্টি ম্যাটার হল এমন এক পদার্থ যার প্রতিটি পরমাণু অ্যান্টি প্রোটন, অ্যান্টি নিউট্রন আর পজিট্রন দিয়ে তৈরি। স্বাভাবিক পদার্থের ক্ষেত্রে পরমাণুর মধ্যে থাকে তিন ধরনের কণা—- নিউট্রন, প্রোটন আর ইলেকট্রন। পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াস গঠিত হয় নিরপেক্ষ কণা নিউট্রন ও ধনাত্মক কণা প্রোটন দিয়ে। নিউক্লিয়াসের চারপাশে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে ঋণাত্মক কণা ইলেকট্রন। ইলেকট্রনের প্রতিকণা হচ্ছে পজিট্রন। পজিট্রন হচ্ছে হুবহু ইলেকট্রনের মত, একমাত্র পার্থক্য হল এটি ধনাত্মক কণা। অনুরূপভাবে অ্যান্টি প্রোটন হল প্রোটনের প্রতিবস্তু কণা যা ঋণাত্মকধর্মী। নিউট্রনের প্রতিবস্তু কণার নাম অ্যান্টি নিউট্রন। দুটিই নিরপেক্ষ কণা এই অর্থে যে এদের মধ্যে বৈদ্যুতিক ধর্ম অনুপস্থিত। নিউট্রন আর অ্যান্টি নিউট্রনকে আলাদা করা যায় এদের স্পিন-এর ধর্ম দেখে।
প্রত্যেকটি মৌলিক কণারই রয়েছে প্রতিবস্তু কণা। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাই মেসন বা পাইওন, মিউ মেসন বা মিউয়ন, ফোটন, নিউট্রিনো ইত্যাদি। ফোটন এবং পাইওন কণার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে এরা নিজেই নিজের প্রতিবস্তু কণা।
প্রতিবস্তু কণার ব্যবহার সম্পর্কে দু’চার কথা বলা যেতে পারে। শিল্প ও ওষুধ প্রস্তুতে পজিট্রনকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা আছে। ধাতব অঙ্গের অতি সূক্ষ্ম ফাটল এর সাহায্যে শনাক্ত করা যায়। মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ পরিচিতি নিখুঁতভাবে পেতেও প্রতিবস্তু কণা বেশ দরকারি। সম্প্রতি মেসন কণার সাহায্যে ক্যান্সার জাতীয় পিণ্ডকে ধ্বংস করার উপায় জানা গেছে। যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণেও এদের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।