প্রীতন্বিতা
সমুদ্রের ঢেউ
সমুদ্রের ঢেউ নিয়ে কবিতা হয় সবাই জানি। এখানে আবার বিজ্ঞানের কী ভূমিকা ? আসলে গভীরভাবে ভাবতে গেলে কবিতাও বিজ্ঞান মেনেই হয়। তাই সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যেও যে বিজ্ঞান থাকবে এ আর আশ্চর্য কী !
ভূপৃষ্ঠের ছত্রিশ কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের দখলে, আনুপাতিক হিসেবে মোট আয়তনের তিন-চতুর্থাংশ স্থান। একেবারে সূচনায় পৃথিবীতে বিশাল এক জলাধার ছিল। মহাদেশীয় সরণ, অগ্নুৎপাত এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনা ওই বিশাল জলাধারকে বেশ কয়েকটি মহাসাগর ও সাগরে বিভক্ত করেছে। মহাসাগর মূলত পাঁচটি—- প্রশান্ত, অতলান্তিক, ভারত, উত্তর ও দক্ষিণ মহাসাগর। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু সমুদ্র যেমন বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর, পারস্য উপসাগর, কাশপিয়ান সাগর ইত্যাদি। এসব সমুদ্র আসলে পাঁচটি মহা সমুদ্রেরই অংশবিশেষ।
সমুদ্রের বিপুল জলরাশি সব সময় গতিশীল। সমুদ্রজলের এই গতি কেবলমাত্র জলতলের ওপরাংশে যেমন দেখা যায় তেমনি ওপর থেকে তলদেশের গভীরেও চলমান। গতিশীল সমুদ্রের জল ঢেউ সৃষ্টি করে এগিয়ে চলে. সমুদ্রে ঢেউ কিভাবে সৃষ্টি হয় বা ঢেউয়ের চরিত্র কী সেসবই এখানে আলোচনার বিষয়বস্তু।
ঢেউ সৃষ্টিতে বাতাসের ভূমিকা প্রথমে বলতে হয়। গৌণভাবে হলেও বাতাস তৈরি হয় সূর্যের কারণে। ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণে চাপজনিত তারতম্য বাতাস তৈরি করে। পৃথিবীপৃষ্ঠে বড় ধরনের বায়ু প্রবাহগুলি হচ্ছে বাণিজ্য বায়ু, পশ্চিমাবায়ু ও মেরুদেশীয় বায়ুপ্রবাহ। সমুদ্রের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় এইসব বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রতলের জলরাশিকে সঙ্গে টেনে নিয়ে যায়। এভাবেই সৃষ্টি হয় ওপরতলের বিশাল স্রোতপ্রবাহ। বায়ুতাড়িত এই স্রোত জলতলের গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। বায়ুপ্রবাহের শক্তি ও স্থায়িত্বের ওপর এই স্রোতের গতি নির্ভরশীল। মহাদেশ ও দ্বীপসমূহের উপস্থিতিতে সমুদ্রস্রোত জটিলভাবে ঢেউয়ের আকৃতি নেয়। এছাড়া জলতলের ওপর বায়ুপ্রবাহ প্রত্যক্ষভাবেও ঢেউ সৃষ্টি করে। এসব ঢেউকে বড় ঢেউ এবং স্ফীত ঢেউ, এই দু’ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। ঢেউ সৃষ্টিকারী বায়ুক্ষেত্রের অভ্যন্তরে বড় ঢেউ দেখা যায় এবং এসব ঢেউ ওই বায়ুক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে শান্ত সমুদ্রে এলে তাদের বলে স্ফীত ঢেউ। এজন্যই বাতাস না থাকলেও সৈকতে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত ঢেউ ভাঙছে দেখা যায়। এগুলি সবই স্ফীত ঢেউ, হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে সমুদ্রতলের বায়ুক্ষেত্র থেকে যাদের উৎপত্তি। বিশৃঙ্খল বড় ঢেউগুলি উৎপত্তিস্থল থেকে বেরিয়ে বায়ুহীন অঞ্চলে এসে সুশৃঙ্খল আকৃতি