অমিতাভ সরকার
সঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ
কৃষ্ণচন্দ্র দে
এই সংগীত সাধকের জীবন অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর কথা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, যখন প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রচারমাধ্যম এতটা উন্নত ছিল না, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় কীভাবে সঙ্গীত জগতে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বতন্ত্র জায়গা তিনি তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় উপেক্ষা করে সেই আমলে নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটা সম্পূর্ণ ইন্সটিটিউশন। তাঁর কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয়, রেকর্ডকৃত গানগুলো যেন হৃদয়ের গভীর অন্তস্থল থেকে বেরিয়ে এসে শ্রোতাদের আত্মাকে প্রবলভাবে অনুরণিত করছে। এ যেন সাক্ষাৎ কোনো সাধুর ঈশ্বর ভজনা। আবার এই মানুষটিই যখন মঞ্চ আলোকিত করে অভিনয় করতেন, তখন দেখে কারোরই বোঝার উপায় ছিল না, যে মানুষটির দৃষ্টিশক্তি নেই। ওঁর সংলাপ বলা, হাঁটাচলার স্টাইল, অভিনয় এতখানি সাবলীল ছিল, যে সহ-অভিনেতারাও এই মানুষটির কর্মকুশলতা দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হতেন। একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। একবার উনি কলকাতা হেদুয়ার ফুটপাত দিয়ে কারোর কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটছেন। এক ভদ্রলোক ওঁকে দেখতে পেয়ে নাতিকে বললেন, ‘ওই দ্যাখ, কানাকেষ্ট যাচ্ছে।’ উনি শুনতে পেয়ে বলেছিলেন,’ঠিক বলেছ ভাই, আমি কানা-ই বটে। তবে শুধু আমি না, উপরে বৈকণ্ঠে বসে যে ব্যাটা মৌজ করছে, সেই কেষ্ট ব্যাটাও তো কানা।’ যাঁর কথা বলছি তাঁর নাম কৃষ্ণচন্দ্র দে। বর্তমান প্রজন্ম তাঁকে শুধুমাত্র বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে-র কাকা হিসাবেই জানে। এছাড়াও যে, সে আমলে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র একটা বিরাট পরিচিতি ছিল, বর্তমান প্রজন্ম সেই সম্বন্ধে আদৌ তেমন অবহিতই নয়। কৃষ্ণচন্দ্র দে কিন্তু সমকালেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী, নিজে গাইতেন, সুর করতেন, অভিনয় করতেন, শুধু তাই নয় তাঁর সাবলীল অভিনয় -সেকালের যে কোনো চক্ষুষ্মান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকেও ছাপিয়ে যেত, নিজেও অসম্ভব পারফেকশনিস্ট ছিলেন। দর্শক, সহ-অভিনেতা গুণগ্রাহীরা তাঁর করিশমা দেখে অবাক হয়ে যেত। আজকের দিনে এসব ভাবা যায়!
জন্ম সিমলের মদন ঘোষ লেনে ১৮৯৪ মতান্তরে ১৮৯৩। জন্মতারিখ ২৪ আগস্ট। জন্মাষ্টমীর দিন জন্ম বলে নাম রাখা হয় ‘কৃষ্ণচন্দ্র’। বাবা শিবচন্দ্র, মা রত্নমালা। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন মা-বাবার কনিষ্ঠ পুত্র। ডাকনাম বাবু। ছোটবেলায় পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন, এর পাশাপাশি প্রিয় বিষয় ছিল, গান শোনা, গান গাওয়া, আর ঘুড়ি ওড়ানো। বাড়িতে কীর্তনীয়ারা গান গাইতে আসতো। কানে শোনার সঙ্গে সঙ্গে গানগুলো আত্মস্থ করে খুব তাড়াতাড়িই তা কণ্ঠে ধারণ করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই চলছিল। একবার গরমের ছুটির সময় বাড়ির ছাদে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একভাবে আকাশের দিকে চেয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন। তখন ফোর্থ ক্লাসে (তেরো বছর বয়সে) পড়ছেন। ইস্কুলে ক্লাস করার সময় অনুভব করলেন চোখে অসহ্য জ্বালা করছে। মেডিকেল কলেজের ডাক্তার দেখানো হলো। ডাক্তারবাবু
