আবদুস সাত্তার বিশ্বাস
গুজরাটে রিয়াদ রাজমিস্ত্রী কাজ করে। বিয়ে করে ঘরে তিন মাসের নতুন বউ রেখে কাজে যায়। কাজে যাওয়ার আগের দিন রিয়াদ শিউলিকে বলে— আমার খুব ইচ্ছ্যা ছিল, বিহ্যা করে আর বাহিরে না যাওয়ার। বাড়িতে থেক্যা কিছু করার।
— তাইহিলে বাহিরে যাছ্যো ক্যানে?
— না গ্যালে যে পাকা বাড়ি করতে পারবো না। টিনের বাড়িতে থেক্যা থেক্যা আমার আর থাকতে ভালো লাগে না। এ্যাকটা পাকা বাড়ি করবো।
শিউলি জিজ্ঞেস করে— গিয়্যা ক্যাতোদিন থাকব্যা?
— এ্যাকটা পাকা বাড়ি করতে যে টাকা খরোচ হয় অই টাকা রোজগার করতে য্যাতোদিন সুমায় লাগবে।
— এ্যাকটা পাকা বাড়ি করতে ক্যাতো টাকা খরোচ হয়?
— আন্দাজ পাঁচ-ছ লাখ টাকা ধরো!
— আর অই টাকা রোজগার করতে ক্যাতোদিন সুমায় লাগে?
— আড়াই-তিন বছর ধরো!
— অতোদিন! অতোদিন আমি থাকতে পারবো? শিউলি রিয়াদের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে— বাহিরে এ্যাখুন কিছুদিন না গ্যালে হতোক না? যে বাড়ি আছে অই বাড়িতেই থাকতুক। আরও কিছুদিন পরে যাত্যাক!
— কিছুদিন পরে গ্যালে হবে না। এ্যাখুনই যাত্যে হবে। য্যাতো তাড়াতাড়ি পারি পাকা বাড়িড্যা করে ফেলতে হবে।
।। দুই।।
রিয়াদরা তিন ভাই দুই বোন। ভাইদের মধ্যে রিয়াদ সব ছোট। আর বোনদের বড়ো। বড়ো দুই ভাই বিয়ে করে আগেই ভিন্ন হয়ে গেছে। তবে তারা আদি ভিটায় নেই। অন্যত্র জায়গা কিনে বাড়ি করেছে। রোডের ধারে বাড়ি। বাড়িও করেছে খুব সুন্দর। সৌদি আরবে সাত বছর ছিল না! সাত বছরে প্রচুর টাকা কামাই করেছে। সেইসব টাকা দিয়ে রোডের ধারে জায়গা কিনে বাড়ি করেছে।
কিন্তু রিয়াদ? তার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে আদি ভিটায় রয়ে গেছে। রিয়াদের রোজগারে তাদের পুরো সংসার চলে।
।। তিন।।
রিয়াদ বিয়ে করতে রাজি ছিল না। তার ইচ্ছা ছিল সে-ও একবার সৌদি আরবে যাবে। সেখান থেকে ফিরে এসে ভালো একটা পাকা বাড়ি করে তারপর বিয়ে করবে। পরে আর বাইরে যাবে না। বাড়িতে থেকে কিছু করবে। কারণ, বিয়ে করে পুরুষের বাইরে যাওয়া ঠিক নয়। মানুষ যায় তাই। ওতে স্বামী-স্ত্রীর মন খারাপ করে, রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে আর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।
কিন্তু রিয়াদের মা তা শোনে না। সে বলে— সৌদি আরবে তোখে যাত্যে হবে না। তার আগেই তোখে বিহ্যা করতে হবে। গ্যাতোক্যাল এ্যাকটা মেয়্যা দেখ্যা আমার খুব পসন্দ হয়্যাচে। য্যামুন চ্যাহারা ত্যামুন গায়ের রং। তোর সাতে ভালো মানাবে। এ বিহ্যাতে তোর অমত করা চলবে না। এ বিহ্যা তোখে করতে হবে। আমি মেয়্যার বাপ ও মায়ের সাতে কথা বুলেছি। অরা বিহ্যা দিতে চাহালচে।
— সে কী! আমি জান্নু না শুন্নু না আর তুমি—
— তোখে জানান্যার সুমায় পানু কখুন? হটাক না!
