শরদিন্দু সাহা
বাংলা কথা সাহিত্যের সুপরিচিত লেখক শরদিন্দু সাহা। লেখক সত্তা ও জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে তিনি অভ্যস্ত নন। নিছক লেখক হওয়ার জন্য তিনি কলম ধরেননি, সামাজিক দায়বদ্ধতাই তাঁকে সৃষ্টিকর্মে উদ্বুদ্ধ করে। শৈশব থেকে সৃষ্টিশীল মন লালন করে প্রস্তুতি পর্ব সারলেও নয়ের দশকের গোড়া থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। এ-পর্যন্ত শতাধিক গল্প, গোটা কয়েক উপন্যাস এবং অন্যান্য গদ্য মুদ্রিত হয়েছে। দশটি উপন্যাস আর সাতটি গল্পগ্রন্থ সহ মোট গ্রন্থের সংখ্যা ষোলো। ১৯৯৮ সালে ‘কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার পুরস্কার’ পান। ২০০৪ সালে ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ পুরস্কার’ পান। ওই বছরেই কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন মেলা কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ‘হল্ অব্ ফেম’-এ সম্মানিত করেন। ২০০৫ সালে ‘ভাষা শহিদ বরকত স্মরণ পুরস্কার’ পান। ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি’র আমন্ত্রণে গৌহাটিতে বাংলা-অসমীয়া গল্পকার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে ‘আমি’ পত্রিকা তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বিশেষ সম্মান দেন। প্রসার ভারতী’র আমন্ত্রণে নানা সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মিলিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রে ও ওয়েব ম্যাগাজিনে লিখে চলেছেন। ইতিমধ্যেই নিজস্ব এক ঘরানা সৃষ্টি করে তিনি পাঠকের মন জয় করেছেন।
(নিত্য সমাজ সংসারের যে স্রোত আমরা চাক্ষুষ করছি তার অন্দরমহল জুড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে কত তো কথাকাহিনী, যার পরতে পরতে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকে গোপনে কত তো নারীর জীবনযন্ত্রনা, ধারক বাহক হয়ে গোটা সমাজকে যাঁরা ছাতার মতো আগলে রেখেছে, নিজের পরিচয় খুঁজে নিয়েছে, সকল ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে দিচ্ছে মুক্তি যুগ যুগ ধরে। কয়জনের কথাই বা আমরা মনে রাখি। তাঁদের গোপন ব্যথা, অনুচ্চারিত কথা গুমড়ে মরে যায়, চোখের জল কেউ মুছিয়ে দেয় না, গণ্ডীবদ্ধ শৃঙ্খলিত জীবনই তাঁদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এমনই এক সাধারণ গ্রাম্য নারীর কথকতা ও চেতনায় চেনা জীবন ও সমাজপিষ্ট অব্যক্ত যন্ত্রনার পাঁচালি ‘দেশের গর্ভে স্বদেশ’ উপন্যাস।)
কথার আগুন মন হোড়াইল
তবু হতের দেখা মিলল নারে
কথাডা গলার মধ্যে কাঁডার মতো আটকি আছে। কোনোদিন তাইলে হিন্দু মুসলমান মিলত হাইরত ন! দেয়ালটা এমন শক্তপোক্ত, কার এমন সাহস যে ভাইঙব। বুয়ের পাডা শক্ত করি মিলাইতে যে আইব, হেথের কল্লা তো কাডা যাইবই যাইব, এক ঘরে হইত ন, এই কথাখান লই কোনো সন্দেহ আছে নি। আশায় মরে চাষা, আঁরও তেমন একখান ইচ্ছা আই মনের মধ্যে বাসা বাঁইধছে। কবে তুন চোয়ে পট্টি হরি রইছে, মুয়ে কুলুপ আঁডি রাইখছে, এর একখান উত্তর খুঁজি বার করতই হইব। দায়খানা কার – হিন্দুদের না মুসলমানদের, নাকি বেগ্গুনের? সময়ই একদিন না