দীপান্বিতা
জোসে সারামাগো
নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগে পর্যন্ত জোসে সারামাগো নামটি ঔপন্যাসিক হিসেবে ইউরোপের বাইরে একেবারেই অপরিচিত ছিল। ১৯৯৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রাতারাতি সারামাগো ও তাঁর সাহিত্যকীর্তি নিয়ে পৃথিবীজুড়ে শুরু হল মাতামাতি। তিনি প্রথম কোন পর্তুগিজ নাগরিক যিনি এই পুরস্কার পান। ব্যাপারটা আশ্চর্য হলেও সত্যি।
জন্ম তাঁর ১৯২২ সালে পর্তুগালের আজিনহাগা অঞ্চলে। তাঁর নাম আসলে হওয়া উচিত ছিল জোসে চৌচা কারণ তাঁর বাবার নাম ছিল জোসে ডি সৌসা। সারামাগো পদবী হওয়ার পিছনে রয়েছে এক গল্প। তাঁর বাবা জোসে ডি সৌসা আর মা মারিয়া ডা পিয়েদা দে ছিলেন আজিনহাগার ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক। অঞ্চলের এক বিশেষ বুনো উদ্ভিদের নাম আসলে এই উদ্ভিদ ওখানকার অতি দরিদ্র লোক খেয়ে বেঁচে থাকে। জোসে ডি সৌসাকে সবাই সারামাগো বলে ডাকত। জন্মের পর সরকারি অফিসের লোকেরা কৌতুক করে তাঁর বার্থ সার্টিফিকেটে পদবি হিসেবে লিখে দিল সারামাগো।
কয়েক বছর পর বাবা পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহরে পুলিশের কাজ পেয়ে গেলেন। ছোট্ট সারামাগোকে সেখানেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। পড়াশুনায় ভালই ছিলেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন এই সুযোগ তাঁর ভাগ্যে রইল না। বাবা-মা ভেবে দেখলেন, তাঁদের যা অর্থকষ্ট তাতে তাঁরা ছেলেকে উচ্চশিক্ষা দিতে পারবেন না। তার চেয়ে বরং তাঁকে কোন কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করে দেওয়া ভালো। তাতে ছেলে অল্প দিনেই প্রশিক্ষণ নিয়ে রোজগেরে হতে পারবে।
এইসব কাঠ-খোট্টা কারিগরি পড়াশুনা কি তার ভালো লাগত ? রক্তে যাঁর সাহিত্য তিনি যে এই রসকষহীন পরিবেশে অসাচ্ছন্দবোধ করবেন সে তো স্বাভাবিক। কলকব্জার ঝনঝনানির মধ্যেও তিনি সাহিত্য খুঁজে বেড়াতেন। সন্ধেবেলাটা সারামাগো পাবলিক লাইব্রেরীতে কাটাতেন। হাতের কাছে যে বই পেতেন তাই পড়তেন। কোন বাছবিচার ছিল না। এ সময় তিনি ফরাসি ভাষাও শিখতে থাকেন।
আসলে সাহিত্যের ওপর এই ভালোবাসা সারামাগোর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল সেই ছোট্ট বয়স থেকে। এর বীজ বুনেছিলেন তাঁর ঠাকুরদা। যিনি নিজে নিরক্ষর হলেও গল্প বলার ছিল অদ্ভুত ক্ষমতা। গ্রীষ্মের রাতে ঠাকুরদা তাঁকে নিয়ে বাড়ির সামনে বিশাল একটা ফিগ গাছের নিচে ঘুমোতে যেতেন আর প্রায় সারারাত ধরে নাতিকে আশ্চর্য সব গল্প শোনাতেন। পরবর্তী জীবনে এসব অভিজ্ঞতা সারামাগোকে ঔপন্যাসিক হওয়ার রসদ জুগিয়েছিল।
বামপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী সারামাগো কারিগরি স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কিছুকাল যন্ত্রকুশলী হিসেবে কাজ করেন। তারপর একটি সরকারি চাকরি জুটিয়ে নেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগসূত্র থাকার কারণে তাঁকে শেষপর্যন্ত এই চাকরিটি হারাতে হয়। তিনি এরপর সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং প্রকাশনী শিল্পেও কিছু কাজ খুঁজে পান। তবে সব জায়গাতেই কাজ করা অসম্ভব হয়ে ওঠে তার বামপন্থী চিন্তা-ভাবনার জন্য। শেষপর্যন্ত রক্ষণশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর বীতশ্রদ্ধ সারামাগো কাজকর্মের সমস্ত চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি নাগাদ নিজেকে পুরোপুরি উপন্যাস লেখার কাজে নিয়োজিত করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৪ বছর। পরবর্তী প্রায় কুড়ি বছর ধরে তিনি একের পর এক অভূতপূর্ব উপন্যাস লিখতে থাকেন। এসব উপন্যাসে রয়েছে অনবদ্য বর্ণনাভঙ্গি, রাজনীতি যেখানে মূল উপজীব্য বিষয়। ল্যাটিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজমও সারামাগোর উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ থেকে পর্তুগালকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন মনে হয়। তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় ল্যাটিন আমেরিকার সঙ্গে। সারামাগোর রচনাতেও তাই ওরকম ছাপ।
সারামাগোর বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে দ্য ইয়ার অফ দা ডেথ অফ রিকার্দ রেস। এই উপন্যাসে তিনি ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন যা বিংশ শতাব্দীতে পর্তুগালকে গ্রাস করেছিল। দ্য স্টোন রেস্ট উপন্যাস প্রিয় রাজনীতিভিত্তিক যেখানে সারামাগো দেখিয়েছেন ইউরোপের একটি কল্পিত দীপ হঠাৎ চলে গেল আফ্রিকার কাছাকাছি আর শোষক ও শোষিত এই দুই প্রজাতি একত্রিত হলে পর কী ঘটনা ঘটল। তাঁর গস্পেল অ্যাকোর্ডিং টু জেসাস ক্রাইস্ট উপন্যাস যীশুকে সাধারণ মানুষে পরিণত করেছে যা ক্যাথলিক ধর্মের মূলে এক আঘাত আর এজন্য তাঁকে সরকারের কাছ থেকে অনেক হেনস্থা ভোগ করতে হয়েছে। সারামাগোর সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপন্যাসটির নাম ব্লাইন্ডনেস, যেখানে এক অজানা দেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে রহস্যজনক অন্ধত্ব। এসব ছাড়াও তাঁর লেখা আরও কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাসের নাম অল দা নেমস বাল্টেজার এন্ড রিমুন্ডা এবং জার্নি টু পর্তুগাল ইত্যাদি।