— কী রকম হটাক?
রিয়াদ প্রশ্ন করলে তার মা উত্তর দেয়— তুই তো জানিস, আমি দু’দিন বাড়ি ছিনু না। তোর ছোটো খালার বাড়ি ছিনু; বেড়াতে গেলছিনু।
— জানবো না ক্যানে? আমিই তো তুমাকে বাসে তুলে দিয়ে এস্যাচি।
— হ্যাঁ, তোর ছোটো খালার বাড়িতেই আমি মেয়্যাডাকে দেখ্যাচি। মেয়্যাডা তোর ছোটো খালাহের পাড়ার। বেড়াতে এস্যাচিল। পরে মেয়্যেডা সম্পক্কে তোর ছোটো খালাকে শুধাই— হ্যাঁ রে, মেয়্যাডা কে? দেকতে খুব মিষ্টি!
তোর ছোটো খালা বুলে— আমাহের পাড়ার। অরা দেকতে সবাই মিষ্টি। তুমার রিয়াদের সাতে বিহ্যা দিব্যা নাকি! বিহ্যা দিলে খুব ভালো মানাবে।
— আমি তো মুনে মুনে ওড্যাই ভাবচিনু। কিন্তুক বিহ্যা এ্যাখুন অরা দিবে? বুয়াস তো খুব হালকা মুনে হলো।
— অহের বংশে মেয়্যাহের হালকা বুয়াসেই বিহ্যা দ্যায়। বিহ্যা দিবে।
— মেয়্যারা ভাইবহিন কডা?
— ভাইবহিন নাই। শিউলি এ্যাকা।
— শিউলি মেয়্যার নাম বুঝি!
— হ্যাঁ।
— খুব মিষ্টি নাম। দেকতে য্যামুন মিষ্টি নামও ত্যামুন মিষ্টি! মেয়্যার বাপের অবোস্তা ক্যামুন?
— তুমাহের মুতোনই।
— জায়গাজমি ক্যামুন আছে?
— তুমাহের মুতোনই বিঘ্যা দুয়েক।
— বিক্যালে তুই আমাকে এ্যাকবার অহের বাড়ি বেড়াতে লিয়্যা যাবি!
— যাবো না ক্যানে? যাইয়ো।
তোর ছোট খালার সাতে আমি অহের বাড়ি বেড়াতে যাই। আমাহের মুতোনই টিনের দু’খ্যান ঘর। যাওয়ার পর আমাহের দেখ্যা আকাবাকি করে বসতে জায়গা দ্যায়। শপ পেড়্যা দ্যায়। চা, বিস্কুট, ডিম খাত্যে দ্যায়। খাওয়া হলে পরে কথা শুরু হয়। মেয়্যার মা আমাকে শুধায়— বুবুর বাড়ি তাইহিলে কুন গিরামে হলো?
— কুমারপুর। আমি গিরামের নাম বুলি।
— কুন কুমারপুর? ভগীরথপুর কুমারপুর?
— না, জলঙ্গি কুমারপুর।
মেয়্যার বাপ ত্যাখুন আমাকে বুলে— আপনাহের জলঙ্গিতে ম্যালাদিন আগে আমি এ্যাকবার গেলছিনু।
— কী করতে? পদ্মার ভাঙন দেকতে?
— হ্যাঁ। গাড়ি করে আমরা ম্যালা ক’ জুনা গেলছিনু। ভাঙন দেখ্যা আমার তো চোখে পানি চলে আস্যাচিল। আল্লাহ কুনু মানুষের যানে অমুন দিন না করে।
— আর কিছুডা ভাঙলে আমরাও ভাঙনে তলিয়্যা যাতুক। আল্লাহই আমাহের বাঁচিয়্যা দিয়েছে।
মেয়্যার বাপের সাতে কথা বুলতে বুলতে আমি এব্যার মেয়্যার দিকে তাকাই। তোর ছোটো খালার মুখে নাম শুনা ছিল তা-ও নাম শুধাই— তুমার নাম কী মা?
— শিউলি।
— খুব মিষ্টি নাম। দেকতে য্যামুন মিষ্টি নামও ত্যামুন মিষ্টি। আল্লাহ তুমাকে বাঁচিয়্যা থোক; বাঁচিয়্যা থাকো। বুলে শিউলির মাকে শুধাই— শিউলির এ্যাখুন বিহ্যা দিব্যা না নাকি!