একদিন এর জবাব দিব। সময়ের হাত ধরি এই মাডিতেই এমন কামড়াকামড়ির জন্ম হইছে। মাডি খুঁইড়ত হইব, হাড্ডি মিলব। কোন সালের হাড্ডি, জইমতে জইমতে মাডির রঙই হাল্টি গেছে। চেনা দায়। ছেচল্লিশ হইত হারে, সাতচল্লিশ হইত হারে, পঞ্চাশ হইত হারে, কোনানের জল কন্নাই যাই গড়াই হইড়ছে কে কইব। কার রক্ত কার গায়ে মিশছে, হেইডাই বা কে জানে। কারও দাড়ি আছে, কারও দাড়ি নাই, কারও টুপি আছে, কারও টুপি নাই, কারও কাছে মূর্তি আছে, কারও কাছে মূর্তি নাই, কোন মুই গেলে ভালা থাইকব, অন বলার সময় আইছে নি। হরিক্ষা তো আমরা হক্কলে মিলি দিছি, কজন হাশ কইরছে, গুনি দেইখত হইব, কজন ফেইল কইরছে, গুনি শেষ কইরত হাইরত ন। কিন্তু ভাবি তো একবার দেইখত হইব, ফলটা কী ফইলছে, কয় কদম আগাইছি, কয় কদম পিছাইছি। খালি হিন্দু হিন্দু করি হিট চাপড়াইলে হইব, মুসলমান মুসলমান করি জোট বাঁইধলে হইব। জোট যদি বাঁইধতেই হয় নারী হুরুষের গিঁট বাঁইধত হইব, জনও বাঁইচব, মানও বাঁইচব। এই কথাগাইনের জন্ম ক্যামনে হইল, হেইডাও তো দেইখতে হইব। তবে কিনা আঁর নজরে অন্য এক শক্তি আই হাজির হইছে। শক্তি ছাড়া কীই বা কইতাম, বিরাট শক্তি, ক্যামনে ক্যামনে যে আই গেল! আমরা ভাবি এক, হয় আর এক। আমরা ভাবি কেউ দেইখছে না, কিন্তু দেইখছে, আড়াল তুন দেইখছেে – শত্রুও হইত হারে, মিত্রও হইত হারে।
রসময়রে কইলাম, মাষ্টার,উত্তরটা দাও দেখিনি। শুনে তো থ। কইল, এমন একটা প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেন কী এত সোজা জেঠিমা। দুনিয়া শুদ্ধ মানুষ ভাবি ভাবি কোনো কূলকিনারা হার না, আঁই কোন ছাড়। তবে এইডা ঠিক, শত্রুরাও ভুল করি এমন একখান অস্ত্র তুলি দেয়, বুইঝতে হারে না অস্ত্রখান কত ধারালো অস্ত্র। তবে তুমি কইতে আছ আঁর মনের গতি ঠিক হথেই আগাই যার। রসময় ঘাড় নাড়ায়। শত্রুর চেহারা কেমন করি হালটি গেছে। সাহেবদের লগে লইড়বার লাই তারা এক দ্যাশ এক দ্যাশ করি হরান দিছে, হেথেরা আজ হরান লইবার লাই উঠি হড়ি লাইগছে, ধরি ধরি জলজ্যান্ত হোলাগুনেরে গরাদের ভেতরে লুকাই দের। এর কোনও জবাব আছে নি কারও কাছে! কন যে কী হল কে কইব। চোয়ের নিমেষে বেগ্গাইন দেইখতে দেইখতে কেমন হাল্টি যায়, ছাপোষা মাইনষের কী এমন ক্ষমতা বুইঝত হারে। হা করি খালি চাই থাই, বুঝি না-বুঝি ফাঁসি কাঠে গলা দেয়। ভাবে এই পথে দ্যাশের মুক্তি, দশের মুক্তি। দ্যাশ কারে কয়, দশ কারে কয় হেইডা ক্যামনে জানব। হরের চোখ দিই চাইলে কী হক্কলটা বোঝন যায়। নিজের চোখ আর মন দিই বুইঝলেই হুরাডা না হইলেও কোন হথে হাঁইটত হইব টের হাওন যায়। আঙ্গ গ্ৰামের মাইনষে চালাক চতুর না হইলেও সাদাসিধে, যেমন বোঝায়, তেমন বোঝে। আইজকাল মাঝে মাঝে হুইনতাম হাই ভিন গ্ৰামের মানুষ আই আঙ্গ গ্ৰামের হথেঘাটে ঘোরে আর মাইনষের কানে কুমন্তর দেয়। লাভ লোকসান বুঝি না তবে আগাম আঁচ কইরতাম হারিয়ের বিপদ একখান ঘাড়ের উপরে আই আছড়াই হড়ার উপক্রম হর। কী যে কমু, কারে কমু, নিজের মনরে সুধাই আঁই জিগাইন অনুমান কইরতে আছি, হেডাই যদি ঠিক হয়, তবে তো আর রক্ষা নাই। হজরতের বাপ সকাল না হইতেই আম বাগানের এক কোনায় নাড়া জ্বালাই আগুন হোয়ায়। শীতও হড়ছে, কনকনে ঠান্ডায় ঠকঠক করি কাঁপে। আগুনের তাপ শরীলেরে