পায়। এই পরিবর্তন ঘটে বিচ্ছুরণ প্রক্রিয়ায় যেখানে দ্রুতগামী লম্বা ঢেউ ছোট ছোট ঢেউগুলিকে গ্রাস করে। অনেকটা সময় পর উৎসস্থলের অনেক দূরে এই প্রক্রিয়ায় সমান মাপের সুশৃঙ্খল ঢেউ তৈরি হয়। ঢেউ সৃষ্টির সূচনাপর্ব সম্পর্কে এখনও ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। সমুদ্রের জলতলের ওপর চাপজনিত ওঠানামার ফলে বাতাস তার এলোমেলো ও ডোরাকাটা উপস্থিতি জানায় প্রথমে। এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝঞ্ঝা জলতলে এলোমেলো ভাঁজ তৈরি করে। এসব ভাঁজের ওপর দিয়ে আবার বায়ুপ্রবাহ বয়ে গেলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাঁজগুলি ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ঢেউ হিসেবে গড়ে ওঠে। ঢেউগুলি সমুদ্রতীরে পৌঁছলে সৈকতভূমির গঠন অনুযায়ী একসঙ্গে মিলিত হয় বা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একসঙ্গে মিলিত ঢেউগুলি বিশাল ঢেউ তৈরি করে যা তীরভূমিতে ভাঙ্গনের কারণ। সমুদ্রের ঢেউগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে শক্তির বিপুল উৎস যা দূষণহীন ও পুনর্নবীকরণযোগ্য। জাপান, ব্রিটেন ইত্যাদি দেশে সমুদ্রের ঢেউ থেকে শক্তি উৎপাদনের চেষ্টা বর্তমানে বাস্তবায়িত হতে পেরেছে।
জোয়ার-ভাঁটাও ঢেউ তৈরির কারণ। বারো বা চব্বিশ ঘন্টা পর পর তরঙ্গায়িত জলপ্রবাহ জোয়ার-ভাঁটা হিসেবে পরিচিত। জোয়ার-ভাঁটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রায় চোদ্দশ কিলোমিটার। চাঁদ বা সূর্যের আকর্ষণজনিত কারণে জোয়ার-ভাঁটা সৃষ্টি হয় যেখানে পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থানের জন্য চাঁদের প্রভাব তুলনায় বেশি। তার থেকে বহু দূরে গভীর সমুদ্রে জোয়ার-ভাঁটা জনিত তরঙ্গ প্রায় নজরেই আসে না। কূলের কাছাকাছি অগভীর সমুদ্র এলাকাতেই জোয়ার-ভাঁটা জনিত তরঙ্গ দেখা যায়। জোয়ার-ভাঁটার তরঙ্গকে কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা আজ অনেকটাই সফল হতে চলেছে।
ঢেউ যে কেবল সমুদ্রের উপরতলেই সৃষ্টি হতে পারে এমন নয়। সমুদ্রের সমগ্র জলকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, একটি তলের নিচে অন্যটির অবস্থান। অন্তর্বর্তী জলতলের এসব ঢেউ খালি চোখে দেখা না গেলেও এরা বেশ বড় মাপের হতে পারে, কখনো কখনো উচ্চতায় পঞ্চাশ মিটারেরও বেশি হয়।
সুনামি থেকেও সমুদ্রের ঢেউ তৈরি হয়, আর এসব ঢেউ সবচেয়ে ভয়ংকর। সমুদ্রের তলদেশে ধস, ভূমিকম্প বা অগ্নুৎপাত সুনামি সৃষ্টি করে। তলদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আলোড়ন ওপরতলে বিশাল ঢেউয়ের আকারে দেখা দেয়। অবশ্য খোলা সমুদ্রে এসব ঢেউ প্রায় দেখাই যায় না, যত তীরের কাছাকাছি হতে থাকে তত ঢেউয়ের কলেবর বৃদ্ধি পেতে পেতে পর্বত প্রমাণ হয়ে যায়।
এসব ছাড়াও আঞ্চলিক ঝড় সমুদ্রে বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে। বঙ্গোপসাগরে এমন ঝড় প্রত্যেক বছরই কিছু না কিছু খবর তৈরি করে।