শিউলির মা বুলে— তুমাহের দিকে এ্যাকটা ভালো পাত্র দ্যাখো! বিহ্যা দিব।
— কী রকম ছেল্যা লিব্যা?
— চরিত্র ভালো। দেকতে সুন্দর। মদ-মাতাল না।
— আর অবোস্তা?
— আমাহের মুতোন হলেই হবে।
আমি আর দেরি করি ন্যা। ত্যাখুনই বুলে দিই— তাইহিলে আমার ছেল্যার সাতে তুমাহের শিউলির বিহ্যা দ্যাও! আমার তিন ছেল্যার মধ্যে দুই ছেল্যার বিহ্যা হয়ে গেলছে। এড্যা ছোটো ছেল্যা। নাম রিয়াদ। চরিত্র ভালো। কুনু নিশা করে না। মিস্ত্রি কাজ করে। দেকতে খুব সুন্দর। বিহ্যা দিলে দুজনাকে খুব ভালো মানাবে। কী রে আরজিনা, মানাবে না? দারুণ মানাবে বুল!
— হ্যাঁ, দারুণ মানাবে!
আমাহের দুই বহিনের কথায় অরা বিহ্যা দিতে রাজি হয়। আগ্যামীক্যাল তোখে দেকতে আসবে।
।। চার।।
সব শুনে রিয়াদ বলে— কিন্তুক বিহ্যা করে থাকবো কুন্ঠে? ঘরবাড়ি নাই। পরের বাড়িতে রাত্যে শুত্যে যাত্যে হয়। ঘরবাড়ি না করে আমি এ্যাখুন বিহ্যা করবো না। তুমি মানুষ আসতে মানা করে দ্যাও! আগে আমি সৌদি আরব থেক্যা এ্যাকখ্যাপ কাজ করে আসি। তারপর বিহ্যা করবো।
রিয়াদের মা মোমেনা বিবি বলে— মানা করবো না। দু’খ্যান ঘরের এ্যাখান ঘর তোখে ছেড়্যা দিব। বো লিয়্যা তুই অই ঘরে থাকবি। আর এ্যাখান ঘরে আমরা সবাই মিলে থাকবো। তারপর মাস তিনেক বাদে এ্যাকবার গুজরাটে যাবি। না, আমরা তোখে সৌদি আরবে যাত্যে দিব না। আপদে বিপদে অতোদূর থেক্যা বাড়ি আসতে পারবি ন্যা। আজক্যাল গুজরাটেও ম্যালা টাকা কামাই। গুজরাট থেক্যা আইস্যা পাকা বাড়ি করবি। চিন্তা করিস ন্যা, তোর এব্যারকার টাকা আমরা এ্যাকটাও খাবো না। সব টাকা তোর লিজের কাছে জমিয়্যা থুবি।
— না খাল্যে তুমাহের সংসার চলবে কীভাবে?
— অ আমরা ঠিক চালিয়্যা লিব। আমাহের লিয়্যা তুই কুনু চিন্তা করিস ন্যা। গাই বিয়ালছে; গাইয়ের দুধ বেচবো, নুন্দা-ঘুঁটে বেচবো। আর তোর বাপ মাঝে মাঝে লোকের পাট (মুনিশ) খাটবে। আমরা লাট কাটবো, বিড়ি বাঁধবো। হাতের কুন কাজ জানি ন্যা! সব কাজ জানি।
— তোবু আমার বিহ্যা করতে এ্যাখুন মুন চাহাচে না। আর বছর চার্যেক বাদে বিহ্যা করলে হতোক না?
— ভালো জিনিস সব সুমায় হাতের কাছে পাওয়া যায় না বুঝলি!
রিয়াদ আর কথা বাড়ায় না। বিয়ে করতে রাজি হয়।
।। পাঁচ।।
পরের দিন রিয়াদকে চারজন লোক দেখতে আসে। রিয়াদের পরিবার তাদের জন্য আলাদা করে খাবারের ব্যবস্থা করে। খাবার খেয়ে তারা রিয়াদকে দেখে। রিয়াদকে তাদের পছন্দ। পরে দেনাপাওনা বিষয়ে কিছু কথা জিজ্ঞেস করে— তুমার কুনু দাবি আছে? দাবি থাকলে বুলো, কী দাবি আছে?