গরম কইরলেও কী কারণে জানে মনটা উসখুস করে। মাঠ ভরা ধান হইছে, গোছা গোছা করি ধান কাডি মাঠের এমাথা তুন ওমাথা বিছাই রাইখছে। সবে এক গাঁইট মাথায় করি আনি ধানের মড়াইয়ের হাশে ধপাস করি হালাইছে। হারাদিনে মাঠ খালি কইরত হইব, মাঝখানে শরীল গরম করি দম নেওয়া। ধান ঝাড়াইবাছাই করি হাসিনা এক প্রস্ত উঠান ঝাঁট দেয়। মাড়াই দিত হইব তো। গোয়ালঘরে শ্যামা খামারে দাবনা দিছে, না হইলে বিয়াল তুন খাইটব ক্যামনে। হাসিনা জানে জিয়াদ আলি, হজরতের বাপ, মনসুররা হুক্কাতে এই সময় সুখটান দেয়। হাসিনা টিক্কাতে আগুন জ্বালাই হুক্কাটা হাতে দিলে হেগুনে গড়গড় শব্দ করি একজন টান মারি আর একজনেরে দেয়। ওরা হুক্কা টান দেওয়া হইলে মাঠের দিকে ছোটে। হজরতের বাপ বয়সের ভারে এট্টু ধীরেসুস্থে যায়। কইলাম, কি হজরতের বাপ শরীল নড়তে চায় না বুঝি। শরীরের আর কী দোষ, বয়সটা তো দিনে দিনে বাড়তেছে বই কমতেছে না। ‘তা দিদি আমনে ঠিক কথাই কইছেন। গোয়ালের গরুগুনের মতোই আমরা রাতদিন হরের কথায় উঠবস করি। কারা আঙ্গ গলায় ঘন্টা বাঁধি রাইখছে। আঙ্গ হোলামাইয়াগুনরে হেট ভরি খাইত দিতাম হারি না। কে আর আঙ্গ কথা ভাবে। বদইলা খাডি যা মজুরি হাই দুইজনের মাইনষেরই চলে না, পাঁচ জনের মুয়ে ভাত তুলি দিমু ক্যামনে।’ বড় খারাপ সময় এখন। চারধারে কান হাতলেই শুধু হাহাকার আর হাহাকার। এ ওর কান ভাঙার। ইগাইন হাঁচা কতা নি কন চাই। তোঙ্গ গ্ৰামের মাইনষেরে কারা আই আঙ্গ হিছনে লাগাই দের। ওরা নাকি আঙ্গ বাড়িঘর দখল করি আঙ্গরে উৎখাত করি ছাইড়ব। ঠিক হুনিয়ের নি? হেথে কয়, ‘দিদি ভুল হোনেন ন। চক্রান্ত একখান চইলছে। মুসলিম লীগের মেম্বাররা গোলমাল পাকার। নানা কতা বোঝার। কইতে আছে হিন্দুরা এতদিন আঙ্গরে শোষণ কইরছে, আঙ্গরে উঠতে দে ন। বদলা নিবার সময় আইছে। হেথাগরে বোঝাইতে হইব, আমরাও কোনও অংশে কম ন। এইটা প্রমাণ কইরত হইলে হিন্দুদের দ্যাশ তুন তাড়াইত হইব, একটা মুসলমানের দেশ বানাইতে হইব।’ ওমা হেই কথাগাইন তো বঙ্গবন্ধুর কথার লগে মিল খার না। হেথেনে কইতে আছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আঙ্গ শত্রু, এরা কয় হিন্দুরা আঙ্গ শত্রু, তাইলে কার কথা ঠিক ধরুম। তাইলে কি আঙ্গরে লোটা কম্বল লই দ্যাশ ছাইড়ত হইব। তোমরা বুয়ে হাত দিই কও না, এই দ্যাশ আঙ্গ দ্যাশ নয়? তবে আমরা কোয়ান তুন আইলাম? ‘হেইডা কইতে হাইরতাম ন। তবে যা বুইঝছি, আমনেদের আর বেশিদিন থাইকত দিত ন। মন খারাপ করিয়েন না। আমরা আছি ত। এতকাল আমনেগো নুন খাইছি, সুখে দুঃখে আঙ্গ হাশে ছিলেন কত হুরুষ ধরি, আমনেগো মাইরতে আইলে আমরা হেগুনরে ছাড়ি দিমু নি, আমনেগো গায়ে হাত লাগানোর আগে আঙ্গ বুয়ের উপর দিই মাড়াই যাইত হইব।’
মাইয়ার আঁর কদ্দিন ধরি হেডের গোলমাল হইছে। আদামনি বাডি খাওয়াইলাম। কিঞ্চিৎ উপশম হইলেও সোয়াস্তি হয়নি। সেই মনোরঞ্জন কবিরাজেরে ডাক কইরতে হইল। মাইয়ার হেডের গুড়গুড়ানি থাইমলই না। অবস্থা বেগতিক দেই কবিরাজ মশাই শহরে বড় ডাক্তার দেয়ানের হরামর্শ দিল। কতাটা কওন যত সোজা, করন তত সোজা ন। চারহাশে মিছিল হরতালের বান ডাকি উইঠছে। মানুষ রাগে হোঁসের। এমতাবস্থায় মাইয়ারে নৌকায় চাপাই হেথির বাপ সহ শহরের হতে রওনা দেওন