অন্ধত্বের লক্ষণ দেখতে পেলেও সুস্থ করার চেষ্টায় আই ড্রপ দিলেন। ব্যথা তো কমলই না, উপরন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দৃষ্টিশক্তি চিরতরে চলে গেল। ঘুড়ি ওড়ানো, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল, রইলো শুধু গান। তাতেই জীবনকে সঁপে দিলেন। শৈশবে পিতাকে হারিয়েছেন। আর্থিক অভাব-অনটনও অনেকটাই। গান শেখানোর খরচও আছে। মা কিশোর কৃষ্ণচন্দ্রকে জোড়াসাঁকোর কাছে হরেন্দ্রনাথ শীলের বাড়ি রেখে দিয়ে আসতেন, সেখানে সারাদিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর চলতো, অনেক নামজাদা ব্যক্তিরা আসতেন। কৃষ্ণচন্দ্র সেগুলো শুনতেন, মা বাড়ি নিয়ে আসলে গানগুলো অবিকল সেই ভাবে গাইতেন। হরেন্দ্রনাথ শীল নিজেও ভালো সুরবাহার বাজাতেন। তিনিই বালক কৃষ্ণচন্দ্রকে নিজের বাড়িতে রেখে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা দিতে শুরু করেন। তখন থেকেই শুরু। সঙ্গীতশিক্ষার জন্য কৃষ্ণচন্দ্র বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। প্রথমে খেয়ালিয়া শশীভূষণ ঘোষ, তারপর টপ্পা গায়ক সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, একে একে কেরামতুল্লা খান, বদল খান, দবির খান, জমিরউদ্দীন খান, মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, কীর্তনে রাধারমণ দাস প্রভৃতি সেকালের বিখ্যাত সব শিল্পীদের কাছে সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় তালিম নেন। অন্ধ হয়ে গিয়ে অন্তরে অন্য কিছু একটা শক্তি অনুভব করলেন, ঈশ্বর যেন বহির্লোকের দরজা বন্ধ করে অন্তর্লোকের দরজা খুলে দিলেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমী, কর্মযোগী, উদ্যমী কৃষ্ণচন্দ্র আপন দক্ষতায় একজন বড় সঙ্গীতশিল্পী হয়ে উঠলেন। এমনকি হিন্দি, উর্দু শেখার জন্য নিজে মৌলভী রেখে শিক্ষাগ্রহণও করেছিলেন। সেকালের কলকাতায় অনেক বর্ধিষ্ণু ব্যক্তিদের বাড়িতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসতো। নির্মল চন্দ্র স্ট্রিটের বেচারাম চন্দ্রের বাড়িতে ১৯১৬ সালে গুরু কেরামতুল্লা তাঁকে শিল্পী হিসেবে পরিচিত করান। কৃষ্ণচন্দ্র সেদিন বিদগ্ধজনের সভায় খেয়াল গান শুনিয়ে উচ্চ প্রশংসিত হন। আস্তে আস্তে এরকম আরো অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পেতে শুরু করলেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে
এইচএমভি থেকে কৃষ্ণচন্দ্র দের গানের প্রথম রেকর্ড বের হয়। গান দুটি ছিল, যথাক্রমে-’’আর চলে না চলে না মাগো”, এবং ”মা তোর মুখ দেখে কি।” তবে গানদুটোর একটিও চলেনি। নিজের লেখা গান ‘’দীনতারিণী তারা” এইচএমভি থেকে বেরোনোর পর কৃষ্ণচন্দ্রকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গ্রামোফোন কোম্পানির ভগবতীপ্রসাদ ভট্টাচার্য সেইসময় কৃষ্ণচন্দ্রের গান শুনে মুগ্ধ হন। তারপর থেকে প্রতি মাসে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে কৃষ্ণচন্দ্রের একটা করে রেকর্ড বেরোতে শুরু করে, এবং অচিরেই তা জনপ্রিয় হয়। গ্রামোফোন কোম্পানিতে স্থায়ী শিল্পী হিসাবে যোগদান করেন কৃষ্ণচন্দ্র। রাগাশ্রয়ী গান থেকে শুরু