— আমার কুনু দাবি নাই। রিয়াদ বলে।
— দাবি নাই ক্যানে? রিয়াদকে তারা পাল্টা প্রশ্ন করে।
— কারোণ, আমাহের মধ্যে দাবি করে বিহ্যা করা নাই। কেহু কুনুদিন দাবি করে বিহ্যা করে নি। তাছাড়া দাবি করে বিহ্যা করা হলো হারাম। কুনু হারাম কাজ আমরা পসন্দ করি ন্যা।
— ঠিকাছে; বিনা দাবিতেই তাইহিলে বিহ্যা হবে।
এক মাস বাদে নগদ পাঁচ হাজার এক টাকা দেনমোহরে বিনা দাবিতে বিয়ে হয়।
তিনমাস বাদে গুজরাটে যাওয়ার দিন রিয়াদ শিউলিকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দেয়। রিয়াদের জন্য শিউলির কোনো সময় মন খারাপ করলে ফোনে রিয়াদের ছবি দেখে সে মন ভালো করবে।
।। ছয়।।
শিউলির লাল টুকটুকে ঠোঁটের মিষ্টি হাসি রিয়াদ ভুলতে পারে না। ট্রেনে চেপে গুজরাটে যাওয়ার সময় শুধু তারই কথা তার মনে পড়ে। ফলে তার কিছুই ভালো লাগে না। ট্রেনের খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুধু শিউলিরই কথা ভাবতে থাকে। সঙ্গীদের কারও সাথে সেভাবে কথা বলে না। তা দেখে সঙ্গীরা তাকে জিজ্ঞেস করে— কী রে, বোর লাগ্যা তোর খুব মুন খারাপ করছে?
— খুব মুন খারাপ করছে রে! মুন বুলছে, টেন থেক্যা নেম্যা পড়ে অন্য টেন ধরে বাড়ি যাইয়্যা বোর মুখে চুম্যা খাই!
সঙ্গীরা তা শুনে খুব মজা পেয়ে খিলখিল করে হাসে— শালা আস্ত এ্যাকটা বো পাগলা ছেল্যা রে!
।। সাত।।
গুজরাটে পৌঁছে রিয়াদ শিউলিকে ফোন করে।
শিউলি ফোন ধরে— হ্যালো!
— ক্যামুন আছো?
রিয়াদের গলা পেয়ে শিউলি কেঁদে ফেলে।
— কী হলো? কানছো ক্যানে? কথা বুলো!
শিউলি চোখ, মুখ মুছে পরে স্বাভাবিক হয়ে বলে— ভালো নাই। তুমার লাগ্যা খুব মুন খারাপ। থাকতে পারছি ন্যা। তুমাকে এ্যাখুন যাত্যে মানা কন্নু তা-ও তুমি শুনল্যা না!
— ধোরযো ধরো, সব ঠিক হয়ে যাবে।
— ধোরযো ধরতে পারছি ন্যা।
— পারছি ন্যা বুললে হবে? ধরতে হবে।
— কখুন পৌঁছাল্যা?
— খানিক আগে।
— রাস্তায় কুনু অসুবিত্যা হয়নি তো?
— না, কুনু অসুবিত্যা হয়নি।
— খাওয়া দাওয়া করেছো?
— করিনি। এ্যাখুন করবো। আব্বা-মা, দখিনা-সখিনা কেমন আছে?
— সবাই ভালো আছে।
— তুমি খাওয়া দাওয়া ঠিক মুতোন করছো তো?