ছাড়া অন্য উপায় কি। চিন্তায় তো আঁই দুই চোয়ের হাতা এক কইরতাম হারিয়েন না। কচি মাইয়ারে লই শহরে হোঁচাইতে হাইরলে হয়। মাঝি তো নৌকা বায়, আর একজন গুণ টানে। খালে ভরপুর জল, নদীতে জোয়ার আইছে বিধায় ঢেউয়ের দপদপানি। ছইয়ের নিচে ঠাণ্ডা কি আর মালকাড়ায়। মাইয়ারে কোনোরকমে জাপটাই ধইরলাইম। মাইয়া তো হেডের যন্তনায় থাকি থাকি লাফাই ওডে। কিছুদূর যাওয়ার হরে আঙ্গ বাড়ির সদর দরজার কাছে শ্মশানের মঠ চোয়ের আড়াল হই গেছে। নৌকাটা তো ভাইসতে ভাইসতে দেড় মাইল খানেক হার হনের হর সুলতানপুরের কবরখানা। রসুল মিঞার ইন্তেকাল হইলে গত হরশুই কবর দিছে। আঁর স্বামীর লগে ভালা সম্পর্ক ছিল। জমিজমা লই গোলমাল লাইগলে হরামর্শের লাই হেথেনের কাছে শনিবার শনিবার করি আইত। মানুষটার হরের জন্য ছিল মেলা দরদ। হেথেনরে দাদা দাদা কইত, মানুষটার হঠাৎ করি চলি যাওনে হেথেনে বড় কষ্ট হাইছে। আঁর এট্টু ভয়ও হইতেছে। মনে মনে ইষ্টনাম জপ কইরতে শুরু কইরলাম। এমনিতে মাইয়া মাইনষের শত রকমের ভয়, আর যদি কবরখানার হাশ দিই ঘেঁষি নৌকা চলি যায়, এবার আঁরই থরথর করি কাঁপুনি শুরু হই গেল। আঁর স্বামী মাথায় হাত রাই সান্ত্বনা দিই কয়, ‘মাইয়ার কথা ভাব, মাইয়ার মাথায় হাত বুলাও, দেইখবা ভয়ডর কন্নাই চলি যাইব।’ ওমা দেই ছলাৎ ছলাৎ করি গলুইয়ে জল ওডে। দু-একখান হুডি মাছ আর কাঁচকি মাছ তিড়িং বিড়িং করি লাফাই ছইয়ের উপরে হড়ে। চাইর মুই হাড়ের দৃশ্য কি দেইয়ুম, মাইয়ার দিকে মন হড়ি রইছে। থাই থাই মাইয়া আঁর কইতে লাগে, ‘হেডের মধ্যে যন্তন্না হর’ গরম তেল লই আইছি বাড়ি তুন বার হইবার সময় শিশি ভর্তি করি। চাইর পাঁচ হোডা নাভির মধ্যে মালিশ করনে মাইয়া এট্টু শান্ত হইল। একজন দাঁড় বায়, আর একজন গুন টানে। মেঘ গজরার আকাশ যেন হাঁডি হড়ের। বাতাস যেন পাগল হই উইঠছে। আঁর স্বামী কয় মাঝি অন কি উপায় হইব। তুঁই এক কাম কর হাড়ে নৌকা ভিড়াও, নৌকা তো দোলের। আঁর মাইয়ার কী দশা হইব। কেন্নে শহরে হোঁচাইয়ুম কন চাই।’ ‘বাবু, আমনে চিন্তা করিয়েন না, আঁর উপরে ভরসা রাখেন। আল্লার ওয়াস্তে ঠিক হৌঁচাই দিমু আমনেগরে। খোদাত আল্লাহ ঠিক রহম কইরব।’ আঁই আঁর মাইয়ারে চাইদর দিই মোড়াই জড়াই ধরি রাইখলাম। খালের জল যত বাড়ে, চিন্তা আঁর তত বাড়ে। খালের দুই হাড়ের জমির ধানের ছড়া জলের দামালপনায় অস্থির হইলে সোজা হই থাওনের চেষ্টা করিও নেতাই হড়ে। মড়মড় করি গাছ ভাঙি হড়ের, ডরে গায়ের লোম খাড়া হই যার, বুকের ধুকপুকানি গরু ছোটার মতো ছোটে। এর হড়ে আঙ্গ কী গতি হইব দম বন্ধ করি হড়ি রইলাম। ভগবান মুখ তুলি চাইল। ঘাটে আই নৌকা ভিড়াইলে দেইখলাম শহরের ঘরবাড়িখাইন মাথা তুলি খাড়াই আছে।
আঁর স্বামী কয় ‘সাবধানে হত চল।’ দলে দলে নানা মুই তুন লোকজন আই ভিড় কইরছে। হিন্দুর বাড়ির বউ মাইয়া দেই দোকানঘর তুন দুই চাইরজন বাঁকা চোয়ে চায়। কী জানি নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করি কথা কয়। মনের মধ্যে সন্দেহ একখান দানা বাঁধে। রাস্তাঘাটে দিন দুপুরে কত কিছুই না ঘটে। কার মনে কী আছে ক্যামনে কওন যায়। এ ওর কানে ফুসমন্তর দেয়। কদ্দুর যাই থাইমলাম। শেষমেশ বুকের বল আনি কয় পা আগাই গেলাম। যা হইবার তা হইব, ভয়ে হিছপা হইলে চইলব নি। মাইয়ারে ডাক্তারের কাছে লই যাইতেই হইব, না হইলে হেথিরে যে বাঁচান যাইত ন। ওমা এ কী! উল্টা দিক তুন দুই তিন জন যুবক হোলা দৌড়ি যাইতে যাইতে সাবধান করি গেল। হেগুনের হিছনে হিছনে আরও ক’জন মোড়ের দিকে তুন ডান দিকে চলি গেল। বুইঝতাম হাইরলাম, বড় একখান কিছু ঘটি গেছে। পিডাপিডি শুরু হই গেছে দূরে কন্নাই। কে কারে পিডার, খবর কেউ আর দেন না। মাইনষে খালি ছুইটতেই আছে। চোয়ে-মুয়ে আতঙ্ক, মুখ দিই কথা হরে না। চিন্তায় হড়ি গেলাম কী করুম,কী করুম। দ্যাশের অবস্হাটা যে এতটা খারাপ হই গেছে, আঁর স্বামী আঁরে কনও কয়নো। ছুতা একখান হাইলেই ধরি ধরি গারদে ঢুকায়। রিকশার হেছনে, হোলের গায়ে, দেয়ালের গায়ে গায়ে পোষ্টার হইড়ছে, কত কত দাবির কথা লেখা। দ্যাশের মাইনষে ক্ষ্যাপি আগুন। আঁর স্বামী জিগাইল, ‘কীয়ের এত গণ্ডগোল?’ ‘ওমা, আমনেরা হেও জানেন না। আওয়ামী লীগ আর অন্য কটা দল মিলে আন্দোলনে নাইমছে, পাকিস্তানিরা যে আঙ্গ দ্যাশের ধন সম্পত্তি লুডি লই যার, সেনাদের মধ্যে আঙ্গ বাঙালিদের জায়গা দিচ্ছে না, সরকারি দপ্তরে হেথাগো হচন্দের মানুষদের চাকরিতে ঢুকার, আইন সভায় আঙ্গ স্থান নাই, শোষন চালাইতে আছে, সেইসব লই ঢাকা সহ হক্কল শহরে হত্যেক দিন মিটিং মিছিল হর। আমনেরা দেইখছি কিছুই খবর রায়েন না।’ ‘আমনে এত খবর জাইনলেন ক্যামনে? দাদা আমনে কী কাম করেন?’ ‘আদালতে মুহুরীগিরি করি।’ আঁই এসব কথা হুনি বোবা হই গেলাম। মাইয়ার ইগাইন দেই মুখ দিই আর কথা হরে না। মুদি দোকানদার, ঔষধের দোকানদার, খাবার হোটেলের মালিকরা হক্কলে ঝাঁপ বন্ধ করি দিই হলাই চলি যার। গ্ৰামের তুন যারা কারবার কইরবার লাই শহরে আইছে হেথারা দিশাহারা। এমন অবস্থায় আমরা দিশাহারা, কোন মুই যাইলে একখান আশ্রয় মিলব। সামনে বড় রাস্তার তুন নামি হা চালাই চইললাম। আঙ্গ হাঁটু কাঁপা শুরু হই গেছে। মসজিদ দেই ধড়ে হরান আইল, ইমামরে জিগাইল, ‘রহমান ডাক্তারের কাছে যাইবার লাই ঘুরহতে কোনো রাস্তা আছে নি? আঁর মাইয়ার শরীল খারাপ, যেমন করি হোক যাইতেই হইব।’ ‘চারদিকের অবস্থাটা ভালা না, তবুও আঁই আমনেদের যেমন করি হারি হৌঁচাই দিমু, চিন্তা করিয়েন না।’
চিন্তায় আঁর দিন কাঢে। কন কী দশা হয় কি কমু। রেডিওতে খবর হুনি বেগ্গুনে অস্থির হই যার। কোন দিকে যে দ্যাশ যাইব, কিছুই বুঝা যান না। হুলিশের হিডাইনি আর গুলি খাই জেলায় জেলায় তরতাজা হরান চলি যার। আঁর এক হোলা আর স্বামী টাউনে থায়। থাই থাই কারফিউ জারি করে সরকার, কন রে কোন সংবাদ আইয়ে হরানডা ঢিপ ঢিপ করে। আর এক হোলারে তো ভারতে হাঢাই দিছি, জানি না কি সুখে আছে। কত দিন, মাস চলি গেল কোনো সংবাদ হাই না। ভারত তো পাকিস্তানের শত্রু দেশ, দিনরাত শাপ-শাপান্ত করে, একখান পোস্টকার্ড আই হৌঁইছতে মাসের হর মাস চলি যায়। চোয়ের জলের বাঁধ মানে না। আঁর মাইয়াঢাও দাদার জন্য চিন্তায় বাঁচে না। পাকিস্তান সরকার যদি এই দ্যাশেরে কব্জা কইরবার লাই উডি হড়ি লাগে, মাইনষে ছাড়ি কথা কইব নি, আইজ না হয় কাইল হেথাগো মাজা ভাঙি দিব, এই আঁই কইতাম হারি। কদ্দিন হইল এক দল হুলিশ সকালে বিয়ালে আঙ্গ বাড়ির সামনে দিই ঘুরি ঘুরি চলি যায়। কিল্লাই যায়,কন্নাই