করে বাংলা আধুনিক গানেও কৃষ্ণচন্দ্র নিজেই একটা মহীরূহ হয়ে ওঠেন। বাংলার কীর্তনের নিজস্ব ধারাকে অক্ষুণ্ণ করে তারই আদলে প্রচুর বেসিক গান তিনি তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন, সুরারোপও করেছিলেন। ‘স্বপন দেখিছে রাধারানী’,’শতেক বরষ পরে’,’নবদ্বীপের শোভন চন্দ্র’ -র পাশাপাশি ‘ছুঁইয়ো না ছুঁইয়ো না বঁধু’-র মতো পদাবলি কীর্তন, আবার ‘মেঘ হেরি নীল গগনে’, ‘ঘন অম্বরে মেঘ সমুদ্র’,’ঘন ডম্বরু তালে এলো’ প্রভৃতি রাগাশ্রয়ী বাংলা গান, আবার ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকে কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক অভিনীত ও গীত), ‘স্বপন যদি মধুর এমন’ বা স্বদেশী আন্দোলনের সময় মোহিনী চৌধুরীর কথায় নিজের করা সুরে ‘মুক্তির মন্দির সোপানো তলে’, বা ’হরে মুরারে মধুকৈটভারে’ প্রভৃতি গানগুলো কৃষ্ণচন্দ্র দের কণ্ঠে এক অনন্য মাত্রা যোগ করে। কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতও রেকর্ড করেছিলেন, যেমন-’তোমরা যা বলো তাই বলো’,’আঁধার রাতে একলা পাগল’, ’হে মহাজীবন’,’আমার যাওয়ার বেলায় পিছু ডাকে’। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে উনি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কবিতা কৃষ্ণচন্দ্রকে পড়ে শোনাতেন, ক্রমশ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিও কৃষ্ণচন্দ্র অনুরক্ত হন। সুধীন্দ্রনাথের অনুরোধে কিছু রবীন্দ্রকবিতায় কৃষ্ণচন্দ্র সুরও বসিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলো নেহাৎই ঘরোয়া পরিবেশে, তার কোনো রেকর্ড বা সেইসব সুরের কোনো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। যদি সেটা করা যেত, বাংলা সংগীত যথেষ্ট উপকৃত হতো, সেটা বলবার অপেক্ষা রাখে না। কৃষ্ণচন্দ্রের গানে কাব্যিক ভাব, আর অপূর্ব প্রেমমাধুর্যের এক রসঘন সুরমূর্চ্ছনা শ্রোতাদের এক অনাবিল আবেশে আচ্ছন্ন করে রাখতো, এবং এত বছর পরেও তার কোনোই ব্যতিক্রম হয়নি। পরবর্তীকালে
তাঁর প্রিয় ভাইপো ও শিষ্য মান্না দে(প্রবোধচন্দ্র দে) কাকার স্মরণে ‘স্বপন যদি মধুর এমন’,’ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’,’জয় সীতাপতি’, ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে’ প্রভৃতি গানগুলো রেকর্ড করেছিলেন, এবং জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিল। পাঠকেরা ভেবে দেখুন, তখনকার দিনে আজকের মতো প্রচারমাধ্যম এত সক্রিয় ছিল না, কম্পিউটার, স্মার্টফোন আসেনি, youtube ছিল না, মিউজিক সিস্টেম, রেকর্ড করার যন্ত্রপাতি এত উন্নত ছিল না, তার মধ্যেও এইসব সঙ্গীত সাধকরা কী অনায়াসে তাঁদের সেরাটুকু আপামর শ্রোতাদের কাছে উজাড় করে দিয়ে গেছেন, তুলনায় প্রতিদানে কিছুই পাননি বললেই চলে,পাওয়ার ভাবনাও তাঁদের মধ্যে ছিল না, ছিল শুধু নিরন্তর সাধনা আর সাধনা। মিষ্টভাষী, সদাহাস্যজ্বল, গৌরবর্ণের দেদীপ্যমান সুপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র সুন্দর বেশভূষা পছন্দ করতেন। জীবনের কোনো কষ্টকে কষ্ট বলে মনে করেননি। মানুষের ব্যবহারে মর্মাহত হলেও নিজের অপূর্ব ক্ষমাগুণে তা মাফ করে দিতে পারতেন। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম মঞ্চাভিনয়, ১৯২৪ সালে শিশির ভাদুড়ির আমন্ত্রণে অ্যালফ্রেড থিয়েটারে ‘বসন্তলীলা’ নাটকে বসন্তদূত চরিত্রে। তিনি মিনার্ভা, রংমহল, নিউ থিয়েটার সব জায়গাতেই কাজ করেছিলেন। থিয়েটারে অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে ‘সীতা’,’প্রফুল্ল’,’চন্দ্রগুপ্ত’,’জয়দেব’,