— খাবার ঢুকচে না। সব সুমায় তুমার কথা মুনে পড়ছে।
— না না, তা করোনা। খাবার খাইয়ো। নাইহিলে শরীল খারাপ হয়ে যাবে। শুকিয়্যা যাবা। যা হোক, শিউলি? এ্যাখুন ফোন রাখছি। খাবার খাওয়ার লেগ্যা সবাই ডাকাডাকি করছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে পরে ফোন করবো।
।। আট।।
গুজরাটে কাজে যাওয়া রিয়াদের পুরো তিন বছর হল। এরমধ্যে তার পাড় ভেঙেছে বহুবার। সেই ভাঙা পাড় সে পরে আবার সারিয়ে নিয়েছে। ওখানে টাকা দিলে একটা জায়গায় মেয়ে পাওয়া যায়। যে যেমন মেয়ে চায়। কিন্তু শিউলি? মনের নদীতে বান ডেকে ডেকে তারও কম পাড় ভাঙেনি। রিয়াদের দ্বিগুণ! তবু সে নিজেকে সংযত রেখেছে। নিজেকে ধরে রেখেছে। রিয়াদের মতো কাউকে দিয়ে সে তার ভাঙা পাড় সারিয়ে নেয়নি। রিয়াদের তো টাকা লেগেছে। তার টাকা লাগত না। শুধু ইশারা করলেই কত ছেলে এসে সারিয়ে দিয়ে যেত। তার যাওয়ার দরকার হতো না।
আবু নামের একটা ছেলে তো প্রায় দিনই তাকে বলত— এ্যাকদিন আসবো নাকি ভুঁই লিড়িয়্যা দিতে?
একই কথা রোজ রোজ শুনতে শিউলির ভালো লাগে না। ফলে সে একদিন বলে— আইসো। কখুন আসব্যা?
— তুমি য্যাখুন বুলব্যা।
— তাইহিলে কাল দুফোরে আইসো। দুফোর ডেট্টায়। তুমার লেগ্যা ঘরে আমি বসে থাকবো। তুমি আসার সুমায় এ্যাক কল ফোন করে আইসো।
— ঠিকাছে, আসবো। কিন্তুক ঘড়ি দেখ্যা দুফোর ডেট্টায় ক্যানে? তার আগে বা পরে না ক্যানে?
— ওড্যা তুমি বুসতে পারোনি? অই সুমায় বাড়িতে কেহু থাকে না। শ্বশুর মাঠে আর শাশুড়ি ঘাটে থাকে। আর ছোট দুই ননদ ইশকুলে। দুফোর ডেট্টায় আসতে বুলার কারোণ এব্যার বুসতে পারল্যা?
— তুমার মাথায় ক্যাতো বুদ্ধি গো!
কথামতো আবু পরের দিন দুপুরে শিউলির ঘরে আসে। কিন্তু ভেতরে সে ঢুকতে পারে না। বিরাট একটা হেঁসো নিয়ে শিউলি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। যাতে আবু টপ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে নেশার ঘোরে তাকে জড়িয়ে না ধরতে পারে।
হাতে হেঁসো দেখে আবু শিউলিকে জিজ্ঞেস করে— কী গ, তুমার হাতে হেঁস্যা ক্যানে?
শিউলি হেঁসোটা তখন মাথার ওপর একবার কায়দা করে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে— আমি তোখে এই হেঁস্যা দিয়ে কাটবো। কেট্যা কুটি কুটি করবো। আমাকে তুই চিনিস ন্যা। আমি কে আজ তোখে চিনিয়্যা দিব। যাথে তুই আমার সাতে আর কুনুদিন ফাজলামি করতে না পারিস। বলে শিউলি আবুর দিকে যেই অগ্রসর হতে যায় অমনি আবু প্রাণ নিয়ে দৌড়ে পালায়।
।। নয়।।
রিয়াদ যে টাকা রোজগারের স্বপ্ন নিয়ে গুজরাটে গিয়েছিল তিন বছরে সে টাকা তার রোজগার হয়ে গেলে শিউলিকে সে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে সে বাড়ি আসছে। রিয়াদের এমন ধারা ফোন পেয়ে আনন্দের অন্ত থাকে না শিউলির মনে। প্রাণের মানুষ ঘরে আসছে। মনের মানুষ কাছে আসছে। এতদিন সে ভালো কোনো শাড়ি পরে সাজগোজ না করলেও রিয়াদের ফোন পাওয়ার পর সাজগোজ করতে শুরু করে। এতদিন যে তার সাজ দেখার মানুষ ছিল না। এখন সাজ দেখার মানুষ আসছে।
কিন্তু রিয়াদ ঘরে ফেরার খানিক আগেই তার সব উদ্যম নষ্ট হয়ে যায়। নিজের ওপর বিরক্তিভাব নেমে আসে এবং ভীষণ রাগ হয়। ভালো শাড়ি খুলে একখানা পুরনো শাড়ি পরতে হয়। এরপর রিয়াদ ঘরে ফিরলে পুরনো শাড়িতেই তাকে রিয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়— ক্যামুন আছো?
— ভালো আছি। তুমি ক্যামুন আছো?
— ভালো আছি।
বলা পর রিয়াদ শিউলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে, কোলাকুলি করে, চুমো খায়। এসব হয়ে গেলে শিউলিকে সে বলে— পুরোনো শাড়িতে তুমাকে এ্যাকদোম ভাল্লাগছে না। ভালো শাড়ি পরোনি ক্যানে? এ্যাতোদিন বাদে কাছে আসনু পুরোনো শাড়িতে তুমাকে দেখবো বুলে? না, এড্যা তুমি ঠিক করোনি।
শুকনো হেসে শিউলি বলে— ভালো শাড়িই পরেছিনু। কিন্তুক তুমি আসার খানিক আগেই খুলে থুনু।
— খুলে থুলে ক্যানে?
— পরে বুলবো। তুমি এ্যাখুন পোশাক পালঠ্যা হাত, মুখ ধুয়ে খাইয়্যা ল্যাও!
রিয়াদ তখনই শিউলির দিকে তাকিয়ে বলে— আজ রাত্যে ঘুমাবো না। সারারাত জেগ্যা থাকবো, সারারাত গল্প করবো, সারারাত…
।। দশ।।
দিনের সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে অস্ত গিয়ে রাতের আঁধার নেমে আসে। রিয়াদ শিউলিকে বিছানায় আহবান করে— আইসো সুনা, পাখি আমার!
কিন্তু শরীর খারাপ আর পেট ব্যথা থাকার কারণে শিউলি আহবানে সাড়া দিতে পারে না।
— কী হলো, আইসো! দেরি করছো ক্যানে? রিয়াদ অস্থির হয়ে ওঠে।
শিউলি রিয়াদের কাছে গিয়ে তখন দুই গালে দুটো চুমো খেয়ে বলে— আজ হবে না সুনা, শরীল খারাপ আর প্যাট ব্যথা। অর লেগ্যাই তো ভালো শাড়ি খুলে পুরোনো শাড়ি পরেছি। আমারও খুব ইচ্ছ্যা ছিল তুমার সাতে রাত জাগার। কিন্তুক ওড্যার কী হিংস্যা দ্যাখো, ডেটের আগেই হয়ে গ্যালো…
রিয়াদ শিউলিকে তখন বলে— আসলে তুমি হলে এ্যাকটা নষ্টা মেয়্যা! নাইহিলে এ্যামুন হয়? কুনু পরপুরুষ কাছে আসলে ত্যাখুন শরীল খারাপ হয় না, প্যাট ব্যথা থাকে না। আর বহুদিন বাদে স্বামী ঘরে আসলেই শরীল খারাপ আর প্যাট ব্যথা হয়! এ্যাসব আমার ভাল্লাগে না, সহ্য হয় না।
রিয়াদের কথার ছিরি দেখে শিউলি বলে— কী বুলল্যা! আমি নষ্টা মেয়্যা!
— তাছাড়া কী!
রিয়াদের কথা শিউলির একেবারে সহ্য হয় না। মুহূর্তের জন্যও সে কোনোদিন ভাবেনি যে তার প্রিয়তম স্বামী ঘরে ফিরলে তার মুখ থেকে তাকে এমন কথা শুনতে হবে। কিন্তু আজ শোনার পর ঘর থেকে সে বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। রাত্রে আর বাড়ি ফেরে না। পরের দিন সকালে পাড়ার আবদুল কাবিল মোড়লের আম বাগানে গিয়ে দেখে, মোড়লের কাঁচা মিষ্টি আম গাছটার একটা ডালে গলায় ফাঁস নিয়ে একটা মেয়ে ঝুলছে। জিভ বেরিয়ে গেছে। মেয়েটাকে দেখে আবদুল চিনতে পেরে চিৎকার শুরু করে— শিউলি গলায় দড়ি দিয়ে গাছে ঝুলচে গ, শিউলি গলায় দড়ি দিয়ে গাছে…