যায়, নতুন কোন ফন্দি আঁঢের কিনা, কে কইব। আমরা তো ভয়ে ভয়ে থাই। হেথাগো তো আবার হিন্দু বউঝিদের উপরে নজর। বউ মাইয়াদের কই, তোরা কিন্তু কেউ হাইত্তে সদর দরজার কাছে কিনারে যাইস না। কে কইত হারে নি যদি হেগুনের কুনজর হড়ে। বাড়ির কুকুরগুন দিনরাত ঘেউ ঘেউ করে। নতুন মানুষদের দেই ওরাও ভয় হাইছে। হেথাগো মুখের উপর দিই কিছু বলার লাই কোমর বাঁধি। একদিন ওরা আঙ্গ বাড়ির ভিতরে ঢুকি জল খাওনের ভড়ং করে। যাওনের বেলা সাবধান করি দেয় – তোমরা কান খুলি হুনি রাখ যদি কোন হোলা ওই সরকারের বিরুদ্ধে কোন চক্রান্ত করে তবে কিন্তু হাতকড়া হরাই টাইনতে টাইনতে লই যাইয়ুম, এমন ঠ্যাঙানি দিমু না, বাপের নাম ভুলাই দিমু, খোদা আইলেও বাঁচাইতে হাইরত ন। শেষমেশ বাড়ির মধ্যে যে হেথাগো কোপ হইড়ব, বুইঝতাম হারি ন। বাড়ির হোলামাইয়ার হড়ালেখা টঙে উইঠছে। ইসকুলে হাডাইবার কথা উইঠলে হক্কলে দশ পা পিছায়। বুড়াবুড়িরা তো দ্যাশের অবস্থা আর কিছু বোঝেন না। খালি কয়, ‘তোরা এত ডরে ডরে থাকস কিয়ের লাই, এই দ্যাশ তো আঙ্গ দ্যাশ, হেথাগো বাপের সাধ্যি আছে নি আঙ্গ দ্যাশখান তুলি লই যাইব।’ কিন্তু আগুন যে জ্বলের দেয়া না গেলেও টের হাইতে বেশি সময় লাগে না। বঙ্গবন্ধুর চোখ দিয়েও আগুন জ্বলে, মরণপন কইরছে একখান হেস্তনেস্ত করি ছাইড়ব। সপ্তাহান্তে যে একখান দৈনিক ইত্তেফাক আঁর স্বামী বাড়ি লই আইয়ে, দেইখবার লাই আঁই ছটফট করি। হেইঢা হেথেনে বোঝেনও ভালা করি। বাড়িতে ঢুকি হইলা কাগজখানা আঁরে দিই কয় ‘এই নাও তোঁর মনের খোরাক, না হইলে তো ঘুম আইত ন। আইজ কাগজে একখান নতুন খবর আছে।’ আগে দেইখতাম আইয়ুব খানের ছবি, অন দেই নতুন একজনের ছবি, ইয়াহিয়া খান, ইনি নাকি এখন দ্যাশের হর্তাকর্তা। কারে কি কমু একবার জাইনতামও হাইরলাম না, কখন সব হাইলটায় যায়। কী কাণ্ড কী কাণ্ড, আঙ্গ দ্যাশেরে হেথারা গনায় ধরে না, সাধে আঙ্গ নেতারা ক্ষেপি যায়।
বুইঝতে আঁর দেরি হইল না কেন্নে কেন্নে এই হাল্টাহাল্টি হইল। আঙ্গ গ্ৰামের অনেকের কাছেই এই খবর অজানা। কেউ কেউ আনন্দে নাইচল, কেউ আবার কইল, এই একখান খবর হইল, এইডা লই এত মাথা ঘামানোর কী আছে। কেউ আবার পণ্ডিতের মতো মাথা দোলাই দোলাই কইল, আছে, আছে। নানা মাইনষের নানা মত। এইঢা লই আঁর একটা অন্য মত আছে। আরে, সরকার হালটাইল কি হালটাইল না, এই খবরে আঙ্গ কি অমন হইব, দ্যাশের মাইনষের ভাগ্য কি হালটাই যাইব? বাঙালিদের নিজের একখান দ্যাশ লাইগব। আমরা কি খাই, কি হরি, কন্নাই আমরা থাই, কেন্নে আমরা থাই, কোন বাজারে বাজার করি, হোলামাইয়ারে কেমনে আদর করি হেথারা কেমন করি জাইনব, হেথারা কেমন করি আঙ্গ সুখ দুঃখের ভাগ লইব ? এই সকল প্রশ্নগাইন আঁর মাথায় গিজগিজ করে। তোরা হক্কলে ভাব, তোদের হোলারে তোগো মতো অন্য কেউ মানুষ কইরত হাইরব, ওগো হেঢের ক্ষুধা লাইগলে তোরাই তো বুঝবি, না অন্যরা আই খাওয়াই দিব, দ্যাশের মা’র-ও একই দশা, বুঝিস ন। না বুইঝলে আঁই ভালা করি বুঝাই দিমু। আঁর কথাগাইন হুনি বেগগুনে হাসে, আঁর স্বামী কিন্তু একটুও হাসে না, গালে হাত দিই ভাবে কিছুক্ষণ, তারপরে কয়, ‘তুমি এই কথাগাইন কোন তুন শিখলা, আঁই তো তোঁরে শিখাইনি।’ নিজে নিজে শিখছি, মাইনষে বুঝি নিজের তুন কিছু শিখতে হারে না, এ কেমন কথা! তোমরা হুরুষ মাইনষে ভাব, মাইয়ালোকেরা খালি চুলা ধরাইত জানে, ভাতের হাঁড়ি ধরি নাড়েচাড়ে, লাকড়ি, হরমুল জোগাড় করে, হোলামাইয়ার জন্ম দিত হারে, আর কিছু হারে না। এইবার আঁর কথায় চুপ করি থায়। কি জানি হুরুষ মাইনষেরে ঠেস দিই কথা কইছি বলে গায়ে ফোসকা হইড়ল কিনা। যদিও আঁই জানি আঁর স্বামী একটু অন্য ধাতের লোক, মাঝে মাঝে মাইয়াদের অধিকার লই দু’চার কথা বলে, তবে এইটা জানি না, কোন কথাটা উনি মাইনত হাইরব, আর কোন কথাটা মাইনত হাইরত ন। আঁর জায়েরা আঁর কথা হুনি ঠকঠক করে কাঁপে। হেগুনের স্বামীদের লগে ওরা কোন কথা কয়, আর কোন কথা কয় না, হেগুনেই জানে। মাইয়াগো যে আর একটা জীবন আছে, এইটা কোনদিন টের হায় ন, খোঁজেও ন। আবার ভাবি ওদেরও একটা ধর্ম আছে, যা আঁই জানি না, জাইনবার চেষ্টাও তো করি নি কোনদিন, কিন্তু এক লগে সংসার সামলাইছিলাম কত বছর। ওরাও আঁরে বড় জা বলি মান্যিগন্যি কইরছে। ওদের মনের কথাগাইন আঁরে খুঁজি দেইখতে হইব। হেগুনের মনে এত ভয় কেন, এই কথাখান আঁরে জাইনতেই হইব ।
ভয়টা যে কন্নাই লুকাই আছে, আঁই নিজেও জানি না। কেউ কম কথা কয়, কেউ বেশি কথা কয়, তাইতে দোষের কি আছে। হ্যাঁ আইজকাল হক্কলে যেন কেমন চুপ মারি থায়। চিন্তায় চিন্তায় হক্কলে আধমরা হই আছে। প্রশ্ন একখান মনের মধ্যে আই খোঁচা মারে এমন একখান দুঃসহ অবস্থা হাঁচাই আঙ্গ চাইরধারে গিলি খার! এরকমটা হইবার দরকার কি ছিল? কারা এর লাগি দায়ী, হিয়ানেই হক্কল কথার উত্তর আছে। আঁর দেওরের নাতনিটা আইজকাল খুব করি কারন নাই, অকারণ নাই ছটফট করের। হেথিরে আঁই বুঝাই হারি না, লাফাই লাফাই চলি যায়, এই আছে, এই নাই। আঙ্গ দ্যাশে যা হর, হেইডা কী হর, কারও জানা বোঝা নাই, শুধু দেখি যাই, বেগ্গাইন মনমানি যেন। বড় বড় শহরের মুই চাই থায়, হেথেনরা যে হতে চলে, বুঝি না বুঝি হেই হত ধরে। কামকাজ হালাই বদইলারাও দশখান কথার মধ্যেই পাঁচখান কথা ইয়াহিয়া খানরে লই কয়। এই বেডার কথা আঁর কানে আইছে। ইসলামাবাদে বই প্যাঁচ কষে কেন্নে আওয়ামী লীগের মাথা মুড়াইব। বড় আজব দ্যাশখানা, মাইনষে কয় হেথাগো সৈন্যরা নাকি জল্লাদের মতো, এক গুলিতে সাবাড় করি হালায়। লঙ্কার দ্যাশের রাইক্ষসদের যেমন ছিটাফোঁটা দয়ামায়া ছিল না, খালি হরের মাইয়াদের দেইখলে ছলচাতুরি করি চুরি করে, হেগুনেও নাকি রক্তমাংস চিবাই খায়। হায় হায় রে, এরা আঙ্গ দ্যাশে আইলে কী হাল হইব। দ্যাশের মাইনষেরে ভূত বানাই ছাইড়ব। একখান জিনিস হোনা যার, মুসলিম লীগের যে নেতাগুন লাফাইতে ঝাপাইত তারা কোন কারনে নাকি চুপ মারি গেছে। কী জানি হেথাগো হত হালটাই হালাইছে কিনা। এইটা বুইঝতাম হারিয়ের কোনানে না কোনানে কেউ আঙ্গরে হতে বসাইবার ফাঁদ বানার। আঁর তো চিন্তা বাড়ি যার দিন দিন কেন্নে হোলাপাইনরা হড়াশোনা চালাইব। আইয়ুব খান গদি ছাড়ি চলি যাইবার হর মাইনষে ভাইবতে শুরু কইরছে এখন আবার কোনরমের আদেশ জারি হইব। কি চাপ আই হইড়ব? বাজার যদি আরও আগুন হই যায়, আরও মাইনষের রোজগার কমি যাইব, ইগাইনের সুরাহা হইব ক্যামনে? হোনা যার অন নাকি হাঁড় ভাঙ্গা খাটনির টাকাগুন ওরা লই চলি যার ঘুরহতে। বাড়ির লোকজনেরে কই, তোরা যিহানে হিয়ানে মুখ লাগাইচ না, কে যে কার চর, শেষমেশ বড় বিপদ হই যাইব। রেডিওতে হক্কল কথা ঠিক কয় না, রাখিঢাকি কয় যাতে করি দ্যাশের মাইনষে জাইনতে না হারে। সিলেট তুন খুড়তোতো দেওরের বড় হোলা আইছে কত রাস্তা ভাঙ্গি, বাসে রেলগাড়িতে চড়ি, পায়ে হাঁঢি। সওদাগরি আফিসে খাতাহত্র লেয়ে। এমন হইছে ওর চোয়ের দিকে তাকাইতাম হারিয়েন না। তোর কি হইছে রে রেবতী, অত ঘাবরাই আছস ক্যান? চাকরি বাকরি ঠিক আছে তো রে? ‘না গো জেঠি, আর চাকরি কইরতাম হাইরতাম ন। বিছানাপত্র গুটাই বাড়ি চলি আইত হইব, ওপরের তুন নাকি চাপ আইছে, হিন্দু কর্মচারী রাওন যাইত ন। মালিক খারাপ ন, কনডাই তুন চাপ আইছে, কে কইব। আঁর অনুমান যত নষ্টের গোড়া ওই পাকিস্তান সরকার, হেথাগো লগে কারবার কিনা।’ কিন্তু এত সহজে যে ভাঙ্গি হইড়লে চইলত ন।
অন এমন অবস্থা হইছে, বাড়ির হোলাপাইনরা যারা ছড়াইছিটাই ছিল কাজেকর্মে কেউ চাঁটগায়, কেউ ঢাকায়, কেউ ময়মনসিংহে কেউ কুমিল্লায়, হক্কলে গুটাই গাটাই ঘরে চলি আইয়ের। মনের মধ্যে ভয় ঢুকি গেছে। একদিকে তো মিটিং মিছিল প্রতিবাদ ভাঙচুর, কোম্পানির লোকেরা কারবার গুটাই হালার। লস খাই আর কদ্দিন চালাইব। এগুনেই-বা গ্ৰামে আই কি কইরব, গ্ৰামে আর কামকাজ কিছু আছে নি। ব্যবসা-বানিজ্য যে কইরব দোকানপাট হাইব কন্নাই। এমনিই হিন্দুর দোয়ানের ব্যবসা চলে না। কেউ আর সওদা কেনে না, না খাই মইরবার জোগাড়। এই তো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আঙ্গ দুঃখের কথাগাইন কে আর হুইনব, চেঁচাইলেও, কাঁদাকাঁঢি কইরলেও কি সরকারি বাবুরা হুইনব, হেথেনরা তো অমনিতেই চোখ কান বন্ধ করি আছে। আঁর জাইনতে ইচ্ছা করে গোটা দুনিয়াটা চইলছে এমন করি, না আঙ্গ দ্যাশেই এত কষ্ট, এত ভাগাভাগি, এরুম হইলে আমরা বাঁচুম ক্যামনে? কারও কি আক্কেল, হচন্দ নাই যা খুশি তাই কইরব। জোয়ান হোলাগুন কী ঘরে বই থাইকত হারে! কে আগাই আইব এই বিপদের দিনে। মাথার উপর শনি নাচের। একটা দুঃসংবাদ কানে আইছে, হুলিশেরা মিছিলের উপর গুলি চালাইছে, মরি গেছে দুইজন, কত মানুষ যে জখম হইছে, তার কি ইয়ত্তা আছে। মুজিবুর রহমান সরকারেরে হুঁশিয়ারি দিছে এর ফল হেথাগরে ভুইগত হইব। খবরের কাগজে বড় বড় করে ছাইপছে বঙ্গবন্ধুর গর্জনের কথা। রেডিওতে টু শব্দটা করে নাই। এত যে কাজ চলি যাওনের লাই মাইনষে না খাই থার, হার তলার জমি চলি যার কারও কি মাথাব্যথা আছে। হুইনলাম একটা দল ভিতরে ভিতরে গরীব মাইনষের লাই দরবার করে, কম্যুনিষ্ট কয়। হেথাগো দলের কয়জন আঙ্গ গ্ৰামেও আইছে। ইয়ানের এক হোলা হেই দলে নাম লেখাইছে। হেথেই নাকি ডাকি আইনছে। আঙ্গ বাড়ির যে হোলাগুন কাম হারাইছে ওদের হুসলাইতে আছে হেথাগো দলে যেন নাম লেখায়। আঁই আর কি কমু, খড়কুটা হাইলেই আঁকড়াই ধরে। ওরাই ফের অন্যদের মাথা খায়। আওয়ামী লীগের লগে এতাগো কী সম্পর্ক কে জানে। তবে এগুনের কথাগাইন হুইনতে মন্দ লাগে না। ধম্মকম্ম লই কোন উচ্চবাচ্য এগুনে করে না। ইয়াহিয়া খান কি এদের খবর জানে? এগুনে ঠিক না বেঠিক হেইঢাই বা কে জানে। আঁই একখান কথা ওদের জিগাইলাম, এত ভারি ভারি কথা বুঝি না, হেঢের ভাতের জোগাড় করি দিতা হাইরবা, তাইলে তোঙ্গ কথা হুনুম।
(পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)