’দেবদাসী’, এমনকি রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক উল্লেখযোগ্য। এই নাটকের জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে গানও শিখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। থিয়েটারের পাশাপাশি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রেও গান গাওয়ার পাশাপাশি সফলভাবে অভিনয়ের দক্ষতাও দেখিয়ে গেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তখন নির্বাক থেকে সবাক যুগ আসতে শুরু করেছে।
১৯৩২ থেকে ১৯৪৬ অবধি সিনেমার গান করেছিলেন ও তাতে সুরও দিতেন।
দেবকী বসুর ‘চন্ডীদাস’ থেকে শুরু করে ‘বিদ্যাপতি’,’আলোছায়া’,’ভাগ্যচক্র’,
’বামুনের মেয়ে’,’গৃহদাহ’,’চাণক্য’,’পূরবী’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে সার্থকতার সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ‘চন্ডীদাস’ সিনেমায় ‘ফিরে চলো আজি আপন ঘরে’,’সেই যে বাঁশি বাজিয়েছিলে’,’শতেক বরষ পরে’ গানগুলো খুবই সাফল্য পায়। এই চলচ্চিত্রে কৃষ্ণচন্দ্র নায়ক দুর্গাদাসের বন্ধু অন্ধগায়ক শ্রীদামের চরিত্রে অভিনয় করে জমিয়ে দেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রণব রায়, বাণীকুমার, শৈলেন রায় প্রভৃতি গীতিকারদের গানে যেমন কাজ করেছেন, তেমন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরেও গান রেকর্ড করেছেন। রেকর্ড, নাটক, সিনেমা থেকে কৃষ্ণচন্দ্রের আয় ভালোই হতো, তবে তার অধিকাংশটাই সংগীতের উন্নতিকল্পে ব্যয় করে গেছেন। অনুষ্ঠান করার জন্য যা পারিশ্রমিক পেতেন, তার পরিমাণ যত কম বা বেশিই হোক না কেন, অনুষ্ঠানের মধ্যে তা কখনোই খুলে দেখতেন না।
নিজের তিন ভ্রাতুষ্পুত্র -প্রণব দে,প্রবোধ দে, প্রভাস দে তাঁর সার্থক উত্তরসূরী। পরবর্তীকালের শ্রেষ্ঠ সুরকার, গায়ক
কুমার শচীন দেববর্মনকে পাঁচ বছর সঙ্গীত শিক্ষা দিয়েছিলেন। বাংলা হিন্দি গুজরাটি উর্দু ,আটটি নাৎ মিলিয়ে প্রায় ছশো মতো গান রেকর্ড করেছেন কৃষ্ণচন্দ্র। ১৯৪২ সালে অভিনয়ের জন্য দুই ভাইপো- প্রণব, প্রবোধকে নিয়ে তিনি বোম্বে(মুম্বাই) চলে যান, সেখানে বাড়ি কেনেন, এবং অভিনেতা, গায়ক সুরকার, সংগীত পরিচালক হিসাবে নিজের পায়ের জমি শক্ত করেন। এখানে তিনি পরিচিত হন কে সি দে নামে। বোম্বাইতে মান্না দে-র প্লে-ব্যাকে গান গাওয়ার হাতেখড়ি তাঁর এই বাবুকাকার হাত ধরেই। ১৯৪২ সালে ‘তমান্না’ ছবিতে সংগীত পরিচালক হিসেবে মান্না দেকে সুরাইয়ার সঙ্গে ডুয়েট গাওয়ান। অভিনয়ের পাশাপাশি
সুরস্রষ্টা হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্র কিশোরকুমার, মুকেশ, মহম্মদ রফিকে দিয়ে বোম্বেতে বেশ কিছু সিনেমায় গান গাইয়েছিলেন।
বোম্বেতে অল্প সময়ের মধ্যে বেশ নাম করলেও ১৯৪৬ সালে একরাশ দুঃখ নিয়ে ওখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে কলকাতা চলে আসেন। বোম্বাইতে কিছু মানুষকে বিশ্বাস করে তাদের দ্বারাই তিনি
ভীষণরকম ভাবে প্রতারিত হন। তবে কলকাতায় এসে বাংলা সিনেমায় প্রযোজনা করতে থাকেন, তাতে সাফল্যও আসে। ১৯৫৭ সালে ‘একতারা’ চলচ্চিত্রে শেষবারের মতো (অতিথি শিল্পী হিসাবে) তাঁকে দেখা যায়।
অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এখানেই চারুচন্দ্র বসুর কন্যা তারকবালার (মিস লাইট নামে পরিচিত ছিলেন) সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম আলাপ হয়। পরবর্তীকালে রংমহল থিয়েটারে কৃষ্ণচন্দ্র দের সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছিলেন মিস লাইট। দুজনে গোপনে শাস্ত্রমতে বিবাহ করেছিলেন বলে শোনা যায়। বিবাহিত জীবনে মিস লাইটের নাম ছিল রমা দে। তাঁদের এক সন্তানও ছিল। কিন্তু মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ছেলেটি মারা গেলে দুজনে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। মৃত্যুর আগে কৃষ্ণচন্দ্র বলে গেছিলেন, স্ত্রী তারকবালাকে যেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যায়টুকু দেওয়া হয়,(যদিও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি) এবং কৃষ্ণচন্দ্রের অবর্তমানে তাঁর বাড়ির সম্পূর্ণ অংশীদার তারকবালাই থাকেন।
এবার কলকাতা বেতারের কথায় আসি। ১৯৩৬ সালে ৮ ই জুন কলকাতা কেন্দ্রের সূচনা হলে কৃষ্ণচন্দ্র দ্বিতীয় শিল্পী হিসাবে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়ে ধ্রুপদী গান গেয়েছিলেন। তাছাড়া বাংলা গানে তিনিই ঠুংরি, খেয়াল, গজল ব্যবহার প্রচলন করেন। কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল প্রভৃতি গানে যশস্বী হলেও নিজেকে কীর্তনীয়া হিসেবেই ভাবতে ভালোবাসতেন। পরবর্তীকালের সংগীতশিল্পীরাও তাঁকে
শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। একবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে কৃষ্ণচন্দ্রের শেষ বয়সের গাওয়া কোনো গান পুনরায় রেকর্ড করতে বলা হলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ’যে গান কৃষ্ণচন্দ্র দে গেয়েছেন, সেখানে আমি আর সেই গান কী গাইবো!’ পরবর্তীকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গানটি আর রেকর্ড করেননি। শচীন দেববর্মন, মান্না দে প্রমুখেরাও নানা স্মৃতিকথায় এই মহান সাধককে নানা ভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছেন।
শেষের দিকে ওঁর গান তেমন হিট হতো না। মাত্র ঊনসত্তর বছর বয়সে ১৯৬২ সালে ২৮ নভেম্বর কলকাতাতেই মারা যান কৃষ্ণচন্দ্র। সেইসঙ্গে একটা বর্ণময় যুগের অবসান ঘটে। সংগীতশিল্পী, সুরকার, প্রযোজক, অভিনেতা, নট এতগুলো ভূমিকায় একচ্ছত্র ভাবে একটা সময় কাজ করে গেছেন, সাফল্যও পেয়েছিলেন। কিন্তু এরসঙ্গে সারাটা জীবনেই ছিল শুধু দুঃখ আর যন্ত্রণা। তাই গানগুলো সেই সময় হিট হলেও তিনি কিন্তু কোনোদিনই কোনো আত্মশ্লাঘায় ভোগেননি। জীবনটাকে তিনি ঠিকই চিনেছিলেন। সাফল্য আর ব্যর্থতা জীবন-মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। পাওয়া, না-পাওয়া সবকিছুই তিনি প্রাণের ইষ্টদেবতা শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করেছিলেন। গানই হয়ে উঠেছিল তাঁর আরাধ্য পরমেশ্বর, শ্রোতারাই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরম সখা। তাই শত্রুকেও পরম মিত্রভাবে ক্ষমা করে দিতে পেরেছেন, ঈশ্বরের নামগানের মধ্যেই, যে ঈশ্বরের মানুষের মধ্যেই বাস, মানুষের মনই যেখানে তাঁর আরাধ্য মন্দির। ‘’অন্তর মন্দির মাঝে” – তাই সারাজীবন তাঁরই খোঁজ করে গিয়েছেন সুরের পথিক কৃষ্ণচন্দ্র। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। এই মহান পুরুষকারকে আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানাই।